দুখিনি মা

দেশপ্রেম (ডিসেম্বর ২০১১)

বশির আহমেদ
  • ৩৭
  • 0
  • ১৪
উনিশ একাত্তরের আশ্বিনের সবে শুরু, বন্যার পানি দ্রুত নেমে যাচ্ছে। মাঠের পাট কাটা প্রায় শেষ। বীজ পাট গাছ গুলো মাঝে মাঝে দাড়িয়ে আছে মাথা উচু করে। পানি নেমে যাবার সাথে সাথে আমন চাড়া রোপনেi সময়। কৃষক জমিতে হাল দেয়া শুরু করেছে| গ্রামের উত্তরাংশ দিয়ে ঢাকা চট্টগ্রাম রেল লাইন চলে গেছে। সপ্তাহ দুই আগে গ্রামের এক কিলোমিটার পশ্চিমে বড় রেল ব্রিজটা মুক্তিযোদ্বারা ভেঙ্গে দিয়েছে। রোজ সকালে ভৈরব থেকে একটি সাটল ট্রেনে এক প্লাটুন পাক সেনা কিছু শ্রমিক নিয়ে ব্রিজ মেরামতের জন্য আসে|


প্রতি দিন বিভিন্ন সেক্টর থেকে মুক্তিযুদ্বের খবর আসছে। সে দিন খুব ভোরে অহেদ তার চাচাতো ভাই ছালামকে নিয়ে মাছ ধরতে মাঠে নেমে পড়েছে| বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় প্রচুর ছোট মাছ ধরা পড়ে। উছা (মাছ ধরার ত্রিভূজাকৃতির বাঁশের তৈরী ফাঁদ)কাছি দিয়ে তারা চিংড়ি, বাইনসহ ছোট মাছ ধরার নেশায় মশগুল। কোন দিকে খেয়াল করার ফুরসত নেই। আশ পাশের গ্রাম জুড়ে মানূষ ছুটাছুটি করছে। যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে। একটি বাচ্চা ছেলের চিৎকার কানে এল। ছেলেটির বাবা পানিতে হাল দিচ্ছে । সে তার বাবা কে হাল ছেড়ে দ্রুত পালানোর তাগিদ দিচ্ছে। এদিকে ভৈরব থেকে সাটল ট্রেনটি আসার শব্দ শোনা যাচ্ছে। অহেদরা কিছু বুঝে উঠার আগেই চারদিক থেকে পালাও পালাও বলে চিৎকার ভেসে আসছে। তারা উছা কাছি ও মাছের হাড়ি জলে ফেলেই রেল লাইন ধরে গ্রামের দিকে দৌড়াতে লাগল। ট্রেনটি গ্রামের সীমানা অতিক্রম করেছে। অহেদরা বাড়ী পৌছার আগেই গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল। মুক্তিযোদ্ধারা সাটল ট্রেনে অক্রমন চালিযেছে।


পাঁচ কি সাত মিনিটের মধ্যে ট্রেনটি ব্যাক করে দ্রুত গতিতে ভৈরবের দিকে ফিরে গেল। বেলা তখন সকাল ৮টা। সবাই বুঝতে পাড়ল পাক সেনারা আবার ফিরে আসবে। সাড়া গ্রাম জন শুন্য হয়ে গেল। যে যেখানে পারে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেল। অহেদের মা ছেলেকে না পেয়ে ছোট ট্রাঙ্কটি বগল দাবা করে তার বোনের বাড়ী কুঁড়েরপাড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেল । অহেদ বাড়ী এসে মাকে না পেয়ে বাড়ীতেই রয়ে গেল।


অহেদ ষোল সতের বছরের এক তাগড়া যুবক। পির্তৃহীন মায়ের এক মাত্র সন্তান। অভাবের সংসার। পৈত্রিক ভিটেমাটি ও অল্প কিছু জমি আছে তাদের। অভাব সংসারের নিত্য সঙ্গী। খাদক হিসেবে দশ গ্রামে তার বেশ নাম ডাক। গ্রামের যে কোন বিয়ে শাদী বা ভোজ অনুষ্ঠানে তার দাওয়াত ছিল অবধারিত।


