এলোমেলো পথ চলছে পলাশ। আর কোথাও যাবার ইচ্ছা নেই। হাত ঘড়িটা দেখে নেয়। রাত আটটা। আধ ঘণ্টা লেট। সাড়ে সাতটায় চকবাজারের টিউশনিটা। যাবে কিনা ভাবছে। যাওয়াটা উচিত। সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। এই সময়টা ছাত্রদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পলাশ চকবাজারের সামনে এসে দাঁড়ায়। একজন লোক পিছন থেকে দৌড়ে আসছে। একেবারে পলাশের সামনে এসে দাঁড়ায়। হাত তুলে সালাম দেয়। পলাশ বিব্রত বোধ করে। চিনতে পারে না। বয়সটা মাঝারী। পরনে ময়লা শার্ট প্যান্ট। ভেবে চিন্তে মনে করার চেষ্টা করে। মনে পরছে না। হালকা ছিপছিপে গড়ন। লোকটির চোখে মুখে কৃতজ্ঞতার ছাপ। নিজে থেকে বলল- ভাইজান, আমারে চিনতে পারলেন না। আমি সিরাজ মিয়া। ঐ যে আমারে চিডি লেইখ্যা দিছিলেন। ভালোবাসার চিঠি। একটু লজ্জিত হয় সিরাজ মিয়া। যেন আরও কিছু বলতে চায়। মনের পাতায় সহসা উঠে আসছে না সিরাজ মিয়াকে। না ভেবেই জবাব দেয় - ও আচ্ছা। কেমন আছেন। - ভালা আছি। আপনের দেহা পায় নাই। অনেক খুঁজছি। জানেন ভাইজান - ঐ মাইয়াডার লগে আমার বিয়া হইছিল। - কোন মেয়েটা। - ঐ যে, আপনে হেই পরতম চিডি লেইখ্যা দিছিলেন। আমার মাছুমার জন্য। কি আর বলব, আপনার হাতে কি একখান যাদু আছে। মাছুমা আমারে পাগলের মত ভালোবাসছে।
পলাশের মনে পরে। বাস কনট্রাকটর সিরাজ মিয়া। লেখাপড়া জানে না। একটা মেয়েকে ভালোবেসেছিল। সে বছর কয়েক আগের কথা। সিরাজ মিয়ার ফুফুর বাসায় একদিন পরিচয়। সিরাজের ফুফাতো ভাইদের পড়াত পলাশ। প্রথম বার পরিচয়ের পর সিরাজ মিয়া আমতা আমতা করে কি যেন বলতে চেয়েছিল। সাহস করে বলতে পারে নি। তার ক'দিন পরে এসে বলেই ফেলল- - ভাইজান আমারে একখান চিডি লেইখ্যা দিবেন। - কার চিটি। সিরাজ মিয়া লজ্জা পায়। - হেইডা পরে কমু। পলাশ বুঝতে পারে। কৌতূহল হয়। একটু সহজ ভাবে বলে - ভালোবাসার চিঠি বুঝি? সিরাজ মিয়া মাথা নিচু করে হ' বলল। পলাশ হাসল। তারপর বলল - কি নাম। - মাছুমা। - বাড়ী কোথায়। - আমাগো গেরামে। - আচ্ছা, একসময় লিখে দেব। বলে টিউশানি শেষ করে পলাশ চলে আসছিল। সিরাজ মিয়াও পিছু পিছু আসছে। পলাশ বারণ করেনি। সোজা পলাশের বাসায় চলে এসেছে সিরাজ মিয়া। পলাশ সিরাজকে চৌকিতে বসতে বলে নিজে চেয়ারে বসল। - খুব ভালোবাস বুঝি। - হ' ভাইজান। অরে ছাড়া আমি বাঁচুম না। - তোমার মা বাবা। - সবার তো মা বাবা থাকে না। আমারও নাই। - মারা গেছে। - না। মরে নাই। - তাহলে। - বাবায় রিক্সা চালাইত। মারে রাইখ্যা আর এখখান বিয়া করছে। পরে জানাজানি হওনের পর দিছে তালাক। তহন আমার বয়স সাত। আমার বইনের বয়স চাইর বছর। মার লগে কিছুদিন থাহনের পর মা'য়ও আরেকজনরে বিয়া করছে। - তারপর। পলাশের মায়া