আগর তলার হাফানিয়া ক্যাম্প । ট্রেনিং শেষে কমান্ডার আবিদ রেজা নির্দেশ দিয়ে জয়দর মিয়ার মুখের দিকে তাকাল । কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করল না ভেন্ডেজ বাধা অকেজো হাতটা সে নাড়াতে চাইল কিন্তু শিরশির করে একটা ব্যথা চিনচিন করে উঠল । মুখটা পান্ডুর মত হয়ে গেল । আবিদ প্রশ্ন করল কিরে পারবি না ? জয়দরের পান্ডুর মুখেও হাসি ফুটে উঠলো । ডান হাতে ষ্টেনগানটা উঠিয়ে নিয়ে আকাশের দিকে তাকাল । আকাশ স্বচ্চ নির্মল পরিষ্কার । মাঝে মাঝে একদল সাদা মেঘ দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে ছুটে যাচ্ছে । সবাই সারিবদ্ধ ভাবে লাইনে দাড়িয়ে আছে । তারা পঞ্চাশ জনের একটি দল আজ ট্রেনিং শেষ করে যুদ্ধের মাঠে যাবার জন্য প্রস্তুত । এক জন আর এক জনের মুখের দিকে তাকাল । আবিদ সবার চোখে মুখে এক কঠিন দীপ্ত ভাষা বুঝে মুচকি হাসল । দশজন দশজন করে পাচটি গ্রুপ করা হল । দশ জন বাছাই করা মৃত্যু ভয়হীন দূর্দান্ত সাহসীদের সমন্বয়ে গড়া অগ্রবর্তি গ্রুপের লিডার শফিক । তার সাথে জয়দর,সেতু , মতি, ফজল, আলফাজ, এনাম সহ আরও তিন জন । তারা প্রয়োজনীয় অস্ত্র গোলাবারুদ ডিনামাইড, গ্র্যানেড, এক্সক্লুসিভ নিয়ে জয়বাংলা বলে দেশের অভ্যন্তরে রওয়ানা হয়েছে । অপর গ্রুপ গুলো তাদের পেছন পেছন প্রয়োজনীয় সহায়তা সহ ব্যাকিং করে আসবে ।
শফিক ও তার দলকে নির্দেশ দেয় হয়েছে দেশে ঢুকেই সিএন্ডবি রোডের ব্রিজটি ভেঙ্গে দিতে হবে । যাতে নির্বিঘ্নে মুক্তি যোদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে ঢুকতে পারে । দেশে ঢুকেই তারা একটি গ্রামের গভীর জঙ্গলে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিল । শফিক, মতি, জয়দর, সেতু ছদ্ধবেশে, বেশ কবার ব্রিজটা রেকি করে এসেছে । সন্ধ্যা হতেই আকাশ ঘণ কাল হয়ে ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হল । বাইরে ঘণ গভীর অন্ধকার । মাঝে মাঝে বজ্রপাতসহ বিদ্যুত চমকাচ্ছে । শফিক, মতি, জয়দর আর সেতু নদীর জলের আড়ালে হারিয়ে গেল । অন্য ছয়জন নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে তাদের অনুসরন করবে । নদীর তীব্র স্রোত তাদের টেনে নিয়ে চলছে । যতটা সময় লাগবে বলে ভেবে ছিল তার অনেক আগেই তারা ব্রিজের কাছাকাছি পৌছে গেল । সহজ সরল বোকা বকলম জয়দর আজ অনেক পরিনত সাহসী যোদ্ধা । শফিক ভাবল সেই জয়দর আর আজকের মুক্তিযোদ্ধা জয়দর যেন আকাশ পাতাল তফাৎ । একই গ্রামে একই সাথে তারা বড় হয়েছে । দারিদ্রতার কারনে জয়দরের স্কুলে যাওয়া হয়ে উঠেনি । কিন্তু শফিকদের মত লেখা পড়া জানা বন্ধুদের সে কোন দিন পিছু ছাড়েনি । বিকেলের