অহেদের লেংটা কালের জিগিরি দোস্ত মজনু। তারা দিন মান ধরে সারা পাড়া মাতিয়ে রাখে। গাছের আম, কাঠাল, শসা, মটরসুটি, মিষ্টি আলু চুরি করা, গ্রামের কেউ বিপদে পড়লে সবার আগে ঝাপিয়ে cড়া, নিশুতি রাতে মাঠে বসে বাশীতে সুর তোলা তাদের প্রিয় কাজ| বয়স তখন দশ বছর হবে। অহেদ মজনুকে বলল চল দোসত খড়মপুর মাজারে যাই। মজনু রাজি যেই কথা সেই কাজ। কাউকে কিছু না বলে পর দিন উধাও। অহেদ আর মজনুকে কোথাও খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার মা একে ওকে ধরে জানতে চায় তোমরা কি আমার ছেলেকে দেখেছ? কেউ কিছু বলতে পারেনা। এক দুদিন করতে করতে এক মাস পার হয়ে গেল। দুজনের খোঁজ নেই।


ওরা নাই বলে গ্রামের কারো গাছের ফল চুরি যায়না। কারো ক্ষেতের বেড়া ভেঙ্গে পড়ে না। শিষের শব্দে কারো কান ঝালাপালা হয় না। রাতের আধারে মাঠে বাশীর সুর শোনা যায় না।


এক মাত্র ছেলের নিখোঁজ হওয়ায় তার মা পাগল প্রায়। এক মাস দুদিন পর দুজন এসে হাজির। তাদের কাছে জানা গেল ভুল করে তারা আখাউরা থেকে সিলেটের ট্রেনে চড়ে সিলেট চলে গিয়েছিল। আখাউরা জংসন ষ্টেশন। কোন গাড়ী কোন দিকে যাবে জানা না থাকলে বিপত্তি ঘটে যাওয়া স্বাভাবিক| সিলেট ষ্টেশনে নেমে তারা কান্না কাটি করতে থাকে। এক ব্যবসায়ী দুজনের কাছে তাদের কান্নার কারন জানতে চায়। তারা তাদের ঘটনা খুলে বলে। লোকটি সাময়িক আশ্রয়ের জন্য দুজনকে তার নিজ গ্রামের বাড়ী গোলাপ গঞ্জে নিয়ে যায়। কানু মিয়া ব্যবসার কাজে সিলেট থেকে ঢাকা যাবার পথে ভৈরবে তাদের নামিয়ে দিয়ে যায়।


মজনু উনসত্তুরে গ্রামে উলাউঠা রোগে মারা যায়। মজনু মারা যাওয়ার পর থেকে অহেদ অনেকটা একা হয়ে পড়ে । গ্রামের কাউকে আর অতিষ্ট করেনা। অহেতুক করো কাজে হস্তক্ষেপ করেনা। আপন মনে নিজ জমি চাষাবাদ ও অন্যের জমিতে মজুর খাটে। যা আয় হয তা দিযে মা কে নিয়ে কেটে যায়। এরই মধ্যে দেশে শুরু হয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধ।

বৈশাখ মাস সকাল থেকে গুমোট গরম। দক্ষিন দিক থেকে ছেড়া ছেড়া মেঘ গুলো উত্তর আকাশে উড়ে যাচ্ছে। বিকাল তিনটা থেকে উত্তরাকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। ক্রমাস্বরে মেঘ গুলো কুচকুচে কালো রূপ ধারন করল| মেঘগুলো আস্তে আস্তে উপর দিকে উঠে আসতে শুরু করল। সূর্যাস্তের আগেই অন্ধকারে ছেয়ে গেল। শুরু হলো তীব্র ঝড়ো বাতাস। চারিদিক থেকে শঙখ কাশর, উলু ধ্বনি, আজানের আওয়াজ ভেসে আসছে। প্রায় ঘন্টা দুই ঝড়ের তান্ডব চলার পর মুষল ধারে বৃষ্টি শুরু হলো। সারা রাত থেমে থেমে বৃষ্টি হলো ফজর ওয়াক্তে বৃষ্টি থেমে গেল।

