লুকোচুরি

ভয় (এপ্রিল ২০১৫)

মিলন বনিক
  • ১০
আইজ আসুক তোর বাপ। আইজ তর একদিন কী আমার একদিন। সন্ধ্যাপূজার থালাবাটিগুলো ধুতে ধুতে রাগে ক্ষোভে গজ গজ করছিল টুকুর মা। টুকুর দেখা নাই। টুকু কোথায় কে জানে। এর মধ্যে বিকালে নাড়–-র মা ক’কথা শুনিয়ে গেলো।

এমন ডাকাত্যা পোলা জন্মে দেখি নাই। বাপরে বাপ। পোলার মাও যেমন, বাপও তেমন। বলি পোলাগুলারে একটু শাসন কইরতে। তা না। আহ্লাদে মাথায় তুইলা রাখছে। এমন ছেলের মুখে কালি। রাম রাম। এই সন্ধ্যায় আমার নাড়–টার কী হাল করছে দেখো। তুলসি ক্যান, গঙ্গাজলের ছিটা দিলেও গায়ের গন্ধ যাইবো না। ছিনান করা লাগবো। মাইনসে মাইনসের গায়ে এমুন কইরা হাগু দেয়। বজ্জাত পোলা। সন্ধ্যায় নাড়–ুর মা রেগেমেগে একটানে কথাগুলো বলে গেলো। ভয় দেখিয়ে গেলো-আইজ যদি এর বিহিত না করেচো তো কাইল পাড়ার মেম্বররে বিচার দিমু।

সেই থেকে টুকু ঘরে নাই। নীরবে অপমান হজম করে টুকুর মা। রাগে অপমানে চোখে জল আসে। ইষ্ট নাম নিয়ে গলায় শাড়ীর আঁচলটা পেঁচিয়ে তুলসি তলায় মুচি বাতিটা জ্বালিয়ে দেয়। আবার নিজের মনে বিড়বিড় করে।

আমার হয়েছে যত মরণ। ছেলেটা যদি একটু কথা শুনতো। ঘরে তো আগ বাড়াই দেওয়ার কেউ নাই। ধান চাইলের দিন। এমুন পোড়া রইদে পিঠ তাতাইয়া তামাটে হইয়া গেছি। ধানটা লাইড়া দিলেওতো আমার একটু যোগান হয়। তা না। সারাদিন শুধু বিলে বিলে ঢং ঢং করবো। আর তিনবেলা খাইবো। কোন জনমে কী পাপ করছিলাম কেডা জানে।

টুকুর স্কুল বন্ধ। এই কয়টা দিন একেবারে হাত পা ঝাড়া। কোন নিয়ম নাই। নিয়মের বাইরেই চলছে সব। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। সেভেনে যাবে। এখন প্রাইভেট মাষ্টার, স্কুল, পরীক্ষা কোনটায় নেয়। আছে শুধু মায়ের শাষণ, বাবার বকুনি। মা মাঝে মধ্যে মারে। সারাক্ষণ খ্যাঁক খ্যাঁক করে। বাবা মারে না। খুব বেশি রেগে গেলে বড়জোড় একটা চড় থাপ্পর। এই যা। সারাদিন দোকানে থাকে। সন্ধ্যার পড়ে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে। বাবার সামনে একটু মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করলে বাবা খুশি। মা যতই নালিশ করে বাবা হাসে। বলে, এই বয়সে হেরা দুষ্টামি কইরবো না তো আমরা করুম। হেগো বয়সে আমরা আরও বেশি করছি। দুষ্টামির আর দেখলা কী।

