নরসুন্দা নদীতে আজ নতুন পানির বান ডেকেছে। পূর্ণ যৌবনা নারীর মতই কানায় কানায় ভরে উঠেছে তার বুক। ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ তুলে তা বারবার আছড়ে পড়ছে দু'পাড় জুড়ে। তারেরঘাট বাজারের বটতলায় ইটের বেদীতে বসে থাকা হারান ফকীরের মনের মাঝেও উথাল-পাতাল ঢেউ উঠেছে। আজ প্রায় তিন দিন সে বাড়ী ছাড়া। ক'দিনের টানা বৃষ্টিতে জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে আছে। ফলে মাচা ছেড়ে নড়বার মত অবস্থা ছিল না। মহাজনী নৌকাগুলো ডিম পাড়া কাছিমের মত ঝিম মেরে আছে। জনারণ্যে এখন মরুভূমির হাহাকার। লোকসমাগম যথাযথ হলেও কোন সাড়াশব্দ নেই। নৌকার মাঝি মাল্লারা কখনো কখনো বৃষ্টি মাথায় করেই ছুটে এসেছে তার মাচায়। বেদীতে বিছানো ছালায় বসে আয়েশে গাঁজার কল্কিতে সুখটান দিয়েছে। ওদের দেওয়া দু'পাঁচ টাকার ছেড়া-ফাঁড়া নোটের ভিক্ষাটুকুই তার এ ক'দিনের আয়। উপরি পাওনা-রূপে গাঁজার কল্কিতে দু'একবার ঠোঁট ছোঁয়াবার সৌভাগ্যও হয়েছে। কিন্তু, এসব কিছু ছাপিয়ে তার শরীরে অন্যরকম ক্ষুধার যে বান ডেকেছে তা মেটাবার ফুরসৎ তো পায়নি। এমনিতে সে দু'এক দিন পরপর'ই বাড়ীতে যায়। বাড়ন্ত লাউ ডগার মত বউটার লিকলিকে শরীরে তার ক্ষুধার অন্ন খুঁজে নেয়। কিন্তু, এ ক'দিনের বৃষ্টিতে তার এই মাচা-নিবাসে আটকে থাকায় তা আর হয়ে উঠেনি। ফলে আজকের এই বৃষ্টিহীন শুকনো দিনে তার তৃষ্ণার্ত মনে নতুন করে যৌবনের বান ডেকেছে, ঠিক যেন পুরনো সেই মরা নদীর অদ্যকার ফুলে-ফেঁপে উঠা শরীরের মতই।
কিরে তুই দেহী একদম ভিইজ্যা ছপছপা অয়া গেছস।
হ খালা। কি করুম আমগো তো ছাতি নাই।
তোর জামাই তো হুনছি কামায় মন্দ না। তাইলে একটা ছাতি কিনলেই পারে।
কি যে কন খালা ! আমগো যদি ছাতি কিননের ট্যাহাই থাকতো, তাইলে কি আর এই বিস্টি-বাদলার দিনে কাম করনের আহি।
হ বুজছি। তুই একটু খাড়ো। আমার একটা কাপড় দিতাছি। এইডা খুইল্যা অইডা পইরা ল।
ধনাঢ্য গেরস্তের পাকা গোসলখানা। উপরে টিনের চাল। লোহার গেট'টা শক্ত করে আটকোনো। তারপরেও কাপড় ছাড়তে ভীষণ লজ্জা লাগছে ওর। বোধকরি পরিচিত জায়গার অচেনা পরিবেশই এর বড় কারণ। তবুও অনেক কষ্টে-সৃষ্টে ভেজা কাপড়টা ছাড়িয়ে নিল শরীর থেকে। ভাল করে চিপে পানি বের করে নিল। তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে শেষমেশ লোহার গেট'টার মাথায় রেখে দিল ওটাকে। খালার কাছ থেকে পাওয়া প্রায় নতুন শাড়ীটা যত্ন করে শরীরে জড়িয়ে নিল। ভেতর থেকে কেমন একটা মিষ্টি গন্ধ আসছে। বড়লোক মাইয়া মাইনষ্যের শাড়ী তাইলে এমনি হয়, ভাবলো সে। তার মনে হলো, শাড়ী নয় তার শরীরে জড়িয়ে নিয়েছে একটা নতুন সুখ, যা এর আগে কখনোই