পরীক্ষা শেষ।
নিষাদ ও চম্পা মামা বাড়ি এসেছে। শীতকাল। গ্রামের বাড়িতে বেড়ানোর আনন্দটাই আলাদা। সারাক্ষণের সাথি হিসেবে পেয়েছে দুই মামাতো ভাই বোন। রঞ্জু ও শাপলা। রঞ্জু নিষাদের দুই বছরের বড়। শাপলা রঞ্জুর ছোট। নিষাদ এবার পিএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। লেখাপড়ায় ভালো বলে রেজাল্ট নিয়ে খুব একটা টেনশন নেই। নিষাদ বরাবরই স্কুলে প্রথম হয়ে এসেছে। স্কুল শিক্ষকরাও নিষাদের এমন পড়ালেখায় খুব খুশি।
মামার বাড়িটা ঢাকা শহর থেকে অনেক দূরে। একেবাওে অজপাড়া গাঁ। গাড়ি থেকে নেমে নৌকায় অনেকটা পথ। তার পর আবার পায়ে হেঁটে, সাঁকো পার হয়ে মেটো পথে অনেকটা হেঁটে তবেই মামাবাড়ি পৌঁছানো যায়। এই দূরত্বের কারণে সবসময় আসা হয় না। শেষবার যখন এসেছিল তখন ছোটবোন চম্পার জন্মই হয়নি। নিষাদের বয়স কত হবে? বড়জোর তিন চার বছর। সারাক্ষণ নানার কাঁধে চড়ে ঘুরে বেড়াতো সারা গ্রাম।
গায়ে ধুলো ময়লা লেগে সর্দি, কাশি হবে, এই ভয়ে মোটেও হাঁটতে দিত না। সন্ধ্যার সময় কুসুম কুসুম গরম পানি দিয়ে হাত পা মুছিয়ে দিত। তার পর গায়ে কাঁথা জড়িয়ে কোলে বসিয়ে শুরু হতো গল্প। নিষাদ কাঁথার ভিতর নানার কোলের উম পেয়ে বেশ মজা পেতো। একের পর এক গল্প শুনতো আর মিটি মিটি করে হাসতো।
এই ক’বছরে আর আসা হয়নি। বাবার চাকরি। মায়ের নানান রকম সাংসারিক ঝামেলা। নিষাদের স্কুল। চম্পার জন্ম সব মিলিয়ে সময় সুযোগ হয়ে ওঠেনি। এত দূরের পথ। ইচ্ছে করলেও হুট করে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া মুশকিল। এর মধ্যে নানা নানিও কয়েকবার ঢাকা এসেছে। দেখা হয়েছে, কথাবার্তা হয়েছে। কত করে বলে গেছে একবার মামার বাড়ি বেড়িয়ে আসার জন্য। অনেক দূরের পথ। কিছুতেই সময় হয়ে উঠে না।
এবার কিন্তু নিষাদের একদম কষ্ট হয়নি। বরং বেশ আনন্দই হচ্ছে। কাঁচা রাস্তাগুলোতে এখন ইট বসানো হয়েছে। যে পথটা নৌকা দিয়ে পার হতে হতো সেখানে এখন ইঞ্জিন বোট হয়ে গিয়েছে। পায়ে হাঁটা পথটাতে এখন রিকশা চলে। তার পর বাঁশের সাঁকোটা পার হয়ে মাইলখানেক হাঁটলেই কুসুমপুর গ্রামে মামার বাড়ি। সেই মামার বাড়ির উঠোনে পা দেওয়ার সাথে সাথে দীর্ঘ পথের ক্লান্তি একেবারে মুছে যায়। পথের কষ্টটা একদম মনে থাকে না।
অনেকদিন পর নাতি-নাতনিরা আসার খবর পেয়ে নানির কত রকমের আয়োজন। পিঠা, পায়েস, খেজুর রসের ভাত, নারকেলের নাড়– আরও কত কী! এখন আর নানার কোলে চড়ে নিষাদের সময় কাটাতে হচ্ছে না। মামাতো ভাই রঞ্জুর সাথে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি ঘুরছে। সাথে চম্পা ও শাপলা। কোনো বাধা নেই, কোনো সীমানা নেই। গ্রামের সবাই নতুন অতিথিদের পেয়ে খুব আদর যতœ করছে। কেউ হাতে দ’ুটো মোয়া, কেউবা পাটালি গুড়ের সন্দেশ, কেউবা গাছের দু’টো ফল হাতে দিয়ে বলছে, এগুলো খাও। ঢাকা থেকে আইছ, কী আর দিমু?