হল। মাছুমার কথা মনে হয়। মনে মনে হাসিও পেল। হাসি সংবরণ করল পলাশ। বড় অদ্ভুত লোকটি। কোন ভাবান্তর নেয়। কথাগুলো কত সহজ সরল ভাবে বলে যাচ্ছে। সিরাজ মিয়া যে মাছুমাকে ভালোবাসে সেটা তার চেহারায় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। - তারপর আর কি। মায়ের লগে আমরা ভাইবোন কিছুদিন ভালোই ছিলাম। নতুন বাপেরে আব্বা কইতাম না বলে চড় থাপ্পড় দিত। তাও সহ্য করছিলাম। একদিন একটা প্লেইট ভাঙ্গছে বলে আমার বইনটিরে খুব মারল। আমি ধরবার লাইগ্যা গেছি। আমারেও খুব মারলো। আমার মাও চুপচাপ। কিচ্ছু কইলো না। তারপর জ্বরে বইনটা মরতে বসছিলো। একটু ঔষধ পর্যন্ত খাওযাইলো না। হে যাত্রায় কোন ভাবে বইনটারে লইয়া ফুফুর বাসায় আশ্রয় লইছি। - হনুফা বুঝি তোমার বোন। - হ' ভাইজান। - ও খুব ভালো মেয়ে। - হ' ভাইজান। পলাশ ডায়েরীর ভিতর থেকে দু'টো পাতা ছিঁড়ে জিজ্ঞাসা করল- - কি লিখতে হবে বলো। - আমি কি কমু ভাইজান। আপনে ভালোমতন সুন্দর ভাষা দিয়া একখান চিডি লেইখ্যা দেন। এইডা আমার পরতম চিডি। আপনেরা লেহাপড়া জানা মানুষ। আপনেগো কলমে কত ভাষা। আমি কিছু কইবার পারুম না। তয় চিডির শেষের দিকে কয়ডা শোলক লেইখ্যা দিয়েন। - আমি যে শ্লোক জানি না। - হেইডা আমি কইয়া দিমুনে। - আচ্ছা ঠিক আছে। মাছুমা পড়তে পারে তো। - হ' ভাইজান। পারে। কেলাস ফাইভে উঠছিল।
সেদিন চার পৃষ্ঠার একটা চিটি লিখে দিয়েছিল পলাশ। নিজের জীবনে এতবড় চিটি কখনও লিখে নাই। লিখার প্রয়োজন হয়নি। চিঠিটা লিখে সন্দেহ হয়েছিল সিরাজ মিয়ার ভালোবাসাকে সে যেভাবে বর্ণনা করেছে, সিরাজ মিয়ার জীবনে তার কতটুকু সত্যতা আছে। কিংবা মাছুমা আদৌ সিরাজ মিয়াকে ভালোবাসে কিনা। তা জিজ্ঞাসা করা হয়নি। ভালো না বাসলেও এ চিটি পেয়ে মেয়েটির মন নরম হতে পারে। ভালোবাসতেও পারে। চিটি লিখা শেষ। সিরাজ মিয়ার চোখে মুখে আনন্দের ছাপ। এক অবর্ণনীয় আনন্দ খেলা করছে। সামান্য একটা চিটি লিখে মানুষ এত খুশী হতে পারে কি করে। পলাশ এতটা ভাবতে পারছে না। মনে হচ্ছে সে যা লিখেছে তা অদিতির কাছে লিখলেই ভালো হতো। অদিতির কাছে কখনও এত দীর্ঘ চিঠি লেখা হয়নি। একবার ভাবল দুই কপি করে একটা অদিতির কাছে পাঠালে কেমন হয়। শ্লোক গুলো এখনও লেখা হয়নি। শ্লোক লিখে দিলে অদিতি খুব হাসবে। মজা করবে। মাছুমার কাছে লিখতে গিয়ে সে যেন নিজের কথায় ছাপিয়ে দিয়েছে। তাতে সিরাজ মিয়ার কোন সামঞ্জস্য নেয়। অবশ্য পৃথিবীর সব ভালোবাসার সুখ দুঃখের অনুভূতিগুলো তো একই। ভালোবাসার কাছে সিরাজ মিয়া আর পলাশ কিংবা অদিতি বা মাছুমার কোন পার্থক্য নেই। সবশেষে লিখল আমি সারা জীবন তোমার ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে থাকবো। ইতি তোমারই- সিরাজ। পলাশ লেখা