সামনেই নির্বাচন । কে জয়ী হবে কে হবে পরাজিত সেই বিতর্কে চায়ের কাপে কাপে ঝড় উঠছে। ইদ্রিস মিয়ার টং দোকানটার কন্ডেন্স মিল্কের লিকারবিহীন পানসে চা সুপেয় হয়ে গেছে অনেকের কাছে । নিতান্ত চা পানে নেশাহীন অনেক মুরুব্বিও স্থানাভাবে ড্যাম সল্টেড বিস্কুট আর কাপ হাতে দাঁড়িয়ে মতামত প্রদানে ব্যস্ত । বিভিন্ন মাঠে জনসভা হচ্ছে। প্রতিশ্রুতির বন্যা বয়ে যাচ্ছে নেতাদের মুখে মুখে ।
আমার কলেজের পাশে রাস্তা দিয়ে মিছিল চলেছে । জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি।
এই মাত্র নেতৃত্ব দিতে দৌড়ে মিছিলে মিশে গেল যে ছেলেটি সে আমার বন্ধু তপু । অবশ্য আমি তাকে যতটুকু বন্ধু ভাবি সে আমাকে তার চাইতে আর ও বেশি কিছু মনে করে । যেকোন বিষয়ের পরামর্শে সে আমার দারস্থ হয়। আমি উদারভাবে সম্ভব অসম্ভব সব ধরনের সমস্যার সমাধান দিতে চেষ্টা করি সেই পাঠশালার জীবন হতেই । তাই শৈশব থেকেই সে আমার একনিষ্ঠ ভক্ত ছিল বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছাড়িয়ে। আর আমিও অহংকারি হয়ে উঠেছিলাম। তপুকে বন্ধুর চেয়েও অনুগ্রাহী ভাবতাম।
আমি ছিলাম ক্লাসের বরাবরের ভাল ছাত্র। মা স্কুল শিক্ষিকা। পড়ালেখা সহ সব বিষয়ে আমার প্রতি সবার যত্ন ছিল। আর তপু শেষ বেঞ্চের ছাত্র। প্রায় সময় ক্লাসের বাইরে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতো দীঘি পেরিয়ে খেজুঁর গাছের মাথার উপরে উড়ন্ত ঘুড়ির দিকে। যখন আমরা পানি পথের প্রথম যুদ্ধ ব্যর্থ হওয়ার কারন অনুসন্ধান করতাম ইতিহাসের পাতায় তপু তখন জানালার ফাকঁ দিয়ে আসা রোদ গায়েঁ মেখে হেমন্তের সোনাঝরা দুপুরকে ব্যর্থ হয়ে যেতে দেখতো । আমরা অবশ্য তার উদাসিন্যে সবসময় বিরক্ত হতাম।
আমাদের স্কুলে একটি বড় দীঘি ছিল । এখন অবশ্য সেখানে নতুন ভবন । দীঘির অন্যপ্রান্তে ছিল লাল শাপলা ফুল। আমাদের বয়সী কোন ছাত্র সেই পুকুর পেরিয়ে শাপলা তুলে আনতে সাহস পেতোনা । অতীতে দুই একটি ছেলের দীঘিতে ডুবে মরার করুণ ইতিহাস জানা ছিল সবার । তাই লুব্ধ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমাদের উপায় ছিলনা । তপু সেই দীঘি পার হয়ে লাল শাপলা অবলীলায় তুলে এনে বিলিয়ে দিত সবার মাঝে । ক্লাসের বাইরে তপু ছিল সবার হিরো । শুধু বইয়ের অক্ষরগুলু দেখলেই সে মিইয়ে যেত।
তপুর রাগী বাবার অনেক হুমকি ধামকি অত্যাচারের পরেও তপুর লেখাপড়া বিশেষ এগোলনা । ফেল করে করে এক সময় সে পড়ালেখা ছেড়ে দিল। সব ধরনের নিষিদ্ধ কাজে সে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে লাগলো ।এক রাজনৈতিক দলের ক্যাডার বনে গেল। বখে গেল আমার বন্ধু তপু। বছর গুলি চলে যাচ্ছিল নৈব্যিক্তিকভাবে ।
এত কিছুর পরেও তার সাথে আমার বন্ধুত্বের মৃত্যু ঘটেনি। কোন ব্যাপারে পরামর্শ নিতে হলেই তপু আমার কাছে চলে আসে । এদিকে আমি পড়ালেখা শেষ করে আমাদের কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলাম। এক শরতের রাতে তপু গায়েঁ চাদর জড়িয়ে আমার কাছে উপস্থিত হলো । “মাহিন, দোস্ত আমি বিপদে পড়েছি। ” এটা তপুর কমন ডায়ালগ। যেকোন নতুন সমস্যা আমার সাথে আলোচনা করার আগে এই বাক্য দিয়ে শুরু করে । আমিও নড়েচড়ে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেলি। কিন্তু এবার ঘটনা শুনে আমি থ’ হয়ে গেলাম। তপু এক মেয়ের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছে। মেয়েটি চেনা । আমার কলেজেই পড়ে । শ্যামলা না বলে কালোই বলা চলে ছোট খাটো মেয়েটিকে। আহামরি কিছুই নয় । দেখতে বোকা বোকা লাগে । তবে চোখ দুটি একেবেরে শান্ত আর কাজল কালো । এত জীবন্ত চোখ যেন কথা বলে । প্রেমে পড়ার মত কোন বিশেষত্ব আমি খুজেঁ পেলাম না তার মাঝে ।
