রোদসীর চোখে জল

২১শে ফেব্রুয়ারী (ফেব্রুয়ারী ২০১২)

আফরোজা অদিতি
  • 0
  • ৪৩
অমর একুশে গ্রন্থমেলায় চার শ'র বেশী স্টল থাকে প্রতিবছর। প্রতিবছরের মতো এবারেও একাডেমী প্রাঙ্গনের বাইরে আণবিক শক্তি কমিশন থেকে পুষ্টিভবন পর্যনত্দ রাসত্দার দুই পাশেও স্টল বরাদ্ধ দিয়েছে বাংলা একাডেমী। স্টলগুলোর কোনটা এক ইউনিট, কোনটা দুই ইউনিট, কোনটা তিন ইউনিট হিসেবে প্রকাশকদের বরাদ্ধ দেয় বাংলা একাডেমী। এই স্টলগুলোর সাজ, বইয়ের বিকি-কিনি, বইয়ের প্রচার এবং পুরাতন বইয়ের সঙ্গে নতুন বইয়ের আবেদন সবসময়ই ভালো লাগে রোদসীর। নতুন বইএর গন্ধ না পেলে, সারা্ বছর; বিশাল এক শূণ্যতা ঘিরে রাখে ওকে। প্রতিদিন বইমেলায় না এলে ভালো লাগে না কিছুই। মেলায় নতুন বইয়ের গন্ধ তো আছেই, আছে লেখক পাঠকের মেল-বন্ধন। মেলায় এলে অনেক মানুষের মনের ভাব, তাদের বই সম্পর্কে চিনত্দা চেতনা, বইয়ের প্রতি ভালোবাসা সব জানা যায়। মানুষের রং রূপ জীবন সম্পর্কেও জানা যায়। রোদসীর এ-সবই প্রিয় থেকে প্রিয়তর। প্রিয় একুশে ফেব্রম্নয়ারী, প্রিয় প্রভাতফেরী, প্রিয় শহীদমিনার, প্রিয় এই সবুজ বাংলাদেশ।

আজ একুশে ফেব্রম্নয়ারী। আনত্দর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে একাডেমীতে ঢুকেছে রোদসী। কবিতা মঞ্চের কবিতা পাঠ শুনেছে কিছুৰণ। কবিতা শুনতে, পাঠ করতে ভালো লাগছে না আজ। অথচ প্রতিবছর এই মঞ্চের কবিতা না শুনলে, কবিতা না পড়লে ওর মন ভালো থাকে না। 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারী/ আমি কি ভুলিতে পারি'-রোদসী গুনগুন করলো কিছুৰণ, কিন্তু মন থেকে সজীবের আজকের বলা কথাগুলো তাড়াতে পারলো না। একাডেমী চত্তরে ঘুরলো, তথ্যকেন্দ্রের সামনে সিড়িতে বসলো। নাহ! কিছুতেই মনটাকে ভালো করা যাচ্ছে না, কোন কিছুতেই মনও দেওয়া যাচ্ছে না।

সময়ের মতো সময় গড়াচ্ছে। কোন কিছুতেই মন দিতে পারছে না তো পারছেই না রোদসী। মন ভাঙা এক ভালোলাগা নিয়ে একাডেমীর বটতলা নজরম্নল মঞ্চের পাশের এক ইউনিটের এক স্টলে আনমনা বসে আছে রোদসী। রোদসীর রক্তের মধ্যে ভাষাযুদ্ধ, রক্তের মধ্যে লেখা। লেখা তার প্রাণ। লিখে আনন্দ পায় সে। লেখা আর বই ওর নেশা। প্রতিবছর একুশে গ্রন্থমেলায় বই বের না হলে ভালো লাগে না ওর। যে বছর বইমেলাতে বই বের না হয়, সে বছর মনে হয়, জীবন তো একটাই আর ছোট্ট এই জীবনের অনেক কাজের মধ্যে একটা কাজ বাঁকি রয়ে গেলো এবার।