পায়নি। সেই সুখে সে এমনি আবিষ্ট হয়ে রইলো যে, জানতেই পারলো না গৃহকর্তার এক জোড়া লোভী চোখ দরজার চিলতে ফাঁক দিয়ে তার পুরোটা শরীর লেহন করে চলেছে। চাক চাক সোনা রোদ ছড়িয়ে পড়েছে চারিপাশময়। মহাজনি নৌকার উদোম চালায় রোদ পড়ে চিকচিক করছে। তাকালে চোখ আপনা থেকেই কুঁচকে যাচ্ছে। তবুও অনেক কষ্টে চোখ ছোট করে তীর্থের কাকের মত ঘাটপানে তাকিয়ে আছে হারান ফকির। তার চোখ আঁকড়ে আছে সদ্য ঘাটে ভিড়ানো প্যাসেঞ্জার বোট'টার দিকে। দলে দলে যাত্রীরা নেমে আসছে। কিছুক্ষণ বাদেই এদিক দিয়ে হেঁটে যাবে তারা। কাছেই বাজারের ভেতরে দাঁড়ানো অপেক্ষমাণ রিকশায় করে চলে যাবে যে যার গন্তব্যে। কেউ কেউ হয়ত সাথে নিয়ে আসা তরিতরকারি মাটিতে বিছিয়ে বিক্রি করতে বসে যাবে। আবার এদেরই কেউ'ই টুকটাক কেনাকাটা করে ফিরতি যাত্রার নৌকায় উঠে বসবে। তবে যেই যাই করুক না কেন আখেরে লাভ হবে তার। সঙ্গী-সাথীরা ইতিমধ্যে ছালা বিছিয়ে বেদীর সামনে বসে পড়ছে। সমস্বরে সুর আওড়াচ্ছে, আখেরাতে ছওয়াব পাইবেন পাহাড়ও সমান, বলেন আমার আল্লাহ্ নবীজির নাম। সে ভাল করেই জানে, যাত্রীরা সবাই যাত্রাপথে এক'দু টাকা ছুড়ে দেবে ওদের দিকে, সারাদিন শেষে যা রীতিমত একটা টাকার স্তূপে পরিণত হবে। ফকির সর্দার হিসেবে তা সবার মাঝে সমবণ্টন করেও যথাসম্ভব ভারী হয়ে উঠবে হারানের পকেট। পকেটের কথা ভাবতেই মনটা খুশী হয়ে উঠলো হারানের। মানসচক্ষে ভেসে উঠলো বউয়ের লিকলিকে শরীরটার কথা। আজ অনেকদিন পর ওকে আবার কাছে পাবে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে আজ রাতে বাড়ী ফিরে যাবে। তবে তার আগে বাজার থেকে একটা গোলাপি রঙের নতুন শাড়ী কিনতে হবে। গোলাপি শাড়ীতে বউটাকে একদম নববধূর মতই নতুন লাগবে। সহসা টের পেল তার বুকের ভেতর সেই উথাল-পাতাল ঢেউটা আবারো জেগে উঠেছে।
ওস্তাদ এইডা আমার মামাতো বইন লাগে। কথাটা কানে যেতেই সুখ-স্বপ্নের ঢেউয়ের মাথায় চড়ে থাকা হারান বাস্তবের তীরে ফিরে এলো। ল্যাংড়া নগেন দাঁড়িয়ে। পাশেই একটা হালকা-পাতলা গড়নের মেয়ে। হের জামাই ছাইড়্যা গেছেগা। অহন খাউন-পরানোর কেউ নাই। তুমি কইলে আইজ থাইক্যা আমগো লগে বইবার পারে।
মেয়েটার আপাদমস্তক একবার নজর বুলালো হারান। ছেঁড়া-ফাটা শাড়ীটা তার ওর উদ্ধত যৌবনকে বিন্দুমাত্র আড়াল করতে পারেনি। জামাইটাকে একটা আস্ত রকমের গাড়ল মনে হল। এমন খাসা শরীরের মেয়েকে কেউ ছেড়ে যেতে পারে, ভাবতেই পারলো না। কোনও সমস্যা নাই। থাউক। তয় রাইতের রিস্ক তোর লউন লাগবো না। হেইডা আমি দেহুম নে।