আড্ডায়,ফুটবল খেলায় কিংবা তাস খেলায় জয়দর থাকতো সর্বত্র । যুদ্ধে যাবার খবর শুনে সেই সবার আগে দারিদ্র ক্লৃষ্ট বৃদ্ধ বাবা, মা, বিধবা বোন কে ফেলে তাদের সাথে যুদ্ধে চলে এসেছে । আগর তলায় আসার পথে পাক সেনাদের অতর্কিত আক্রমনে একটা গুলি এসে তার বাম হাতটি বিদ্ধ করে । তাৎক্ষনিক চিকিৎসার অভাবে হাতটি চিরতরে অকেজো হয়ে পড়ে । তবুও সে যুদ্ধের ময়দান থেকে পিছপা হয়নি । ট্রেনিংয়ের ময়দানে প্রথম প্রথম তার কথা আচরণে ও সরলতায় অনেক হাসি ঠাট্টা হতো ।
তাদের চোখের সামনে এখন ভাসছে ব্রীজটি । তারা জল থেকে আস্তে আস্তে উঠে পড়ল । ব্রীজের গোড়ায় যেতে হবে শফিক আর সেতু এগিয়ে গেল । সমস্ত পরিকল্পনা আগেই নেয়া আছে । উপরে ভারী বুটের আওয়াজ শুনা যাচ্ছে । পাক সেনারা টহল দিচ্ছে । জয়দর আর মতি শুয়ে পড়ল । শফিক আর সেতু ডিনামাইট ফিট করে ফেলেছে । দুরে সরে এসে ব্যাটারী অন করে সুইচ দিতে যাবে হঠাৎ সমস্ত রাস্তা জুড়ে আলো জ্বলে উঠল । বিদ্যুত গতিতে একটা শিসা শফিককে বিদ্ধ করল । সেতুর মরণ চিৎকার কানে এল । উপর থেকে হ্যান্ডস আপ বলে শব্দ শুনতে পেয়ে জয়দর ষ্টেনটা উপরে তুলে দাড়িয়ে পড়ল । চারিদিক থেকে পাকসেনারা তাকে ও মতিকে ঘিরে আছে । ভাঙ্গা হাতটা নাড়াতে চাইলো কিন্তু পারল না । হ্যাচকা টানে এক সেনা তার হাত থেকে ষ্টেনটা কেড়ে নিয়ে একটা ঘুষি মেরে তাকে মাটিতে ফেলে দিল । চারদিক থেকে বুটের লাথি পড়তে লাগল । রাইফেলের বাটের আঘাতে মাথা ফেটে গিয়ে রক্তে ভেসে যাচ্ছে । কিছুক্ষণের মধ্যে জয়দর জ্ঞান হারিয়ে ফেলল ।
জ্ঞান ফিরে এলে দেখতে পেল সে পাকহায়েনাদের একটি জীপের মাঝে একা পড়ে আছে । প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দ কানে আসছে । সে মাথা তুলে দেখতে চেষ্টা করল । অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেল না । সে হাতরাতে শুরু করল । একটা বাক্স হাতে ঠেকল । বাক্সের ভেতর হাতরে বেশ কিছু হ্যান্ড গ্রেনেড ও গুলি খুঁজে পেল । জয়দর একটু মুচকি হাসল । আস্তে আস্তে উঠে বসল দুটো গ্রেনেড হাতে তুলে নিল । বাইরে তাকাল দেখলো জীপটি ব্রীজের মাঝ বরাবর দাড় করানো । জয়দর চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে । এক টানে দুটো গ্রেনেডের পিন খুলে ফেলল । গ্রেনেড দুটো জীপের মাঝে ফেলে দিয়ে জীপ থেকে এক লাফে রেলিং ডিংগিয়ে নদীতে পড়ার আগেই প্রচন্ড জোরে গ্রেনেড গুলো ব্রাষ্ট করল । জীপটি প্রায় বিশফিট উপরে উঠে জ্বলে উঠলো । জ্বলতে জ্বলতে আবার ব্রীজের উপর আছড়ে পড়ল । পাক সেনারা কিছু বুঝে উঠার আগেই অনেকে নদীর জলে তলিয়ে গেল আর বাকীরা ভাঙ্গা ব্রীজের দুই পাড়ে আটকা পড়ল ।
