দিনের প্রথম ভালোবাসা।
গ্রামের বাড়ী। ছোট এক টুকরো উঠান। উঠোনের এক কোণায় একটা তুলসী গাছ। পাশে একটা বেলী আর জবা ফুলের গাছ। খুব সকাল। অধরা সবে স্নান সেরে এসেছে। সকালের স্নিগ্ধ রোদে ভেজা চুলের গন্ধে এক ধরনের মাদকতা আছে। একটু পরে ঠাকুর ঘরে যাবে। পুজো শেষ। কাসাঁ আর শঙ্খ ধ্বনি শুনলেই অমিতাভ বিছানা ছাড়ে। এটাই প্রাত্যাহিক নিয়ম।
এই নিয়মের মধ্যে আরও দু'টো বিষয় নিয়মিত হয়। আবার মাঝে মধ্যে নিয়মের ব্যতিক্রমও ঘটে। প্রথমটা হলো-অধরা বিছানা ছেড়ে বের হওয়ার আগে অডিও রেকর্ডারটা অন করে। বাজিয়ে দেয় রবীন্দ্র সংগীত। খুব ছোট ভলিউম। এটা অমিতাভর খুব প্রিয় একটা অভ্যাস। আধো ঘুম, আধো জাগরন, মিষ্টি আলসেমি এ এক অন্যরকম আনন্দ।
দ্বীতিয়টা হচ্ছে- স্নান শেষে পূজার ফুল তোলা। সেই সাথে দু'একটা বেলী ফুল নিয়ে অমিতাভর মাথার কাছে বেড ড্রয়ারটার উপড়ে কাঁচের প্লেটে রেখে দেওয়া। তাতে সারা ঘরে মিষ্টি একটা গন্ধ দোল খায়। একটা স্বর্গীয় অনূভুতি পাওয়া যায়। অমিতাভ কিংবা অধরা কেউ জানে না স্বর্গের পারিজাত কিংবা অন্য কোন ফুলে এর চেয়ে বেশী সুবাস পাওয়া যায় কিনা। সারা দিনটা যদি এরকম সকাল হয়ে থাকতো মন্দ হতো না। ভোরের এই ভালোবাসাটা দু'জনের মধ্যে এক নিবিড় বন্ধন তৈরী করে।
সংসারের ছোট খাট মান অভিমানগুলো এই দ্বীতিয় বিষয়টা দিয়ে খুব সহজে সমাধান হয়ে যায়। যেদিন এই যন্ত্রটা বাজবে না বুঝতে হবে কিছু একটা হয়েছে। হয়তো কিছুই না। আবার অনেক কিছু। মেঘে ডাকা ঘন ঘোর বরষা যেন এই সংসারে প্রাণ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। দু'জনে চুপ চাপ। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কথা বার্তার উপর ১৪৪ ধারা জারি। এতে অবশ্য একটা উপকারও আছে। অমিতাভ সেটা খেয়াল করেছে। নিজের উপড় নির্ভরশীল হওয়া যায়। কথা না বলে নিজের কাজগুলো নিজেই করে নেওয়া যায়। এক কাপ চা সে আর কি। নিজেই বানানো যায়। ভাত বেড়ে খাওয়া তাও কঠিন কিছু নয়।
অকারণে মন খারাপ। হতেই পারে। এতো অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাই বলে একজনের সাথে অন্য জনের কথা বার্তা বন্ধ হয়ে যাবে সেটা কেমন যেন মনে হয়। এই খন্ডকালীন মেঘের উপড় নির্ভর করে অমিতাভর সময়মতো ঘরে ফেরা না ফেরা। তার চেয়ে কিছুটা বাড়তি সময় অফিসে কিংবা বাইরে সহসাথীদের সাথে কাটিয়ে আসলেও মন্দ হয়না। যেদিন গানের সাথে বেলী ফুলের গন্ধ থাকে সেদিন মেঘ পরিষ্কার থাকে, ঝরঝরে তরতাজা সুর্যটা উঁকি দেয় পূব আকাশে। মনটাও ভালো থাকে। অফিস থেকে সোজা ঘর। সুখ দুঃখটা আনন্দের সাথে দু'জনে ভাগাভাগি করে নেয়। সংসারে এক ধরনের প্রশান্তি বিরাজ করে।
"আমার প্রিয়ার ছায়া বাতাসে আজ দোলে"- সুমনের ভারী গলায় গানটা শুনতে বেশ লাগছে। শঙ্খ ধ্বনি শুনার সাথে সাথে উঠে পরে অমিতাভ। ঝটপট তৈরী হয়ে বাইকটা স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে পরে।