হে হে ওস্তাদ। তাইলে আমার আর কোনও চিন্তা নাই। যাই। ওরে তাইলে উত্তর দিকের ভিটিতে বসাইয়া দেই। মাথা কাৎ করলো হারান। ঘুরে উল্টোদিকে হাঁটা দিল নগেন। মেয়েটাও যাচ্ছে পাশাপাশি। নগেন লেংচে লেংচে হাঁটচে বলে মেয়েটাকে ওর পাশে বেশ লম্বা লাগছে। ওর বউয়ের কথা মনে পড়ল। আচ্ছা এই মেয়েটার সব কিছুই কি ওর বউয়ের মত। সহসা জানতে ইচ্ছে করলো, গোলাপি শাড়ীতে এই মেয়েটাকে কেমন লাগবে।
ঘুম আসছে না কিছুতেই। কেবলই বিছানার এপাশ-ওপাশ করছে ও। কত আশা করে ছিল আজ রাতে ওর জামাই আসবে। তাই গেরস্ত খালার দেওয়া শাড়ীটা আর শরীর থেকে খুলেনি। ভেবেছিল ওর জামাই এসে নিজেই খুলে নেবে। সুখের সাগরে ভাসিয়ে দেবে ওকে। কিন্তু হলো না। এদিকে ঘুমও আসছে না। সহসা দরজায় ঠকঠক শব্দে চমকে উঠলো। তবে কি ও সত্যিই এসেছে। কি ভেবে মনটা আশান্বিত হয়ে উঠলো। লাফিয়ে বিছানা থেকে নামলো। প্রায় দৌড়ে গিয়ে খোলে দিল দরজাটা। পরমুহুর্তে বুকের উপর প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেয়ে বিছানায় ছিটকে পড়লো। ঝড়ের বেগে একজন পুরুষ মানুষ ঢুকে গেল ভেতরে। একটা বলিষ্ঠ হাত চেপে ধরল তার নাক-মুখ। আর একটা হাত ধীরে ধীরে তার পরনের শাড়ীটা খুলে নিতে লাগলো। সে জানে তার কিছুই করার নেই। তারপরেও মরিয়া হয়ে সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে তার ডান হাতটা ঠেলে দিল বেড়ার দিকে। স্মরণশক্তি যদি বিশ্বাসঘাতকতা না করে থাকে, তাহলে ঠিক ওখানেই একটা দাঁ থাকার কথা।
রাত্রি প্রায় মধ্য প্রহর। সবাই ঘুমিয়ে আছে। ঘুম নেই কেবল হারানের চোখে। পাশেই শুয়ে থাকা মেয়েটার গা থেকে একটা বুনো গন্ধ আসছে, যা তাকে ঘুমুতে দিচ্ছে না। একসময় আর থাকতে পারলো না। আস্তে করে মেয়েটার কোমরে হাত রাখল। মেয়েটা যেন এতক্ষণ এরই অপেক্ষায় ছিল। পেছন ফিরে শুয়ে থাকা শরীরটা ধীরে ধীরে ঘুরিয়ে নিল সামনের দিকে। মাথার কাছে রাখা প্যাকেটটা ওর হাতে ধরিয়ে দিল হারান। প্যাকেটটা নাকে চেপে ধরে নতুন কাপড়ের গন্ধ নিল মেয়েটা। পরক্ষণেই আবিষ্কার করলো শিকারি হায়েনার মতই হারান তার শরীর থেকে সমস্ত আবরণ খুবলে নিচ্ছে। দূরে কোথাও একটা কুকুর ডেকে উঠলো। তার মনে হলো, এই মানুষটা আর ওই কুকুরটার মাঝে কোন পার্থক্য নেই।
থানা পুলিশের লক্কড় মার্কা গাড়ীটা যখন গ্রামের মূল সড়কে এসে দাঁড়ালো তখনো ভোরের আলো ফোটেনি। তবুও খুন বলে কথা। তাই ঘটনাটা ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। রাস্তাঘাটে লোকসমাগমও কম নেই। হারান ফকীরের বাড়ীটা চিনিয়ে দিতে আগ্রহী লোকের কোনও অভাব হলো না। দেখানো পথ বেয়ে অছি সাহেব আর কনস্টেবল দু'জন যখন হারানের বাড়ী পৌছুলো তখনো রাতের শেষ প্রহরের আঁধারে মুড়ে আছে চারপাশ। অছি সাহেব খুনির মুখোমুখি হতেই প্রথম যে প্রশ্নটার সম্মুখীন হলেন তা হলো, তোমরা আমার জামাইরে নিয়া আইছোনি ?
