(এক)
মনসুর আলীর ধারনা, আমার ছেলে রাফি হচ্ছে এযুগের শ্রেষ্ঠ সন্তান।
মেধাবী রাফি। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। সবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছে। স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে উচ্চ শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করছে। আর দশজনের সাথে মিলে মিশে ঢাকা শহরে মানুষ। বাবার সান্নিধ্য খুব একটা পায়নি। ছোটবেলা থেকে ফুফুর বাড়িতে বেড়ে উঠা। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর টিউশনি করে জীবন ও জীবিকার সংগ্রামে টিকে থাকতে হয়েছে। বাবাকে নিয়ে রাফির খুব গর্ব। আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা।
একটা চরম রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে রাফির জন্ম। মনসুর আলীর গর্ব ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা হোক। এদেশ স্বাধীন হোক। আমরা পরাধীনতা চাই না। বাঙ্গালী জাতি হিসাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাই। এই শপথ নিয়ে একাত্তরে যুদ্ধ করেছিল মনসুর আলী। যাওয়ার সময় সুফিয়া বেগম খুব বারণ করেছিল। বলেছিল আমি পোয়াতি। আমারে এই অবস্থায় রাইখা তুমি যুদ্ধে যাবা, যদি তোমার কিছু হইয়া যায় তহন আমার কি হইবো, তোমার এই পোলাডার কি হইবো।
মনসুর আলীর সাহস ছিল। ভরসা দিয়ে বলেছিল-তুমি ভাইবো না। আল্লাহ আছে, আল্লাই একমাত্র ভরসা। আমি কোন অন্যায় কামে যাইতাছি না। দেশ স্বাধীন কইরা আমি অবশ্যই ফিরা আসুম। আমার পোলাডা একটা স্বাধীন দ্যাশে জন্ম লইবো। স্বাধীন ভাবে বড় হইবো। এতে আমার কম আনন্দ, তুমি কও। আমি একজন বাবা হিসাবে আমার পোলার জন্য এটুকু করবার পারুম না। মনসুর আলী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
সুফিয়া বেগমের অবস্থা দেখে ভেতরটা কেমন আনচান করে উঠলেও বউয়ের সামনে তা প্রকাশ করেনি। গামছাটা কাঁধে নিয়ে বাড়ীর পাশের সুখছড়ি নদীর ধারে অনেকক্ষণ একা একা হাটে। বার বার ভাবছে এখন আমি কি করব। দেশের এই অবস্থায় কাপুরুষের মত ঘরে বসে থাকতে কোন ভাবে মন সায় দিচ্ছে না। কিছু একটা করা দরকার। আমার সন্তানের জন্য। দেশের জন্য। শেষ পর্যন্ত নদীতে জোড়ে একটা ঢিল ছুঁড়ে বলে উঠল-যুদ্ধে যামুই।
যুদ্ধ শেষ। দেশে ফিরল মনসুর আলী। ফিরে এসে সুফিয়া বেগমকে আর দেখতে পায়নি। এই আকালে রাফিকে জন্ম দিয়ে চিরতরে বিদায় নিয়েছিল সুফিয়া বেগম। এমনিতে যুদ্ধে গুলি লেগে চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছিল। এখন মনে হচ্ছে দুনিয়াটা আরও বেশী অন্ধকার। রাফিকে কোলে নিয়ে ঝাপসা চোখে মুখে হাত বুলিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদল মনসুর আলী। আর দ্বিতীয় বিয়েও করেনি। রাফিকে ছোট বোন রহিমার হাতে তুলে দিয়ে বলল - বইন পারলে পেটে দুইডা ভাত দিয়া আমার পোলাডারে বাঁচাইয়া রাখিস। আমি আল্লাহর কাছে দুই হাত তুইলা দোয়া করুম। তোর কোন অভাব হইবো না। আল্লাহ তরে সুখে রাইখবো।