অহেদদের গ্রামটি উত্তর দক্ষিনে লম্বা লম্বি ভাবে বিস্তৃত। পেছনে বিল ও সামনে ফসলের মাঠ। বর্ষা কালে গ্রামের চার পাশে পানি থৈ থৈ করে। দুর থেকে গ্রামটিকে তখন দৌড়নাও মনে হয়। বৃষ্টি থামার সাথে সাথে মাছ ধরার জন্য লোক জন রেরিয়ে পড়েছে। অহেদ তার জাল নিয়ে বিলে মাছ ধরতে নেমে পড়ল। ক্রমে শান্ত প্রকৃতি ভেদ করে মিষ্টি রোদ হাসতে শুরু করল। মাছ ধরা শেষে অহেদ সবে ঘরে ঢুকেছে | চারদিকে হৈ চৈ শুনে অহেদ ঘর থেকে বেড়িয়ে এল। পশ্চিমে রেল লাইনের দিকে তাকিয়ে দেখল রেনকোর্ট পড়ে সারি বদ্ধ ভাবে এক দল সৈনিক পশ্চিম থেকে পুর্ব দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের আর সবার মত অহেদ রেল লাইনের দিকে ছুটল। গ্রামের ছেলে বুড়ো সবাই “জয় বাংলা” ধ্বনি দিতে দিতে রেল লাইনে উঠে পড়ল। তাদের ধারনা ইপিআর বাহিনী পাকসেনাদের সাথে যুদ্বের জন্য তৈরী হচ্ছে । কিছু বুঝে উঠার আগেই এক সৈনিক হুংকার দিয়ে বলে উঠল.... তুম এ ধার কিয়া কর রাহা হো ? গ্রামের নিরিহ সহজ সরল অশিক্ষিত মানুষ এর মাথামুন্ডু কিছুই বুঝল না। তারা দাড়িয়ে দাড়িয়ে ‍‌‌‌ “জয় বাংলা” ধ্বনি দিতে থাকল।

গ্রামের এক বড় ভাই বুঝতে পারলেন। আাসলে এরা ইপিআর নয় পাকসেনা। বড় ভাই ঢাকায় চাকরী করেন। যুদ্ব শুরু হওয়ায় তিনি গ্রামে এসেছেন। তিনি সবাইকে থামিয়ে দিয়ে পেছনে সরে যেতে বললেন। সবাই ফ্যাল ফ্যাল করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। পাক সেনারা এগিয়ে যেতে লাগল। বড় ভাই সবাই কে বললেন আমাদের এখনই গ্রাম ছেড়ে পালাতে হবে। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই গোলাগুলি শুরু হবে। কেউ বিশ্বাস করলো কেউ করতে চাইলো না । দশ পনর মিনিট পরই শুরু হয়ে গেল গোলাগুলি। গ্রামের মানুষ এর আগে কখনো গুলির শব্দ শোনেনি। চারদিকে কান্নার রোল পড়ে গেল। যে যেদিকে পারে ছুটা ছুটি করতে শুরু করল। প্রায় ঘন্টা খানেক গোলাগুলির পর পাকসেনারা পেছনে সরে এসে অহেদদের গ্রামে আশ্রয় নিল। অহেদ তার মাকে মামার বাড়ীতে রেখে এল। গ্রামের সহজ সরল মানূষ জীবনে এই প্রথম আর্মি দেখল।


গুলি বিনিময় শেষ হবার ঘন্টা খানেকের মধ্যে খবর এল একদল ইপিআর বাহিনী রামনগরে পাকসেনাদের বিরোদ্বে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। অতর্কিত গোলাগুলিতে বহু গ্রামবাসী গুলিবিদ্ব হয়েছে। কয়েক জনের অবস্থা আশষ্কা জনক। পাকবাহিনী পেছনে ফিরে এসে অহেদদের গ্রামে ট্রেন্‌স খুড়ে আশ্রয় নেয় । পরদিন থেকে টানা তিন দিন বিমান থেকে ইপিআর বাহিনীর উপর বম্বিং করে তাদেরi হটিয়ে চতুর্থ দিন থেকে তারা সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। যাবার কালে গ্রাম থেকে প্রায় বিশ পঁচিশ জন নিরীহ লোককে ধরে নিয়ে গুলির বোঝা বহন করায়| এক থেকে দেড় মাস পর এক এক জন কুমিল্লা, আখাউরা, লাকসাম থেকে ছাড়া পায়। গ্রামে চার দিন অবস্থান কালে পাকসেনারা মানুষের বহু মুরগী, ছাগল খেয়ে সাবার কেরছে|


