প্রজন্ম ’৭১
মন ভাল নেই নাইমুলের । পাক আর্মির হাতে ধরা পড়েছিলেন তাদের দলনেতা বদিউল ভাই । অমানুষিক নির্যাতনের পর তাকে হত্যা করা হয়েছে । স্বাধীনতার ঊষালগ্নে ক্ষণজন্মা সেই মেধাবী দেশপ্রেমিকের কথা বড় বেশি মনে পড়ছে তার ।
ট্রেনিং এর শেষ দিন ট্রেইনার জাহাঙ্গীর ভাই বলেছিলেন “ স্বাধীন দেশেই আমাদের দেখা হোক ।“
জাহাঙ্গীর ভাইকে দেয়া কথা তারা রাখতে পারবে কিনা না জেনেই দলের সবাই প্রতিধ্বনি তুলেছিল “স্বাধীন দেশেই আমাদের দেখা হবে “।বদিউল ভাই কথা রাখতে পারেননি । নাইমুলের চোখ ভিজে আসে ।
বিচিত্রময় তাদের দল । যুদ্ধ তাদের এক করেছে । হাবিব ভার্সিটির ছাত্র, সবুজ চাকরিজীবি, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে আসা সোহেল । রাজশাহীর তুহিন আবার কবিতা লিখে । সুকান্তর সুস্পষ্ট প্রভাবযুক্ত সেই কবিতা তাদের উদ্দীপ্ত করে । রক্তে আগুন জ্বালায় ।
হাবিব তার অদ্ভুত স্বপ্নের কথা বলে । দেশ স্বাধীন হলে আবার সে পাপিয়াদের বাড়ির সামনে অকারণে পায়চারি করবে আর বারান্দায় একটু যদি পাপিয়াকে দেখা যায় তবে এবার সে ঠিকই চিৎকার করে মনের কথাটি তাকে বলবে । পাপিয়ার বাবা যদি তেড়ে আসে তো আসুক !
ভাটিয়া পাড়ায় পনের ষোল বছরের কিশোর ওমর আলী যোদ্ধাদের সাথে সাথে থাকে, ছোটখাটো কাজে সাহায্য করে । যুদ্ধের খবর আনা নেয়া করে বিভিন্ন এলাকায় । তার বাবা গত হয়েছে অনেক আগেই । ছোট অনেকগুলি ভাই বোন নিয়ে অনটনের সংসার তাদের । গ্রামের সরকারী স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে সে । আগে লম্বা বাবরি চুল রেখে বাংলা সিনেমার গানে শীষ তুলে ঘুরে বেড়ালেও যুদ্ধ তার মাঝে অনেক পরির্বতন এনেছে । অনেক পরিণত হয়েছে সে এই ক’মাসেই ।
দীর্ঘ লড়াইয়ের শেষ পর্যায়ে অধিকাংশ এলাকা স্বাধীন হয়েছে তখন । ইতিমধ্যে ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে । তারপরও বিক্ষিতভাবে দেশের কোথাও কোথাও যুদ্ধ চলছে । সেরকমই একটি যুদ্ধ ক্ষেত্র ভাটিয়া পাড়া । রাজাকারের দল দেশ স্বাধীন হবার পর তাদের দোসর পাকিস্তানীদের ফেলে পালিয়েছে । ক্যাম্পটিকে চারিদিক থেকে মুক্তি বাহিনী ঘিরে ফেলেছে । থেমে থেমে গুলি বিনিময় হচ্ছে দুই পক্ষের । অনেক আগেই মিত্র বাহিনীর বিমান হামলায় হানাদারদের বেতার যোগাযোগও বিছিন্ন । স্বাধীনতার খবর তাদের অজানা । নানা উপায়ে সারেন্ডার করার জন্য বলা হচ্ছে তাদের ।
নিকটবর্তী গঞ্জ থেকে মাইক এনে বাংলা উর্দু মিশিয়ে ভুল উচ্চারনে “ বাংলাদেশ স্বাধীন হো গ্যায়া । তুমলোক সারেন্ডার কর ।“ বার বার ঘোষনা করছে । কিন্তু পাক সেনারা এটাকে যুদ্ধের কূট-কূশল মনে করে ব্যাংকারে বসে মাঝে মাঝে গুলি ছুঁড়ছে । মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার পরিকল্পনা করে যে তাদের ভেতর থেকে কেউ একজন ক্যাম্পে গিয়ে যুদ্ধশেষের খবর জানিয়ে তাদের আত্মসমর্পনের জন্য বলবে ।