তারপর থেকে প্রতি ঈদে রাফির জন্য নতুন জামা জুতা নিয়ে মনসুর আলী রহিমার বাসায় গিয়ে রাফিকে দেখে আসত। রহিমার হাতে কয়টা টাকা দিয়ে বলত - ইচ্ছা হয় আমার কইলজাটা কাইটা তোর হাতে তুইলা দিই, আমার পোলাডারে তুই মানুষ করতাছস, লেহাপড়া শিখাইতাছস। রাফি পরীক্ষায় ভালো ফল পাইতাছে সবই তোর জন্য। পোলাডা যদি মানুষ হয় তয় আমার আর কোন দুঃখ থাকবো না।
রাফি সব কষ্ট নীরবে সহ্য করে। বাবার মতোই এক রোখা হয়েছে। সমাজের একজন হয়েই মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। বাবার দুঃখ ঘুছাবে।
আর কদিন পরে ঈদ।
রাফি বাবাকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে এবার ঈদে তোমার ঢাকায় আসতে হবে না। আমার বন্ধুদের নিয়ে এবার বাড়িতে ঈদ করব। আমার পরীক্ষাও শেষ। ক'দিন বাড়িতে থাকব। আমি ক'দিন আগে আসব। ফুফুরা আসবে ঈদের আগের দিন। তোমার শরীরের প্রতি খেয়াল রাখবে। ঔষধ গুলো ঠিকমত খাবে। আমি তোমার জন্য ঈদের জামা কাপড় নিয়ে আসব।
(দুই)
এলোমেলো পথ চলছে অধীর বাবু।
ভাবছে আমিও একজন বাবা। আজ সকালে সাগর বায়না ধরেছিল। ফ্যান্টাসি কিংডম আর ওয়াটার পার্কে যাবে। সাথে নদীও। খরচের বিষয়টা মাথায় রেখে ছেলে মেয়েদের আবদার রক্ষা করতে পারিনি। বেশ কিছু যৌক্তিক কারণও আছে। মাসের শেষ। দৈনন্দিন হালচাল আর সীমিত আয়। রীতিমত ম্যানেজ করে চলতে হয়।
ক্লাস সিক্সে পড়ে সাগর। আমার "না" বলাটা সহজ ভাবে মেনে নিতে পারেনি। প্রায়ই অভিযোগ করেই বলল-তোমাকে কতবার বলেছি। আজ নেবে কাল নেবে করে নিচ্ছনা। আমার বন্ধুরা কতবার যায়।
- ঠিক আছে বাবা আগামী মাসে ঠিকই নিয়ে যাবো। এই কথা দিলাম।
- এ্যাঁ, তোমার কথার কোন মূল্য নেই। আগেও বলেছ।
আমি আর কথা বাড়ায়নি। থলেটা নিয়ে বাজারের দিকে পা বাড়ালাম। কষ্ট হচ্ছিল, আমি ছেলেমেয়েদের আবদার রাখতে পাললাম না। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, আমি তাদের কাছ থেকে আসল সত্যটা লুকাতে চেষ্টা করলাম কেন। না না এটা আমার মোটেও উচিৎ হয়নি। হোক না ছোট, তাদের সাথে আমার মনের কথাটা ভাগাভাগি করা উচিৎ ছিল। ঠিক আছে ফাস্ট ফুড-এর দোকান থেকে দু'টো স্যান্ডউইচ নিয়ে কোলে বসিয়ে আদর করে আমার কথাগুলো বলবো। তারা তো আমারই ছেলেমেয়ে। নিশ্চয় বুঝবে। আমি সান্ত্বনা পেলাম। আনন্দ পেলাম এই ভেবে যে, ওদের ভালোভাবে মানুষ করার জন্য লেখাপড়া কিংবা ছেলেমেয়েদের পারিবারিক আনন্দে বেড়ে উঠার জন্য যেটুকু সময় দেওয়া প্রয়োজন, তাতে কোন ত্রুটি করছি না। কোন আপোষ নেয়। একজন নিম্ন মধ্যবিত্তের সামর্থ্যের মধ্যে যেটুকু সম্ভব তা পূরণ করার চেষ্টা করছি। আজকালকার ছেলেমেয়েদের এ বিষয়গুলো ভাবা উচিত। আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে কি সব উদ্ভট চিন্তা ধারা ভর করছে মাথায়। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা ভালো। তাই বলে মানবিক দিকগুলো একটুও ভাববে না। মা বাবার কষ্টের কথাগুলো বুঝতে চেষ্টা করবে না।
বাজারে রফিক সাহেবের সাথে দেখা।
পেছনে দশ বারো বছরের একটা ছেলে মোট বইছে। মাথার উপর ঝুড়ি ভর্তি বাজার। দেখা হতেই হাত বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন - আরে অধীর বাবু যে, কেমন আছেন?