মুক্তি যুদ্ব তুঙ্গে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন যুদ্বের খবর প্রচার হচ্ছে। আখাউরা, কসবা, মন্দবাগ, মাধবপুর, শাহজীবাজার সেক্টর থেকে তুমুল যুদ্বের খবর আসে। কামানের গোলার আওয়াজ শোনা যায়। ইতি মধ্যে তাদের গ্রামেও মুক্তিযোদ্বারা বেশ কয়েক টি অপারেশন চালিয়ে গ্যাস এবং বিদ্যুত লাইণ উড়িয়ে দিয়েছে। বাড়ীতে মাকে একা ফেলে রেখে মুক্তি যুদ্বে যাবার ইচ্ছা থাকা সত্বেও অহেদের যুদ্বে যাওয়া হয়ে উঠেনি। গ্রামের মানুষ রেডিওতে যুদ্বের খবর দল বেঁধে শোনে। বিবিসি, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশ বানী শুনতে শুনতে গ্রামের সবার জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্ড, নিক্সন এর নাম মুখস্ত হয়ে গেছে। চরম পত্রের প্রতিটি লাইন প্রায় সবার মুখে মুখে ।


বেলা একটার দিকে সকালের ফিরে যাওয়া ট্রেনটি প্রচুর গোলাবারুদ ও পাক সেনা বোঝাই করে এসে গ্রামে হানা দেয়। রেল লাইনের পাশ ঘেষা চারটি গ্রাম্তে আগুন লাগিযে উল্লাস করতে থাকে| মেশিন গান থেকে চারি দিকে গুলি ছুড়তে শুরু করল। অহেদ কিছুটা ঘাবরে গিয়ে বিলে জাঁক দেয়া পাটের আঁটির নিচে লুকিয়ে পড়ল। লুকিয়ে লুকিয়ে পাক সেনাদের কর্মকান্ড দেখতে লাগল। বেলা প্রায় পড়ে এসেছে । গ্রামের প্রতিটি ঘর পুড়ে ছাই। পাক সেনারা ফিরতি পথ ধরেছে। অহেদ পিছনে পড়ে আছে। পাকসেনারা তার চোখের আড়াল হতেই সে পাটের জাকের ভেতর থেকে মাথা তুলে দাড়িয়ে জয় বাংলা বলে চিৎকার করে উঠল। কিছু বুঝে উঠার আগেই ঘাতকের এল এমজি থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি বেড়িয়ে এল। ঝাঝরা হয়ে গেল অহেদের বুক পিঠ মাথার খুলি।

অহেদ পানির নিচে তলিয়ে যেতে যেতে দেখতে পাচ্ছে -সবুজ শ্যামল ছায়াঘেরা ছোট্র গাঁ। সামনে বিস্তৃত ফসলের মাঠ। মাঠের মাঝ বরাবর রেল লাইন। সবুজ ফসলের মাঠ বাতসের সাথে নেচে উঠছে। সোনালী ধানের ক্ষেত ঢেউ খেলে যায়। মাঠের পুর্ব দিক থেকে একটা ট্রেন অজগর সাপের মত ফনা তুলে এগিয়ে আসছে।
গ্রামের এক পাশে খদাই কুর। কুরের পাড়ে বড় বড় শিমুল, পলাশ, কড়াই, শেওরা গাছ। বিষকাটালী, মেহেন্দি,আর বাবলা বন। গাছের মগ ডালে চিল, বাজ আর শকুন বসে আছে শিকারের সন্ধানে। মাঝে মাঝে শকুন আর চিলের চি-হি-হি চিৎকার কানে বাজছে।

