ঘড়িতে তখন দশটার কাঁটা ছুঁই ছুঁই। বাংলোতে পৌঁছা মাত্র’ই পঞ্চাশার্ধো এক লোক ছুটে এলো।
ঃ ছ্যার, আপনি নিশ্চয়ই জনাব শাহেদ রহমান ..?
শাহেদ মাতা নাড়াতেই লোকটি খুব হাসি মাখা মুখে ছালাম জানালো।
ঃ আইয়্যুন ছ্যার আইয়্যুন..আমি এতোক্ষন আপনের অপেক্ষা’ই করতাছিলাম। আমি এই বাংলোর দারোয়ান মতি মিয়া।
মতি মিয়া শাহেদ রহমানের বেডিংপত্র ভেতরে নিয়ে গেলো। শাহেদ হাত মুখ ধুয়ে কাপড় পাল্টালো। খুব গরম লাগছে আজ। তবে ঝির ঝির বাতাস আর হাসনাহেনার মিষ্টি গন্ধে মুখরিত করে রেখেছে বাংলোটা।
জীবনের এই প্রথম কর্মক্ষেত্রে পদার্পন করলো শাহেদ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভ’মি সিলেটের একটি চা বাগানে এসিসট্যান্ট ম্যানেজার - ভাবতেই কেমন যেনো অবাক লাগে! মাঝে মাঝে ওর বিশ্বাস’ই হয় না যে- চাকরি নামক সোনার হরিনটা তার হাতে ধরা দিয়েছে। ওর কেবলি মনে হয়- ও এখানে বেড়াতে এসেছে।
রাতের খাবার খেয়ে বারান্দায় কিছুক্ষন পায়চারি করে একটার দিকে ঘুমাতে গেলো শাহেদ। এতো লম্বা জার্নি- ক্লান্তি ভর করে আছে সমস্ত শরীর। বিছানায় শোয়ার সাথে সাথে চোখের পাতা দু’টো আত্বসমর্পন জানাচ্ছে। ঠিক এসময় মুঠোফোনের রিং টোনের শব্দে কিছুটা কেঁপে উঠে শাহেদ। হ্যালো,শাহেদ স্পিকিং ...
ও পাশ থেকে ভেসে এলো অপরাধের সুর। দুঃখিত, আমি ভুল করে আপনার নাম্বারে কল দিয়ে ফেলেছি। কিছু মনে করবেন না প্লিজ।
শাহেদ কিছুটা রাগ¦ত কন্ঠে বললো, কিছু একদম মনে না করে পারছি না। আপনি আশি বছরের কেউ হলে গভীর রাতের এই ভুল মেনে নিতাম। কিন্তু ইয়াংএকটা মেয়ে হয়ে...
মেয়েটি এবার আরো বিনয়ের সুরে বললে, অনীচ্ছাকৃত ভাবে আপনাকে ডিষ্ট্রাব করার জন্য আমি আবারো দুঃখ প্রকাশ করছি।
হু, বলে শাহেদ মুঠোফোন সেটটি রেখে দেবে-এ মূহুর্তে মেয়েটি বললো, এবার ইচ্ছাকৃত একটি ডিষ্ট্রাব করতে চাই, প্লিজ...
ঃ মহা যন্ত্রনায় পড়লামতো দেখছি ! ঘোষণা দিয়ে আবার কি ডিষ্ট্রাব করতে চান বলুন তো..?
ঃ না, মানে মোবাইল সেটটি একটু ওপেন রাখুন না দয়া করে...
ঃ কেন ?