মায়ের রাগ আরও চড়ে যায়। যেমন বাপ তেমন ব্যাটা। তারপর সারা দিনের ফিরিস্তি তুলে ধরে। আজ অমুকরে মারছে। হরি কাকুর ক্ষেতের খিরা চুরি কইরা খাইছে। সবিতার বাপের ফেলন ক্ষেতের কচি ফেলন একটাও রাহে নাই। ক্ষেতের কচি ফেলন তুইলা ভাজা কইরা সিন্দুইরা আমগাছের ডালে বইসা খাইছে। রাস্তার পাড়ের সোনালীদের সিম গাছের শুকনা সিম নাকি সব চুরি করছে। নালিশের আর শেষ নাই। এই সব শুনে টুকুর বাবা মিটিমিটি হাসে। টুকুকে কানে কানে বলে, আইজ তর মা ভালাই ক্ষেপছে। ভালা কইরা পইড়া ল। তারপর মায়েরে গলা জড়াইয়া ধইরা সরি কবি। ক’বি মা কাইল থেইকা তোমার কথামতন চলুম। আইজ মাপ কইরা দেও। টুকু বাবার কথামত তাই করত। মা হাসত। আর একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস শাড়ির আঁচলে লুকানোর চেষ্টা করত।

আজ দুপুরের পর নাড়–, ঝন্টু, রুবি, অনন্ত, পটলা সবাই মিলে উত্তরের বিলে খড়ের গাঁদার মধ্যে লুকোচুরি খেলছিল। বাড়ির পাশে খালি শুকনো জমি। বেশ কিছু জায়গা পরিষ্কার করে চার পাশে গোল করে ধানের আঁটি রাখা হয়েছে। এখন ধান কাটার মৌসুম। ধানের আঁটির পারাটা ছোট পাহাড়ের মত হয়েছে। সারাদিন ছেলেগুলো ওখানে লুকোচুরি খেলেছে। একফাঁকে সবাই যুক্তি করল। মতি কাকুর ফল ক্ষেতে যাবে। কী সুন্দর কচি কচি শশা মাচা বেয়ে ঝুলছে। মতি কাকু সারাক্ষন পাহাড়ায় থাকে। খুব সাবধান। কীভাবে এই মিশন শেষ করা যায় তাই ভাবছে। বাঁধ সাধল রুবি। নিজের বাড়ি থেকে একটু দুরে বলে রুবি যেতে নারাজ। অনন্ত সায় দিল। বলল, মেয়ে মানুষ না যাওনই ভালা। তাড়া খাইয়া দৌড়ান দিলে ধরা খাইতে হইবো।

পটলাটা ভীতুর হাড্ডি। মতি কাকুর নাম শুনে পটলার কাঁপুনি শুরু হয়েছে। গতবছর খিরা চুরি করতে গিয়ে যা কানমলা খেয়েছে তা এখনও মনে আছে। তাই পটলা নিজে থেকেই বলল আমিও যামু না। তোরা যা। টুকু বলল,
- না গেলে না যা। ভীতুর ডিম। তাইলে আমরা যায়। তয় তোর জন্য শশা নিয়া আসুম।
- হে কামে যাইবো না। হের জন্য শশা আনুম ক্যান। প্রতিবাদ করলো ঝন্টু।
- আরে বোকা, তুই তো বুঝস নাই। হের ও কাম আছে।
- কি কাম। হে তো যাইবো না।
- পটলা আমাগোর জন্য লবণ আর মরিচের গুড়া আইনা দিবো। লবণ মরিচ মিশাইয়া কচি শশা খাইতে যা মজা!
- হ তাই ক। তাইলে ঠিক আছে।
দূর থেকে দেখা যাচ্ছে মতি কাকা ক্ষেতের কাছে মাদুর পেতে বসে আছে। যেদিকে বসে আছে তার উল্টো দিকে দুধ্যা আমের গাছ। আমগাছটা খুব উঁচু নয়। বটগাছের মত ঘন ডালপালা চারপাশে ছড়িয়ে আছে। ওরা সবাই আবার উল্টা পথে হেঁটে আমগাছের কাছে আসে। গলা খাঁকাড়ি দিয়ে উঠে মতি কাকু। সবাই ভাবল মতি কাকু ওদের দেখে ফেলেছে। তার উপস্থিতি টের পেয়ে ঝন্টু থরথর করে উঠে গেল আমগাছে। তারপর টুকু। পটলার কানমলার কথা মনে হলো টুকুর। ঝন্টু ডেকে বলছে, তাড়াতাড়ি উঠে আয়। কাকু এদিকেই আসছে। অমনি টুকুও উঠতে লাগলো গাছে। এই বিপদের সময় টুকুর হাগু আসবে কে জানে। হয়তো মতি কাকুর ভয়ে। পেছন পেছন উঠছে নাড়–। টুকু আর বেগ সামলাতে পারছে না। নাড়–কে ডেকে বলছে, তুই নেমে যা। আমার হাগু আসছে। নাড়– ততক্ষণে মাঝামাঝি উঠে এসেছে। এই মুহূর্তে নামলে কাকুর হাতে ধরা খাবে নিশ্চিত। টুকু কিছুতেই চেপে রাখতে পারছে না। প্যান্ট খুলেই কাজ সেড়ে ফেলল। সব গিয়ে পড়ল নাড়–র গায়ে মাথায়। নাড়– বেচারা মতি কাকুর ভয়ে কিছুই বলতে পারছে না। কাকু চলে যাওয়ার পর টুকু সরি বলেছে। সামলাতে পারিনি, এও বলেছে। নাড়– কিছুই শুনতে নারাজ। বাড়ি গিয়ে কেঁদে কেঁদে মাকে সব বলে দিয়েছে।