ছাত্র জীবনে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলো রোদসী। পরবর্তীতে রাজনীতিবিদদের দলাদলি, কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির জন্য রাজনীতি থেকে সরে এসেছে। ছেড়ে দিয়েছে রাজনীতি, সেই সঙ্গে ছেড়ে দিয়েছে রাজনৈতিক লেখালেখিও। এখন গল্প, কবিতা, উপন্যাস লিখছে, লিখছে শিশুদের জন্যও। এবারে নতুন বই এসেছে ৪টা। ২টা শিশুতোষ ছড়া ও গল্প, ১টা প্রেমের কবিতা, ১টা উপন্যাস।

বই বের করেছে প্রথা প্রকাশন। সেই স্টলেই বসে আছে রোদসী। স্টল সুন্দর করে সাজিয়েছে প্রকাশক। নারী প্রকাশক। প্রকাশক, নারী হলেও বেশ চটপটে কর্মতৎপর। খাটতে পারে, খাটাতেও পারে। প্রকাশনীর বয়স মাত্র ছয় বছর। এরই মধ্যে তার প্রকাশনীর বই এর সংখ্যা ১০০০ ছাড়িয়ে গেছে। রোদসীর বই ভালো যাচ্ছে তবুও বিষন্নতা কাটছে না।

আজ সজীবের ব্যবহার ওর বুকের ভেতরে জল ঝরিয়ে যাচ্ছে অনবরত। ভুলতে চেয়েও ভুলতে পারছে না। সজীবের ব্যবহারে আনত্দরিকতার অভাব আছে মনে হয় নি কখনও কিংবা সজীবকেই বুঝতে পারে নি ও। ওর ব্যবহারে আনত্দরিকতা দেখেছে, দেখেছে ভালোবাসাও। ওরা দু'জনে, যে যে-কাজে আনন্দ পায় তাতে বাধা দেয় নি কেউ কখনও। কিন্তু আজকে সজীবের আচরণ বিবর্ণ, বিদীর্ণ, ছিন্ন-ভিন্ন করে দিয়েছে ওকে। এতোদিনের সজীব সম্পর্কে ধারণা পাল্টে গেছে। এমন বর্বর, রাজাকারটাইপ ব্যবহার সজীব করেতে পারে, এখনও বিশ্বাস করতে মন চাইছে না ওর। ওদের সম্পর্কের ভাঙন যে এতোটাই গভীর ওর চিনত্দাতেই আসে নি কখনও। কবে, কখন যে সম্পর্কে ভাঙন ধরেছে আজকের আগে টেরই পায় নি রোদসী। ও বিশ্বাস করে মানুষ যখন প্রয়োজনে একে অন্যের কাছাকাছি থাকে তখন সেই থাকাটা হয়ে যায় অভ্যাস। সেই সঙ্গে অভ্যাস হয় ভালোবাসা, পুরানো হয় সম্পর্ক। তবে দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্কের ভিতও হয় মজবুত, তখন ভালোবাসাকে আর অভ্যাস মনে হয় না। কিন্তু আজ ওর মনে হচ্ছে ওদের সম্পর্কের ভিত ভঙ্গুর শুধু নয়, সম্পর্কের ভিতই নেই! ভালোবাসাও নেই! কবে থেকে নেই? নিজেকেই প্রশ্ন করে রোদসী। উত্তর পায় না।

সব শূণ্য আজ। সজীব যে ওর লেখালেখি আর শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া সম্পর্কে এমন রাবিশ মনত্দব্য করবে ওর ধারণার বাইরে। সজীব জানে, লেখালেখি ছাড়া এক মুহূর্ত বাঁচতে পারবে না রোদসী। মাছ যেমন ডাঙায় তুললে নিশ্চুপ হয়ে যায়, লেখা থেকে বিচ্ছিন্ন হলে ওর অবস্থাও তাই। লেখা ভালো কী মন্দ এ বিচার পাঠকের, এ বিচার ভবিষ্যতের। এ বিচার লেখকের নয়। তা ছাড়া এক লেখকের সব লেখা ভালো হবে কিংবা সব লেখা যে পাঠকের ভালো লাগবে তাও নয়। কারণ ভালো লাগাটা আপেৰিক ব্যাপার। এ কথাও সজীবকে আগেই বলেছে, অনুরোধ করে বলেছে লেখা নিয়ে সমালোচনা করতে পারো, কিন্তু কোন বাজে মনত্দব্য যেন কখনও না করে। তবুও সজীব মেলায় আসার মুহূর্তেই অশস্নীল মনত্দব্যের সঙ্গে বলেছে, রোজ রোজ মেলায় গিয়ে কী লাভ তোমার। তোমার লেখা কী কেউ পড়ে! আজেবাজে ছাইপাশ লেখো, আর মানুষের কাছে ফেরি করো। আসলে, তুমি মেলায় যাও লোক দেখতে, নিজেকে দেখাতে। আজ থেকে বই লেখা বন্ধ, তুমি মেলাতেও যাবে না। আর মিনারে ফুল দেওয়ার নামে অন্য মানুষের ছোঁয়া পাওয়ার লোভ, তা না হ'লে ওই পূজা দিতে যায় কেউ।

সেই ছোটবেলা থেকে শহীদমিনারে ফুল দিয়ে আসছে, প্রভাতফেরীতে গান গেয়ে আসছে রোদসী। এ ধরণের মনত্দব্য কখনও শুনতে হয় নি। রোদসী এতোটাই অবাক হয়েছিলো সজীবের কথায়, ওর মুখে জবাব দেওয়ার মতো কোন কথা জোগায় নি। কোন কথা না বলে দরোজা খুলতেই গায়ে হাত তুললো। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো, সোফায় লেগে কপাল কেটে গেলো। ওর গায়ে হাত তোলার ব্যাপারে প্রতিবাদ করতেই বললো, আর সম্পর্ক নেই তোমার সঙ্গে। এতোদিনের সম্পর্ক এক কথায় ছিন্ন হবে? এ কেমন কথা!

ও চুপচাপ বসে তাই ভাবছিলো। ওর সঙ্গে সম্পর্ক নেই, এর অর্থ কী! লেখালেখি ছাড়া অন্য কোন কারণ! যা, ও জানে না। সজীব কী তা'হলে অন্য কোন নারীতে আসক্ত, যা ভাবে নি কখনও। এমন তো মনে হয় নি কখনও! ও কি এতোটাই নির্বোধ, বুঝতে পারে নি স্বামীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা, স্বামীর চরিত্র। তাছাড়া এই পঞ্চাশ পেরোনো জীবনে এসে সম্পর্কের ভাঙন সেতো কোন মানুষই কল্পনা করতে পারে না, পারবেও না। ও লেখালেখি করে ঠিকই তাই বলে কখনও অবহেলা করে নি, সন্দেহ করে নি সজীবকে। করার প্রশ্নও আসে নি কখনও। সজীব সম্পর্ক ভেঙে দিবে এ কথা বিশ্বাস করতে এখনও সায় দিচ্ছে না ওর মন। মনটাকে নানাভাবে বশে রাখার চেষ্টা করছে রোদসী।

হঠাৎ চোখ পড়ে নজরম্নল চত্বরের ওপাশে। দাঁড়িয়ে আছে সজীব, সঙ্গে এক মহিলা আর বছর চারের এক ছেলে। ছেলেটা দেখতে সজীবের মতো। আর মহিলাকে তো চেনে রোদসী। সজীবের এক বন্ধুর বোন, নীলা। ওদের বাড়ি এসেছেও কয়েকবার। রোদসী ডাকলো সজীবকে, ডাকলো নীলাকেও। সজীব তাকালো ওর দিকে কিন্তু এলো না। এমন কি সাড়াও দিলো না। ছেলেটার হাত ধরে এগিয়ে গেলো গেইটের দিকে। রোদসী স্টল থেকে বের হতে হতেই ওরা গেইটের কাছে চলে গেলো। দূর থেকেই দেখতে পেলো একসঙ্গেই গাড়িতে উঠছে ওরা।

সজীবের সঙ্গে কী সম্পর্ক নীলার ? নীলার স্বামী বিদেশে অন্য এক মেয়েকে বিয়ে করেছে, তা জানে রোদসী। বছর পাঁচেক সজীব এখানে-ওখানে যাওয়ার নাম করে মাঝে মাঝেই রাতে বাড়ি ফিরে না। তার কারণ কী তবে নীলা? এ কথা ভাবতেও মন সায় দিচ্ছে না। নিজের চোখকে অবিশ্বাস করতে ইচ্ছা হচ্ছে ওর। সম্পর্কের এই ভাঙন কল্পনাও করে নি রোদসী। বুকের ভেতর মরম্নভূমির ধু ধু তপ্ত বালুর হল্কা চোখে-মুখেও ছড়িয়ে যাচ্ছে। শুকনো চোখে তাকিয়ে থাকে ওদের চলে যাওয়া পথের দিকে। সজীব জানে ও মেলায় আছে, তারপরেও এসেছে, তাহলে ওকে কি জানিয়ে গেলো সজীব, ওর অন্য আর এক জীবনের কথা, যা ওকে জানায় নি এতোদিন। সজীব, তুমি কাজটা কী ভালো করলে! কাজটা ভালো করলে না সজীব !

এই মুহূর্তে রাতুলকে মনে পড়ছে। রাতুল থাকলে রাতুলের ছেলে মেয়ে নিয়েই দিন কেটে যেতো! রাতুল থাকলে এমন লাগতো না আজ। রাতুল যখন হারিয়ে যায় তখন ওর বয়স পনেরো পুরো হয় নি। কতো বিজ্ঞপ্তি কতো খুঁজাখুঁজি পাওয়া যায় নি। রাতুল ফিরে আয়, ফিরে আয়। হাহাকার ওঠে বুকের গভীরে। রাতুলের মায়াবি চেহারা ভেসে ওঠে বুকের মাঝে। বুকের ভেতর টলটল জলের ওপর ভাসতে থাকে রক্তজবার মতো রাতুলের মুখ। চোখে জল এসে যায়।

প্রকাশক মেরিনা তৌহিদ স্টলে ঢুকে বললো, আপা, আপনার বই তো ভালো যাচ্ছে, তা'হলে আপনি কেন এমন বিষন্ন, এমন চুপচাপ বসে আছেন!
ওকে কিছুই বলতে পারে না রোদসী। সবাইকে কি সব কথা বলা যায়! যায় না। আসত্দে বললো, আজ আমার কিছুই ভাল লাগছে না মেরিনা ।

মেরিনা, ওর মুখের দিকে চেয়ে বলে না কিছু। অন্য ক্রেতাদের দিকে নজর দেয়। আজ মেলায় ভীড় খুব বেশী না হলেও কম বলা যাবে না। স্টলের সামনেও দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন। রোদসী হঠ্াৎ খেয়াল করে সামনে দাঁড়িয়ে এক কিশোর দেখছে ওকেই। ছেলেটার দিকে চাইতেই সমুদ্রের বিশাল ঢেউ ভেঙে পড়লো ওর মন-প্রাণ-হদয়ে। শ্যামল রঙের, টানা টানা চোখের লম্বা ছেলে। কোকড়া চুল। হাতের পর হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখেই রোদসীর মনে হয় রাতুলই এসে দাঁড়িয়েছে স্টলে। অনেকৰণ তাকিয়ে থাকে রোদসী। গায়ের রং ছাড়া রাতুলের সঙ্গে বদল করা যায় ছেলেটাকে ।

রাতুল,এই ছেলেটার বয়সেই সমুদ্রের শহর কঙ্বাজারে গিয়ে আর ফিরে আসে নি। খুব দুষ্ট ছিলো, কিন্তু লেখাপড়ায় ভালো। স্কুলের সব টিচারের পছন্দের ছাত্র ছিলো, স্কুলেরও। সহপাঠিরা ভালোই বাসতো রাতুলকে। এস.এস.সি. দেওয়ার পর ছাত্র শিৰক সকলে মিলে গিয়েছিলো কঙ্বাজার। সহপাঠিরা ফিরে এসেছিলো, ফিরে এসেছিলো শিৰক, শুধু ফেরে নি রাতুল।

ছেলেটার ভঙ্গি একেবারে রাতুলের মতো। রাতুল যেমন কোন প্রশ্ন করার ইচ্ছা হলে চোখের পলক ফেলতো বারবার আর ঠোঁট দুটো কথা বলার জন্য ফাঁক করে রাখতো। ওকে দেখেই রোদসী বুঝতো কিছু বলবে রাতুল। কিছু বলবে রাতুল ? প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গেই কথার ফুলঝুরি ছুটিয়ে দিতো রাতুল। সারাদিনের জমানো কথা এক নিঃশ্বাসে বলেই তবে শেষ।

ছেলেটিও সেইরকম। ওকে দেখেই বুকের ভেতরের জলের প্রবাহ দ্বিগুন হয় রোদসীর, ওর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে। কিছু বলবে ? একটু দ্বিধা করেই ভেজা কন্ঠে প্রশ্ন করে রোদসী ।
প্রশ্ন করেই নিজেই অবাক। অনেক দিনের পুরানো স্মৃতি আর স্মৃতি থাকে না, বর্তমান হয়ে ওঠে। প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা কথা বলতে শুরম্ন করেলো ।
আপনি কোথায় থাকেন , খুব চেনা লাগছে। আপনার কয়টা বই বের হয়েছে। আমাকে দেন, পড়বো।
জল-চোখে হেসে ফেলে রোদসী। তাই ! তোমাকেও চেনা লাগছে। আমার বই আগে পড়েছো!
হঁ্যা, পড়েছি। আপনি কোথায় থাকেন?
আমি মালিবাগ। তুমি কোথায়?
আমি, এখানে বেড়াতে এসেছি। মালিবাগে আমার এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেছি। ছেলেটা জবাব দেয়।
তোমার গ্রামের বাড়ি কোথায় ?
আমার গ্রামের বাড়ি কোথায় তা তো জানি না।
আমি, আর আমার বাবা,নানীর সঙ্গে পাবনাতে থাকি।
বাবার বাড়ি যাও না ?
বাবার বাড়ি তো চিনি না। আমার জন্মের আগেই এক অ্যাকসিডেন্টে আমার বাবার স্মৃতি হারিয়ে যায়।
আগের কোন কথাই মনে করতে পারেন না। কোথায় বাবার বাড়ি, কে বাবার মা, কে বাবা কিছুই জানি না। কোনো আত্নীয়স্বজন আছে কিনা তাও জানি না। আমার মা, আমার জন্মের সময় মারা যায়। নানুর বয়স হয়েছিলো, আর মামা গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে।
দুঃখ পায় রোদসী। আহা! এমন সুন্দর ছেলে, ওর এক নানী ছাড়া কেউ নেই! রোদসীর চোখে জল এসে যায় আবারও।

আচ্ছা চলি। আপনাকে অনেক আপন মনে হচ্ছে। ভালও লেগেছে। আমাদের বাসায় আপনার মতো দেখতে কিন্তু বয়স কম একজনের ছবি আছে। জানি না কার ছবি ? বাবার মানিব্যাগ থেকে ওটা পেয়েছিলেন আমার নানু। বাবা ভালো থাকলে হয়তো বলতে পারতেন কার ছবি। আচ্ছা চলি।

রোদসীর আরও কিছুৰণ ছেলেটার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছিলো। কিন্তু নতুন পরিচয়ের একটা ছেলের সঙ্গে ব্যক্তিগত এতো কথা বলাটা ঠিক মানায় না। ছেলেটার যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে রোদসী। ওর চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ডাকতে ইচ্ছা করলো ছেলেটাকে। কিন্তু ওর নাম? নামতো জানা হয় নি! ও কি ওকে রাতুল নামে ডাকবে! না কি ডাকবে এই ছেলে শোন। কিন্তু ছেলেটাকে ডাকতে গিয়ে মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, এই রাতুলের ছেলে ! রোদসী, রাতুল না ডেকে ডাকলো রাতুলের ছেলে বলে। ছেলেটাকে ডেকে নিজেই আশ্চর্য হলো রোদসী। আরও আশ্চর্য হলো যখন দেখলো, ছেলেটাও পেছন ফিরলো, কাছেও এলো!
আপনি বাবার নাম জানলেন কী ভাবে ?
এবার আশ্চর্য হওয়ার পালা রোদসীর। তোমার বাবার নাম রাতুল।
হ্যাঁ। বাবার পকেটে ক্লাসের আইডি কার্ড ছিলো, সেটা থেকেই জানা গিয়েছিলো বাবার নাম, রাতুল। বাবার অবশ্য মনে নেই।
তোমার বাবা কি করে ?
তেমন কিছু না। নানুর জমি আছে, তিনটা বাড়ি আছে। এসব দেখাশুনা করে। বাবার তো কিছু মনে নেই। ক্লাসের যে আই.ডি কার্ড ছিলো তা থেকে জানা যায় দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন তখন বাবা। বাবাকে কঙ্বাজার গিয়ে পেয়েছিলেন আমার নানু। নানু, নানী মা আর মামাকে সঙ্গে নিয়ে সাগরে গিয়েছিলো বেড়াতে, তখন এক বিকেলে বাবাকে পেয়েছিলেন ঝাউবনের ভেতর। মাথায় আঘাত ছিলো বাবার। শরীরেও জখম ছিলো অনেক। বাবা, প্রায় এক বছর কোমাতে ছিলেন। বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে, আইডি কার্ড নিয়ে কলেজে গিয়েছিলেন নানু, ওখানে যে ঠিকানা ছিলো, সেই ঠিকানায় খোঁজ করে পাওয়া যায় নি কাউকেই। ওখানে, তখন নতুন বিল্ডিং হচ্ছিলো। হারানো বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছিলেন নানু।