শুক্রবারে গ্রামের মসজিদে নামাজ পড়েছে নিষাদ। গ্রামের অনেক ছেলেরাও এসেছে নামাজ পড়তে। ওদের সাথে নিষাদের ভাব হয়। ওদের বাড়িতে নিষাদকে শীতের পিঠা খাওয়ার দাওয়াত দেয়। নামাজ শেষে সবার সাথে কোলাকুলি করে নিষাদ। মনে হচ্ছে ওরা সবাই কত আপন! সবাই কত দিনের চেনা!
নিষাদকে এখন আর আগের মতো এটা করো না, ওটা করো না, ওখানে যেও না, এমনটি আর কেউ বলছে না। সারাটা দিন ঘুরে দিনের শেষে যখন শীতের সন্ধ্যা নামে তখন একটু ভয় ভয় লাগে। চারিদিকে ঘন কুয়াশা। গাছপালাগুলো কেমন কুয়াশার সাদা চাদর মুড়িয়ে ঘুমিয়ে পরে। সন্ধ্যা হতে না হতেই পুরো গ্রামটা ঝিমিয়ে পরে। লোকজনের চলাচল তেমন থাকে না। প্রয়োজনের বাইরে কেউ ঘর থেকে বের হয় না। ঘরের বারান্দায় বসে দেখা যায় দূরের বাড়িগুলোতে কেবল একটুখানি কুপি বাতির আলো দেখা যায়। কোনো কোলাহল থাকে না। সবকিছু কেমন যেন নীরব, নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে কেবল খেঁকশিয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক আর ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ শোনা যায়। তখন গা ছম ছম করে ওঠে।
এই গ্রামে এখনও বিদ্যুৎ আসেনি। কোনো টেলিভিশন নেই। রঞ্জু বলেছে পাশের গ্রামের করিম চাচার বাড়িতে টেলিভিশন আছে। ব্যাটারি দিয়ে চালায়। সন্ধ্যার পর গ্রামের অনেকে করিম চাচার বাড়িতে গিয়ে টিভি দেখে। সাদাকালো টিভি। দূর গ্রাম থেকেও অনেকে আসে টিভি দেখতে। নিষাদ হাসে। বিশ্বাস করতে পারে না। শুধু টিভি দেখার জন্য মানুষ রাত জেগে এতদূর পথ পায়ে হেঁটে আসবে?