নয় মাসের কঠিন যুদ্ধ শেষে সবাই বিজয়ের পতাকা হাতে বাড়ি ফিরতে উদগ্রীব । পারিবারিক স্নেহের হাতছানি, স্বাধীন দেশে বেঁচে থাকার স্বপ্ন যখন এত কাছাকাছি তখন কেউ আর নিশ্চিত প্রায় মৃত্যুর মুখোমুখি হতে রাজী হয় না । সবার সেই ইতস্তত মুহূর্তে এগিয়ে আসে একজন ।
কোন একজনের সাদা শার্টকে পতাকা বানিয়ে লাঠির মাথায় নিয়ে পাক বাহিনীর ক্যাম্পে প্রবেশ করে সে । সারাদিন পার হয়ে যায়, কোন খবর নেই । সবাই ধরে নিল তাকে মেরে ফেলা হয়েছে । পরের দিন পার্শ্ববর্তী এলাকার ক্যাম্প থেকে আত্মসমর্পণকৃত এক পাক সেনা অফিসারকে এনে ভাটিয়াপাড়া ক্যাম্পে পাঠানো হল । সে গিয়ে বুঝিয়ে বলার পর দুইশ বারজন পাক সেনার এক দল আত্মসমর্পন করতে রাজী হল ।
হাত উপরে তুলে প্রথমে ক্যাপ্টেন নাদিম পরে একজন একজন করে সেনা বের হয়ে আসে মলিন মুখে । বের হয় জীবন বাজি রেখে ক্যাম্পে যাওয়া সেই দেশপ্রেমিক বীর ওমর আলী । সবশেষে শত নির্যাতনের চিহ্ন নিয়ে বের হয় ষাট সত্তরজন বীরাঙ্গনা ।
তারপর সবার সাথে ডিসেম্বরের কুয়াশায় ওমর আলী আস্তে আস্তে দূরে মিলিয়ে যায় প্রজন্ম একাত্তরের একজন হয়ে বাংলাদেশকে নতুন করে গড়ে তোলার প্রত্যয়ে ।
প্রজন্ম ২০১১
নিতুনের মন ভাল নেই । রাতে উড়ে আসা রঙ্গীন প্রজাপতিটি, যাকে নিয়ে কবিতা লিখে সে গল্প কবিতা লিখার ওয়েব সাইটে পোস্ট করেছে এবং অনেক প্রশংসাও পেয়েছে । আজ সকালে কম্পিটারের পাশেই তাকে মৃত পাওয়া গেছে । পিঁপড়েরা মহা উৎসাহে তার নরম পাখার রেনু নিয়ে লাইন দিয়ে চলে যাচ্ছে ।
নিতুন এক স্বপ্নচারি মানুষ । বাইরের পৃথিবীর গ্লানি কুটিলতা তাকে অনেক সময় আক্রান্ত করলেও অস্তিত্বের যে স্হানটিতে হৃদয় থাকে, স্বপ্ন থাকে, বিবেকের দায়,দেশপ্রেম থাকে সেখানে নিতুন এক শুদ্ধতম মানুষ । নিতুন একজন সাধারণ মানুষও । মোবাইলে রেট কম থাকলে কথা বলে রাত পার করে দেয়, উঁচু আওয়াজে গান শোনে, ক্রিকেট খেলায় দল হারলে চিৎকার করে ।
তার এক সমস্যা সে কোন কিছুই ঠিক ভাবে শেষ করতে পারেনা । কত কাজ সে করতে চায় কিন্তু কিছুদূর এগিয়েই তার আগ্রহ কমে যায় । বড় অস্থির, চঞ্চল সে । হয়তো এই প্রজন্মের এটাই বৈশিষ্ট্য ।
মৃত প্রজাপতির শোক নিয়ে বাসা থেকে বের হল নিতুন । অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রিক্সার দেখা পাওয়া গেল । কিন্তু চালক পঞ্চাশোর্ধ শুভ্র কেশ দাড়ির অধিকারী । তাই রিক্সায় উঠলনা সে ।