তারের ঘাট বাজার থেকে ভোর রাতের ফার্স্ট ট্রিপ নৌকোটা ছেড়ে যাবার মুহূর্তে প্রায় দৌড়ে এসে দু'জন প্যাসেঞ্জার উঠলো। বসে থাকা দু'সারি প্যাসেঞ্জারের ফাঁক গলে একদম মাথার দিকে যেয়ে গুটিসুটি মেরে বসে পড়লো তারা। একজন পুরুষ আর একজন মহিলা। পুরুষটার আপাদমস্তক চাদর মোড়া। মেয়েটাও আধ হাত লম্বা ঘোমটা টেনে রেখেছে। ফলে তাদের মুখটা কেউ'ই দেখতে পেল না। তবে মহিলার গোলাপি শাড়ীটা নজর কাড়লো সবার।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
পলাশ কবির
পথ বেকে গিয়ে নতুন পথে উঠেছে । ভালো গল্প তবে শেষটা বাদে কারণ নাটকীয়তা নাটকেই বেশি মানায় ছোট গল্পে নয় । এই ধরনের ঘটনা প্রায়শই ঘটছে আমাদের চারিদিকে বড়ই লজ্জার কথা ।
মোঃ শামছুল আরেফিন
আমার কাছে মনে হচ্ছে আজ পর্যন্ত সুমন ভাইয়ার যত গল্প পড়েছি তার মাঝে এই গল্পটি সবচেয়ে সেরা। অসাধারণ ছাড়া আর কোন উপমাই চলেনা এমন লেখনীর জন্য। সমাজের দুই স্তরের মানুষের নোংরামি দেখানো হয়েছে গল্পে। যেখানে আর্থিকভাবে সচ্ছল গৃহকর্তার চোখ এড়ায়না কাজের মেয়ের শরীর আবার সেই মেয়েটির স্বামী ঘরে বউ রেখে পর-নারী সম্ভোগে ব্যস্ত। মানুষের অবস্থা ভিন্ন হতে পারে অথচ রুচিগত তেমন কোন পার্থক্য নেই। মানুষ আসলেই বড় বিচিত্র। সবমিলিয়ে গল্প ভাইয়া অসাধারণ। বিজয়ীদের তালিকায় এইবার চলে আসতে পারে আপনার নাম। সেই অপেক্ষায় রইলাম।
মামুন ম. আজিজ
পরিপক্ক বুনট লেখনিতে। শেষটা নাটকীয় হওয়ায় এটা দিয়ে বেশ একটা মঞ্চ নাটক বানানো যাবে কিন্তু, সত্যি বলিছ। টিভি নাটক হলেও আরও জমবে। ...আপনার ইদানিংকালের লেখায় খুব গভীর ভাবনার আভাস পাচ্চি।..পুরুষ মানু হয়ে পুরুষকেই খরাপ দেখানো সাহসের পরিচায়ক।
জাফর পাঠাণ
আমি কবিতা প্রেমিক।গল্প পড়ার ধৈর্য আর সময় দেয়ার ব্যাপারে অসহায় চাতক আমি।কিন্তু নিকট জনের লিখার ঘরে ঢুকে পকেট খালি করে বেরিয়ে যাই খুব দ্রত।ভালো লাগলো।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।