মাঠ ভর্তি তিল ক্ষেত। সাদা ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। অসংখ্য প্রজাপতি আর ফড়িং উড়ে বেড়াচ্ছে। শহিদ, ফজল, অহেদ, ছালাম, সিরাজ প্রজাপতি আর ফড়িংয়ের পিছু পিছু ছুটছে। ধরতে গিয়ে ধরতে পারছেনা। শহিদ দৌড়ে গিয়ে বাঁশের কঞ্চিতে কাফিলা গাছের আঠা লাগিয়ে এনেছে। ফড়িং আর প্রজাপতি আঠায় অটকা পড়ছে।

চৈত্রের খরতাপে ঘূর্নি বাও উড়ছে। সিরাজ, শহিদ, অহেদ , মজনু, জহির ঘুর্নির পেছন পেছন ছুটছে।
বিলের মাঝে অজস্র শাপলা আর কচুরী পানা ফুল ফুটে আছে। সাদা বেগুনী, আর ভায়োলেট রংয়ে রঙিন চারদিক। দল বেধে শাপলা আর ভ্যেট তুলছে। পানিতে ডুব দিচ্ছে আর বড় বড় শালুক কুড়িয়ে আনছে।
গাছে পাতার আড়ালে জোড়ায় জোড়ায় ঘুঘু। গুলাল দিয়ে ঘুঘু শিকারে মেতে উঠছে।
তাল গাছের শাখে শাখে বাবুই পাখীর বাসা বাতাসে দোল খাচ্ছে।

বাড়ীর সামনে আম বাগান। গাছে গাছে কাচা আম ঝুলছে। অহেদ বলল- মজনু চল আমের ভর্তা বানাই। শহিদ ,জহির, সিরাজ, ছালাম সবাই হাজির। প্রত্যেকে নিজ নিজ গাছ থেকে চারটি করে আম নিয়ে এল। ছুড়ি চাকু দিয়ে আম কাটা শুরু হল। কলা পাতা জোগাড় করা হল। শহিদ আর সিরাজ পোড়া মরিচ ও লবন নিয়ে এল। জহির আনল সরিষার কাসুন্দি। বিশাল কলা পাতায় আম ভর্তা হল। পাট ক্ষেতের আড়ালে বসে ভর্তা খাচ্ছে।
আগুন (অগ্রহায়ন) মাস খাল বিলে পানি কমে এসেছে। হাতিয়ে মাছ ধরতে নেমে পড়ছে। পাতিল ভর্তি শিং, কৈ, মেনী, আর টাকি মাছ নিয়ে বাড়ী ফিরছে।

শীত কাল ঘন কুঁয়াশায় ছেয়ে গেছে মাঠ, ঘাট, জনপদ। দশ হাত দুরের কোন কিছু চোখে পড়ছেনা। হিম হিম শীত উপেক্ষা করে বেড়িয়ে পড়েছে। অহেদ, মজনু, জহির, শহিদ , সিরাজ হাতে মাটির পাতিল, কোমরে গোজা দেয়াশলাই। মাঝ মাঠে মটরসুটি আর কলাইক্ষেত। গুটি গুটি পায়ে ক্ষেতের আল ধরে এগিয়ে চলছে। বেলা প্রায় দশটা এগারটা হবে। কুঁয়াশা কেটে রোদ উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। দ্রুত হাতে কলাই তুলছে। মাটির ঢেলায় চুলা বানিয়ে নাড়ার আগুনে কলাই সিদ্ধ হচ্ছে।