রঞ্জু ভাবছিল, নিষাদ একবার রাজি হলে ওকে নিয়ে টিভি দেখতে যাবে। কিন্তু নিষাদের টিভি দেখার কোনো ইচ্ছা নেই। ঢাকা শহরে ওদের ঘরে দু’টো টিভি, একটা কম্পিউটার আছে। টিভি অন করলেই অনেকগুলো চ্যানেল চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কম্পিউটারে কত রকমের গেম খেলতে পারে। তাই এই সাদাকালো টিভি দেখার কোনো ইচ্ছাই নিষাদের নেই। তার চেয়ে বরং কাঁথা মুড়ি দিয়ে বারান্দায় বসে নানার মুখে ভূতের গল্প শুনলে অনেক ভালো হবে।
মা নানির সাথে রান্না ঘরে ব্যস্ত। বাবা হারিকেনের আলোয় বই খুলে বসেছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাড়ির সামনে মসজিদ। তারাবির আজান দিচ্ছে মোয়াজ্জিন। কী মধুর সেই আজানের ধ্বনি! গ্রামের নীরবতা ভেদ করে কী অপূর্ব লাগছে শুনতে। নিষাদ ঢাকায় শুনেছে। কিন্তু এতটা মোহনীয় মনে হয়নি কখনও। হয়তো চারিদিকের ঝাঁ ঝাঁ, প্যাঁ পোঁ শব্দ, তাই হয়তো কখনও মন দিয়ে শোনা হয়নি। চারিদিকে কুয়াশার চাদরে ঢাকা বাড়িগুলোতে কুপি বাতির আলোও আর দেখা যাচ্ছে না।
নিষাদ, চম্পা, রঞ্জু, শাপলা নানার সাথে বারান্দায় মাদুর পেতে বসেছে। নানার গায়ে একটা মোটা কাঁথা। রঞ্জু আর নিষাদ একটা কাঁথা মুড়ি দিয়ে বসেছে। অন্য একটা কাঁথায় চম্পা আর শাপলা। গ্রামের বাড়িতে মামার মুদির দোকান। এখনও বাড়ি ফেরেনি। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
বারান্দার সামনে উঠোন। তার পর পুকুর। মাঝখানে পাকা সিঁড়ি দেওয়া ঘাট। তার দুপাশে সুপারি পাতার বেড়া। ঘাটের দু’পাশে গাছ-গাছালিতে ভরা জঙ্গল। নিষাদ নানার মুখে গল্প শুনছে আর বাইরে তাকাচ্ছে। যেন কিছু একটা খুঁজতে চেষ্টা করছে। নিষাদ শুনেছে রাতের বেলা গ্রামে ভূত থাকে। কিন্তু কখনও বিশ্বাস করতো না। এই বিজ্ঞানের যুগে কেউ কি ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করে?
হঠাৎ নিষাদ খেয়াল করল, ঐ পুকুর পাড়ের জঙ্গলের ভেতর থেকে দু’টো তির্যক আলোকরশ্মি তার চোখ বরাবর এসে পরছে। কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারছে না নিষাদ। সে মুখ ফুটে কথাও বলতে পারছে না। হঠাৎ ভয় পেলে যেমন মানুষের কথা বন্ধ হয়ে যায়, নিষাদেরও তাই হয়েছে। গলায় কী যেন একটা আটকে আছে। গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। চোখ দু’টো জ্বল জ্বল করছে। এই অন্ধকারে এমন তির্যক আলো কীভাবে এলো? নিষাদ কিছুই ভেবে পাচ্ছে না।
একটু আগেও নিষাদ আর চম্পা নানার মুখে ভূতের গল্প শুনতে চেয়েছিল। নানা বলেছে, আগে কাঠুরিয়া আর কুঠারের গল্পটা শেষ করি, তারপর বিড়াল ভূতের গল্প শোনাবো। নিষাদ হঠাৎ নানার কোলে ওঠে বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে চুপ হয়ে আছে। কিছু বলছে না। নানা জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে? নিষাদ কথা বলছে না। কেবল গোঁ গোঁ শব্দ করছে। নানা গা ধরে জোরে ঝাঁকি দিয়ে বলল, কী হয়েছে বলবি তো? সাথে সাথে চম্পাও ভয়ে শাপলার কাঁথা ছেড়ে নানার কাঁথার মধ্যে ঢুকে গেলো। নিষাদ ভয়ে ভয়ে নিচু গলায় বলল, ভূত---ভূ-----ত----ঐ দ্যাখো কেমন করে তাকিয়ে আছে।
নানা বুঝতে পেরে সাহস দিয়ে বলল, আমি আছি তো। তোর ভয় কীসের? আসলে বিড়াল ভূতের গল্প বলা শুরু করবো তো, তাই ঐ ভূতটাও গল্প শুনতে এসেছে। ওটাই বিড়াল ভূত।
নিষাদ ও চম্পা কাঁপা গলায় বলে উঠলো, আমরা ভূতের গল্প শুনবো না। চলো ঘরে চলো।
০৭ এপ্রিল - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১১৩ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