গল্পটা এমন নাও হতে পারতো

স্বাধীনতা (মার্চ ২০২২)

বিষণ্ন সুমন
মোট ভোট প্রাপ্ত পয়েন্ট ৩.৮৭
  • ২৩২
সকাল থেকেই অস্থির হয়ে আছে মানুষটা। প্রতি বছর এই দিনটা এলেই তার এমন লাগে। হালিমা জানে আজ পঞ্চাশ বছর যাবত এটাই ঘটছে। যদিও বছর খানেক আগে ব্যপারটা একটু অন্যরকম ভাবে ঘটতো। কারণ সেসময় মানুষটা সচল ছিল। তখন সে আগের রাত থেকেই অস্থির হয়ে উঠতো। ঠিকমত ঘুমাতো না। বিছানায় উঠে বসে থাকতো। এভাবেই রাতটা পার হতেই সকালে বেরিয়ে যেত। তারপর ফিরতো সেই রাতে। হালিমা কখনোই জানতে চাইতো না সে কোথায় গিয়েছিল, কেন গিয়েছিল। কারণ, সে জানতো কেন এমনটি ঘটে। তার নিজের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার খুব স্বাভাবিকভাবেই ঘটে থাকে। তারপরেও সে তা প্রকাশ করে না। কেননা সে তো মা। মায়েদের অনেক কিছু সহ্য করে নিতে হয়।

আজকের্ এই দিনটা এ দেশের প্রতিটা মানুষের জন্য আনন্দের দিন হলেও তার জন্য ভারী কষ্টের দিন। কারণ, আজকের এই দিনে সে তার প্রাণপ্রিয় সন্তানকে হারিয়েছিল। তার ছেলেটা ছিল ভারী বোকাসোকা। সাড়াক্ষণ মায়ের আঁচল ধরে থাকতো। কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক এটা বুঝার জ্ঞান তার ছিল না। আহা সেদিন কতই বা বয়স ছিল তার। মাত্র সাত বছর। বেঁচে থাকলে আজ তার বয়স হতো পাক্কা ৫৭ বছর। শুধু কি তাই । তার একটা বউ থাকতো। তাদের কোল জুড়ে নাতি-নাতনী থাকতো। সারা বাড়িটা হল্লা-কল্লায় ভরপুর থাকতো। দুর কি ভাবছি ! এদ্দিনে তো সেও পোলা-মাইয়ার বিয়া দিয়া নাতি-নাতনী পায়া যাইতো। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো হালিমার বুক চিড়ে। চোখের উপর থেকে লকলকে চশমাটা সরিয়ে চোখ মুছলো। যে বাড়ীটা জন মনুষ্যের কথার শব্দে টুই-টুম্বুর হতে পারতো। সেই বাড়ীটা আজ নিঃশব্দের আখড়া হয়ে আছে।