দরগা বিলে পলো বাওয়া হবে। চারি দিক থেকে দলেদলে পলো নিয়ে সবাই বিলের দিকে যাচ্ছে। অহেদ আর মজনু ছাড়া সবাই স্কুলে। তাদের নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু কি করে। পন্ডীত স্যার টের পেলে রক্ষা নেই।
মজনু বলল অহেদ তুই বাবলা বনের ভেতর দিয়ে স্কুলের ভাঙ্গা বেড়ার কাছে যা। আমি স্কুলের মাঠে দাড়াই”|
অহেদ চুপি চুপি বনের ভেতর দিয়ে ষ্কুলের ভাঙ্গা বেড়ার পাশে চলে এল। আস্তে আস্তে শহিদ কে ডাকল- “শহিদ` এই শহিদ”|
শহিদ ডাক শুনতে পেয়ে পেছন ফিরে তাকাল। পন্ডীত স্যার দেখে ফেলেছে। স্যার বলে উঠলেন কেরে ওখানে? ঐ ধরে আন ওকে। বলার আর অপেক্ষা রাখেনা। দল বেধে ক্লাস থেকে সবাই বাইরে বেড়িয়ে পড়ল। মজনু মওকা বুঝে দরগা বিলে পলো বাওয়ার খবর দিল।
ফজল, ছালাম, শহিদ, সিরাজ স্কুল পালিয়ে অহেদ আর মজনুর সাথে পলো নিয়ে দরগা বিল মুখী রওয়ানা দিল।
পর দিন স্কুল ফাঁকি দেওয়ায় পন্ডীত স্যার সবাইকে রোদ মূখী এক ঘন্টা দাড় করিয়ে রাখল।

মনু কাকা আজ তার বড় ঘুড়িটা উড়াবে। সবাই মাঠে জড় হলো। শুন পাটের মোটা ডোর। বিশাল বেনা ঘুড়ি। চার হাত লম্বা তিন হাত পাশ। ঘুড়ির মুখে ধনুকের মত জালি বেতের বেনা। ঘুড়ি আকাশে উড়ল। দশগ্রামের মানুষ বেনার সুর শুনতে পাচ্ছে। মনু কাকা ডোর ছাড়ছে তো ছাড়ছে। ঘুড়ি উপরে উঠে সাদা সাদা মেঘ গুলিকে
ছুয়ে ছুয়ে যাচ্ছে। আচমকা ডোর ছিড়ে গেল। মজনু অহেদ আর সবাইকে ডাকল। ধর ধর ঘুড়ি উড়ে যাচ্ছে। সবাই ডোর কাটা ঘুড়ি ধরতে পেছন পেছন ছুটছে। কচি পাটের ডগা, ধানের কচি চাড়া, বাঙ্গি ক্ষেত, ডাটা শাক, উচ্ছে
ক্ষেত মাড়িয়ে দৌড়াচ্ছে দৌড়াচ্ছে। ঘুড়িটা আর দেখা যাচ্ছে না। আকাশে মিলিযে গেছে যেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। দৌড়াচ্ছে আর দৌড়াচ্ছে। দৌড় আর শেষ হচ্ছেনা। অহেদের চোখ বন্ধ হয়ে আসছে----

তরতাজা ষোল সতের বছরের যুবকের আর্তচিৎকারে আকাশ বাতাস মাটি গ্রাম প্রকম্পিত হয়ে উঠল। কেউ শুনল না তার চিৎকার। এগিয়ে এল না কেউ তাকে উদ্বারে। রক্তের বন্যায ভেসে উঠল পাটের জাক। পাটের আটি গুলো চারিদিকে ছড়িয়ে গেল তার দাপানিতে। সারা রাত লাশটি পড়ে রইল । সকালে পানিতে ভেসে উঠল।।
ভয়ার্ত মানুষ একে একে ফিরতে শুরু করেছে। সবাই ঘর, বাড়ী , ধান, পাট, টাকা ,পয়সা হারিয়ে হাহা কার করে উঠছে। পোড়া টিন জড়ো করে রাতের আশ্রয় নির্মানে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। অহেদের মা তার সন্তানকে খুজে বেড়াচ্ছে। এক সময় খবর এল বিলে কার যেন লাশ দেখা যায়। সবাই দৌড়ে গেল বিলের পাশে। আজিম আর
মতিন নেমে পড়ল বিলে। লাশের কাছে পৌছেই তারা চিৎকার করে উঠল। হায় হায রে এযে অহেদ। ধরা ধরি করে অহেদের লাশ উপরে তুলা হলো। ভীর ঠেলে অহেদের মা কাছে এল । ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে একটা চিৎকার দিয়ে নির্বাক হয়ে গেল।

