আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম...
ফজরের আজান হচ্ছে। এই আজান শুনে অনেকেই ঘুম থেকে জেগে উঠবে। কিন্তু আমাদের ঘরে কেউ জাগবে না। কেননা গতরাতে আমাদের ঘরে কেউ একরত্তি ঘুমায়নি। সবাই এমনিতেই জেগে আছে। জেগে থাকবার একজন যাও ছিল, সেই এখন চিরতরে ঘুমিয়ে আছে। তার আর কোনোদিন জাগবার জো রইলো না।
খুব বেশী দূরে নয়। আমি এখন যেখানে বসে আছি। তার খুব কাছেই সে শুয়ে আছে। আমার রুমের চৌকাঠ পেরুলেই টানা বারান্দা। তার শেষ মাথায় যে ঘরটিতে সে অনেক বিনিদ্র রজনী পার করেছে, সেখানেই আজ আমাদের সবাইকে বিনিদ্র রেখে নিজেই চির নিদ্রায় শুয়ে আছে। অবশ্য এটা তার জন্য ভালই হয়েছে। আমার মত নষ্ট হয়ে যাওয়া ছেলের জন্য প্রতিরাতে দুশ্চিন্তা করার চেয়ে এটা ঢ়ের ভালো হয়েছে।
আমি হচ্ছি এই পরিবারের বখে যাওয়া সন্তান। পরিবারের সবার অঢেল ভালবাসার ফসল আমার এই নষ্ট জীবন। জীবনে আমি চেয়ে পাইনি এমন জিনিস বুঝি পৃথিবীতে কমই আছে। বাবা ছিলেন সরকারী চাকুরে। পাশাপাশি পারিবারিক ঐতিহ্যগত জৌলুস তো ছিলই। ফলে অহেতুক খরচ করার মত টাকার অভাব আমার কখনোই হয়নি। চাকুরীর প্রয়োজনে বাবা আমাদের পরিবারের সাথে খুব কমি থেকেছেন। ছুটি-ছাটায় যাও বা বাড়ী আসতেন, সেটা ছিল অনেকটা বেড়াতে আসা অথিতির মত। আসলে বাবা ছিলেন আমাদের পরিবারের একজন পার্মানেন্ট অতিথি, যাকে পেলে আমাদের সবার মাঝে এক অবারিত খুশীর ধারা বয়ে যেত। আর তাই বাবার কাছে থাকার সময়টাতে তার অবারিত বাৎসল্য ছাড়া শাসন বস্তুটি কখনো জুটেছে বলে মনে পরেনা। আর মা তো বরাবরই ছিলেন প্রশ্রয়ের এক অপরিমেয় আধার। সেই পরিবারের একমাত্র সন্তান হিসেবে আমি যদি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে কাঁচকলা দেখিয়ে নিজেকে স্বশিক্ষায় নিয়োজিত করি, তবে এতে পরিবারের কারো মাইন্ড না করাই স্বাভাবিক। আমি বরাবরি ভিন্নতর কিছু হতে চেয়েছি। চেয়েছি নিজেকে আলাদা ভাবে চেনাতে। আমি সত্যিই তা হতে পেরেছি। যে কোনো রাজনৈতিক নেতার চেয়েও আমার পরিচিতি অনেক বেশী। আমার কথায় না বলার সাহস রাখে, এমন লোক আমার চেনা গণ্ডীতে বিরল। আর তাই দুর্মূল্যের বাজারে অনেক সস্তায় আমার বাবা এই জমিটা কিনতে পেরেছিলেন। বাংলো প্যাটার্নের নিখুঁত এই বাড়িটা তৈরি করতে আমার বাবাকে কাউকে এক টাকাও চাঁদা দিতে হয়নি। বাবা তো গর্ব করেই বলেন, নিশ্চিন্তে বাড়ি করতে চাইলে প্রতিটি পরিবারে অন্তত: একটি ছেলেকে আমার মত হওয়া উচিৎ।
কিন্তু সেই আমিই আজ ভয় পাচ্ছি। ভয় পাচ্ছি অদূরে যে মানুষটা শুয়ে আছে তার কাছাকাছি যেতে। ভাবতে অবাক লাগে, যে মানুষটা প্রতিদিন এই আমায় শত ডেকেও ঘুম ভাঙাতে পারতো না, সেই আমি আজ পুরো রাত এক ফোঁটাও ঘুমাইনি।
একটা সিগারেট টানতে ইচ্ছে হলো। বালিশের নিচ থেকে সিগারেট বের করে ধরাতে যাব, এমনি সময় মনে হলো দূর থেকে কে যেন বলে উঠলো: খাসনে খোকা। ওটাতো বিষ। ওটা খেলে তুই মরে যাবি। আমি কেঁপে উঠলাম। সত্যি বলতে কি, আমি ভীষণ ভয় পেলাম। না, এমন তো হবার নয়। এই কণ্ঠস্বর তো আর শুনতে পাবার কথা নয়। একটু আগ বাড়িয়ে মাথাটা দরজা দিয়ে বাইরে ঠেলে দিলাম। ওই তো দেখতে পাচ্ছি, সাদা খাঠিয়ার বিছানায় সাদা কাফনে জড়ানো মানুষটা শুয়ে আছে। তার পাশেই মাদুর পেতে বসে আছে এবাড়ী-ওবাড়ীর মহিলারা। বেশ ক'জন তরুণীকেও দেখলাম, মাথায় ঘুমটা টেনে বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। অবাক কাণ্ড, এরা তো কেউ এর আগে আমাদের বাড়ীর আশেপাশেও ভীড়তো না। অবশ্য যে বাড়ীতে আমার মত নারী পূজারী আছে, সে বাড়ী থেকে মেয়েরা শত সহস্র হাত দূরে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। অথচ আজ দেখি সব