- ভালো।
- আপনি? ব্যবসা কেমন চলছে।
- খুব একটা ভালো নেই ভাই।
- কেন কি হয়েছে ? ছেলে মেয়েরা ভালো? বড় ছেলেটা না এবার এইচ, এস, সি দিলো মনে হয়।
- আর বলবেন না। দু'বার পরীক্ষা দিল । মায়ের আদর পেয়ে পেয়ে ছেলেটা নষ্ট হয়ে গেছে।
- কি বলছেন আপনি।
- ঠিকই বলছি। এসব কথা বলতেও অপমানে মাথা হেট হয়ে আসছে। এখন পুরোপুরি মাদকাসক্ত। কদিন আগে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল। ছাড়িয়ে এনেছি। একটা মাত্র ছেলে। মেয়েটাও উচ্ছন্নে যাচ্ছে। সেদিন মিনি চাইনিজ থেকে..কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। কথার মোড় গুড়িয়ে বললেন-রাত বিরাতে কখন বাড়ী ফিরে তার কোন ঠিক নেই। সারাক্ষণ বন্ধু বান্ধব নিয়ে ব্যস্ত। কি করি বলেন। আমি একা মানুষ। সারাক্ষণ ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। অথচ কখনও কোন অভাব বোধ করতে দিইনি।
অধীর বাবু খেয়াল করল রফিক সাহেবে রীতিমত হাফাচ্ছে। চোখ দিয়ে পানি পরছে। অধীর বাবু ছেলে নিয়ে চিন্তিত। তবে এভাবে কখনও ভাবেনি। নিজের কষ্টটা কোন ভাবে বলতে পারল না। পরনে ধবধবে সাদা শিফনের পাজামা পাঞ্জাবী। পায়ে বহুদামী নাগড়া। শরীর থেকে মন কাড়া পারফিউমের গন্ধ খিলবিল করছে।
অধীর বাবুর সাথে বন্ধুত্ব অনেকদিনের। পারিবারিক ব্যাপারে এমন খোলামেলা আলোচনা আর কখনও হয়নি। অধীর বাবু চিন্তিত। হঠাৎ এ কি হলো রফিক সাহেবের। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছলেন রফিক সাহেব। কি সান্ত্বনা দেবেন ভেবে পাচ্ছিল না অধীর বাবু। বললেন-
- চলুন, চা খায়। অন্য সময় হলে না করতেন। আজ না করল না। রফিক সাহেব পা বাড়ালেন।
বিয়ারিং এর ছোট তিন চাকার একটা কাঠের বাক্স। একজন মাঝবয়সী প্রতিবন্ধী লোক বসে আছে গাড়িতে। আট দশ বছরের একটা ছেলে দড়ি বেঁধে গাড়িটা টানছে আর বলছে-সাহেব গো আমার বা'জানের জন্য দুইটা টাকা দ্যানগো..বা'জানের জন্য দুইটা টাকা দ্যান..। লোকটির কোলের উপর প্লাস্টিকের গামলা। তার মধ্যে ক'টা খুচরো টাকা আর কিছু ভাংতি পয়সা। ছেলেটি রফিক সাহেবের সামনে এসে দাঁড়াল। হঠাৎ কি মনে করে রফিক সাহেব ছেলেটির মাথায় হাত রাখলেন। কিছু বললেন না। পকেট থেকে একটা পাঁচশ টাকার নোট বের করলেন। ছেলেটির হাতে দিয়ে অধীর বাবুর সাথে পা বাড়ালেন।
অধীর বাবুর বিস্ময়ের সীমা থাকলো না। আজ রফিক সাহেব নিজে বাজার করছেন। তারপর এই ছেলেটির মাথায় হাত রেখে খচ করে পাঁচশ টাকার নোট বের করে দিলেন। গড় গড় করে কোনদিন না বলা কথাগুলো অকপটে বলে যাচ্ছেন। সাধারণত বাইরে কোন দোকানে বসে কারও আতিথেয়তা নেন না। অথচ আজ চা খেতে চললেন। বয় বেয়ারা কর্মচারীর অভাব নেয়। বড় অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ বলে মনে হলো।
চায়ে চুমুক দিয়ে কাপটা নামিয়ে রেখে বললেন-অধীর বাবু আপনি আমার বন্ধু মানুষ। আমাকে একটা উপায় বলে দেন আমি কি করব।
- আপনার স্ত্রী..কথাটা শেষ করলেন না অধীর বাবু।
- তারও সময় নেই। সভা সমিতি নিয়ে ব্যস্ত। এসব ব্যপারে কোন মাথাব্যথা নেই। আরও বলে যুগ পাল্টেছে। আজকালকার ছেলেমেয়েরা অমন এক আধটু বেখেয়ালি হয়। সময় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন যা সব শুনছি তাতে আমার আত্মহত্যা ছাড়া কোন উপায় নেয়। অথচ যখন যা চেয়েছে তা দিয়েছি।
- সময় কতটুকু দিয়েছেন।
রফিক সাহেব ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালেন অধীর বাবুর দিকে। সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন অধীর বাবু। আমার মনে হয় প্রত্যেক মা বাবার ছেলেমেয়েদের একটু সময় দেওয়া প্রয়োজন। তাদের বোঝার জন্য, বোঝানোর জন্য। একেবারে হাল ছেড়ে দেওয়া ঠিক না। ছেলেমেয়েদের বোঝান। তাদের সাথে সব বিষয় নিয়ে বন্ধুর মত আলাপ আলোচনা করেন।
রফিক সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন-আসলে ভুলটা আমারই। যা করেছি সব ওদের কথা চিন্তা করে। আজ মনে হচ্ছে সব ভুল করেছি। আবার রুমালে চোখ মুছলেন।
(তিন)
সামনেই পাঁচতলা শপিং মল।
পিছনের দিকটায় তেমন লোক চলাচল নেই। ঐ গলির মোড়েই অস্থায়ী দোকানগুলো বসেছে ঈদ উপলক্ষে। পাশ ঘেঁষে চলে গেছে বড় রাস্তা । ঈদের বাজার। চারিদিকে লোকে লোকারণ্য। পথচারীর ব্যস্ততাও বেশী। গলির মোড়ে একজন অন্ধ লোক বসে আছে। চোখে কালো চশমা। ছিপছিপে গড়ন। মুখভর্তি উসকোখুসকো দাড়ি। পরনে কালো ময়লা লুঙ্গি আর মাঝে মাঝে জোড়া তালি দেওয়া পাঞ্জাবী। গুটি সুটি হয়ে বসে আছে। একমাত্র সম্বল বেহালাটা। নতুন নয় অথচ অতি যত্নে চাকচিক্য বেড়েছে। কভারও আছে। লোকটি কভারের হুক খুলল।
কিশোর অম্লার দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ শুনলে মন্দ হয় না। এখুনি হয়তো বাজাবে। শুনতেও বেশ লাগে। কিছু সময়ও কাটবে। হাতে কোন কাজ নেই। ক'দিন হলো মাত্র শহরে এসেছে। রাস্তাঘাট এখনও ভালোমতো চেনা হয়নি। বেকার বলে হয়তো বাবা সারাক্ষণ গালমন্দ করত, মারধর করত। ছোট বেলা থেকে বাবার স্নেহ মমতা পায়নি। কথায় কথায় মারধর করত। লেখাপড়া যেটুকু হয়েছে তা মায়ের বদৌলতে। মাকেও কম অত্যাচার সহ্য করতে হয়নি। মদ খেয়ে যখন বাবা বাড়ি ফিরত মনে হত একটা মূর্তিমান আতংক। কারণে অকারণে ইচ্ছে করে মায়ের সাথে ঝগড়া করত। তারপর শুরু হতো অত্যাচার। অম্লান শৈশব থেকে দেখে আসছে এসব। বাবার প্রতি দিন দিন একটু একটু করে ঘৃণা জন্ম নেয়। কোন ভাবেই বাবাকে ক্ষমা করতে পারে না। অম্লানের কাছে বাবা মানে এক বিরাট ভয়, আতংক, ঘৃণা। বাবার হাত ধরে কোন বন্ধুদের বাজারে যেতে দেখলে অম্লানের মনটা কেঁদে উঠত। মনে হতো আমার বাবাও যদি এভাবে আমাকে হাত ধরে বাজার থেকে দুটো চকলেট কিনে দিত। ওদের বাবারা কত ভালো।
একদিন গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে অম্লান। কারখানা থেকে ফিরে অম্লানকে দেখে বাবা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। চিৎকার করে বলল-আজ হয়তো তুই থাকবি নয়তো আমি। এই বলে ঘরের ভেতর থেকে বেতের লাঠিটা নিয়ে তাড়া করল। আর বলছে - রাজ ভাণ্ডার পেয়েছিস। আমি তোকে বসে বসে খাওয়াবো। এখনি বের হয়ে যা। পাড়া শুদ্ধ লোক দেখল। অম্লান গ্রামের রাস্তা দিয়ে দৌড়চ্ছে।
শহরে এসে আশ্রয় নিয়েছে এক আত্মীয়ের বাসায়। তাও ক'দিনের জন্য। যেভাবে হোক পেটে ভাতে হলেও একটা হাতের কাজ জুটিয়ে নিতে হবে। জীবনের অর্থ বোঝার বয়স এখনও অম্লানের হয়নি। কিশোর মনটা এই বৃদ্ধ লোকের বেহালা শুনে কিছুটা সময় কাটিয়ে দিতে চায়।
একজন লোক তাড়া হুরো করে বলল - বাজান চাচা, তাড়া তাড়ি শুরু করেন। ঈদের সময়। মাইনষের দাঁড়াইয়া বেহালা হুননের সময় নাই। দর্শকের মধ্যে তেমন কেউ নেই। শুধু লোকটার পাশে অম্লান দাড়িয়ে আছে। গানের বেশ সমঝদার লোক মনে হচ্ছে। লোকটি আবার বলে উঠল - চাচা ঐ গানটা বাজান। সারা জীবন বাসলাম ভালো, তবুও তোর মন পাইলাম নারে বন্ধু...। দেইখবেন অহনি লোক জমা হইয়া যাইবো। চাচা নিরুত্তর। বেহালাটি কাঁধে নিয়ে সুর বাঁধতে বাঁধতে বলল - অহন কি আর মাইনষের বেহালা হুননের সময় আছে বা'জান।
লোকটি সুর তুললেন। খুব মিষ্টি সুর। ওস্তাদের নির্দেশ সালাম করে বেহালা কাঁধে নিয়ে আগে সারগাম সাধন করতে হবে। কোন রাগ সাধনা মনে হচ্ছে। অম্লান রাগ, তাল লয় ওসব বুঝেনা। তবে শুনতে বেশ লাগছে। বেহালার আওয়াজ শুনে আরও কয়েকজন লোক এসে জড়ো হয়েছে।
লোকটি আবার বলল - চাচা ঐসব গান মাইনসে হুনবো না। গরম গান তোলেন। চাচা অন্য একটা সুর তুললেন। খেঁকিয়ে উঠল পাশের দোকানদার। ঐ বুড়া, ঐদিকে যাও। দোকানের সামনে এত ফ্যাঁ ফ্যাঁ করবা না। এখন বেচা কেনার সময়। বাজাইতে হয় রাত্রে বইসা বাজাও। চাচা নিরুত্তর। কভারটা গায়ের সাথে লাগিয়ে রেখেছে। পাছে কেউ না নিয়ে যায়। রাগে গা গিজ গিজ করছে। দেশটা যেন মগের মুল্লুক। যার যা খুশি বলবে আর আমরা হাভাতে লোকগুলো সব মুখ বুঝে সহ্য করব। শালার দ্যাশ।
বেহালার তার থেকে বৃদ্ধ লোকটি হাত তুলে নিল। সমঝদার লোকটিও কিছু বলল না। লোকটি মাটিতে বসে কালো চশমাটা খুলে চোখ মুছল। অম্লান ঠাঁই দাড়িয়ে আছে। কিছু বলছে না। এই শহরে সে নতুন। হয়তো অন্য জায়গায় সরে গিয়ে বাজাবে। লোকটি বেহালাটা বগল চাপা করে বলল - বা'জান বেহালা না বাজাইলে যে পেডের ভাত হজম হয় না। অহন কেউই বেহালা হুনতে চায় না। দূর দূর কইরা তাড়াইয়া দেয়। তিরস্কার করে।
অম্লান বিনয়ের সুরে বলল - চাচা ঐ খানে গিয়ে বসেন। কেউ কিছু বলবে না।
- না বা'জান, আইজ আর বাজামু না। আল্লাহ আমারে অনেক দিছে। উপোষ রাখইবো না। আমি আল্লাহর গুন গান করুম। ওস্তাদে কইছিলো যখন তোর গান কেউ হুনবো না তখন এক মনে আল্লারে স্মরণ কইরা এই সুরটা বাজাবি।
সমঝদার লোকটি আবার অনুরোধ করল কিন্তু লোকটি অটল। না না বা'জান। পরান গেলেও আইজ আর বাজামু না। দেখলা না ঐ দোকানদার কেমন ব্যবহারটা করলো। বেহালা বাজাইয়া মাইনসেরে আনন্দ দিই, খুশি হইয়া দুই চার টেহা দেয়, ভিক্ষা করি না। কেউ যদি মনে করে ভিক্ষা, তয় আমার কি বলার আছে। আমাগো আর কদর কি। মাইনসে মনে করে ভিক্ষুক। আমি ভিক্ষুক না।
কারও কথায় শুনলো না। লাঠিটা ডানে বায়ে চালিয়ে ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে গেল।
হঠাৎ চারপাশে কিসের একটা শোরগোল শুরু হয়েছে। ধর্ ধর্, পালাও পালাও চিৎকার। দিগ্বিদিক ছুটছে মানুষ। পাগলের মত ছুটছে। বেশ কয়েকটা গুলির আওয়াজ শোনা গেল। সম্ভবত রাজনৈতিক গণ্ডগোল। একপক্ষ আরেক পক্ষকে পাল্টাপাল্টি হামলা করছে। শব্দ শুনে বৃদ্ধ লোকটি জবু থবু হয়ে এক জায়গায় আড়াল করে বসেছিল। গাড়ী আর জনসাধারণের ছুটাছুটি শুনে মনে হচ্ছে গুরুতর কিছু ঘটে যাচ্ছে।
ভীত অম্লান কি করবে বুঝতে পারছে না। ভয়ে দৌড়াতেও পারছে না। চোখের সামনে অসহায় মার ছবিটা ভেসে উঠে। বাবাকে ধিক্কার দেয়। এক সময় আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। মানুষের পায়ে লেগে লাঠিটা দূরে সরে গিয়েছিল। অম্লান লাঠিটা কুড়িয়ে নিয়ে বৃদ্ধ লোকটির হাতে দেয়। লোকটি অম্লানের একটা হাত ধরে বলে - দৌড়াইস না বা'জান। মনে হয় মারা মারি লাগছে। এইহানে আমার পাশে বইসা থাক্। গণ্ডগোল থামলে তারপর যাইস বা'জান। অম্লানের মনে হলো কতদিন এমন নিরাপদ আশ্রয় পায়নি সে। ভেতরটা আবারও ডুকরে কেঁদে উঠল।
লোকটি এই এলাকায় থাকে। প্রায়ই দেখা যায়। আবার চলেও যায়। কোন অসুবিধা হয় না। অভ্যাস হয়ে গেছে। অন্ধের ষষ্ঠি একমাত্র সম্বল বেহালা আর লাঠিটা। চিৎকার চেঁচামেচি ক্রমশ: বাড়তে থাকে। ভয় পেয়ে যায় বৃদ্ধ লোকটি। আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। এ যেন সময় ফুরোয় না। সূর্যের তেজ দেখে আন্দাজ করে নেয় বেলা চারটার কম নয়। একসময় গুলির আওয়াজ বন্ধ হয়ে আসে। যান চলাচল স্বাভাবিক হয়ে আসছে।
বৃদ্ধ লোকটি উঠে দাঁড়ায়। অম্লানকে বলল - আমারে একটু সামনের রাস্তাটায় তুলে দে বাপ। অম্লান লোকটির একটা হাত ধরে এগিয়ে দেয়। পুলিশের তাড়া খেয়ে কয়েকজন পিকেটার এলোপাথাড়ি দৌড়াতে থাকে। বৃদ্ধ লোকটির গায়ে প্রচণ্ড ধাক্কা লাগে। পড়ে যায় লোকটি। কপালে আঘাত লেগে সামান্য কেটে গেছে। রক্ত পরছে। বেহালাটা খানিকটা দূরে ছিটকে পরে। হাতড়াতে থাকে লোকটি। পুলিশের তাড়া দেখে অম্লানও ভয় পেয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে।
সামনে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়ায়।
ট্যাক্সি থেকে খুব দ্রুত নেমে আসে রাফি। বৃদ্ধ লোকটিকে বুকে টেনে নেয় রাফি। ট্যাক্সি থেকে রাফির বন্ধু রেবেকা আর টুটুলও নেমে আসে। বন্ধুরা জিজ্ঞাসা করে - লোকটি কে।
রাফি বাবাকে আরও নিবিড় করে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল - আমার বাবা।
বুক ফুলিয়ে গর্ব করে আবার বলল - আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবা।
অম্লান বেহালাটা হাতের কাছে দিয়ে বলল এই নিন আপনার বেহালা। রেবেকা আর টুটুল হাত বাড়িয়ে পরম যত্নে গাড়ীতে তুলে নেয় মুক্তিযোদ্ধা মনসুর আলীকে।
০৭ এপ্রিল - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১১৩ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