বে-ওয়ারিশ

বাবা (জুন ২০১২)

বশির আহমেদ
  • ৬২
  • ১০
তন্দ্রা কেটে গেল । পত্রিকা পড়তে পড়তেই টেবিলের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে গিয়ে ছিল শাহীন । ঘরের চারিদিকে তাকাল । ঘরের এক কোনে দেয়ালে পেড়েক দিয়ে লটকানো রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের একটি ক্যালেন্ডার ঝুলছে । ক্যালেন্ডারের ছবিটার প্রতি নজর পড়ল । মুক্তিযুদ্বের ছবি দিয়ে ক্যালেন্ডারটি সাজানো । পাশের রুম থেকে বিদ্যুতের লাইনটি এপাশে এসেছে । ঘরে ১০০ ভোল্টের একটি বাতি জ্বলছে । একটা টিকটিকি বাতির চার পাশে ঘুর ঘুর করছে । শাহীনের চোখটা আবার ক্যালেন্ডারটার উপর এসে স্থির হলো । বাতিটির তীব্র আলোর রশ্নি শাহীনের চোখে এসে লাগছে । চোখটা ঝাপসা হয়ে এল । হালকা বাতাসে ক্যালেন্ডারটা নড়ে উঠল । দেয়ালে লটকানো ঘড়িটা টিক টিক করে ঘুরে চলেছে আপন বলয়ে । শাহীনের দৃষ্টিটা যেন সরে গেল দুরে বহুদুরে । ৭১ এর সেই ভয়াল দিনগুলোর পানে ।
বিকাল তিনটা । শাহীনদের গ্রাম থেকে মিছিল শুরু হলো । প্রথমে মিছিলে দেড় দুশ লোক থাকলেও এক গ্রাম পেরোতেই মিছিলে হাজারো লোকের সমাগম হয়ে গেল । মিছিল একগ্রাম দু-গ্রাম করেকরে মেঘনা নদীর তীরে আলগী বাজারে এসে থামল । মিছিল এখন লোকে লোকারন্য । এত বিশাল মিছিল গ্রামের মানুষ এর আগে কখনো হতে দেখেনি । মিছিল আবার এগিয়ে চলছে । গ্রামের প্রতিটি আঙ্গিনা থেকে কুল বধুরা উৎসুক দৃষ্টিতে ঘন্টার পর ঘন্টা মিছিলের দিকে তাকিয়ে আছে । আজ ১৭ই মার্চ বাংগালীর অবিসংবাদিত নেতার জন্ম দিন । মিছিলে সবার মুখে একই শ্লোগান “ পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা । আমার নেতা তোমার নেতা শেথ মুজিব শেখ মুজিব । ইয়াহিয়ার গদিতে লাথি মার বাংলা দেশ স্বাধীন কর । পিন্ডি না ঢাকা ঢাকা ঢাকা । জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু “। মিছিল শেষ হতে হতে রাত প্রায় বারটা বেজে গেল । তিন বন্ধু শাহীন, জহির আর শহিদ মিছিলের উত্তেজনায় কোথায় এসে মিছিল শেষ হয়েছে এত ক্ষন তা টের পায়নি । তাদের গ্রামের পথ কোন দিকে ঠাহর করতে পারছেনা । তিন জনেরই তখন বষস বড় জোড় চৌদ্দ পনের হবে । পুরো রাস্তা জন শুন্য হয়ে পড়েছে । সুনসান নিরবতা চারদিকে । অগত্যা তিন বন্ধু পশ্চিম দিক আন্দাজ করে হাটা দিল । কিছুদুর হাটার পর রাস্তা শেষ হয়ে গেল । আকাশের তারার আলো লক্ষ্য করে ক্ষেতের আল ধরে হাটতে শুরু করল । আধা ঘন্টা হাটার পর পুবাকাশে চাঁদ উকি দিতে শুরু করেছে । কুঁয়াশার চাদর ভেদ করে চাঁদের ক্ষীণ আলো তাদের পথ দেখিয়ে সামনে এগুতে সাহায্য করছে ।
প্রায় এক ঘন্টা হাটার পর তারা একটি মন্দিরের পাশে এসে থামল । ক্ষিধা আর ক্লান্তিতে পা আর চলতে চাচ্ছে না । তিন বন্ধু দাড়িয়ে পড়ল । চারিদিক নিস্তব্দ নিঝুম । কুঁয়াশার চাদরে ঢাকা পড়েছে চারিদিক । রাতের শেষ প্রহরের শীতে সবাই কাবু হয়ে পড়ছে । শহিদ বলল দুস্ত চল বাকী রাতটা এখানে মন্দিরের বারান্দায় কাটিয়ে দিই । এ কথা শুনেই জহির বাচ্চা ছেলের মত কাঁদতে শুরু করে দিল ।
শাহীন ধমক দিয়ে বলল এই জহির মেয়ে ছেলের মত কাঁদছিস কেন ?