ভার্সিটিতে গিয়ে বৃদ্ধ রিকশাচালকের গল্প করতেই বন্ধু অসীম বলল তার এলাকায় বাদশা নামের এক মুক্তিযোদ্ধা রিকশাওয়ালা আছে যার একটি পা গুলিবিদ্ধ । অনেকখানি শুকিয়ে যাওয়া পা লুঙ্গি দিয়ে ঢেকে সে রিকশা চালায় ।
নিতুনের ভাবনার জগতে এক বিশাল পরিবর্তন নিয়ে এল বাদশা । শীতের রাতে ঘুমুতে গিয়ে মনে হল বাদশা হয়ত ঠান্ডায় কষ্ট পাচ্ছে । ঝমঝম বৃষ্টি । নিতুনের কবিতায় যুদ্ধাহত বাদশা ঢুকে পড়ে অনাহুত । শখের বৃষ্টিতে ভিজে রোমান্টিক কবিতা আর লিখতে ইচ্ছে হয়না ।
এমনই এক দিন অসীমের সাথে আলোচনা করল বাদশাকে সাহায্য করার ব্যপারে । তারা কয়েকজন বন্ধু মিলে বাদশাকে টাকা দিয়ে একটা রিকশা কিনে দিতে পরিকল্পনা করল । আস্তে আস্তে তার সব বন্ধু, ক্লাসমেট এমনকি অন্য ক্লাসের অনেক শিক্ষার্থী পর্যন্ত আগ্রহী হয়ে উঠল এ কাজে । তারা যে রিকশা বানানোর গ্যারেজে গেল সেখানকার মালিক তাদের অভিনব পরিকল্পনার কথা শুনে বিনা মজুরীতে রিকশা তৈরি করে দিতে চাইল । সবার এই আন্তরিক সহযোগিতা দেখে দেশের মানুষ সর্ম্পকে ধারনাই বদলে গেল নিতুনদের দলের । সবাই এই দেশটাকে এত ভালবাসে, যেকোন শুভ উদ্যোগে হাত বাড়িয়ে দেয় তবু কেন এই দেশটার বেশিরভাগ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে, সময়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা অবহেলায় অভিমানে কেন নিজের পরিচয় লুকিয়ে রাখতে চায় নিতুনেরা তা বুঝে উঠতে পারে না । সার্টিফিকেটধারী অনেক নব্যমুক্তিযোদ্ধাদের ভিড়ে বাদশারা কোন সহায়তা পায়না । কারণ তারা অশিক্ষিত । সার্টিফিকেট তোলার প্রমাণপত্রও অনেকের নেই । এই লজ্জা এই দায় সকলের ।
কিন্তু নিতু্ন ,অসীম আরো অনেকে তাদের প্রজন্মের দায় তারা নিজেরায় বহন করার সাহস অর্জন করে । এখনকার তারুণ্যের দেশপ্রেম নেই এই বাক্য মিথ্যে করে দিয়ে তারা বিভিন্ন কোম্পানীতে, স্বচ্ছল ব্যক্তিদের কাছে ঘুরে বেড়ায় ফান্ডকে আরো সমৃদ্ধ করতে । একটা সময় বড় একটা পরিমান দাঁড়িয়ে যায় অর্থের । ফলে তারা মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় বাদশার সাথে আরো দুইজন আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল যোদ্ধাকে যুক্ত করে তাদেরকে স্থায়ীভাবে সহায়তা করতে ।
এই কাজ করতে গিয়ে মন ভাঙ্গা ব্যাপার যে ঘটেনি তা নয় । নিজাম নামের একজনকে গাজীপুরে পাঠানো হল আগ্রহী এক ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা আনতে । সে ফিরে এসে বলল টাকা দিতে এখন আর রাজী নয় সেই ব্যক্তি । পরে জানা গেল নিজাম টাকা নিয়ে এসেছে ঠিকই কিন্তু তাদের কাছে মিথ্যে বলে নিজেই সেই টাকা ভোগ করেছে ।