শেষ করে বলল- - বুঝলে সিরাজ মিয়া-এ পৃথিবীতে কে কার সেটাই বুঝা বড় মুশকিল। - হ' ঠিকই কইছেন ভাইজান। মায়া মানুষের মন হইলো কচু পাতার পানির লাহান। তয় ভাইজান, মাছুমা খুব ভালা মায়া। আমারে কথা দিছে, আমারে ছাড়া আর কাউরে হে বিয়া করবে না। - এবার তোমার শ্লোক বলো। কাগজের শেষের পৃষ্ঠায় কিছু জায়গা খালি আছে। সিরাজ চোখ ঘুরিয়ে একবার দেখে নেয়। তারপর জিজ্ঞাসা করে- - শোলকের জায়গা হইবো। - হবে হবে। নয়তো আলাদা কাগজে লিখে দেব। সিরাজ মিয়া লজ্জা পায়। বলতে পারছে না। পলাশ তাগাদা দেয় - তাড়া তাড়ি বলো। - ভাইজান আমার শরম করে। - শরমের কিছু নাই। শরম থাকলে ভালোবাসা হয় না। তুমি বলো। - আইচ্ছ্যা লিখেন- গাছের জীবন লতাপাতা, মাছের জীবন পানি, পুরুষের জীবন টাকা পয়সা, নারীর জীবন স্বামী। পলাশ লিখে একটু হাসল। একবার ভাবল-ভালোবাসার জন্য মানুষ কত নির্লজ্জ হতে পারে। বলল-আরও জায়গা আছে। এবার দ্বিতীয় শ্লোক বল। সিরাজ মিয়া দ্বিতীয় শ্লোকটি বলল- কথায় কথায় মিষ্টি হাসি আমি তোমায় ভালোবাসি, পায় যদি গো ভালোবাসা সুখের লাগি বাঁধবো বাসা। এই শ্লোকটার মধ্যে এক ধরনের কবি কবি ভাব। জিজ্ঞাসা করল- কে বানিয়েছে। - আমি ভাইজান। আরও কত কথা মনে পরে। বেবাক কথা মনে থাহে না। বুঝলেন ভাইজান। অহন মনে হইতাছে লেহাপড়া না শিখা জীবনে কত বড় ভুল করছি। পলাশ চিঠিটা হাতে দিতেই আর একবার হাসল সিরাজ মিয়া। সে হাসি গর্বের, আনন্দের, আত্মতৃপ্তির। এই মুহূর্তে সে ভালোবাসার পরিপূর্ণতা পেয়েছে। চিঠিটা খুব যত্নের সাথে ভাঁজ করে পকেটে নিলো। তারপর বুক পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করে পলাশের হাতে দিয়ে বলল - ভাইজান কিছু মনে কইরেন না। আপনে একটু চা পানি খাইয়েন। পলাশ খুব লজ্জা পেল। রাগে সারা শরীর ঘিন ঘিন করছে। পরক্ষনে শান্ত হয়ে ভাবল, সিরাজ মিয়া হয়তো আমাকে ওর মত করে ভেবেছে। আমি তো বেকার। সে আমাকে ছোট করেনি। আমার বেকারত্বকে অপমান করেনি। ভালোবেসে আমার লেখাপড়ার মূল্য দিতে চেয়েছে। তাছাড়া পেশা হিসাবে তো মন্দ না। দু'চার পাতা লিখে দিয়ে কেমন কড়কড়ে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট। এরকম কয়েকজন কাস্টমর পেলে পরিচিতি পেতে বেশীদিন লাগবে না। দিনে আট দশটা চিঠি লিখতে পারলে হবে। কিন্তু আপাতত: এ টাকা নেওয়া যাবে না। পলাশ টাকাটা সিরাজের বুক পকেটে দিয়ে বলল - এটা তোমার কাছে রাখ। তোমাদের বিয়ের সময় মিষ্টি খাবো। তাতেই আমি খুশী। তারপরও সিরাজ মিয়া নাছোড় বান্দা। অনেকটা জোড় করে চায়ের দোকানে নিয়ে গেল। চা খাওয়াল। চা খেতে খেতে পলাশ জিজ্ঞাসা করল - কিভাবে পাঠাবে। - ডাকে দিতে ভয় লাগে। এই পরশু শনিবারে বাড়ী যামু। একটা শাড়ীও কিনছি। সামনে ঈদ। বাড়ী গেলে হাতে হাতে দিয়া দিমুনে।
তার কিছুদিন পর আবার হাজির হয় সিরাজ মিয়া। পলাশ ঘর থেকে বেরুতে যাচ্ছিল। সিরাজকে দেখে হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করল - কি খবর। মাছুমার চিঠি পেয়েছো। সিরাজের মুখখানা হাসি হাসি। এখন আর আগের মত লজ্জা নেই। অনেকটা সহজ হতে পেরেছে। - হ' ভাইজান। আপনের লেখা চিঠি পাইয়া হে তো দিশাহারা হইয়া গেছে। এই দ্যাহেন বলে সিরাজ বুক পকেট থেকে একটা চিটি বের করে দেয়। বাংলা রোল কাগজে লেখা। বড় বড় অক্ষর। অনেকগুলো বানান ভুল। পড়তে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু চিটির ভাষা বুঝতে মোটেও কষ্ট হচ্ছিল না। চিটিতে লেখার ফাঁকে ফাঁকে অনেকগুলো শ্লোক। তবুও কৌতূহল নিয়ে দেখছে চিটিটা। মাছুমা লিখেছে - ওগো তুমি আমার আদার (আঁধার) রাইতের তারা। নিসিত (নিশিত) রাইতে আমি তোমারে সপন (স্বপন) দেহি। তোমারে কেমন করিয়া ভুলিব। তোমার চিটি পরিয়া (পড়িয়া) আমি পাগলনি (পাগলিনী) হইয়াছি। সবশেষে লিখল ইতি তোমার জানের জান - মাছুমা। পলাশ না হেসে পারল না। চিটিটা সিরাজের হাতে দিয়ে বলল - ভালোই লিখেছে। মাছুমা সত্যিই তোমাকে খুব ভালোবাসে। তুমি মাছুমাকে কখনও কষ্ট দিও না। - ভাইজান এই চিটির উত্তরটা একটু লেইখ্যা দিবেন না। - আজ আমার তাড়া আছে। কাজে যাচ্ছি। আরেক দিন লিখে দেব। পলাশ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই সিরাজ মিয়া বলল - আইচ্ছা, কাল সন্ধ্যায় আসব। - ঠিক আছে । পরের দিন সন্ধ্যায় এসে আবারও চিটির উত্তরটা লিখিয়ে নিয়েছিল সিরাজ মিয়া।
তারপর থেকে সিরাজ মিয়াকে আর দেখা যায়নি। সেই সিরাজ মিয়াকে এতদিন পরে চিনতে পারার কথা নয়। কালো ছিপছিপে গড়ন। স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গেছে। হাতে একটা পলি ব্যাগ। ভিতরে কাগজে মোড়ানো পুটলি। কতক্ষণ বগলের নীচে রাখছে আবার কতক্ষণ হাতে ঝুলিয়ে রাখছে। রোগা রোগা চেহারা। উসকো খুসকো চুল দাড়ি। দেখে মনে হচ্ছে অনেকদিন চুলে আঁচড় পরেনি। চোখ দু'টো কেমন যেন নিস্তেজ। ঘোলাটে দৃষ্টি। হাফ শার্টের নীচে দু'টো বোতাম নেই। ঢিলা ঢালা প্যান্টটা নাভির নীচে পর্যন্ত ঝুলে আছে। প্যান্টের নীচের অংশটা প্লাস্টিকের স্যান্ডেলের ভিতর ঢুকে আছে। কোমড়ে কাল সুতার সাথে একটা তাবিজ আর একটা চাবি বাঁধা। প্যান্টের বাইরে ঝুলছে। বুকের কাছে বোতামটাও খোলা। গায়ের ময়লা আর ঘাম মিলে মিশে একাকার। চিক চিক করছে। মুখে পান খয়ের আর তামাক পাতার ঝাঁঝালো গন্ধ। আজ পলাশের তাড়া দেখেও সিরাজ মিয়া পথ ছাড়ল না। জোড় করে পাশের চায়ের দোকান বসিয়ে বলল - ভাইজান আপনের লগে অনেক কথা আছে। - কিন্তু আমার যে সময় নেই। সিরাজ কোন অজুহাত শুনল না। হাত ধরে ফেলল পলাশের। না গিয়ে উপায় নেই। চায়ে চুমুক দিয়ে পলাশ জিজ্ঞাসা করল _ কি কথা বল। ফুফুর বাসায় যাওনি। - না। - হনুফা কেমন আছে। বিয়ে হয়েছে নিশ্চয়। - হ' বিয়া হইছে। - তারপর। তোমার মাছুমা কেমন আছে। চুপ হয়ে গেল সিরাজ মিয়া। গরম চা গুলো যেন এক ঢোকে গিলে নিল। শার্টের কোনা টেনে ঠোঁটের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পরা চা'টা মুছে নিল। চোখ দু'টো স্থির। হঠাৎ লাল হয়ে উঠল চোখের কোণা। হিংস্র বাঘের মত ফোঁস ফোঁস করছে। চায়ের কাপটা টেবিলে রাখতে গিয়ে নীচে পরে গেল। হয়তো খেয়াল করেনি। ঝনাৎ করে কাপ ভাঙ্গার শব্দ হয়। বেয়ারা এসে কৈফিয়ত চাইতে একটা চড় বসিয়ে দেয়। দোকানের মালিক আসল। পলাশ ভদ্রভাবে ব্যাপারটা সামলে নিয়েছে। সিরাজ মিয়া হোটেলে এতগুলো লোকের সামনে কিছু বলতে পারছে না। পলাশ খাবার বিলটা দিতে গিয়ে বাঁধ সাধল সিরাজ মিয়া। - এইডা কি করলেন ভাইজান। - আমি চা খাওয়ানোর জন্য আপনেরে আনছি। - কিচ্ছু হবে না। আমার কাজ আছে। আমি গেলাম। - তাইলে আমি রাইতে বাসায় আসুম। চিন্তিত হয় পলাশ। একে-তো মতি গতি ঠিক নেই সিরাজের। কি হয়েছে কে জানে। নয়তো মাছুমার কথা জিজ্ঞাসা করাতে সে এরকম করল কেন। কিছুই বুঝতে পারছে না। ভাবছে বাসায় আসতে বলবে কিনা। এদিকে পিছু ছাড়ছে না সিরাজ। আজ আর টিউশানিও নেয়। অন্য রাস্তার ধরে হাঁটছে পলাশ। কৌতূহলও হচ্ছে। ভদ্রতার খাতিরে বলল- আচ্ছা আস। পাশ থেকে সিরাজ মিয়া জিজ্ঞাসা করল-এখন আপনের বাসা কই। - সৈয়দ শাহ্ রোডে, গনি সওদাগরের বিল্ডিং। - আমি আজ-ই আসুম ভাইজান। আপনেরে কইতে না পারলে আমার শান্তি নাই।
কাঁদছে সিরাজ মিয়া। কথা বলতে পারছে না। বার বার হিক্কা উঠছে। পলিথিন থেকে কাগজের পুটলিটা বের করে বিছানায় ছুড়ে মেরে বলে- এই দ্যাহেন শাড়ী। ফুফুরে দিয়া কিনাইছি। ফুফুরে কইছি - ফুফু দাম যাই হোক, একখান ভালা শাড়ী কিনবা। আমি তো চিনুম না। আড়াই হাজার টেকা নিছে। পলাশ দেখল শাড়ীটা সুন্দর। কমলা রংয়ের শাড়ী। হাতের নক্সা করা। নীল পাড়। বেশ চওড়া। দামও কম নয়। শাড়ীটা খুলতেই একটা ষ্টেনলেস ষ্টীলের লম্বা ছুরি। বেশ কয়েকটা রোল টানা কাগজ। প্রতিটা কাগজ সযত্নে ভাঁজ করা। পলাশ বুঝতে পারে এগুলো মাছুমার হাতের লেখা চিঠি। পানের খসটা গড়িয়ে পরছে ঠোটের পাশ দিয়ে। পলাশ জিজ্ঞাসা করল - এগুলো কি। ছুরি কেন। - মাগীরে আমি খুন কইরা ফালামু। একবার পাইয়া লই। ভাইজান বিশ্বাস করেন আমি কখনও ভাবি নাই মাছুমা আমারে এত বড় দাগা দিবো। আমি ওরে মনে প্রাণে বিশ্বাস করছিলাম। বিয়ার দুই মাস পর শহরে লইয়া আসি। টার্মিনালের কাছে ছোড একখান বাসাও নিছি। আপনে তো জানেন সারাদিন আমার গাড়ীর লগে থাকতে হয়। আইজ এক মাস হইলো। এই শাড়ী নিয়া আমি ঘুরতাছি। আমারে কইছিলো সামনের পনের তারিখে আমাগো বিয়ার একবছর পুরাইবো। তুমি আমারে কি দিবা। আমি কইছি, বউ বিয়ার পর তোমারে ভালা কিছু দিবার পারি নাই। তোমারে একখান ভালা শাড়ী দিমু। আর আমি তো ড্রাইভার হইছি। সামনে মাসে লাইসেন্স পামু। গাড়ীতে উঠলেই তোমারে এক জোড়া সোনার দুল বানাইয়া দিমু। চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝড়ছে সিরাজ মিয়ার। এই মনে হলো কান্না করছে আবার মনে হচ্ছে সব স্বাভাবিক। মনে হচ্ছে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। কিছুক্ষন চুপ চাপ বসে থেকে আবার বলল- - হেই দিন মাছুমা কি খুশী হইছে। সারা রাইত আমারে ঘুমাইতে দেয় নাই। আমার কোলের কাছে বইস্যা সারা রাইত গল্প করছে। পরদিন উস্তাদের কাছ থেইক্যা টেকা লইয়া এই শাড়ীখান কিনছি। রাতে বাসায় আইসা দেখি মাছুমা নাই। ঘরে তালা। - কোথায় গেছে কিছু বলে যায়নি। জিজ্ঞাসা করল পলাশ। - বলতে পারলে তো ভাইজান ওই খানেই অর লাশ ফালাইয়া দিতাম। - মাথা ঠান্ডা রাখো। এই ছুরি টুরি নিয়া মাথা গরম করলে কি চলে। কোন খবর পেয়েছো। আবার কাঁদল সিরাজ মিয়া। থেমে বলল- - পেয়েছি। তয় আমি আগে বুঝবার পারি নাই, পরে হুনছি আর একজনের লগে পালাইছে। এবার ডুকরে কেঁদে উঠল সিরাজ মিয়া। সিরাজের কষ্টটা বুঝতে একটুও বেগ পেতে হয়নি পলাশের। সিরাজকে সান্তনা দিয়ে বলল - আর ভেবে কি লাভ। তুমি যদি সত্যিই মাছুমাকে ভালোবাস, যদি কখনও তার দেখা পাও, তাহলে এই শাড়ীখানা তার হাতে দিয়ে বলো যে, আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি। রেগে যায় সিরাজ মিয়া। হেইডা আপনে কি কন ভাইজান। যে আমার এতবড় সর্বনাশ করল তারে আমি এমনি ছাইড়া দিমু। এত বড় মহাপুরুষ আমি হইবার পারুম না। এবার পিঠে হাত রেখে পলাশ বলল-মহাপুরম্নষ বলে কথা নয়। তুমি মাছুমাকে ভালোবাস বলেই বলছি। ইচ্ছা করলেও তুমি প্রতিশোধ নিতে পারবে না। ভালোবাসলে প্রতিশোধ নেওয়া যায় না। সিরাজ মিয়া কাগজের পুটলিটা সযত্নে বগলদাবা করে ঘর থেকে বেরিয়ে বলল - ভাইজান আমার জন্য একটু দোয়া কইরেন। আমার আর কিছুই রইলো না।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
জাকিয়া জেসমিন যূথী
গভীর ভালোবাসা ও কষ্টের গল্প। এরকম ভালোবাসা পেলে অন্যের সাথে পালানোর দরকার পরে নাকি! টাকা পয়সা হয়। কিন্তু ভালোবাসা সত্যি অধরা। খুবই সুন্দর নিখুঁত বুননে ঠাঁসা গল্পটা।
তানি হক
গল্পের শেষটা এমন কষ্টের হবে ..চিন্তাই করতে পারিনি ..শক্তিশালী লেখনি শক্তিতে ..আবিষ্ট করে রেখেছেন পুরো গল্প জুড়ে ...ভাইয়া ধন্যবাদ এমন ..ঝরঝরে ..মিষ্টি একটা লিখা উপহার দেবার জন্য ..ধন্যবাদ
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।