জহির বলল-বাড়ীতে না ফিরলে আব্বা আমাকে মেরেই ফেলবে ।
মেরে ফেলবে বললেই হল । আমরা কি ইচ্ছে করে পথ হারিয়ে ফেলেছি । বলেই শহিদ গজগজ করতে লাগল । জহির ফ্যাস ফ্যাস কান্না বন্ধ কর আর কয়েকটা খড়কুটা জোগাড় করে বসার ব্যবস্থা কর । যাতে শীতের হাত থেকে একটু ওম পেতে পারি ।
তারা পাশের বাড়ীর খরের গাদা থেকে কিছু খড় নিয়ে এসে মন্দিরের বারান্দায় বিছানা পেতে বসে পড়ল ।
মন্দিরের পাশে মানুষের ফিস ফিস আওয়াজে পুরোহিত ঠাকুরের ঘুম ভেঙ্গে গেল । মন্দিরের বিগ্রহ চুরি করতে কেউ মন্দিরে প্রবেশ করেছে কিনা তা দেখার জন্য ঠাকুর ঘর থেকে টিমটিমে হারিকেনটা নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে এল । দুর থেকে বারান্দায় তিনটি কিশোর বসে আছে দেথতে পেয়ে কাছে এগিয়ে এল । ঠাকুর জানতে চাইল- তোমরা কেরে বাবা ? তোমরা কোথা থেকে এসেছ ? মন্দিরেই বা কি করছ ?
শাহীন জবাব দিল-দাদা আমাদের বাড়ী জয়নগর । মিছিলে গিয়ে ছিলাম পথ হারিয়ে এখানে এসে পড়েছি । রাতটা কোন রকমে কাটিয়ে সকালে বাড়ী চলে যাব ।
ঠাকুর বলল- জয়নগরের কার ছেলে তুমি ?
শাহীন জানাল মুন্সি বাড়ীর করিম মুন্সির ছোট ছেলে আমি ।
কি বলছ তুমি ? জান আমি কে ? আমি ললিত ঠাকুর । তোমার বাবা আমার প্রিয় বন্ধু । আমিতো প্রায়ই তোমাদের বাড়ী যাই । তুমি আমায় কোন দিন দেখনি ?
শাহীন বলল- দেখেছি কাকা বাবু । তবে অন্ধকারে ঠিক চিনতে পারিনি ।
ললিত ঠাকুর বলল রাতে নিশ্চয় তোমরা কিছু খাও নি ।
সবাই মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে রইল ।
ঠাকুর বলল দাড়াও আমি আসছি- বলেই তিনি ঘরের দিকে ছুটে গেলেন । ঘর থেকে একটি বাটিতে করে কিছু চিড়া গুর আর এক জগ জল নিয়ে হাজির হলেন ।
চিড়া, গুর আর জল খেয়ে তারা খড়ের গাদায় পরম আনন্দে শুয়ে পড়ল ।

দুই
পচিশে মার্চে রাতের অন্ধকারে পাক বাহিনী নিরীহ বাঙগালীদের উপর অতর্কিত আক্রমন চালিয়ে হত্যা যঞ্জচালিয়ে যাচ্ছে । সারা বাংগালী জাতি নিস্তব্দ । ভেতর ভেতর ফুসে উঠছে তুষের আগুনের মত । বোশেখ মাস সকাল থেকে উত্তর আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে । সারা দিন গুমট গরমে কেটেছে । জমিতে কাজ করা কৃষকের জন্য দুরুহ হয়ে পড়েছে । ক্ষেতে নিড়ানী দেয়া জরুরী । সন্ধ্যার পর থেকে আকাশ কালো করে কালবৈশাখী ঝড় বইতে শুরু করল । থেমে থেমে দমকা বাতাস আর বৃষ্টি । কাচা ঘর বাড়ী, গাছপালা ঝড়ে মড়মড় করে ভেঙ্গে পড়ছে । রাত ভর ঝড় বৃষ্টির তান্ডব চলল । মাঠ –ঘাট, বিল-ঝিল বৃষ্টির পানিতে সয়লাব । উজান থেকে তীব্র বেগে পানি নেমে আসছে । ভোরে আজান দিতেই শাহীনের বড় ভাই শাহীন কে ঘুম থেকে ডেকে তুলল । শাহীন এই শাহীন উঠ । চল মাছ ধরতে যাই ।
মাছ ধরার কথা শুনে শাহীন সকালের আরামের ঘুম ফেলে মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে গেল । দু;ভাই রেললাইন ধরে দুই কিলোমিটার দুরে কামাল পুরের বিল । মেঘনার সাথে দরগা বিলের সংযোগ স্থলে রেলব্রিজের নিচে এসে জাল ফেলল । পুবাকাশে সূর্য উকি দেয় দেয় করছে । চারদিক জন শুন্য । জলের নিচে মাছ যেন খই ফুটছে । জাল টান দিতেই মাছ লাফিয়ে জাল পেরিয়ে বাইরে ছুটতে লাগল । বড় বড় রুই, কাতল, বোয়াল মাছ গুলো জালে ধরে রাখা খুব কষ্ট কর হয়ে যাচ্ছে । দেখতে দেখতে এক ঘন্টার মধ্যে ধান সেদ্ধ করার সিলবারের হাড়ীটি কৈ ,সিং ,মাগুর , পুটি টেংড়া সহ নানা বিধ গুড়া মাছে ভরে গেল । বড় বড় রুই, কাতল. বোয়াল যা ধরতে পেরেছে তা কচি পাট গাছের ছাল দিয়ে গেথে মালা করে নেয়া হয়েছে । মাছ ধরে আর রাখার জায়গা না থাকায় তারা বাড়ীর পথ ধরল । হাড়ির মুখ গামছা দিয়ে শক্ত করে বেধে নেয়া হল । পথে অনেকে তাদের এত মাছ ধরার খবর পেয়ে দলে দলে ব্রিজের দিকে মাছ ধরতে ছুটে গেল । বাড়ীতে এনে মাছ রাখতেই প্রতিবেশীরা সবাই ছুটে এল । জিয়ল মাছ গুলো মাটির গামলায় জিয়ে রেখে সবাই মিলে উঠানে মাছ কুটতে বসে পড়ল । দিনটা সম্ভবত সতেরই এপ্রিল । বেলা তখন নয়টা । আবার গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে ।
বাড়ীর পেছনে উত্তর পাশে পূর্ব থেকে পশ্চিমে রেললাইন । উঠান থেকে পেছনে তাকালেই রেললাইন চোখে পড়ে । রেললাইন দিয়ে দেখা যাচ্ছে সারি করে এক দল লোক রেণকোর্ট পড়ে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে হেটে যাচ্ছে । গ্রামের ছেলে বুড়ো সবাই তাদের দেখার জন্য রেললাইনের দিকে ছুটতে লাগল । গিয়ে দেখা গেল তারা একদল সৈনিক । হাতে অস্ত্র মাথায় লোহার ক্যাপ । নিরবে হেটে অগ্রসর হচ্ছে । গুনে দেখা গেল পাচশত সৈনিকের একটি কাফেলা । কাফেলা শাহীনদের গ্রামটি পেরিয়ে কিছুদুর যাবার পরই গুলাগোলি শুরু হয়ে গেল । দশ গ্রামজুড়ে হুরোহুড়ি আর কান্নার রোল পড়ে গেল । যে যেদিক পারে দৌড়াতে শুরু করে দিল । প্রায় ঘন্টা খানেক গুলাগোলি চলার পর অগ্রসরমান সৈনিকেরা শাহীনদের গ্রামে ফিরে এসে ট্রেন্সখুড়ে আশ্রয় নিতে শুরু করল । ভয়ে গ্রামের মানুষ গ্রাম ছেড়ে পালাল । এক টানা চারদিন পাক সেনারা গ্রামে অবস্থান করল । পঞ্চম দিন তারা সামনের দিকে রওয়ানা হল ।
দ্বিতীয় দিন থেকে কিছু কিছু পরিবারে মানুষ না বুঝে গ্রামে ফিরে এসে বাস করতে শুরু করল । একদিন বসবাসরত একটি পরিবারে দিনে দুপুরে হানা দিল পাক হানাদার । শাহীন দেখল একটি নরখাদক পাকসেনা ঘর থেকে একজন যুবতীকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছে । যুবতীর চিৎকারে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছে । ভযে কেউ তাকে রক্ষায এগিয়ে আসছে না । যুবতীর কাপড় ছিড়ে যাচ্ছে । আস্তে আস্তে যুবতীটি উলঙ্গ হয়ে গেল । নরপিসাচের উললাস আর যুবতীর আর্তচিৎকার শাহীনের কানে বাজছে ।
ঝাপসাটা কেটে গেল । আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল হাওয়ায । দৃষ্টি ফিরে এল পেরেক ঠুকানো ক্যালেন্ডার টার পাতায । ছবিটা দেখে মনে হলো যেন সেই নরখাদকের সেই মুখ সেই চোখ । কপালের বলি রেখায় একটু যেন ভাজ পড়ল । মনে হচ্ছে পিঠে যেন কে আঘাত করল । আস্তে করে হাত দিল পিঠে । হাতটা ভিজে উঠল । হাতটা সামনে এনে ধরল তাকিয়ে দেখল লাল তাজা রক্ত । বুঝতে পেড়েছে হানাদার বাহিনীর একটি বুলেট শাহীনের পিঠের উপর অংশ ছিড়ে বেড়িয়ে গেছে ।
মনে পড়ছে সেই দিনের কথা । মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে দলে দলে লোক জন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য ভারতে পাড়ি দিচ্ছে । শাহীন,শহিদ,নজরুল,এনাম, কুদ্দুস একদিন রাতের অন্ধকারে কাউকে না জানিযে পাড়িদেয় ভারতের আগর তলায় । শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং । দেড় মাস ট্রেনিংয়ের পর তারা ফিরে আসে যুদ্ধ ক্ষেত্রে ।
তাদের গ্রামে প্রথম পাকবাহিনী আসার বেশ কিছুদিন পর । ললিত ঠাকুর তার বাবার সাথে দেখা করতে এসেছিল । কথায় কথায় ললিত ঠাকুর শাহীনের বাবাকে বলে ছিল –মুন্সি এ দেশ স্বাধীন হবে । আমি পাজি কুষ্টি গননা করে দেখেছি অনেক মানুষের প্রান যাবে । হতে পারে তুমি আমি বা আমরা থাকবনা । আগামী পৌষ মাসের মধ্যে দেশ শত্রু মুক্ত হবে । ঠাকুরের ভবিষ্যত বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে ছিল । ঠাকুর মশায়ের কথা শাহীনের প্রায়ই মনে পড়ে । ললিত ঠাকুর, শাহীনের বাবা, মা কেউ স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেনি । তারা নরপিচাসদের বলি হয়েছে ।

তিন
মনে পড়ছে জীবনের প্রথম মানুষ হত্যার কথা । মানুষ বললে ভুল হবে এক নরপিচাস হত্যার কথা । নরপিচাসের রক্তে রাঙানো ছুরিটার কথা । বয়স তখন কিই বা আর চৌদ্দ পনের হবে । ছবিটা আবার দুলে উঠলো । বাতিটার পাশে একটা টিকটিকি শিকারের অপেক্ষায় ঘুর ঘুর করছে । খপ করে একটা মশা তুলে নিল মুখে । টিকটিকিটা শব্দ করে উঠলো । অজানা ভয়ে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো । ছোট বেলা মা বলতেন টিকটিকি ডাকলে কিংবা ভোরে কাক ডাকলে যে কোন একটা অমঙ্গল ঘটতে পারে । পত্রিকাটা টেনে নিল । দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হচ্ছে । অনিচ্ছা সত্বেও শাহীন উঠে দাড়াল । মনে মনে ভাবছে শহিদ এসেগেছে নিশ্চয় । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত দশটা বেজে গেছে । শহিদ একটা গামের্ন্টস এ চাকুরী করে । শাহীনের এখানেই থাকে । শহিদের বিধবা মা গ্রামের বাড়ীতে থাকে । শহিদের বাবা মুক্তিযুদ্ধের সময় এক বিহারীর রুটির কারখানায় দারোয়ানের চাকরী করত । যুদ্ধের শেষ সময়ে একদিন শহিদের বাবাকে বিহারী ক্যাম্পে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় । সেই থেকে নিখোঁজ । শাহীন দরজা খুলে দিল । শহিদের সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে আছে ।
শহিদ বলল- খেয়েছিস শাহীন ?
শাহীন বলল- না ।
এত রাত অবধি না খেয়ে বসে আছিস কেন ?