মানুষটার দিকে তাকালো। তার চঞ্চল চোখ জোড়া জানালার মরিচা ধরা গ্রীলের দিকে নিবন্ধ। লম্বা হয়ে অনড় শু্য়ে আছে সে। ডান হাতটা ভাজ করে বুকের উপর রাথা। হাতের নিচে বুক পর্যন্ত টানা সাদা ক্ষ্যাতাটা তার ফিনফিনে ধুসর দাঁড়ির সাথে লেপটে আছে। শুকনো মুখটায় অবসন্নতার ছাপ সুস্পষ্ট। গত রাতেও সে ঘুমায়নি। এ বয়সে ঘুম এমনিতেই কম হয়। হালিমা নিজেও মাঝে মাঝে জেগে যায়। তবে তার মত টানা জেগে থাকে না। যদিও কালকে তার নিজেরও খুব একটা ঘুম হয়নি। মানুষটার সাথে সাথে সেও জেগে ছিল। আসলে প্রায় সারা রাতেই সে মানুষটার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পেয়েছে, যা তাকে ঘুমাতে দেয়নি। তার কাছে মনে হয়েছিল মানুষটার বুকটা যেন হাপর হয়ে উঠেছে। ক্রমাগত বাতাস ঢুকছে আর বেরুচ্ছে। সে একটিবার ভয়ও পেয়ে গিয়েছিল। বয়স তো কম হয়নি। তিন কুড়ি পেরিয়ে চার কুড়ি শেষ হতে চলল। কাজেই তার চলে যাওয়ার সময়ও হয়ে এসেছে প্রায়। তাছাড়া আজ বছর খানেক যাবত তার চলার শক্তিও রহিত। বার্ধক্য তাকে বিছানার সাথে জুড়ে দিয়েছে। এদিকে তার নিজেরও তো তিন কুড়ি পেরিয়ে চার কুড়ির আধেক শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। পার্থক্য শুধু একটাই সে এখনো বিছানায় পরে যায়নি। আসলে এখন কে আগে যাবে তাই নিয়ে তাদের মধ্যে প্রতিযোগীতা হচ্ছে। না মানুষটা তার আগেই চলে যাক। মনে মনে বললো হালিমা্। কেননা, সে আগে চলে গেলে বুড়ো অথর্ব মানুষটাকে দেখার কেউ থাকবে না।

- এধার শশী মন্ডলকা ঘর কাহা হে? পাক সেনার আচমকা এমন প্রশ্নে হতবিহব্বল হয়ে গেল করিম সরকার।

সে জানে তার দু বাড়ি পরেই শশী মন্ডলের বাড়ী। এও জানে মন্ডলের বড় ছেলেটা মাত্র সতের বছর বয়স কদিন আগে মুক্তিসেনায় নাম লিখিয়েছে। কানা ঘুষা শোনা যাচ্ছে সে নাকি ট্রেনিং নিতে এরই মধ্যে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে গেছে। যদিও শশী মন্ডল সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে তার ছেলে সেখানে তার খালার বাড়ি গেছে। দেশের পরিস্থিতি যেভাবে খারাপ হচ্ছে, তারাও সময় সুযোগ পেলে চলে যাবার চিন্তা ভাবনা করছে। কিন্তু, এই ঘটনো তো পাক সেনাদের জানার কথা তো। তাদের গ্রাম মূল রাস্তা থেকে অনেক দূরে। ফৌজি গাড়ী ঢুকবার রাস্তা এখানে নেই। সে কারণেই যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে আজ অবধি এখানে পাক সেনা ঢুকেনি। রাজাকার, আলবদর দলেও এখান কার কেউ নাম লেখায়নি । করিম সরকার নিজেও ততটা সাহসী মানুষ নয়। তাই যুদ্ধে যাবার চিন্তা তার মাথাতেও নেই। বউ হালিমা আর একমাত্র ছেলেটাই তার সব। তাদের রেখে যুদ্ধে যাবার মত মানসিক শক্তি তার অন্তঃত নেই। স্বাভাবিক ভাবেই চলমান যুদ্ধের সাত-পাঁচে থাকবার লোক সে নয়। তাই সাত সকালে তার উঠোনে পাক-সেনাদের পদার্পন দেখে সে মুষড়ে পড়ল। তার ডাকে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো হালিমা। পাক-সেনাদের দেখে মাথার উপর থাকা আঁচল টেনে মুখ ঢাকলো। এক মাত্র ছেলেটা সেও মায়ের পিছু পিছু বেরিয়ে এলো। চোখ কচলানো দেখে বুঝা যায় সবেই ঘুম ছেড়ে উঠেছে।

বউ বাচ্চাকে দেখে কিছুটা শক্তি পেল করিম সরকার।
- মোঝে নেহি মালুম জনাব। সাহস সঞ্চয় করে উত্তর দিল।