সেদিনের অপারেশনে জয়নগর , সাধুনগর, মেরাতুলি, পিরিজকান্দি চারটি গ্রাম পুড়ে ছাই হয়ে গেল । চারটি গ্রামের দশজন লোক পাকসেনাদের গুলিতে নিহত হল। মুক্তি যোদ্বারা কোন প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারল না। নিরিহ নিরপরাধ গ্রাম বাসী শহীদ হয়ে দেশ প্রেমের এক উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেল । তাদের সেই ত্যাগের কথা আজ আর কেউ ভুলেও মনে করে না ।

অহেদের মা আজও বেচে আছে। সেদিনের পর থেকে আর কোন দিন কথা বলেনা। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। স্বামির ভিটায় ছোট্ট একটি কুঁড়ে ঘরে একা বাস করে। কোথাও কজন লোককে একত্রে দেখলেই দৌড়ে এসে সেখানে দাড়ায়। সবার মুখে তাকিয়ে কি যেন খুঁজে ফিরে। দুখিনি মায়ের বিনাশ্রু কান্না গুমরে গুমরে মরে।। অকাল বিধবা সেই মহিলাকে আজ আর চেনা যায়না। ঋজু হয়ে এসেছে দেহ। চোখের দৃষ্টিও কমে এসেছে।

ট্রেনের আওয়াজ শুনলেই দৌড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। পাগলিনি মা মাঠে ময়দানে, আকাশে বাতাসে সন্তান কে খুঁজে ফেরে । খোঁজা তার শেষ হবেনা অনন্ত কাল ধরে----------------।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
বশির আহমেদ আনিসুর রহমান মানিক আপনাকে শুভেচ্ছা ।
বশির আহমেদ ভাই সূর্য ঘটনাটি নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার পূবাঞ্চলের কয়েকটি গ্রামের । স্বাধীনতা যুদ্ধের যুদ্ধকালিন ঘটনা যেহেতু ইতিহাসতো অবশ্যই । আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ।
সূর্য ঘটনার স্থানগুলো কি ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায়? কুড়ের পার জায়গাটায় যাওয়া হয়েছিল বেশ কয়েক বার। এই কুড়ের পার হয়ত অন্য কোথাও হতে পারে। গল্পে ফ্লাশব্যাক এবং গুলিবিদ্ধ হবার পরে তড়িৎ স্মৃতি পড়তে গিয়ে খেই হারিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সেটা বুঝা যায় ঠিকই। অনেক কষ্টের একটা গল্প (আসলে ইতিহাস হবে)।
বশির আহমেদ ধন্যবাদ নীলাঞ্জনা নীল আপনার মন্তব্যের জন্য ।
নিলাঞ্জনা নীল সুন্দর গল্প.....
বশির আহমেদ ভাই খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি আমরা যারা মুক্তি যুদ্ধ দেখেছি` তাদের কাছে ঘটনাটা বিস্বাশ করা যত সহজ যারা দেখেনি তাদের কাছে বিস্বাশ করা তত সহজ নয় । আর আজ কাল অনেকেই শুনে শুনে মনগড়া কিছু কাহিনিও লিখে মুক্তিযুদ্ধ কালিন ঘটনা বলে চালিয়ে থাকে । আপনাকে আমার পক্ষে থেকে লাল গোলাপ শুভেচ্ছা ।
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি বশির ভাই, আলভির প্রশ্ন করার ঢং দেখে বলতেই হয় যে মুক্তি যুদ্ধর কাহিনী গুলো কল্পনা প্রসুত নয়। বাস্তবতার নিরিখেই কাহিনী গুলোকে তুলে এনে লেখক তার আপন মাধুরী মিশিয়ে লিখে থাকেন। আপনার লেখাটি পড়ে আমার খুব ভালো লেগেছে ভাই।বশির ভাই আমি মুক্তি যুদ্ধ দেখেছি বলেই এত কথা বলা। প্রিয়তে রাখছি। ধন্যবাদ................................
বশির আহমেদ ভাই খন্দকার আযাহা সুলতান আক্কেলমান্দ কে লিয়ে ইশারাই কাফি । আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ ।
Azaha Sultan বশির ভাই, দারুণ! এর চেয়ে বেশি বললাম না......

০৭ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