তোকে ফেলে আমি একা কখনো খেয়েছি ? তুই হাতমুখ ধোয়ে আয় আমি খাবার রেডি করি ।
খেতে খেতে কথা হলো । শহিদের অমানুষিক পরিশ্রমের কথা,স্বল্প বেতনের কথা, শ্রমিকদের শোষনের কথা,মুক্তিযুদ্ধের সময়কার প্রত্যাশার কথা । নেতা নেত্রীদের উত্থান পতনের কথা । স্বাধীনতা বিরোধীদের মন্ত্রী হবার কথা । তাদের গাড়ীতে লালসবুজ পতাকা ওড়ার কথা । কথায় কথায় অনেক রাত হলো । শহিদকে আবার সকাল সাতটায় অফিসে যেতে হবে । বাতিটা নিবিয়ে দিল । আধারে টিকটিকিটা আবার ডেকে উঠলো । বড্ড খারাপ লাগে শাহীনের । অসহ্য লাগে শব্দটা । একেক বার ভাবে উঠে গিয়ে টিকটিকিটা মেরে ফেলবে কিন্তু পারে না ।
কেন যেন নিষ্ঠুর হাতটা আর হত্যায় আনন্দ পায় না । হত্যার কথা মনে হলেই মনে পড়ে সেই নরখাদকের মুখ । আর যুবতী নারীর উলঙ্গ চেহারা । ভাঙ্গা স্কুল ঘরটিতে নরখাদকটি তার শুর দিয়ে শুকছে উলঙ্গ নারীর দেহ শুয়োরের মত । ভেঙ্গেচুড়ে চুড়মার করে দিচ্ছে কোমল দেহ টাকে । মেয়েটি আজও বেচে আছে । নাসিং পেশায় চাকরী নিযে মানব সেবার ব্রতে নিজেকে নিয়োজিত করেছে । শাহীন মাঝে মাঝে মেয়েটির সাথে দেখা করে খোজ খবর নেয় । আজ বয়সের ভারে ন্যুজ হয়ে এসেছে দেহ ।
মেয়েটির সেদিনের ভয়ার্ত সেই মুখ কিছুতেই ভুলতে পারে না শাহীন । যখনই পেড়েক বিদ্ধ ক্যালেন্ডারটার দিকে চোখ পড়ে-চোখের সামনে ভেসে উঠে পাক হায়েনার বিকৃত মুখ,উলঙ্গ নারীর চিৎকার । ঘুম আসছে না । ভাবছে অনেক কিছুই । পুকুর পাড়ের পশ্চিম দিকে আমতলায় ১৭ ই ডিসেম্ভর জড়ো হয়েছিল যুদ্ধ ফেরত ক্লান্ত মুক্তিযোদ্ধারা । ক্লান্তি আর অবসাধে ঘুমিয়ে পড়েছিল তারা হাতের অস্ত্র পাশে রেখেই । শাহীন ছোট একটি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে ছিল । পুকুর পাড়ে বড় তাল গাছটার নিচে লুকিয়ে রেখেছিল । আজো আছে সে অস্ত্রটি শাহীনের কাছে । ব্যবহার না করায় অস্ত্রটিতে জং ধরেছে । মাঝে মাঝে শাহীন মুছে রাখে অস্ত্রটা ।

চার
দেশ স্বাধীন হয়েছে অনেক দিন হলো । কিন্তু নরপিচাসরা আজো বেচে আছে বহাল তবিয়তে । আজ আবার তারাই ক্ষমতার ছড়ি ঘোড়ায় মাঠে ঘাটে অফিসে আদালতে ব্যবসা বানিজ্যে কল কারখানায় । শহিদের গার্মেন্টস কারখানার মালিক তাদেরই একজন । সেদিন শাহীনের হাতে এক নর পিসাচের মৃত্যু হলেও আজ জন্ম নিয়েছে হাজারো নর পিচাস তাদের রক্তের ধারায় ।
যুদ্ধ শেষে বাড়ী ফিরে শাহীন জানতে পারল –শাহীনের খোজে একদিন এক দল পাক সেনা দেশীয় রাজাকারদের সহায়তায় তাদের বাড়ীতে হানাদেয় । শাহীনকে না পেয়ে তার বড় ভাই কে ধরে নিয়ে যায় ও শাহীনের বাবা মাকে উঠানের মাঝখানে দাড় করিয়ে হত্যা করে ফেলে রেখে যায । শাহীন অনেক খোজেও তার ভাইয়ের কোন সন্ধান আজও পায়নি । শাহীন জেনেছে তার বাবা মাকে হত্যা ও ভাইকে ধরে নিয়ে যেতে সহায়তায করে ছিল যে লোক সে এ শহরের ই একজন নামকরা ধনাঢ্য ব্যক্তি ।