এনজিও অফিসে চাকরি। প্রায় সময় মাঠ পরিদর্শন, সচেতনতা সভা, ওয়ার্কশপ, সেমিনার, কর্ম এলাকার সেবাগ্রহীতাদের সাথে কথা বলা, তাদের সমস্যা শোনা, অসহায় নিম্মবিত্ত দরিদ্র লোকদের সুখ দুঃখের ভাগীদার হওয়া এইতো কাজ।
মিজানুর রহমান। একজন মাঠকমর্ী। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। কারও ঘরের বারান্দায়, কারও বৈঠক খানায়, কখনও বা গাছ তলায়, কখনও চায়ের দোকানে। সহসাথীদের চার পাঁচজন একত্রিত হলে একটা আধঘন্টার সেশন শুরু করা যায়। সেশন পরিচালনার জন্য কিছু উপকরনও থাকে। অংশগ্রহনকারীদের উৎসাহ বাড়ানোর জন্য থাকে কিছু উপহার সামগ্রী। বন্ধুত্বের মাধ্যমে এটা এক ধরনের যুগোপযোগী শিক্ষা।
মিজান প্রশিক্ষিত মাঠকমর্ী। বয়সে যুবক। মাদসাক্তদের নিয়ে তার কাজ। সে যা জানে তা বন্ধুদেরকে বোঝাতে চেষ্টা করে। বন্ধুরা এতে সচেতন হয়। মনের মধ্যে এক ধরনের ভয় কাজ করে। মিজান তার বন্ধুদের সৎপথে ফিরিয়ে আনার জন্য এক বিশাল দাযিত্ব পালন করে আসছে। এতে এক ধরনের আনন্দ আছে। এই হতভাগা লোকগুলোর সাথে যেন নিবিড় বন্ধুত্ব। এতে করে নিজেদের অনেক না বলা কথা অকপটে বলে ফেলে।
মিজান যখন প্রথম পিয়ার এডুকেটর হিসাবে কাজ করতে আসছিল অমিতাভর ভয় ভয় করছিল। চোখ দুটো লাল, রুক্ষ এলো মেলো চুল, চোয়াল লেগে গেছে দাঁতের সাথে। হাসতে পারত না। ঝিমুনি ভাব। চোখের দিকে তাকানো যায় না। বড় খিটখিটে মেজাজ। ইন্টারভিউতে তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তোমার সাথে যারা আছে, যারা মাদকাসক্ত, নেশা করে, তাদের নিশ্চয় তুমি চেনো।
- হ্যাঁ, চিনি।
- তুমিও তো মাদকাসক্ত।
- হ্যাঁ।
- তাহলে তুমি কিভাবে মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে তোমার বন্ধুদের সচেতন করবে।
- স্যার, আমি স্বাভাবিক একটি নতুন জীবনে ফিরে যেতে চাই, আপনি যদি আমাকে বাচাঁন তাহলে আমি নতুন জীবন ফিরে পাবো।
- তুমি জান এই মাদকের কারনে কি কি রোগ হতে পারে।
- জানি। এইচ আই ভি/এইডস, যৌন রোগ এমনকি মৃত্য পর্যন্ত হতে পারে।
- তাহলে নেশা কর কেন।
- পরে আর একদিন বলব স্যার।
- আর শোন, আমাকে আর কখনও স্যার ডাকবে না। দাদা বলে ডাকলে বেশী খুশী হবো।
সেদিন ছেলেটার মধ্যে একটা আত্মতৃপ্তির হাসি ফুটে উটেছিল। মনে হয়েছিল যেন একটা নির্ভরতা খুঁজে পেয়েছে। রুক্ষ মেজাজ। কিন্তু কোন রকম অভদ্র আচরন করেনি। কোন ভয় বা সংকোচ বোধও ছিলনা। কথা বার্তা সোজা সাপটা অথচ দৃঢ়তাপূর্ণ। আমি একটা নতুন জীবন চাই।
শুভপুর বাজার। বড় বটগাছটা ছেয়ে আছে পুরো বাজারটা। বটগাছের নীচে মিজান আর তার চার পাঁচজন বন্ধু। ওরা অংশগ্রহনকারী। মিজান ক্লাশ নিচ্ছে। বাম হাতে একটা ফ্লিপ চার্ট। এইচ আই ভি/এইডস এর উপরে খুব মনোযোগ দিয়ে বন্ধুদের বুঝাতে চেষ্টা করছে। ফ্লিপ চার্টের ছবিগুলো দেখে মজা পাচ্ছে সংগীরা। মিজান পর পর ব্যাখ্যা করে যাচ্ছে এইডস কি, এইচ আই ভি কি, কিভাবে ছড়ায়, কিভাবে ছড়ায় না, কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়।