স্রোতের টানে জয়দর ভেসে চলছে । সে দেখছে ছোট্র সুন্দর গাঁ, সামনে পেছনে ফসলের মাঠ । জমিতে হাল দিচ্ছে । গরুর পেছন পেছন লাঙ্গলের হাতল ধরে আছে । বন্ধুরা সামনের বড় সড়ক দিয়ে বইখাতা নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে । গাছে গাছে শিমুল পলাশ, কৃষ্ণচুড়া ফুটে সারা গা লালে লাল হয়ে উঠেছে । দুর থেকে একটা ট্রেন হুইসেল বাজাতে বাজাতে এগিয়ে আসছে । দলবেধে মাছ ধরতে খালে নেমে পড়েছে । বিকাল হয়ে আসছে লাঙল জোয়াল কাধে নিয়ে গরু তারিয়ে বাড়ীর পানে দে ছুট । কোন রকমে নাকে মুখে দুটো খাবার মুখে তুলে রেলওয়ে মাঠে ছুটছে । জহির বলটা আমার কাছে দে । জোরে এক লাথি লাগিয়েছে । চারিদিক থেকে শোরগুল গৌল গৌল । দারিদ্র ক্লিষ্ট বৃদ্ধ বাবা মা বিধবা বোনের আর্তি- ভাই তুই কবে ফিরবি । আমাদের যে বড় ক্ষিধা । ঘরে যে আর কিছুই নেই । বোনরে আর কটা দিন সবুর কর দেশটা স্বাধীন হলেই আমি চলে আসবো । তখন দেখবি আমাদের আর কোন অভাব থাকবে না । জানিস আমি নিজ হাতে পাক সেনাদের খতম করেছি । সিএন্ডবি ব্রীজটা উড়িয়ে দিয়েছি । এখন আমাদের অগ্রযাত্রা আর কেউ আটকাতে পারবে না । জয়দর ক্লান্ত বেশ ক্লান্ত । ঘুম পেয়েছে বড্ড ঘুম পেয়েছে । এক সময় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল ।
পর দিন সকালে চানপুরের চরে একটা ক্ষতবিক্ষত লাশ ভেসে উঠেছে । লাশটির পরিচয় কেউ বলতে পারল না । তাই বেওয়ারীশ লাশ ভেবে নদীর পাড়েই তার কবর দিল । তিন দিন পর মুক্তি যোদ্ধারা এ পথে ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছে । তারা গ্রামের মানুষের মুখে শুনতে পেল এখানে গত পরশু এক অজ্ঞাত লোকের ক্ষতবিক্ষত লাশ ভেসে উঠে ছিল । মুক্তি যোদ্ধারা কবর দেয়া স্থানটি দেখতে গিয়ে জয়দরের ব্যবহৃত পোষাক দেখে তাকে চিনতে পারল । স্থানটি জয়দরদের গ্রাম থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দুরে তাদেরই থানায় । কিন্তু কেউ তাকে চিনতে পারল না । মুক্তিযোদ্ধারা গ্রামের কয়েক জনকে ডেকে নিয়ে তার রুহের মাগফেরাত কামনা করে দোয়া পড়ে কবরটি লাল সবুজ পতাকা দিয়ে ঢেকে দিল । মুক্তি বাহিনী জয়দরের রক্তের শপথ নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে ছড়িয়ে পড়ল ।
জয়দর ,শফিক, সেতু, মতিদের সেই বীরত্বের কথা আজ আর কেউ ভুলেও মনে করে না । তাদের অনেক সহযোদ্ধা আজ মুক্তিযোদ্ধাসনদ, পদপদবী, নেতা নেত্রীর পদলেহন আর সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলায় ব্যস্ত ।
০৭ এপ্রিল - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৩৫ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