দরজাটা বন্ধ করে শাহীন রাস্তায নেমে এল । কানে বাজছে টিকটিকির সেই ভয়াল শব্দ । মায়ের মুখটা মনে পড়ল । ক্যালেন্ডারের ছবিটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠলো । মেয়েটা যেন তাকে ডাকছে আর বলছে – আমাকে বাচাও আমাকে বাচাও । রাস্তা দিয়ে কয়েকটা গাড়ী সাই সাই করে চলে গেল । তার প্যান্টের নিচে চোরাই পকেটে ছোট্ট সেই চাইনিজ পিস্তলটা যেন শিকার খুজছে । রাস্তাটা সামনের দিকে সাপের মতো পেচিয়ে চলে গেছে দুরে বহু দুরে । রাত ক্রমশ বাড়ছে । রাস্তায় মানুষ জন কমে আসছে । বহুদুরে একটা গাড়ী দেখা যাচ্ছে । গাড়ীর হেড লাইট নিবানো । রাস্তার মৃদু আলোতে দেখা যাচ্ছে গাড়ীটা যেন দুলছে । কাছে চলে এল শাহীন । কাচের ভিতর বিকৃত রুচির এক পিসাচ একটি মেয়েকে নিয়ে খেলছে । শাহীন এগিয়ে গেল । শাহীনের লক্ষ্য সামনের বড় বাড়ীটার দিকে । গেট দিয়ে ঢুকে গেল । দারোয়ান বেটা প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে গেছে নিশ্চয় । কলিং বেলে হাত রাখল । দরজাটা খুলে দিয়ে অবাক বিষ্ময়ে খবির আলী আগুন্তকের দিকে তাকিয়ে রইল । পিস্তলের বাটটায় হাত ছোয়াল । পলকের মধ্যে সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল গর্জে উঠলো । বিদ্যুত চমকের মত শিশাটা বের হয়ে বিদ্ধ করল সেই হায়েনা কে । উলঙ্গ রমনীর দেহ ভেসে উঠলো তার চোখের সামনে । দৌড়াতে শুরু করল শাহীন দিগ্বিদিক------------।

বাবা মায়ের আদর মাখা মুখ । আজন্ম লালিত স্বপ্নের স্বদেশ । কালবৈশাখীর উলঙ্গ নৃত্য । সামনে বিস্তৃত খোলা ফসলের মাঠ । সবুজ শস্য ভুমি । হেমন্তের খোলা নীলাকাশ । বিলে মাছ ধরার দৃশ্য । শিশির ভেজা সকালের নরম আলোয় চিকচিকে দূর্বা ঘাস । একটা লাশ পড়ে আছে মাঠে নাম গোত্রহীন ।

আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
বশির আহমেদ ভাই পারভেজ রূপক লেখা আমার পেশা ও নয় নেশা ও নয় এক ধরনের শখ । আপনারা পড়ে আনন্দ পান এতেই আমার স্বার্থকতা । অনেক অনেক শুভ কামনা ।
বশির আহমেদ বন্ধু খোরশেদুল আলম আপনার সুচিন্তিত মতামতের জন্য আমার প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানবেন ।
বশির আহমেদ ভাই আনিসুর রহমান মানিক ও মো: আলভী আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ ।
খোরশেদুল আলম দেশ স্বাধীন হয়েছে অনেক দিন হলো । কিন্তু নরপিচাসরা আজো বেচে আছে বহাল তবিয়তে । আজ আবার তারাই ক্ষমতার ছড়ি ঘোড়ায় মাঠে ঘাটে অফিসে আদালতে ব্যবসা বানিজ্যে কল কারখানায় । // বশির ভাই, খুব ভালো লাগলো গল্প । ধন্যবাদ আপনাকে।
Mohammad Alvi বিষয়বস্তু থেকে খানিকটা সরে গেলেও অসাধারণ লাগলো
বশির আহমেদ অনেক প্রীতি ও শুভেচ্ছা গালিব ।
মোঃ গালিব মেহেদী খাঁন আপনার বর্ণনাগুলো নিখুত, অনেক বেশি জিবন্ত ভাল লাগল।

০৭ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