মিজান একটা নারী পুরুষের ছবি দেখিয়ে বলছে এইচআইভি/এইড্স আক্রান্ত পুরুষ বা মহিলার সাথে অরক্ষিত যৌন মিলনের মাধ্যমে এইডস ছড়ায়। বন্ধুদের একজন নাজিম। উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করে-
- ও মিজান অরক্ষিত যৌন মিলন মানে কি একটু বুঝাইয়া বলবি।
- মিজান বুঝিয়ে বলে- অরক্ষিত যৌন মিলনের মানে হচ্ছে স্বামী স্ত্রী ছাড়া অন্য কোন নারী বা পুরুষের সাথে যৌন মিলনের সময় সঠিক ভাবে কনডম ব্যবহার না করা।
নাজিম হঠাৎ করে জিহ্বায় কামড় দিয়ে বসে। অস্পষ্ট কন্ঠে বলে-হায় হায় সর্বনাশ, তা হলে আমার কি হবে। আমারও কি এইডস হবে। চিন্তায় পরে নাজিম। মিজান তার কাঁধে হাত রাখে। ভরসা পায় নাজিম। সে মিজানকে বলে-
- আমিতো ঐটা ব্যবহার করি নাই, তাহলে কি আমারও এইডস হবে।
- না। যদি ঐ মহিলার শরীরে এইডস এর জীবাণু না থাকে তাহলে এই রোগটা ছড়ানোর সম্ভাবনা কম। শুধু তাই নয় এই যে আমরা বিভিন্ন সময় নেশা করি, মাদকদ্রব্য গ্রহন করি তাতেও কিন্তু আমরা কেউ বিপদমুক্ত নই।
নাসির জিজ্ঞাসা করল-
- সেটা কি আবার। নেশা নিলে আবার এইডস এর ভয় থাকে নাকি। গুল মারার জায়গা পাস না। নিজেতো তো ছাড়ার চেষ্টায় আছস, আমাগোরে ও সাধু বানাবার ফন্দি করছস। আমরা কি বুঝি না।
- না রে দোস্ত। আমারে ভুল বুঝিস না। তোদের মতো একসময় আমিও মনে করতাম। কিন্তু অহন বিশ্বাস করি। এটা যে কত বিপদ জনক। এই দ্যাখ বলে মিজান ফ্লিপ চার্ট থেকে সুঁচ/সিরিঞ্জ দিয়ে মাদক গ্রহনরত কয়েকজন যুবকের একটা ছবি বের করে দেখায়। তারপর বলে- মাদকদ্রব্য গ্রহণে একই সুঁচ/সিরিঞ্জ বিভিন্ন জনে ব্যবহার করলে এই রোগ ছড়ায়।
- কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব।
- সম্ভব। এই যে আমরা একই সিরিঞ্জ বিভিন্ন জনে ব্যবহার করছি না।
- হ করছি।
- কিন্তু কার শরীরে কি রোগ আছে আমরা কেউ জানি।
- সবাই এক সংগে বলে উঠল - না।
- তাহলে এবার নিজেরাই চিন্তা করে দ্যাখ-আমার শরীরে যদি এইডস এর জীবাণু থাকে সেটা সবার শরীরেই যাবে।
- কিভাবে।
- রক্তের মাধ্যমে। একটা মাত্র সুঁচ/সিরিঞ্জ আমাদের প্রত্যেকের রক্তের সাথে মিশে যাচ্ছে এতে কিন্তু আমরা কেউই বিপদ মুক্ত নই।
সবাই ব্যাপারটা বুঝতে পারে। এর মধ্যে মিজান নিয়মমত অন্যান্য বিয়য়গুলো বুঝাতে থাকে। প্রতিরোধের বিষয়গুলো বলে- যদি আমরা ধমর্ীয় অনুশাসন মেনে চলি, যদি আমরা শরীরে রক্ত গ্রহনের পূর্বে তা এইড্স জীবাণুমুক্ত কিনা পরীক্ষা করে নিই, জীবানুমুক্ত সূঁচ/সিরিঞ্জ ও অপারেশনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার বা ডিসপোজেবল সুঁচ/সিরিঞ্জ ব্যবহার করি এবং মাদকদ্রব্য গ্রহণে একই সুঁচ/সিরিঞ্জ বিভিন্ন জনে ব্যবহার না করি তাহলে এই ঘাতক ব্যাধিকে আমরা প্রতিরোধ করতে পারব।