পাক অফিসার ভ্রু-কুঁচকে তাকালো তার দিকে। ওর চোখ বলছে করিমের কথা সে বিশ্বাস করেনি। আচমকা তার দৃষ্টি গেল মায়ের শরীর ঘেষে দাঁড়ানো ছোট ছেলেটার উপর।
-ইহা আউ বাচ্চে। সে হাঁক ছাড়লো।

বাচ্চা ছেলেটা ভয়ে ঘুটিসুটি মেরে মাকে আঁকড়ে ধরলো। হালিমাও তাকে হাত দিয়ে পেঁচিয়ে নিজের সাথে শক্ত করে চেপে ধরলো।

পাক অফিসার প্রমাদ গুণলো। পরক্ষণেই হো হো করে হেসে উঠলো। এক সৈনিককে ইশারা করলো মায়ের কাছ থেকে ওকে টেনে আনতে।
অবস্থা বেগতিক বুঝে সৈনিকের সামনে দাঁড়িয়ে গেল করিম।
- ও কুচ নেহি জানতা জনাব। ইছে কুচ মাত কাহনা।

সৈনিকটা ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। টেনে হিচরে হালিমার কাছ থেকে ছাড়িয়ে ছেলেটাকে নিয়ে এলো। অফিসারের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। ছোট্ট ছেলেটা ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। একবার মা’র দিকে তো আরেকবার বাবার দিকে মাথা ঘুরিয়ে পিছন ফিরছে। ওর অবস্থা দেখে কঁকিয়ে উঠলো হালিমা।
- ইছে ছোড়ে দাও জনাব। ও কুচ নেহি জানতা।

পাক অফিসার হো হো করে হেসে উঠলো। বাচ্চাটার কাঁধে হাত রেখে তার মুখের সামনে মুখ নামিয়ে নরম স্বরে বললো,
- ইয়ে বাচ্চা। বাতাও শশী মন্ডলকা ঘর কাহা হে?

ছেলেটা কোন উত্তর দিল না। শুধু হাত ইশারা করে তাদের বাড়ির বাইরেটা দেখাল। অফিসারের মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়লো। সে বিজয়ীর ভঙ্গীতে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। হাসি মুখে একে একে তাকালো করিম ও হালিমার দিকে। পরক্ষণেই ঘুরে তার সৈনিকদের দিকে ফিরে হাঁক ছাড়লো,
- ইসে আপনে সাথ নিয়ে চলো।

বাচ্চা ছেলেটার হাত ধরে একজন সৈনিক উঠোন ছেড়ে বেরিয়ে যেতে লাগলো। হাসতে হাসতে বাকি সবাই তার পিছু নিল।

-উছে ছোড় দাও সাহাব। ওর বাবা-মা’ও চিতকার করতে করতে পেছনে যেতে উদ্যত হলো।
সবার পেছনে থাকা এক সৈনিক অট্ট হাসিতে ফেঁটে পড়লো। অনুসরণরত বাবা-মা’র দিকে বন্দুক তুলে ভয় দেখালো। ওরা দাঁড়িয়ে গেল। পাক সেনারা বেড়িয়ে গেলে দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।

ক্ষানীক বাদেই অদুরে বেশ ক’টি গুলির আওয়াজ শোনা গেল।

********************************

১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১। পাক সেনা প্রধান জেনারেল নিয়াজীর আত্মসমর্পনের সাথে সাথেই বিজয় অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের। বিজয়ের বেশে ফিরতে শুরু করেছে বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা।