নাড়–র মা টুকুদের বাড়ির দিকে আসছে। তখন টুকুও বাড়িতে ছিল। নাড়–র মার গলার আওয়াজ চড়া। এই বুঝি ভূমিকম্প নয়তো সাইক্লোন হবে। এই ফাঁকে টুকু পালিয়েছে। টুকুর মা খেয়াল করেনি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। শীতের রাত। চারিদিকে ঘন কুয়াশা। চোখের সামনে দশহাত দুরের জিনিসও ঝাপসা দেখাচ্ছে। টুকুর মা সন্ধ্যা-আহ্নিক শেষ করে টুকুকে ডাকছে। টুকুর কোন সারা নেই। হারিকেনের আলো দিয়ে চৌকির নিচে দেখল। ভয়ে হয়তো কোথাও লুকিয়ে আছে। তাও কোন সারা নেই।

উঠোনে গিয়ে শুকনো খড়ের গাদার চারপাশে দেখে এসেছে। তাও নেই। অনেকটা সময় খোঁজাখুঁজি করার পর মায়ের মন ডুকরে কেঁদে উঠল। উঠোনে বিলাপ ধরে চিৎকার করে বলছে-আমার টুকু নাই। তোমরা আমার টুকুরে আইনা দাও। আমার কলিজার ধন। আমার সোনা মাণিক। তুই কই গেলি বাপ।

পাড়ার অনেকে এসেছে। সবাই চারিদিকে খুঁজছে। কেউ কেউ বলছে সামনের পুকুরে বেড়িজাল ফেলতে। টুকুর মা পাগলের মত বাড়ির চারপাশটা দৌড়াচ্ছে। নাড়–, ঝন্টু. অনন্ত, পটলা, রুবি সবাই খুঁজছে। তারাও কাঁদছে টুকুর জন্য। টুকুর বাবা এসে খবর শুনে হতবিহŸল হয়ে পড়ে। এমনি করে রাত গভীর হয়। সবার উৎকন্ঠা ও ভয় বাড়ছে। সকলের মনে নানা রকম সন্দেহ উঁকি মারছে।

আকাশে হালকা একটু জোছনা। তাও কুয়াশার জন্য পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। নাড়–ু সব বন্ধুদের ডেকে বলল-
- চল এক জায়গায় দেখে আসি।
- কোথায়? উৎকন্ঠা নিয়ে জিজ্ঞাসা করল পটলা।
- উত্তরের বিলে। খড়ের গাদায়।
- ওরে বাবা! পটলা ভয়ে বললো, এই রাইতে উত্তরের বিলে! তাইলে তো পেছন বাড়ির শ্মশান পাড় হইয়া যাইতে হইবো।
- ভীতু কোথাকার! তুই একটা ছাগল। ভয কীসের? যাবি কিনা বল? নাইলে আমরাই যামু। মনে সাহস দিল অনন্ত।
- আমিও যামু। রুবি সাহস করে বললো।
- পটলা বলল, তোরা গেলে আমিও যামু। ল চল।