মিজানের এই সেশনে আরও কিছু লোক আশে পাশে জড়ো হয়েছে। অমিতাভ বাইকটা একটু দূরে রেখে পেছনে গিয়ে দাড়িয়েছে। মিজান খেয়াল করেনি। হঠাৎ চোখ যায় অমিতাভর দিকে। জিজ্ঞাসা করে-দাদা কতক্ষন।
- এইতো কিছুক্ষন হলো। তোমার সেশন তো ভালোই চলছে। এর পরের সেশন কোথায়।
- বিকাল তিনটায়। পানি ছড়া ঘাটে।
- ঠিক আছে। এখন সেশনটা শেষ করো।
মিজান অমিতাভকে সামনে এনে বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। বন্ধুদের অনেকে অমিতাভকে অনেক প্রশ্ন করে। অমিতাভ তার জবাব দেয়। মিজান সবশেষে আরও কিছু বিষয় আলোচনা করে। এধরনের রোগীদের সাথে কি রকম ব্যবহার করা উচিত। তাদেরকে ঘৃনা করলে হবে না। সমাজের অন্য সব রোগীর মত ওদেরকেও ভালোবাসা, সেবা যত্ন দেওয়া উচিত।
ফরিদা আক্তার। প্রত্যন্ত গ্রামের সহ সহজ সরল এক কিশোরী। বয়স কত হবে। পনের কি ষোল। বাবা নৌকার মাঝি। মা বাড়ি বাড়ি কাজ করে। দুই বোন। বড় বোন ফাহমিদা। প্রেম করে ঘর বেঁধেছে। বাবা হাফ ছেড়ে বাঁচল। যা হোক একটা হিল্লে হয়েছে। সংসারের যা আয় রোজগার তাতে টাকা খরচ করে মেয়েকে সংসার গুছিয়ে দেওয়ার সামর্থ নেই। ছেলেটাও মন্দ নয়। বাসের হেলপার।
প্রথম দু'এক মাস অসহায় তজু মিয়ার অভিমান হয়েছিল। মেয়ের মুখ দেখবে না। শেষ পর্যন্ত সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। এছাড়া কোন উপায় ছিল না। মাঝে মাঝে জামাই আসে। ভালমন্দ কিছু না কিছু হাতে করে নিয়ে আসে। দু'বেলা একটু ভালোমন্দ খাওয়া হয়। ফাহমিদাও আসে। জামাই বলে কথা। ফরিদাকে নিয়ে বেড়াতে যায়। নতুন সিনেমা আসলে খবরটা আগে বাগে পেয়ে যায় ফরিদা। জামাই বাবাজীর সৌজন্যে সংসারে কিছুটা পরিবর্তনও এসেছে। ক্লাস সেভেন পাশ করা ফরিদার আর লেখাপড়া করা সম্ভব হয়নি। জামাই এর সুবাদে আবার স্কুলে ভর্তি হয়েছে। এখন ক্লাস নাইনে পড়ে।
একদিন স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মিজানের সাথে পরিচয়। মিজান তখন কলেজে পড়ে। পাশাপাশি গ্রাম। পরিচয়ের সুত্র ধরে যাওয়া আসা। পড়া লেখায় সহযোগীতা। উৎসাহ দেওয়া। তারপর ভালোলাগা অতঃপর গভীর ভালোবাসা।
একদিন ফরিদাকে তার দুলাভাই শহরে নিয়ে যায়। গার্মেন্টসে চাকরী দেবে। পাঁচ হাজার টাকা বেতন। সাথে বোনাস, ওভার টাইম। সব মিলিয়ে সাত আট হাজার টাকা পরবে। তজু মিয়া একবার অমত করছিল। বলেছিল, মেয়েটা মেট্রিক পাশ করে চাকরীতে গেলে ভালো হত। কিন্তু ধোপে ঠেকেনি। ফরিদার মা বাঁধ সাধল। মেট্রিক পাশ করে কি হবে। সেই তো একই কাজ। চুলায় লাকড়ী দেওয়া, রান্না বান্না, সন্তান জন্ম দেওয়া। এখন তাও ভালো। জামাই বাবাজী এই সুযোগটা করে দিয়েছে। আমাদের সাত পুরুষের কপাল ভালো যে এরকম একটা জামাই পেয়েছি।
ফরিদা যাবার আগে মিজানকে বলেছিল তার জন্য কোন চিন্তা না করতে। মিজান যেন ঠিকমত লেখাপড়া করে। ভালোমত পাশ করে তোমার একটা চাকরী হয়ে গেলে আমাদের আর কোন চিন্তা থাকবে না। ছোট একটা বাসা নিয়ে শহরে থাকব। দ'ুজনে চাকরী করব। কোন অভাব থাকবে না।
মিজান সেই অপেক্ষায় ছিল। একদিন খবর পেল ফরিদাকে পাওয়া যাচ্ছে না। তজু মিয়াসহ অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কোন লাভ হয়নি। দুলাভাইকেও পাওয়া যাচ্ছে না। ফাহমিদা জানায় সে এসবের কিছুই জানেনা। আজ একমাস ধরে সে বাসায় আসছে না। কোথায় আছে তাও জানে না। কোন খবরও দেয়নি। পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হল আবাসিক হোটেল থেকে খদ্দের সহ দশ যৌন কমর্ী আটক। তার মধ্যে একজন ফরিদা। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ফরিদা আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেনি।
এদিকে মিজানের জীবনটা বড় এলোমেলো হয়ে গেল। মিজান মাদকাসক্ত। কলেজে নাম আছে। লেখাপড়া করে না। বাউন্ডুলে ভবঘুরে। নেশায় বুদ হয়ে পরে থাকে। অন্তরে বোবা কান্নার দহন শুরু হয়। মা বাবার একমাত্র সন্তান। একটা সাধারন মধ্যবিত্ত পরিবার। সুন্দর আগামীর স্বপ্ন। একটা নতুন জীবন গড়ার।
এখন আর তা মনে হয়না। মাঝে মধ্যে নেশার খরচ জোগাতে গিয়ে ছোট খাট অপরাধের দিকে হাত বাড়ায়। নেশার ঘোর কেটে গেলে শুরু হয় এক ধরনের বিবেকের দংশন। তাতে কোন লাভ নেই। আবারও সেই নেশা। হাত গুলো সিরিঞ্জ-এর গুতোয় জালি হয়ে গেছে। নতুন জীবনের স্বপ্ন এখন আর হাত ছানি দেয় না।
বন্ধুদের সাথে বাইরে রাত কাটায়। ভাসমান যৌন কর্মীদের সাথে এক ধরনের সখ্যতা গড়ে উঠে। ওখানে সুমাইয়া, সুমনা, লাভলী অনেক আছে। কোথাও ফরিদাকে খুঁজে পায় না। এই লাইনে থেকে জেলা শহরের হোটেল গুলোতে খোঁজ খবর নেয়। না কোন সন্ধান কেউ দিতে পারেনি।
অমিতাভ মিজানকে আরও কাছে থেকে অবলোকন করে। পরামর্শ দেয়। তার ভিতর এক রকম দৃঢ়তা আছে। যা তার আত্মবিশ্বাসকে আরও প্রবল করে তোলে। সব কথা অমিতাভর সাথে ভাগাভাগি করে। কোন দ্বিধা নেই। নেশার জগত থেকে মিজানকে ধীরে ধীরে সরিয়ে আনতে হবে। একদিন মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে যায় অমিতাভ। ওখানে কযেকদিন রেখে কাউন্সেলিং দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠে মিজান।
মিজান অমিতাভর খুব কাছের মানুষ। মাঝে মাঝে অমিতাভর বাড়ীতে আসে। চা নাস্তা খায়। অধরা সহ একসাথে বসে গল্প গুজব করে। অধরা বিষয়টা জানে। অমিতাভ অধরাকে বলেছিল-এ সমস্ত বিষয়ে পারিবারিক ভালোবাসার বন্ধনটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড়। নেশার কারনে মিজানের পরিবার থেকে সেটাও হারিয়েছে। অমিতাভ প্রায়ই মিজানের বাড়ীতে যায়। মিজানের মা বাবাকে বোঝায়। মিজানকে সুস্থ করে তোলার দায়িত্ব অধরা আর মিজান ভাগাভাগি করে নেয়। মিজানের বাড়ীতে অধরাও যায় অমিতাভর সাথে। অধরা নিজের ভাইয়ের মত ভালোবাসে। পরামর্শ দেয়। অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে মিজান। পরিবার থেকে যা হারিয়েছিল তা আবার ফিরে পেতে যাচ্ছে। মিজানের এ সবকিছুর জন্য অমিতাভ আর অধরার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়।
বিভাগীয় জেলা শহরের একটা প্রজেক্ট ক্রস ভিজিট করার দায়িত্ব পায় অমিতাভ। সাথে পাঁচ জনের গ্রুপ। তিন দিনের ট্রিপ। একই ধরনের কাজ। আলাদা প্রজেক্ট। তাদের লক্ষ্য অর্জনে কে কিভাবে কাজ করে যাচ্ছে সেটা শিক্ষনীয়। মিজানও দলের একজন। অমিতাভ দলপতি। যারা যে লক্ষিত জনগোষ্ঠি নিয়ে কাজ করে তারা তাদের গ্রুপকে দেখবে। সাবলীল, সুন্দর এবং মার্জিত ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন খুটিনাটি বিষয়গুলো জেনে নেওয়ার জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরী করতে হবে। পরদিন সকাল ন'টায় সূচনাপর্ব এবং পরিচিতি। ঐ অফিসের পরিচালক, অফিসার এবং পিয়ার এডুকেটররা থাকবেন। ওরাও যে যার লক্ষিত জনগোষ্ঠি নিয়ে কাজ করে। পরিচয় পর্ব শেষে আমাদের মাঠ পরিদর্শন। আগের দিন সন্ধ্যায় হোটেলে অমিতাভ সবাইকে নির্দ্দেশনাগুলো দেয়।
কনফারেন্স রুমে সবাই অপেক্ষা করছে। প্রজেক্ট পারিচালক এখনও এসে পৌছায়নি। পিয়ারদের মধ্যে দু' জন বোরখা পরে এসেছে। আরও তিনজন মহিলা। পাঁচজন পুরুষ পিয়ার। সবাই সামনের সারিতে। পেছনের সারিতে অমিতাভর দলের সবাই। মাহবুব সাহেব এসে পরেছেন। তিনি তার নিজের পরিচয় দিলেন। সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে পরিচয় পর্ব শুরু করতে বললেন এবং ভিজিটরদের সব ধরনের সহযোগীতার আশ্বাস দিলেন। অফিসারকে বললেন-উনারা যা জানতে আসছে তা জানার জন্য সব ধরনের সহযোগীতা করতে।
তারপর এ প্রজেক্ট অফিসার শহীদ এবং অমিতাভ দু'জনের পরিচয় দিলেন। এক এক করে শুরু হলো পিয়াদের পরিচয়। আমি সুমন, আমার টার্গেট গ্রুপ রিঙ্াচালক। বোরখা পরা একজন বলল-আমি লাকী, টার্গেট গ্রুপ-ভাসমান যৌনকমর্ী। আমি রাহাত, আমি মাদকাসক্তদের নিয়ে কাজ করি। বোরখা পরা অন্যজন বলল-আমি ফরিদা, হোটেল বেইজড যৌন কমর্ীরা আমার গ্রুপ।
ফরিদা নাম শুনে মিজান চমকে উঠে। দাড়াতে গিয়ে অমিতাভর চোখে চোখ পরে। আবার বসে পরে নিজের আসনে। মনের ভিতর এই মূহুর্তে যা হচ্ছে তার কোন প্রকাশ নেয়। পাশের ব্বন্ধুটির ইশারায় বুঝতে পারল তার পরিচয় দিতে হবে। দাড়িয়ে বলল-আমি মিজান। আমি মাদকাসক্তদের নিয়ে কাজ করি। পরিচয় পর্ব শেষ। বিশ মিনিটের চা বিরতি।
মিজান ফরিদার সামনে গিয়ে দাড়ায়। কোন ভয় নেই, সংকোচ নেই। ফরিদা নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। এক সময় কেঁদে ফেলে ফরিদা। মিজানের দু'টো হাত ধরে বলে-তুমি আমাকে চিনতে পেরেছো।
- চিনতে না পারলে এভাবে তোমার সামনে এসে দাড়াতাম না।
- তুমি কি জান আমার আর কিছুই নেয়, আমি একজন পতিতা। এ শহরের হোটেল বেইজড যৌন কর্মীরা আমার সহসাথী।
- তা তো তোমার পরিচয়েই জেনেছি। তুমি কি এখনও ঐ পেশায় আছো।
- ফরিদা চুপ করে থাকে। কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞাসা করে-তুমি।
- আমি আর কি। চাচা সহ অনেক খুঁজেছি। হতাশ হয়ে পরলাম। জীবনের মোড় ঘুরে গেলো। এডিক্টেট হয়ে গেলাম। অমিতাভ দাদার কাছে না এলে এতদিন বোধ হয় মরেই যেতাম। তা তুমি এখানে কিভাবে।
- সে অনেক কথা। এত কষ্ট সহ্য করে এখনও বেঁচে আছি। মরে গেলেই ভালো হতো। আত্মহত্যা করতে পারিনি। এখন হয়তো পুরুষরা লুটে পুটে খাচ্ছে, মরলে হয়তো শেয়াল কুকুরে খাবে। যেভাবে এ গলিতে প্রবেশ করেছি শত চেষ্টা করেও বের হতে পারিনি। আমার নিষ্ঠুর নিয়তি আমাকে এখানে থেকে যেতে বাধ্য করেছে।
চা বিরতি শেষ। অমিতাভ এগিয়ে আসছে এদিকে। মিজান আবেগ সংবরন করতে পারেনি। অমিতাভর হাত চেপে ধরে বলে- দাদা, এই সেই ফরিদা। যার কথা আমি আপনাকে বলেছি। আপনি সবকিছু জানেন। আমি ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়। আপনি একটা ব্যবস্থা করে দিন।
নীরবে রক্তক্ষরণ হচ্ছে ফরিদার। কিছু বলতে পারছে না। কাঁদছে। কখনও ভাবেনি মিজানের সাথে এভাবে দেখা হয়ে যাবে। মিজানের প্রতি ভালোবাসা জানানোর সাহস নেয়। মিজানই বা কেন একজন পতিতাকে নিয়ে আবার ভাববে। এও কি সমাজে সম্ভব। সমাজ বহুগামীতার জন্য মিজানকে ঠাঁই দেবে অথচ ফরিদাকে ঠাঁই দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।
অমিতাভ তাড়া দিচ্ছে দলের সবাইকে। আমাদের ফিল্ড ভিজিটে বের হতে হবে। মিজানকে বলল-আমরা আজকের কর্মসূচীটা শেষ করে আসি। তারপর তোমাদের সাথে বসে কথা বলব। সারাদিনের কাজ। এরকম অনেক ফরিদারা শহরের আনাছে কানাছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কেউ সাত তলায় কিংবা কেউ গাছ তলায়। অন্যান্য লক্ষিত জনগোষ্ঠির সাথে কথা হয়েছে। তাদের প্রশ্ন করা হয়েছে। কারা কেন এ পেশায় এসেছে। প্রতিটা প্রশ্নের পেছনে এক একটা বিচিত্র ইতিহাস। একটা চিরন্তন সত্য সবাই বুঝতে পেরেছে যে, কেউ স্বেচ্ছায় এ পথে আসেনি। কোন না কোনভাবে প্রতারিত হয়েছে। এবং যাদের দ্বারা প্রতারিত হয়েছে তারা কোন না কোন আপনজন। মিজান এ সত্যটা একটু বেশী উপলব্দি করেছে। কারণ ফরিদা তাদের মধ্যে একজন। রাগে ক্ষোভে মিজানের শরীর টগবগ করছে। কোন প্রশ্ন করতে পারছে না।
এর মধ্যে শহীদ ভাইয়ের সাথে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করেছে অমিতাভ। শহীদ জানিয়েছে মেয়েটা খুব ভালো। আচার আচরন আর কথাবার্তা দেখে মনে হয় অত্যন্ত ভদ্র ঘরের মেয়ে। এইতো কয়েকমাস হলো আমাদের সাথে কাজ শুরু করেছে। একটা হোটেল থেকে উদ্ধার করেছি। তার দুলাভাই কয়েকদিন হোটেলে রেখে বন্ধু বান্ধব নিয়ে ফুর্তি করে তারপর দালালের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে।
বিকালে সবাই ফিরে এসেছে। সারাদিনের কাজগুলো রিভিউ হচ্ছে। অমিতাভ শহীদ ভাইকে নিয়ে অফিসের ছাদে বসেছে। মিজান এবং ফরিদাকে ডেকে পাঠিয়েছে। ছাদের উপর খোলা আকাশ। এর মধ্যে কথাটা এক এক করে সহসাথীদরে অনেকে জেনে গেছে। হারানো অতীতটাকে ফিরে পেতে চায় দু'জনেই। দেহটার উপর হয়তো অনেকের লালসা আছে কিন্তু মনের উপর কারো লোভ লালসা নেই, এটা নিশ্চিত। কিন্তু কিভাবে। এ ব্যাপারটাই অনিশ্চিত।