ঃ আপনার ওখানে কে যেনো বাঁশি বাজাচ্ছে.. শুনতে চাচ্ছি একটু।
শাহেদ লক্ষ্য করলো- সত্যি’ইতো কি পাগল করা সুর..! মুঠোফোনটি টেবিলে রেখে শাহেদ বাইরে গেলো। মতি মিয়া বারন্দার এক কোনায় বসে কি করুণ সুরে’ই না বাঁশি বাজাচ্ছে! এতো কাছে থেকেও এতোক্ষন তার কানে এই সুর কেনো পৌঁছলো না সে বুঝে উঠে পারছে না। অথচ রং নাম্বারের মেয়েটির কাছে দিব্যি বাঁশির শব্দ পৌঁছে গেলো। শাহেদ মতি মিয়ার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। কি অদ্ভুত সুর.. বুকে কেমন তীরের মতো বিদ্ব করছে। ও লক্ষ্য করলো, মতি মিয়ার দু’চোখে শ্রাবনের বৃষ্টির ধারা। তার চোখে চোখ পড়তে’ই মতি মিয়া থেমে গেলো।
ঃ ছ্যার আফনি অহনো ঘুমাইছুন না ?
ঃ না। আপনি থামলেন কেন ? বাজান। আসুন মতি চাচা আমার রুমে এসে বাজান। আজ রাতটা না হয় বাঁশি শুনে’ই কাটিয়ে দেবো।
স্যারের বাঁশি শোনার আগ্রহ দেখে মতি মিয়া ভীষণ খুশি হলো। শাহেদ টেবিলে রাখা মুঠোফোনটি কানে নিয়ে ক’বার হ্যালো বললো.. ওপাশ থেকে কোনো উত্তর আসছে না। লাইন কেটে গেছে।
ঃ জানেন মতি চাচা এতোক্ষন একটা মেয়ে ফোনে আপনার বাঁশি শুনছিলো।
ঃ উনি কি আমডার মেডাম ?
ঃ না, তা না। মৃদু হাসলো শাহেদ।
ঃ তাইলে উনি ক্যাডা, পরিচয় কি ?
ঃ তাতো জিঞ্জেস করা হয়নি। রং নাম্বারে ফোন করেছিলো মেয়েটি।
ঃ ও আইচ্ছা, যাক কি আর করা .. আরেকদিন ফোন দিলে আমারে একটু খবর দিয়েন। ওনারে বাঁশি শোনাইবাম ইনশাআল্লাহ্।
ঃ অবশ্য’ই খবর দেবো।
ঃ আমি যাই ছ্যার। আফনে ঘুমাইন।
ঃ একটু বসুন মতি চাচা।
মতি মিয়া টুলে বসলো।
ঃ আচ্ছা মতি চাচা, আপনার মনে বুঝি খুব কষ্ট ?
মতি মিয়া একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললো, না ছ্যার অহন আর তেমুন কোনো কষ্ট নাই। তবে একটা সময় আছিন...
ঃ কি সেই কষ্ট..? বলুন না শুনি।
মতি মিয়া কিছুক্ষন নীরব হয়ে রইলো। তারপর বলতে শুরু করলো- আমি ছিলাম ৭১’এর মুক্তিযোদ্ধা এই খবর পাক ক্যাম্পো কইয়া দেয় রেজাকার কুত্তার বাচ্চারা। পাকবাহিনী একদিন মাইজ রাইতে আমার বাড়ি ঘেরাও করে। কুত্তার বাচ্চারা আমার পোয়াতি বউডারে ইজ্জত নষ্ট করে। অপমান সইতে না পাইরা জুলেখা গলায় দড়ি লাগাইয়া মরছে। পিচাশরার ডরে আমার একমাত্র মাইয়াডা পলাইয়া যায়। আইজও তারে খুঁইজ্জা পাই নাই। সেই থেইক্কা নলের বাঁশি অইলো আমার একমাত্র সাথী। রেজাকাররার ফাঁসি অইছে, অহন আর কোনো কষ্ট নাই। আফনে ঘুমাইন ছ্যার, আমি যাই।