ফিরে এসেছে রতন মন্ডল। সে এখন দাঁড়িয়ে আছে বাবা-মায়ের ভিটের সামনে। তার হাত থেকে ঝুলছে এসএমজি। বহু শত্রু সেনার রক্তে হাত রাঙ্গিয়েছে সে। ভেবেছিল নিজের হাতে তার বাবা-মা’র হাতে এই অস্ত্র তুলে দেবে। কিন্তু, কি থেকে কি হয়ে গেল। দেশ মাতাকে রক্ষা করতে যেয়ে আজ সে নিজেই বাবা-মা হারা। এমন একটা ঘটনা সামলানোর জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। কতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো বিমুঢ়ের মত। পাশ থেকে একজনের বলা সেদিনের ঘটনাটা শুনলো বোধহীন ভাবে। আচমকা ফেঁটে পড়লো সে। তড়িৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে তেড়ে এলো করিম সরকারের বাড়ি। করিম আর হালিমা তখন উঠোনে বসে রেডিওতে আকাশবানী শুনছে। পাশেই বাচ্চা ছেলেটা পাঠকাঠি দিয়ে বন্দুক বানিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলছে।

আসলে সেদিন শশী মন্ডলের বাড়িটা চিনিয়ে দেবার পরই পাকসেনারা ওকে ছেড়ে দেয়। তারপর শশী মন্ডলের বাড়ীর সবাইকে গুলি করে মেরে রেখে যায়। ঘটনাটা আজই ফিরে জানতে পারে রতন। তাই তার সমস্ত রাগ গিয়ে পরে করিম সরকারের ছেলের উপর। তার বাবা-মা’র মৃত্যুর জন্য ওকেই দোষী সাব্যস্ত করে সে। এখন চোখের সামনে ওকে দেখা মাত্রই মাথায় খুন চেপে যায় তার। মহুর্তেই তার উদ্যত গানের মাজল খুঁজে নেয় বাচ্চাটাকে। পরক্ষণেইে একটা উড়ন্ত বস্তার মত ঘরের বেড়ার উপর আছড়ে পড়ে বাচ্চাটার রক্তাক্ত দেহ ।

অস্ফুট একটা শব্দে বর্তমানে ফিরে এলো হালিমা। বিছানায় শুয়ে থাকা বৃদ্ধ করিম সরকার তার ডান হাতটা দিয়ে বুকের কাছের ক্ষ্যাতাটা শক্ত করে চেপে থরলো। মুথ দিয়ে তার ক্রমাগত মু-মু শব্দ বেরুচ্ছে। কষা গড়িয়ে পড়ছে ঠোঁটের দু’কোণ বেয়ে। চোখ বিষ্ফোরিত। বাম হাতটা লম্বা হয়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠছে। এক সময় জানালামুখী সোজা হয়েই থেমে গেল। আচমকা আছড়ে পড়লো বিছানায়। অনড় হয়ে গেল চোখের মনি। তার স্ত্রী প্রায় দৌঁড়ে গিয়ে যখন তার হাতটা ধরলো. ততক্ষণে সে সব ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। জানালা দিয়ে সেদিনের সুর্যটা দেশ বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তির বারতা নিয়েে আস্তে আস্তে উঁকি দিচ্ছে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Jamal Uddin Ahmed অভিনন্দন। গল্পের প্লটের নতুনত্ব আছে যদিও বাস্তবতার নিরিখে মেনে নেয়া কষ্টকর। শুভ কামনা রইল। এগিয়ে যান।
ফয়জুল মহী অনেক সুন্দর লিখা। অনেক ভালো লাগলো।
মোঃ মাইদুল সরকার আসলেই গল্পটা এমন না হলেই ভালো হতো। বাচ্চাটাতো আর ইচেছ করে বলে দেয়নি। তার মৃত্যুটা ঠিক মেনে নেওয়া যায়না।
ধন্যবাদ ভাই। আসলে এমনটি না ঘটালে এই গল্পটাও লেখা হতো না।
doel paki nice.
ধন্যবাদ। আমার সাথেই থাকবেন।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

এই গল্পটা যুদ্ধকালীন বিভিন্ন ঘটনার একটা খন্ড চিত্র।

২৪ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৬৮ টি

সমন্বিত স্কোর

৩.৮৭

বিচারক স্কোরঃ ৩.২৭ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ০.৬ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