মিজান আর ফরিদা এসেছে। পাশাপাশি বসেছে দু'জন। একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে। মনের উপড় অদৃশ্য বোঝাটা হালকা হচ্ছেনা। বলে বোঝানোটা একটা কঠিন কাজ। মিজান কিংবা ফরিদা কতজনকে বুঝিয়েছে। কতজনের অভ্যাস পরিবর্তন করতে পেরেছে। কতজনকে একটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পেরেছে। আজ নিজেরাই স্বাভাবিক হতে পারছে না। বুঝতে পারছে না এই মূহুর্তে কার কি করা উচিত। পরিস্থিতিটা একটু স্বাভাবিক করতে অমিতাভ এগিয়ে আসে। জিজ্ঞাসা করে-
- তোমাদের ফিল্ড ট্রিপ কেমন হলো।
- ভালো।
- অভিজ্ঞতাগুলো কোন কাজে লাগবে বলে মনে হয়। শহীদ ভাই জিজ্ঞাসা করে।
- অবশ্যই। প্রতিটা মানুষের জীবন যে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ভরপুর, তা ভাবতেও গা শিউরে উঠে। বলল মিজান।
- এটাই জীবন। বিশ্বাস করতে মন চায় না, তারপরও বিশ্বাস করতে হয়। অমিতাভ হাসে। তারপর বলে- অনেকদিন পর তোমাদের দেখা। তোমাদের ভালোবাসা এখন কোন পর্যায়ে বল।
চমকে উঠে ফরিদা। হঠাৎ এরকম সরল কথা আশা করেনি। মিজান অমিতাভকে জানে। ফরিদা মিজানের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। কোন কথা বলছে না। মিজান কথা বলল-
- দাদা আমাকে মৃত্যর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে এনেছেন। আমি আগেও বলেছি আমি একটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে চায়। যার কারণে আমার এই অবস্থা আজ আমি তাকেও খুঁজে পেয়েছি। এখন ওর যদি কোন আপত্তি না থাকে আমি ফরিদাকে বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করতে চায়।
- রিয়েলী ইউ আর দ্যা গ্রেট মিজান। আই এ্যাম প্রাউড অফ ইউ বলে খুশী হয়ে মিজানকে জড়িয়ে ধরে শহীদ ভাই। ফরিদা কোন কথা বলছে না। অনবরত কাঁদছে। অমিতাভ ফরিদার মতামত জানতে চাইল। ফরিদা নিশ্চল পাথরের মত ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে অমিতাভর দিকে। কি বলবে ফরিদা। কি মতামত দেবে। শহীদ ভাইয়ের সাথে কাজ করে। অনেকটা অভিভাবকের মত। চোখের জল মুছে বলল-আমি কি মিজানের ভালোবাসার প্রতিদান দিতে পারবো। এ সমাজ আমাদেরকে সহজ ভাবে গ্রহন করবে না। আর না করলে মাঝখান থেকে মিজানের জীবনটা দুর্বিসহ হয়ে উঠবে।
- কথা বলল শহীদ ভাই। কি হবে না হবে সেটা তোমরা দু'জনে ভেবে নিও। আপাতত: মিজানের প্রস্তাবে তুমি রাজী কিনা বল। হলে আমরা বিয়ের ব্যবস্থা করি। কি বলেন দাদা।
- সম্মতি দিল অমিতাভ। ঠিকইতো। সেই দিনক্ষণ আর খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা আমি করব।
সেই বৈঠকে ফরিদার সম্মতি নিয়ে সামনের ১৪ এপ্রিল ১লা বৈশাখ কাজী আফিসে বিয়ে হবে। ফরিদা আর মিজান গ্রামে যাবে না। শহরে থাকবে। মিজানও এখানে কাজ করবে। ফরিদার পক্ষে থাকবে শহীদ ভাই আর তার স্ত্রী, মিজানের পক্ষে অমিতাভ আর অধরা। নতুন বছরে নতুন ভালোবাসায় পূর্ণতা পাবে দু'টি নতুন জীবন।