ঃ ওকে মতি চাচা,গুড নাইট। এক গ্লাস পানি পান করে শুয়ে গড়লো শাহেদ। রাত পোহালে জীবনের প্রথম অফিস। কাজেই সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে হবে। ঘুম ঘুম চোখে শাহেদ শুনতে পেলো- মতি মিয়া আবারো বাঁশি বাজাচ্ছে। রাতের নিস্তব্দতায় বাঁশির সুর এখন আরো মায়াবী লাগছে। শাহেদ মনে মনে ভাবছে- মেয়েটি এখন ফোন করলে ভালো করে বাঁশি শুনতে পেতো।
বেশ ভালো’ই লাগছে চাকুারটা। চারদিকে সবুজের বিশাল সমারোহ.. হু হু বাতাসে চা গাছের কচি পাতার নৃত্যের শব্দ .. শ’ শ’ নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের কোলাহল আর হাজারো পাখির কিচির মিচির ডাক ..প্রতিদিন মতি মিয়ার বাঁশির সুরে নিদ্রাদেবীর কোলে আরোহন করছে শাহেদ। তবে একটা অপেক্ষা মনের অজান্তেই কেনো যেনো তাড়িয়ে ফিরছে তাকে। সেই রং নাম্বারের মেয়েটির জন্যে। অপূর্ব তার কন্ঠ। ঠিক যেনো মতি চাচার বাঁশির মতো’ই। রাত বারটার পর মাঝে মাঝে ফোন বাজলেই মনে হয় - এই বুঝি সেই মেয়েটির ফোন, কিন্তু না।
একদিন সত্যি সত্যি মাঝ রাতে হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো মেয়েটির। শাহেদের সাথে সামান্য সৌজন্যতার পর মতি মিয়ার বাঁশি শুনতে চায়লো সে। সেদিন মতি মিয়া ছিলো অসু¯হ। জ্বরে কাতরাচ্ছিলো। শাহেদ বিষয়টি জানিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বললো, মতি চাচা সু¯হ হয়ে উঠলে আমি’ই আপনাকে ফোন দেবো।
ঃ আমাকে বাঁশি শোনানোয় আপনার আগ্রহ দেখে খুশি হয়েছি খুব। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।
ঃ অয়েলকাম। আচ্ছা, আজও কি ভুল করে ফোন দিয়ে ছিলেন ?
ঃ না, আজ ভুল করিনি। জানেন, নলের বাঁশির সুর আমার ভীষণ প্রিয়।
ঃ তাই ? আমারও। এক্সিউজ মি-আপনি কি গান করেন ?
ঃ না, কেন বলুন তো ?
ঃ আপনার কন্ঠটা খুব সুন্দর!
ঃ আমি অসুন্দরতো তাই বোধহয়..
ঃ আর আমি যদি বলি আপনি সুন্দর, তাই আপনার কন্ঠও সুন্দর।
ঃ হ্যাঁ তা বলতে পারেন। তো বাস্তবতা হচ্ছে, কোকিল কালো তাই তার কন্ঠ এতো মিষ্টি। আর সাগর দেখতে খুব সুন্দর, সাগরের কন্ঠ.. আই মিন ঢেউয়ের শব্দ দারুণ ভয়ংকর। আসলে সৃষ্টিকর্তা সব কিছুতেই ক্ষতচিহ্ন এঁেক দিয়েছেন। এই দেখুন না আপনার ওখানে যিনি বাঁশি বাজান- কি মধুর’ই না সেই সুর। খোঁজ নিলে জানতে পারবেন সুরটা আসছে কত’ই না কষ্টের দহন থেকে।
ঃ মানুষতো মনের সুখেও বাঁশি বাজায়।
ঃ তা বাজায়। সুখের সুর ক্ষণ¯হায়ী। আর কষ্টের সুর অনেক দীর্ঘ¯হায়ী এবং হ্নদয়স্পর্শী।
ঃ তাহলেতো বলতে পারি ক্ষতচিহ্নও এক প্রকার অলংকার। আপনার নামটা জানতে পারি?
ঃ নূপুর.. বলা মাত্র’ই লাইন কেটে গেলো।
শাহেদ অনেক বার ট্রাই করলো.. ওপাশ থেকে বলা হচ্ছে- দুঃখিত, এই মূহুর্তে আপনার কাংখিত নাম্বারে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না ...