সবাই এগিয়ে যায়। নাড়– ভাবছে লুকোচুরি খেলার সময় টুকু ধানের পারার মাঝখানে একটা আঁটি সরিয়ে গর্তের মত করেছিল। টুকু কু--লু--ক করে উঁকি দিয়ে সেই যে লুকিয়েছিল আমরা কেউ খুঁজে পায়নি। ওরা ধানের পারার কাছে যেতেই কার গোঁ গোঁ কান্নার শব্দ শুনতে পায়। নাড়– তাড়াতাড়ি ধানের পারার উপর উঠে সেই গর্ত থেকে বের করে আনল টুকুকে। আর বলল, সরি টুকু। আমার ভূল হয়ে গেছে।

সেদিন সারারাত বাবার বুকে মুখ গুঁজে শুয়েছিল টুকু। আর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল টুকুর মা।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
নাজমুছ - ছায়াদাত ( সবুজ ) লেখা নিয়ে কি আর বলব । বরাবর সুন্দর লেখা, সাবলীল , গছানো , অনেক শুভেচ্ছা ।
ধন্যবাদ ভাই....
Arif Billah ভাল লিখেছেন। শুভ কামনা
ধন্যবাদ ভাই....
দীপঙ্কর বেরা ভাল , খুব ভাল ।
ধন্যবাদ ভাই....
নাসরিন চৌধুরী ছোটদের জন্য আপনি খুব সুন্দর সুন্দর গল্প , ছড়া লিখেন। মাঝখানটায় পড়তে গিয়ে হাসি এসেছিল কিন্তু শেষে এসে টুকুর জন্য মায়া লাগল---আসলে ছেলেবেলাটা বুঝি এমনই হয়!! নস্টালজিক হয়ে গেলাম লেখাটুকু পড়ে। ভোট রেখে যেতেই হল। আরও সুন্দর সুন্দর লেখা পড়ব সে প্রত্যাশায়।
প্রিয় নাসরীন আপু..সুন্দর সুগঠিত মন্তব্য আপনার মনোযোগী পাঠের পরিচায়ক...আমি কৃতজ্ঞ..দোয়া রাখবেন যেন আরো ভালো কিছু সৃষ্টি করতে পারি...সাথে থাকবেন...
মোহাম্মদ ওয়াহিদ হুসাইন ..... পটলা বলল, তোরা গেলে আমিও যামু। ল চল। -না হলে বন্ধু কিসের জন্য? ভাল লিখেছেন। ভাল লেগেছে। শুভেচ্ছা রইল।
অনেক ধন্যবাদ দাদা...দোয়া রাখবেন...শুভেচ্ছা নিরন্তর....
আখতারুজ্জামান সোহাগ আপনার গল্পটা পড়ে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল ভীষণ। এমন দস্যিপনা অনেক করেছি, মায়ের হাতে কানমলাও কম খাইনি, ঠিক আপনার গল্পের টুকুর মতো। গল্প পড়তে পড়তে এক সময় ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, টুকুকে পাওয়া যাবে তো! যাই হোক, টুকুকে পাওয়া গেল। ভালো থাকবেন মিলন বনিক দা। শুভকামনা আপনার জন্য।
সোহাগ ভাই...দোয়া রাখবেন যেন আরো ভালো কিছু করতে পারি....আপনার জন্যও শুভকামনা....
রবিউল ই রুবেন অনেক অনেক ভাল লাগল।
ধন্যবাদ প্রিয় রুবেন....
ছন্দদীপ বেরা ভালোই হয়েছে । পরের বারের আশায় আছি ।
ধন্যবাদ বেরা ভাই...
Fahmida Bari Bipu Valo laglo khub. .
অনেক ধন্যবাদ এবং শুভকামনা..

০৭ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১১৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