এমন নয় তপু মেয়েদের দিকে তাকিয়ে দেখেনা কখনো । অনেকের সাথেই তার ভালবাসা, সখ্যতা ছিল । চিঠি চালাচালি করত সুন্দরী অনেকের সাথেই । তবুও কেন যে তপু এই অতি সাধারন মেয়েটার প্রেমে পড়ল এবং আমার কাছে বুদ্ধি চাইতে এল তা আমার মাথায় এলোনা । “ মাহিন, তুই বুদ্ধি দে কি করব এখন ? “ আমার বিস্ময় উত্তরোত্তর বাড়ছে। “আমার মনে হয় পারুল আমাকে মেনে নেবেনা । কত অন্যায় করছি জীবনে। ও যদি আমায় ফিরিয়ে দেয়? আমি জোর করে ওকে পেতে চাইনা । মাহিন, তুই তো আমার বন্ধু। তুই পারুলকে বুঝিয়ে বল একটু। ও আমার পাশে থাকলে আমি সব খারাপ কাজ ছেড়ে দেব । একবার আমাকে সুযোগ দিতে বল্ । তুই কলেজে পড়াস । পারুল তোর কথা মানবে । “
এতবড় বিপদে আমিও এর আগে পড়িনি। সব সময় ভাল ছাত্র বলে একটু আলাদা থেকেছি সব কিছু থেকে । আর এখন বন্ধুর অনুরোধে প্রেমে রাজী করানো কোন মেয়েকে! তাও তপুর মত অস্ত্রধারী ক্যাডারের জন্য!! এর চেয়ে নারী স্বাধীনতা বা আমাদের দুর্নীতি বিষয়ে একটি পাচঁ পাতার প্রবন্ধ লিখে ফেলাও সহজ ছিল আমার কাছে !! তবু ঝুকিঁ আমি ঠিকই নিলাম। যদিও তাতে সুনামহানীর কিঞ্চিত সম্ভাবনা ছিল । একদিন কলেজে নিজের চ্যম্বারে ডেকে পাঠালাম মেয়েটিকে। অজানা উৎকন্ঠায় শুকিয়ে যাওয়া মুখ নিয়ে জড়সড়ভাবে পারুল এসে দাড়াঁলো । সাধারন কিছু লেখাপড়ার কথা বলে বিদেয় করে দিলাম সেদিন। ইচ্ছে হলনা ভীতসন্ত্রস্ত হরিণীর মত মেয়েটিকে তপুর কথা বলে ভড়কে দেই । এরপর মাঝে মাঝেই পারুলকে ডেকে তার পড়ালেখা নিয়ে উপদেশ দিতে থাকলাম । কাজল ছড়িয়ে যাওয়া কালো চোখ তুলে আমার দিকে সে তাকাতে পারেনি কোনদিনও । দীঘল চুলে বৈচিত্রহীন বেনী অথবা খোপাঁর সহজ গাথুঁনী ।
তারপরও কেন জানি এক সময় এই অতি সাধারন মেয়েটিই আমার জীবনে সরলতার প্রতিমা হয়ে দেখা দিতে লাগলো । যখনই মেয়েটির সাথে কথা বলি কি এক ব্যাকুলতা আমাকে তার চোখের গভীরে টেনে নিয়ে যায় । আদ্যোপ্রান্ত ডুবে যেতে থাকি আমি প্রবাহমান সেই নদীতে । অনেক চেষ্টা করেও আমি তপুর রোদে পোড়া রুঢ় মুখটিকে এই মুখের সাথে কল্পনায় আনতে পারিনা । আমি তপুর মতই নিজের অনুভূতি নিয়ে বিচলিত হয়ে উঠলাম। পারুল কে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম । এদিকে তপু আস্তে আস্তে তার বেহিসেবী জগত গুটিয়ে আনতে লাগলো । দলের নেতার সাথে কোন এক বিষয়ে কথা কাটাকাটি করে, কর্মীদের সাথে মারামারি করে জেলে গেলো। আমার মা অতি সাধারন শ্যামলা মেয়েটিকে ছেলের বউ হিসেবে প্রথমে মেনে নিতে রাজী হলেন না । কিন্তু আমার অতিরিক্ত জেদের কারণে পারুলদের বাড়িতে কথা বলে আমার সাথে বিয়ে ঠিক করলেন । তপুও মুক্তি পেল এরই মধ্যে ।