তাদের ভার্সিটির অডিটোরিয়াম নিয়েও এক বিশাল সমস্যা দেখা দিল । কর্তৃপক্ষ কিছুতেই এই অনুষ্ঠানের জন্য অডিটোরিয়াম ব্যবহারের অনুমতি দিতে চাইলনা । মুক্তিযুদ্ধকে তারা বর্তমান রাজনীতি হিসেবে দেখতে লাগলেন ।
অনেক দেন দরবারের পর অবশেষে নিতুনের দল অনুমতি পেল । শর্ত হল অনুষ্ঠানে কোন রাজনৈতিক দলের বিষয়ে আলোচনা হতে পারবেনা ।
ষোলই ডিসেম্বর অনুষ্ঠানের দিন আমন্ত্রণ পেয়ে আসেন বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের স্ত্রী মিলি রহমান । আসেন তাদের ভার্সিটির ভিসি, কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষক, বাদশা ও অন্য মুক্তিযোদ্ধারা । প্রথমে মুক্তিযোদ্ধারা মঞ্চের নিচের সারিতে অন্য শিক্ষকদের পাশে বসলেও উপস্থিত শিক্ষার্থীদের দাবীর প্রেক্ষিতে তাদেরকে মঞ্চে নিয়ে প্রধান অতিথির সাথে একই সারিতে বসানো হল । আজ চল্লিশ বছর পর বাদশাদেরকে যোগ্য মর্যাদার আসন দেয়া হল । তারা অনুভব করলেন যে স্বপ্ন নিয়ে তারা দেশ স্বাধীন করেছিলেন সে স্বপ্ন একদিন এই প্রজন্মই সত্যি করবে ।
মিলি রহমান যখন মতিউর রহমানের দেশপ্রেমের কথা বলছিলেন, পাকিস্তানে বন্দী দিনগুলির স্মৃতিচারন করছিলেন, নাম জানা অজানা সব আত্মত্যাগীর প্রতি সন্মানের আহবান জানাচ্ছিলেন পিন পতন নিরবতা নেমে আসে হাজার শিক্ষার্থীপূর্ণ সেই অডিটোরিয়ামে । এক আবেগময় মুহূর্তের জন্ম হয় সেসময় । এই প্রজন্মের নিতুনেরা রুদ্ধশ্বাসে শুনে যায় প্রজন্ম একাত্তরের দেশপ্রেম আর আত্মত্যাগের মহান ইতিহাস । নিজেদের রক্তেও তারা অনুভব করে সেই উদ্দীপণা যা তাদের পূর্ব পুরুষের রক্তে অনুভূত হয়েছিল সব অসত্যের বিরুদ্ধে । মঞ্চে আসীন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী ভিসির মুখ তখন মলিন ।
আজ অনেকদিন পর কম্পিউটারের মনিটরের দিকে তাকিয়ে মন ভাল হয়ে গেল নিতুনের । একটা ছোট্ট প্রজাপতি এসে বসেছে আলো দেখে । গল্প কবিতার বন্ধুদের উদ্দেশ্যে একটা পোস্ট দিল সে । অভাবনীয় সাড়া এলো দেখা না দেখা বন্ধুদের কাছ থেকে । প্রজন্মের দায় তারা সবাই শোধ করতে ইচ্ছুক । বিভিন্ন বয়স, পেশা, ধর্ম, অঞ্চলের সুন্দর মানসিকতার অনেকেই প্রত্যক্ষ আবার কেউ পরোক্ষভাবে অংশগ্রহনের আগ্রহ প্রকাশ করে মানবেতর জীবনযাপন করা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করে প্রজন্মের দায় শোধ করার তাগিদে ।
স্বপ্নচারী নিতুন এখন অপেক্ষা করছে আরেকটা ষোলই ডিসেম্বরের জন্য ।
২৪ জানুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
২৭ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।
প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী