হটপ্যাটিস

উপলব্ধি (এপ্রিল ২০১৬)

আশিকুর রহমান তানিম
“জানেন? প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা আমাদের গলিতে একটা লোক হটপেটিস বিক্রি করতে আসতো।”

আমার সামনে যে মেয়েটা বসে আছে, সে প্রায় ঘন্টাখানেক এর নীরবতার পর এই কথাটি বললো। আমি খুব মনযোগ দিয়ে কাজ করছিলাম। মেয়েটিও কিছু একটা বই-টই পড়ছিলো, মাঝখানে আমার জন্য এক কাপ চা ঢেলে দিয়েছে কিন্তু কোন কথা বলেনি। আমি একটু অবাক হয়েই ওর দিকে তাকাই। আমার তাকানোর ভঙ্গির মাঝে এই কথাটির প্রাসঙ্গিকতা খোঁজার কিংবা এর পরেও কিছু শোনার আকাংখা থেকেই বোধহয় ও হাতের বই বন্ধ করে আমার দিকে তাকায়। আঙ্গুল দিয়ে বুকমার্ক না রেখে বইটি একদমই বন্ধ করে দেয়াতে আমি বুঝি সে সত্যি সত্যি সিরিয়াস কিছু বলবে। আমি ধীরস্থির ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছি। ও খুব নিপুণ হাতে উড়না ঠিক করে সোফায় মিলিটারি ভংগিতে সটান হয়ে বসে। আমি একটা জিনিস খেয়াল করেছি, সোফায় বসে থাকা কেউ যদি সটান উঠে সমকোণ টাইপের জ্যামিতিক ভঙ্গিতে বসে, তাহলে নির্ঘাত সে খুব গুরুত্বপূর্ণ (অন্তত, তার নিজের কাছে) কিছু বলতে যাচ্ছে। অতএব, আমিও মনযোগী শ্রোতার মত অপেক্ষা করতে থাকি।

“প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা আমাদের গলিতে একটা লোক হটপেটিস বিক্রি করতে আসতো। ঠিক মনে নেই, কবে থেকে, কিন্তু, ছোটবেলায় আমি আর ভাইয়্যা পড়তে বসতাম, আর দোতলা থেকে শুনতে পেতাম, লোকটা গলির মধ্য দিয়ে ধীরপায়ে হেঁটে যাচ্ছে আর ডাকছে, ‘হট পেটিস! গরম পেটিস! খাওয়ার পেটিস!’ আমি আর ভাইয়্যা দুইজনই খুব হাসাহাসি করতাম লোকটার খাওয়ার পেটিস কথাটা শুনে। পেটিস তো খাওয়ারই হবে! অন্য আর কি পেটিস হবে, বলেন?” এতটুকু বলে মেয়েটা হাসলো। হাসলে ওকে সুন্দর দেখায়। এইটা অবশ্য খুব কমন আর ক্লিশে কথা হয়ে গেলো, কিন্তু এটাই সত্যি, হাসলে ওকে একটু বেশিই সুন্দর দেখায়।
চুলগুলো সরিয়ে ও আবার বলতে লাগলো, “অবশ্য, খাওয়ার পেটিস বলে ডাক দেয়ার একটা কারণ আছে। আমরা তখন এমন এক এলাকায় থাকতাম যে আমাদের আশেপাশে বেশিরভাগই একদম সমাজের প্রান্তিক শ্রেণীর ফ্যামিলি। রিকশাওয়ালা, গার্মেন্টসে কাজ করে, জুটমিলে কাজ করে এই টাইপ। এরা হয়তোবা শুধু পেটিস শুনে বুঝতো না যে এটা কি খাওয়ার জিনিস কিনা! লোকটা নিশ্চয়ই আমাদের গলিতে আসলে কিছু বিক্রি-বাট্টা করতে পারতো। এই জন্যই নিয়ম করে ঐ সময়টাতেই চলে আসতো। এরকম ভাবে বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর একদিন কেন জানি আমার ঐ লোকটাকে দেখতে ইচ্ছা করে। আমি লোকটা আসতেই দৌড়িয়ে বারান্দায় চলে গিয়েছিলাম লোকটাকে দেখার জন্য! ভাইয়্যা দেখে জিজ্ঞেস করেছিলো, প্যাটিস খাবি? আমি হ্যাঁ বলতেই ও বের হচ্ছিলো প্যাটিস কিনার জন্য। কিন্তু, আমাদের তখন ক্ল্যাসিক্যাল বাঙালি হায়ার মিডল ক্লাস টাইপ ফ্যামিলি! আমাদের বাসায় দু-তিন রকমের বিস্কিট থাকে, সন্ধ্যায় নিয়ম করে আমাদের চা খাওয়া হয়, আম্মুও এটা-সেটা বাইয়ে দেয় প্রায় প্রত্যেকদিনই। এরকম সন্ধ্যাকালীন খাদ্যাভাসের মধ্যে বাইরের ৫ টাকা-১০ টাকার প্যাটিসের জায়গা থাকার কথা না। তাই ভাইয়া বেরোতে নেয়ার সাথে সাথেই আম্মু এক ধমকে ভাইয়্যা কে নিরস্ত করে! আমারও আর প্যাটিস খাওয়া হয়নি ঐদিন।”

আমি মেয়েটার কথা বেশ মনযোগ দিয়েই শুনছি। কিন্তু, হঠাত করেই আমার এখন প্যাটিস খেতে ইচ্ছে করছে। ঢাকার বেকারী গুলোতে কি এখনও প্যাটিস বিক্রি করে? স্টার, ডিসেন্ট, আনন্দ, আলাউদ্দিন- পুরান ঢাকার সব বেকারীতেই তো এগুলো পাওয়া যেত। আমার অবশ্য খেতে খুব একটা ভালো লাগতো না। কিন্তু, এখন খুব খেতে ইচ্ছে করছে।

“এভাবেই আমি বড় হতে লাগলাম। স্কুল পেরিয়ে একসময় কলেজেও উঠলাম, সন্ধ্যাবেলায় মাগরিবের পরই পড়তে বসতে হবে এমন নিয়ম আর এখন আমার উপর প্রযোজ্য না। আমি এখন সন্ধ্যা বেলায় দিব্যি আম্মুর পাশে বসে সিরিয়াল দেখে টেখে ইচ্ছে হলে পড়তে বসতে পারি! আব্বুর মোবাইল নিয়ে গুঁটুর গুঁটুর করতাম, গল্পের বই পড়তাম। সন্ধ্যাবেলায় কেন যেন কিছুতেই পড়তে বসতে আর ভাল্লাগতো না। কিন্তু, ঐ প্যাটিসওয়ালা কিন্তু তখনও নিয়ম করে আসতো। আমিও যা-ই করতে থাকি না কেন, কান খাড়া করে তার সেই চিরপরিচিত ডাক শুনতাম। যতক্ষণ শোনা যেত, আমি সব কাজ বন্ধ করে, তার হট প্যাটিস ডাক শুনতাম। কেন জানিনা এটা আমার একটা অভ্যাসই হয়ে গিয়েছিলো। আমার ভাল্লাগতো।”

আমি এখনও প্যাটিসের কাহিনী কিচ্ছু ধরতে পারছি না। ওর কি প্যাটিস খেতে ইচ্ছে করছে? নাহ, মেয়েরা কোন ইচ্ছের জন্য এত বাক্যব্যায় করে না। আর, আমি তো বুঝতেই পারছি ও সিরিয়াস কিছু বলবে। আচ্ছা, ওর কি ঐ প্যাটিসওয়ালা ব্যাটার সাথে প্রেম-টেম হয়ে গিয়েছিলো নাকি? হলি শিট!

“একদিন আব্বু অফিস থেকে ফিরেই হই-চই শুরু করে দিলো। পাম্প ছেড়ে পানি উঠাতে গিয়ে অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরও ট্যাংক ফুল না হওয়াতে নিচে গিয়ে দেখে কিছুদিন আগে বসানো সাবমার্সিবল পাম্পটা চুরি হয়ে গিয়েছে! আমি তো আপনাকে বলেছিই, আমার আব্বু ভীষণ বদমেজাজি ছিলো। শুরু হয়ে গেলো আব্বুর চীৎকার-চেঁচামেচি! এরপর তো আমরা সবাই, এমনকি ভাড়াটিয়ারাও সবাই বের হয়ে আসলো! আব্বু গোয়েন্দার মত হম্বি-তম্বি করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলো। সন্ধ্যার পর কে কে বাসায় ঢুকেছিলো জিজ্ঞেস করাতে জানা গেলো নিচতালার আন্টিরা নাকি প্যাটিসওয়ালাকে ভেতরে নিয়ে এসে ৪ টা প্যাটিস কিনেছিলেন। এই কথা শুনেই তো আব্বুর মাথা খারাপ। ওখানেই প্যাটিসওয়ালাকে গালাগালি শুরু। সেইসাথে, নিচতালার আন্টিদেরও। আমি খুব বিব্রত অবস্থায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পরে নিজের রুমে, বারান্দায় চলে আসি। আমার প্যাটিসওয়ালার কথা মাথায় ঘুরছিলো শুধু এই সময়। কয়টা টাকাই বা লোকটা বিক্রি করে বলেন তো? খুব বেশি হলে পাঁচ-ছয়শো টাকা! এর মধ্যে হয়তো লাভ থাকে কেবল এক-দেড়শো টাকার মত। এই দিয়েই লোকটার জীবন চালাতে হচ্ছে হররোজ। আমার তখন মনে হচ্ছিলো, আম্মু খেতে দিক আর না দিক, আমি তো চাইলেই প্রতিদিন দু-একটা প্যাটিস কিনতে পারতাম লোকটার থেকে! আমার কাছে তো ভালোই টাকা থাকতো। লোকটার ইনকামে একটু হলেও আমি কনট্রিবিউট করতে পারতাম!”

আমি ওর দুই চোখে হারিয়ে যাওয়া অতীত আর ফেলে আসা কোন সুযোগের জন্য বিষাদটা টের পাই!

“পরেরদিন ছিলো শুক্রবার। প্যাটিসওয়ালা সন্ধ্যায় আসতেই আব্বু, নিচতালার আংকেল, তিনতালার মামারা সবাই মিলে উনাকে ধরে। এরপর দু-এক মিনিটও ভালোমত জিজ্ঞেস টিজ্ঞেস করে না, মার শুরু করে দেয় তারা। সে কি মার। আমি অবশ্য দেখিনি, কিন্তু, আম্মুর কাছে শুনেছি, লোকটার নাক-মুখ দিয়ে নাকি রক্ত বেরোচ্ছিলো। লোকটা নাকি মার খেতে খেতেও তার প্যাটিসের টিনের বাক্সটা আগলে রেখেছিলো। আব্বুরা সেটাও কেড়ে নিয়ে প্যাটিসগুলো সব মাটিতে ফেলে দেয়। ধস্তাধস্তি তে লোকটার শার্ট ছিড়ে যায়। লোকটা হতবিহবল হয়ে যখন চলে যাচ্ছিলো, তখনও নাকি আমাদের বাসাটার দিকে তাকিয়ে ছিলো।”

আমি চুপ করে আছি এখনও। গল্পটা নিশ্চয়ই শেষ হয়ে যায়নি! ও কাঁদতে লাগলো। আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে জিজ্ঞেস করলাম, “এরপর কি হয়েছে শান্তা?”

“এরপর প্রত্যেকদিন আমি অপেক্ষা করতাম সন্ধ্যাবেলায় কখন প্যাটিস নিয়ে লোকটা আসবে। কিন্তু কোনদিন আসেনি। আমার মনে হয়েছিলো, লোকটা বোধহয় রাগ করেই আমাদের গলিতে আসে না। অন্য গলি দিয়ে চলে যায়। আমার এক দুঃসম্পর্কের চাচাতো ভাই থাকতো পরের গলিতে। ওকে বলেছিলাম প্যাটিসওয়ালা আসে কিনা পুরো এলাকায় সন্ধ্যাবেলা ঘুরে এসে আমাকে জানাতে। কিন্তু, না। প্যাটিসওয়ালা আর কোনদিনই আমাদের এলাকায় আসেনি।