নূপুর এখন আর ভুল করে নয় ; ইচ্ছে করেই শাহেদের কাছে মধ্যরাতে ফোন দেয় প্রতিদিন। কথায় কথায় রাত কেটে যায় ওদের। কখন যে ভোর আসে বুঝতে পারে না ওরা। কখনো মতি চাচার বাঁশি শোনা আবার কথা আর কথা .. এই ভাবে কখন যে ওরা হারিয়ে যায় ভালোবাসার গহীনে, কেউ জানে না। এভাবে কেটে যায় আরো বেশ কিছুটা দিন। অথচ আজো কেউ কাউকে দেখেনি। শাহেদ কতবার বলেছে, মুখোমুখি হতে। আজ নয় কাল নয় পরশু করে করে দিন অতিবাহিত করে যাচ্ছে নূপুর।
শাহেদ এখন নাছোড়বান্ধা। এক দফার এক দাবি- নূপুরকে সামনের শুক্রবার সকাল এগারটায় জাফলং’এ আসতেই হবে। অদৃশ্য হয়ে আর নয়; এবার কথা হবে সামনা সামনি। হাত ধরে দু’জনে ঝর্নার বয়ে চলা স্বচ্ছ জলে হেঁটে বেড়াবে। হাঁটতে হাঁটতে চলে যাবে দূরে অনেক দূরে.. কথায় কথায় কেটে যাবে সকাল দুপুর বিকাল গোধূলী। আসবে সন্ধ্যা। সন্ধ্যার আলো আঁধারীতে ওরা হারিয়ে যাবে ভালোবাসার রাত্রিতে।
কথানুযায়ী নূপুর নীল শাড়ি পড়ে গন্তব্য¯হলে পৌঁছলো যথাসময়ে’ই। নূপুর সামান্য দূর থেকে লক্ষ্য করলো- কথামতো শাহেদও ধূসর রংয়ের পাঞ্জাবী পড়ে অপেক্ষারত। শাহেদ ঝর্নার সামনে বসে সিগারেট টানছে। দৃশ্যটি দেখে নূপুরের খুব রাগ হলো। এতো নিষ্পাপ মুখে জ্বলন্ত সিগারেট কিছুতেই মানাচ্ছে না। নূপুর ভীরু ভীরু পায় এগুচ্ছে আর ভাবছে, কাছে গিয়ে সিগারেটটা ছুঁ মেরে কেঁড়ে নিয়ে তা ঝর্নার জলে ফেলে দিবে। বেশ কিছুটা কাছে গিয়ে দেখা গেলো- ও সিগারেট পুরো না টেনেই ফেলে দিলো। প্যান্টের পকেট থেকে একটা লাল রংয়ের ছোট বক্স বের করলো। কি আছে ঐ বক্সে .. ? কৌতুহলের অবসান ঘটলো সাথে সাথে’ই। শাহেদ বক্স থেকে এক জোড়া সোনার নূপুর বের করে নাড়াচাড়া করতে লাগলো।
সোনার নূপুর দেখে থমকে যায় নূপুর। নূপুরটি নিশ্চয়’ই তাকে প্রেজেন্ট করার জন্য.. পা আর একটুও নড়ছে না। অবশেষে পিছু ফিরে যেতে বাধ্য হয় নূপুর। নূপুর জানে, তার এই ফিরে যাওয়ায় শাহেদ কষ্ট পাবে। ভীষণ কষ্ট। অপেক্ষা করতে করতে শাহেদ এক পর্যায়ে তাকে ছলনাময়ী- প্রতারক ভেবে সোনার নূপুরটি ঝর্নার জলে ছুঁড়ে ফেলে দিবে। নূপুর চাপা একটা কান্না নিয়ে মনে মনে বললো, শাহেদ তাই করুক। ক্র্যাচে নির্ভর করে চলা তার এক পায়ে সোনার নূপুর শোভা পাবে না।
০৬ এপ্রিল - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৩৭ টি
সমন্বিত স্কোর
৫.১
বিচারক স্কোরঃ ২.১ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ৩ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