এক বিকেলে আমি তপুকে নিয়ে এলাম আমাদের মফস্বলের পাশে বয়ে যাওয়া শীর্ণ নদীটির পাশে । জেল খাটা এক সন্ত্রাসীর সাথে কলেজ শিক্ষক আমাকে দেখে দুই একজন আড়চোখে তাকাচ্ছে। আমি নীচু স্বরে বললাম , “ তপু, তুই তো শুনেছিস পারুলের সাথে আমার বিয়ে ......।“ আমার কথার মাঝেই তপু জবাব দিল , “ ভালই হয়েছে । পারুল সুখে থাকবে । আমি ওকে আর কি এমন দিতে পারব বল্ । তুই কলেজে পড়াস । কত সন্মান তোর । আর আমি জেল খাটা দাগী আসামী । পারুল ভাল থাকুক এই আমি চাই । “ দুজনে চুপচাপ অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম কিশোর বেলার ডুবসাঁতার দেয়া সেই নদীর দিকে । তপু চলে গেল আর কথা না বলে । যদিও অনেকদূর যাবার পর আমি দেখলাম সে চোখ মুছলো হাত দিয়ে । এলাকায় কুখ্যাত তপু । আর এত খারাপ একজন মানুষের অশ্রুতে কি আর আসে যায় ! তবু আমার মনটা কেমন করে উঠলো । একবার ভাবলাম ফিরে ডাকি । আমার সাথে পারুলের বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে সাজিয়ে দেই তপুর অগোছাল জীবনটা । কিন্তু বাস্তব মন টুটিঁ চেপে ধরল সেই ইচ্ছার । বিয়ের আয়োজন প্রায় শেষ । আর এই সময়ে পারুলকে সব খুলে বলা এবং পারুলের পরিবারের তপুকে মেনে নেওয়া নিয়েও অনেক অনিশ্চয়তা । এত কিছুর বিরুদ্ধে কিই বা করতে পারে আমার মত ছাপোষা এক সাহসহীন মানুষ ।
তপু ফিরে গেল আগের জীবনে। নেতার সাথে সমঝোতা করে আবার দলের ক্যাডার পদে আসীন হল। পারুল এলো আমার জীবনে।
তপু এখনো আসে আমার কাছে। আজ এসে বলছিল আমার বিপদের সম্ভাবনার কথা । এলাকার এমপি সাহেবের ছেলে যে কিনা কানে দুল পরে মোটরসাইকেল দাপিঁয়ে ঘুরে বেড়ায় । সে এবার আমার সাবব্জেক্টে ফেল করেছে বলে এমপি সাহেব আমার উপর নাখোশ । উপায় খুজঁছে কিভাবে আমাকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করবে । আমি যেন পারলে তার ছেলের খাতাটা নতুনভাবে দেখি ।
মানুষের মন বড় বিচিত্র। সারাজীবন সমাজের কাছে ভাল সেজে থেকেও আমি এক সাহসী বন্ধনহীন বোহেমিয়ান জীবনের টান অনুভব করি । অনেক সময় চেনা জগতটাকে ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে করে আমার । আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে প্রতিধ্বনি শুনতে চাই আমি । আমার করতে না পারা কাজগুলু তপু অবলীলায় করে । কাঙ্ক্ষিত জীবন যাপন করতে না পারার গোপন বেদনায় তপুকে হিংসা করতাম কত দিন ! নিজের মনের এই খবর আমিও আগে এভাবে অনুভব করতে পারিনি পারুল আসার আগে ।
শ্লোগানের শব্দে সম্বিত ফিরে পেয়ে তাকালাম জানালা দিয়ে আবার । আমাকে এখনই উঠতে হবে এমপির বখাটে ছেলের খাতা নতুন করে দেখে পাশ করিয়ে দেবার দায়ে । তারপর প্রিন্টিং ভুল স্বীকার করে নাম্বারপত্র অধ্যক্ষর রুমে পাঠিয়ে দিতে হবে ।
মিছিল বড় রাস্তা ঘুরে কলেজের মাঠের কাছে ফিরে আসছে। তপুর ভাঙ্গা গলা উচুঁতে । এখন মিছিলের মুখগুলু সব মুখোশ পরা মনে হচ্ছে আমার কাছে। এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পবিত্র আসনে বসে থেকেও আমার নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হতে লাগলো । মুখোশ মানুষদের তালিকায় তো আমিও আছি। কপট স্বার্থপরদের ভীড়ে আমি দেখতে পাচ্ছি এক সত্যিকারের মানুষের মুখ । এক প্রকৃত প্রেমিক আর এক নিঃস্বার্থ বন্ধু তপুকে ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।