আমি অনেক অপেক্ষা করেছি লোকটার সাথে দেখা হওয়ার জন্য! শুধু একবার যদি লোকটা আসতো, আমি উনার কাছ থেকে দুইটা প্যাটিস কিনতাম। ২০ টাকার জায়গায় হয়তো একটু বেশিই দিতাম! তারপর তাকে গিয়ে সত্যিটা বলতাম। আমি আসলে জানতাম পাম্পটা কে চুরি করেছিলো। ঐ লোকটা চুরি করেনি। ভাইয়্যা তখন নেশা শুরু করেছিলো। ও-ই পাম্পটা চুরি করেছিলো। আমি নিজ চোখে দেখেছি। ভাইয়্যাকে নিয়ে আব্বুর সামনে কিছু বলতে পারিনি ঐদিন। জানেন, আমি এখনো সেই বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছি। লোকটাকে শুধু যদি সত্যটা বলতে পারতাম! আব্বু-আম্মুকে আমার বলতে ইচ্ছে করেনি কোনদিন। শুধু ঐ লোকটাকেই খুঁজেছি সত্যটা জানানোর জন্য। তাকে পেলে বলতাম, যেই বাড়ির দিকে আপনি ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে চলে গিয়েছিলেন, ঐ বাড়ির একটা মানুষ হলেও জানে, আপনি পাম্পটা চুরি করেননি। ”

শান্তা উড়না দিয়ে চোখ মুছলো। আমার দিকে তাকালো। আমাকে কি ও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে? ওর দৃষ্টি স্পষ্ট কিনা কে জানে, কিন্তু, ওর কন্ঠ একদমই স্পষ্ট শোনালো, “আমি আর আপনার এখানে কখনোই আসবো না। ভেবেছিলাম, সোহেল দেশে চলে আসলেই ওকে সব বলে দিবো। কিন্তু, সুনার দ্যা বেটার। আমি আজকেই ফোনে ওকে সব বলে দিবো। এরপর যা হওয়ার হবে। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন প্লিজ। আমি আর কোনকিছু লুকানোর মত শক্ত মেয়ে নই। আমি আর কোনকিছু লুকানোর মত বোকা মেয়েও নই।”

তারপর শান্তা খুব স্বাভাবিকভাবেই আমার রুমের দরজা খুলে চলে গিয়েছিলো।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
রেজওয়ানা আলী তনিমা গল্পটা বেশ ভালো লাগলো, কিন্তু কিছু প্রশ্ন রেখে গেল।যেমন শান্তার সাথে কথকের সম্পর্কটা কি?''... ভেবেছিলাম, সোহেল দেশে চলে আসলেই ওকে সব বলে দিবো। কিন্তু, সুনার দ্যা বেটার। আমি আজকেই ফোনে ওকে সব বলে দিবো। এরপর যা হওয়ার হবে। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন প্লিজ। আমি আর কোনকিছু লুকানোর মত শক্ত মেয়ে নই। আমি আর কোনকিছু লুকানোর মত বোকা মেয়েও নই।” এই অংশটা স্পষ্ট করা উচিত ছিল। অনেক শুভেচ্ছা রইলো।
কেতকী শেষ হইয়াও হইলো না শেষ, বোধ'য় এমন গল্পের কথা ভেবেই বলা । ভালো লাগা গল্পে ভোট রইল।
মোহাঃ ফখরুল আলম ভাল লেগেছে। ভোট দিতে মন চায়। আমার কবিতা পড়ার আমন্ত্রণ রইল।
ফেরদৌস আলম এত মারাত্মক ভালো একটা গল্পে এত কম কমেন্ট , এত কম রেসপন্স ! দুঃখজনক! কিন্তু আমার কাছে এই গল্পটি অত্যন্ত উঁচু মানের এটি সার্থক ছোটগল্প ! অনেক অনেক ভালো লাগলো। সামনে লেখকের আরো ভালো গল্পের অপেক্ষায় থাকলাম !
ইমরানুল হক বেলাল সন্তোষজনক একটি আত্মজীবনী গল্প। ভালো লাগলো। ভোট দিয়ে গেলাম। আমার পাতায় আমন্ত্রন।
রুহুল আমীন রাজু বেশ ভালো লাগলো গল্পটি....শুভেচ্ছা.
গোবিন্দ বীন ভাল লাগল,ভোট রেখে গেলাম।আমার কবিতা পড়ার আমন্ত্রন রইল।

০৬ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