রোদসীর মনে পড়ে, ওরা ওই বাড়ি ছেড়ে দিয়ে অন্য বাড়ি ভাড়া নিয়ে চলে এসেছিলো। রাতুলের স্মৃতি তাড়া করে ফিরছিলো। কিছুতেই থাকতে পারছিলো না। রাতুল হারিয়ে যাওয়ার পরদিনই অসুস্থ হয়ে পরেছিলো , হাসপাতালে ছিলো ছয়মাস। তারপর ডাক্তারের নির্দেশে হাসপাতাল থেকেই নতুন বাড়ি। খবরের কাগজ দেখা হয় নি তখন।

রোদসী হঠাৎ কী মনে করে ছেলেটাকে বলে, তোমাদের বাড়ি নিয়ে যেতে পারবে আমাকে।
আপনি যাবেন ! অবাক হয় ছেলেটা।
হ্যাঁ, আজই এখনই।
ছেলেটা আরও অবাক। বলে, আমি তো কয়েকদিন পর যাবো।
কয়েকদিন পর ! সেতো অনেক দেরী !
রোদসীর চোখের কোলে জল চকচক করে। ছেলেটা, রোদসীর দিকে চেয়ে কী ভাবলো কে জানে। বললো, ঠিক আছে, কাল সকালে নিয়ে যাবো। আপনি রেডি থাকবেন।

পরদিন ভোর পাঁচটা। কলিংএর আওয়াজ। দরোজা খুলে দেয় রোদসী। আনন্দের নিঃশ্বাস ফেলে বলে, এসেছো তুমি। আমি ভাবলাম আসবে না।
কেন আসবো না ! আমারও বাবার সবকিছু জানা প্রয়োজন।

সজীব বাড়ি আসে নি। আসবেও না কখনও। মেলা থেকে ফিরে একটা খাম পেয়েছে টেবিলে। খামে একটা দলিল আর একটা চিরকুট। চিরকুটে লেখা 'রোদসী, আমি এখন থেকে নীলার সঙ্গেই থাকবো, মাঝে মধ্যে আসবো এ বাড়িতে। এই বাড়িটা তোমাকে দিলাম।' রোদসী চিরকুট পড়ে হেসেছিলো। বাড়ি! যার সঙ্গে কোন সম্পর্ক থাকবে না, তার বাড়ি, তার টাকা নিয়ে কী করবে রোদসী! সম্পর্কহীন মানুষের কাছ থেকে টাকা কিংবা সম্পদ নেওয়া ওর কাছে ভিৰাবৃত্তির মতো, যে দেওয়ার সঙ্গে ভালোবাসার স্পর্শ নেই সে দেওয়ার মধ্যে লুকিয়ে থাকে করম্নণা, দয়া। তাছাড়া, প্রেমহীন সম্পর্কের সঙ্গে এক ছাদের নিচে বসবাস ওর কাছে রৰিতার সামিল। সজীবের শিরায় শিরায় রাজাকারের রক্ত বইছে, এতোদিন বুঝতে দেয় নি সজীব, রোদসীও বুঝতে পারে নি। আজ যখন বুঝতে পেরেছে তখন কোন কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। এই ভাষার মাসে, একজন ভাষা সৈনিকের মেয়ে হয়ে নিজেকে এতেটা নিচে নামাতে পারবে না রোদসী।

এই বাড়ি নেওয়া না নেওয়ার বিষয়ে, সজীবকে কোন কথা বললো না রোদসী। ও যে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে তাও বললো না, কোন মেসেজও দিলো না। এ ফ্ল্যাটের আর একটা চাবি আছে সজীবের কাছে। না বলে গেলেও কোন অসুবিধা হবে না সজীবের। তাছাড়া এ ফ্ল্যাটে আর কোনদিন ফিরবে না রোদসী এটা নিজে যেমন জানে, তেমনি একদিন নিশ্চিত জেনে যাবে সজীব। মোবাইল করা বা না করা, মেসেজ দেওয়া বা না দেওয়ায় কিছুই আসবে- যাবে না সজীবের কিংবা ওর নিজের।




এখন অবশ্য সজীবের কথা ভাবছে না রোদসী, ভাবছে রাতুলের কথা। রাতুলকে ফিরে পাওয়ার বিশ্বাস নিয়েই ছেলেটার সঙ্গে পথে বের হয় রোদসী। যদিও রোদসীর মনের ভেতর রাতুলকে ফিরে পাওয়ার আশা ও আশংকা একসঙ্গে কুয়াসা ভাঙা রোদের মতো একটা রঙিন জগত তৈরি করেছে তবুও ওর মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে, এই ছেলেটার বাবাই ওর হারানো ছেলে রাতুল।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
sakil সাবলীল লেখা . কিন্তু aponar লেখায় ভোটিং বন্ধ দেখে হতাশ হলাম . শুভকামনা রইল
ভালো লাগেনি ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
মামুন ম. আজিজ প্রিয় বইমেলা এসেছে। প্রেম, প্রতারনা, নাটকীয়তা , রাহুলের স্মৃতিবিভ্রম, বেশ একটা আবহ সৃষ্টি করা হয়েছে। বেশ আবহটা আমার মন কেড়েছে
ভালো লাগেনি ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
আফরোজা অদিতি গল্পের পাঠক চাই .
ভালো লাগেনি ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি Khub valo golpo sarthok chchoto golpoer dhara........Afrojaditike dhonnobad.priote rakhlam....Vot bondho bole ........monta vijlona.........agamite dekha jabe.........suvokamona roilo...........
ভালো লাগেনি ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
মিলন বনিক গল্পটা ভাল লেগেছে। অনেক সুন্দর এবং আরো অনেক বিষয় মানে হচ্ছে আপনার ইচ্ছামত শেষ করতে পারেননি। অনেকটা না বলাই রয়ে গেল, শুভ কামনা থাকলো ...................।
ভালো লাগেনি ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
সবকিছু ইচ্ছামত হয় না...
ভালো লাগেনি ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
জাকিয়া জেসমিন যূথী এত সুন্দর লেখাটিতে ভোটিং বন্ধ রাখা হয়েছে কেন?
ভালো লাগেনি ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
গল্প কবিতার পাঠক প্রয়োজন , পাঠক চাই, তাই ভোট বন্ধ. ভালো লেগেছে ধন্যবাদ
ভালো লাগেনি ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
আবু ওয়াফা মোঃ মুফতি বেশ ভালো লাগলো|
ভালো লাগেনি ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
ধন্যবাদ
ভালো লাগেনি ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
মোহাম্মদ ওয়াহিদ হুসাইন . . . . . . . . . . . . . . . ভাল লেগেছে গল্পটা। আমার মনে হয়, ছেলেকে ফিরে পাওয়ার বিষয়টা আরো একটু জটিল করলে আরো ভাল হত। মনে হচ্ছে, যে কোন কারণেই হোক, আপনার ইচ্ছামত শেষ করতে পারেননি। সুভেচ্ছা জানবেন।
ভালো লাগেনি ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
শুভেচ্ছা জানবেন আপনিও ...
ভালো লাগেনি ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

০২ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ২৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