বদলে গেছে। মাত্র একটা মানুষের চির প্রস্থানে অনেক কিছুই বদলে গেছে। বদলে কি আমিও গেছি ? একবার মনে হলো, একটিবার চেহারাটা দেখিয়ে দেখিই না, কি হয়। কিন্তু, করতে ইচ্ছে হলো না। বরঞ্চ সুরুৎ করে নিজেই আবার মাথাটা টেনে নিয়ে রুমের ভেতর সেঁধিয়ে গেলাম। কেন জানি মনে হলো, কেউ আমায় দেখেনি, এতে অনেক বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। হাতের সিগারেট'টাও ফেলে দিলাম। ওটা আর ধরাতে ইচ্ছে করছে না। কি মনে করে ঘরের লাইটটাও নিভিয়ে দিলাম। অন্ধকারে বসে থাকতে এখন বেশ লাগছে। মনে হচ্ছে আমার আর ভয়ের কিছু নেই। এখন আর চাইলেও কেউ আমায় দেখতে পাবে না।
অদ্ভুত তো। এর আগে তো আমি কখনো এমন করে ভাবিনি। বরং যেখানে সেখানে নিজের চেহারা সুরৎ দেখানোটাই আমার জন্য অনেক আনন্দদায়ক ছিল। আমায় দেখার পর উপস্থিত পরিবেশ পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়াটা আমি বেশ উপভোগ করতাম। আর আমার ঘরে লাইট নিভিয়ে রাখার কথা কেউ কল্পনাও করতে পারতো না। প্রতি রাতে যখন বাসায় ফিরতাম, তখন আমার ঘরের লাইট জ্বালানো থাকাটাকেই আমি সবসময় আশা করতাম। টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখা খাবার খেয়ে যখন শুয়ে পড়েছি, তখনো লাইট নেভানোর কথা মনে হতো না। কিন্তু সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর সেই লাইট নিভানোই দেখে এসেছি এদ্দিন। এটাও যে সেই মানুষটারী অবারিত ভালবাসার ফল, এটা বুঝতে আমার কখনোই অসুবিধে হয়নি।
ফজরের নামাজ পড়ে দলে দলে সবাই এসে আমাদের উঠোনে ভিড় করছে দেখতে পাচ্ছি। ইতিমধ্যে অনেক ফর্সা হয়ে উঠেছে চারিপাশ। আশে পাশের ক'জনকে দেখলাম ধরাধরি করে খাটিয়াটাকে উঠোনে নিয়ে এলো। বাবাকে দেখলাম, শেষবারের মত মানুষটাকে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। পরক্ষণেই সন্মিলিত কলেমার আওয়াজে তার কান্নার শব্দ চাপা পড়ে গেল। সবাই মিছিল করে খাটিয়াটাকে কাঁধে নিয়ে হেঁটে বেড়িয়ে যেতে লাগলো।
আমার বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেল। ওইতো চলে যাচ্ছে সেই মানুষটা, যার কারণে আমি এই পৃথিবীতে এসেছি। অথচ তাকে আমি কতইনা কষ্ট দিয়েছি। হ্যাঁ এই মানুষটা আমার জন্মদাত্রী মা। সহসা বোধোদয় হলো আমার। এ আমি কি করছি। অতীব সাহসী আমি আজ কেন ভীরু কাপুরুষের মত নিজেকে লুকিয়ে রেখেছি। কেন আজ আমার মায়ের চির বিদায়ের মুহুর্তে আমি তার মুখোমুখি হতে পারছি না। চিন্তাটা সাহসী করে তুললো আমায়। সটান উঠে দাঁড়ালাম। সজোরে ছুটতে গিয়ে দরোজার চৌকাঠে পা বেঁধে হুমরী খেয়ে সামনে পড়লাম। মাথায় আঘাত পেয়ে চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। নিজের অজান্তেই আমার কন্ঠ চিড়ে বেড়িয়ে এলো, মা-আ-আ-আ !
"খোকা, এই খোকা, এই তো আমি। কি হয়েছে তোর ?" চোখ খুলেই দেখি আমার মুখের উপর ঝুঁকে আছে মায়ের উদ্বিগ্ন মুখ।
"মা' তুমি বেঁচে আছো ?" আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম।
"শোন দেখি ছেলের কথা। আমি কি মরে গেছি নাকি।" মা হেসে ফেললেন। "তুই স্বপ্ন দেখছিলি।"
আমি আশ-পাশ তাকিয়ে দেখি আমি শুয়ে আছি আমারী ঘরে আমারী বিছানায়। মা বেড়িয়ে যেতে লাগলেন দেখে লাফিয়ে বিছানা ছাড়লাম।
"ও কি্ব ! উঠে পড়লি যে ?" এবার মা'র অবাক হবার পালা।
"আমিও নামাজ পড়বো।" বলেই মা'র পিছু পিছু আমিও ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম।
দূর থেকে তখনো ভেসে আসছে ফজরের আজান, আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম ।
২৪ জানুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৭০ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