তরী চলে যাচ্ছে।
তরীর মা বাড়ি নেই। তরীর মা, ভাগ্যলিপি গিয়েছে মায়ের কাছে। আজ তার মায়ের মৃত্যু দিবস। বাবা-মায়ের দু’জনের কবর একই জায়গায়। মায়ের মৃত্যুদিন আর বাবার মৃত্যুদিন- এই দুই দিনই ভাগ্যলিপি এখানে আসে। কবরে ফুল দেয়। ফকির-মিসকিনদের টাকা দেয়। মসজিদে মসজিদে সিন্নি দেয়। বাবা-মায়ের জন্য এটুকুই তো অবশিষ্ট আছে ওর জীবনে। তাই এইটুকু সে মন প্রাণ দিয়ে করে। এ-দিন না মেয়ে, না স্বামী কাউকেই সঙ্গে নেয় না ও।
তরীর বাবা বসে ছিলো সোফায়। ব্যাগ হাতে মেয়েকে যেতে দেখে সামনে এসে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে,
কোথায় যাচ্ছো !
আমি চলে যাচ্ছি, যাচ্ছি বাবার কাছে। ডেকেছে আমার বাবা।
তোমার বাবা ? সে আবার কে ? আশ্চর্য হয় বাবা।
মনে হয় আকাশ থেকে পড়লে! বাবাকে চিনো না, জানো না। ব্যঙ্গ ঝরে পড়ে তরীর কন্ঠে।
বিস্মিত বাবা অবাক তাকিয়ে থাকে মেয়ের মুখের দিকে। কোনমতে কিছুটা শক্তি সঞ্চয়ে কথা বলে। বলে,
তাহলে আমি কে ? এই আমি! যে আমি, তোমাকে কোলে পিঠে রেখেছি, অসুখ হলে খাই নি, ঘুমাই নি, এই আমি, তাহলে তোমার কে? আমি তোমার বাবা নই! বলো, তরী বলো।
তরী এ কথার জবাব দেয় না। কোন কথাও বলে না। ব্যাগ হাতে দরোজার দিকে এগিয়ে যায়। বাবা, মিনহাজ সরকার ব্যাকুল কণ্ঠে ডাকে,তরী যেও না। তোমার মা দুঃখ পাবে। তুমি ছাড়া আমাদের সব শূন্য তরী। তুমি যেও না।
আমি যাবোই। কেনো বাধা দিচ্ছো। বলছি না আমার বাবা ডেকেছে।
বাবা, বাবা, আর বাবা। যে তোমার জন্মের কোন খোঁজ রাখে নি, যে কখনও একটিবার দেখতে আসে নি, যে তোমার লালন পালনের ভার নেয় নি, সে তোমার বাবা হয়ে গেলো, আর এই আমি, যার এতোটা আদরে তুমি বড়ো হলে, সেই আমি তোমার কেউ নই! মিনহাজের চোখ ভিজে ওঠে। কণ্ঠে ঝরে আকুতি।
তরী ব্যাগ নামিয়ে রাখে। বলে,
আমি তোমাদের আদর যত্নে বড়ো হয়েছি বলে কিছুই বলতে চাই নি তোমাদের। কিন্তু এখন তো বলতেই হচ্ছে। তোমরা, আমাকে চাও নি! তুমি চেয়েছো মিসেস ভাগ্যলিপিকে আর মিসেস ভাগ্যলিপি চেয়েছে তোমাকে। সেইজন্য তোমরা, আমার বাবার খোঁজ করো নি। করতে চাও নি।
তোমার বাবাকে, আমরা খুঁজি নি এ কথা কে বললো তোমাকে? মিনহাজ সরকারের কণ্ঠে ঝাঁঝ ফুটে ওঠে ক্ষণিকের জন্য। তারপর আবার মনটা দুঃখে আদ্র হয়ে যায়। ভেজা কণ্ঠে বলে,
আমরা, তোমার বাবাকে অনেক খুঁজেছি, অনেক। পাই নি। নব্বইয়ের মিছিলে যারা ছিলো তারা বলেছে নূর হোসেনের গুলি, টিয়ারগ্যাস আর গরম পানি,সব মিলিয়ে মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। কে যে কোন দিকে ছিটকে যায় কেউ বলতে পারে না। তাছাড়া, সে নিজেও তো আসতে পারতো।
আসতে পারতো। কিন্তু আসবে কোথায় ? তোমার স্ত্রী তো আসার সময় ঠিকানা রেখে আসে নি। নির্বিকার কণ্ঠে কথা বলে তরী।
মিনহাজ সরকার অবাক হয়ে মেয়ের মুখের দিকে তকিয়ে থাকে। এই মেয়ে, যাকে কোলে পিঠে বড়ো করে তুলেছে। গান গেয়ে ঘুম পাড়িয়েছে। অসুখে রাত জেগেছে। খাওয়ার টেবিলে অপেক্ষা করেছে। মুখের থেকে কথা বের হওয়ার আগেই সব আব্দার পূরণ করেছে। এই মেয়েও তো এতোদিন ওকে ছাড়া বুঝতো না। তাহলে--- আজ কী এমন হলো, ও এমন ভাবে কথা বলছে!
মিনহাজ তাকিয়ে থাকে। কথা বলতে ভুলে যায়। ওদিকে তরী বলেই চলেছে।
আমার কাছে তো কিছুই লুকিয়ে রাখতে পারো নি। সব জেনে গেছি আমি। সেদিনের সেই মিছিলে তুমি গুম করতে চেয়েছিলে আমার বাবাকে। গুপ্তঘাতক লাগিয়েছিলে। বাবা ভয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছে। আমার বাবা সব বলেছে আমাকে। তুমি চেয়েছিলে মাকে। মায়ের জন্য অন্ধ হয়েছিলে তুমি।
তরী---
হাহাকার ছিটকে বের হয় মিনহাজ সরকারের কণ্ঠ চিরে। দুঃখে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যান তিনি। মেয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারছেন না। দু’চোখ ভরে উপচে পড়ছে জল। মিনহাজ সরকার, ব্যবসায়ী। ওষুধ কোম্পানী আর গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক। শহরের অভিজাত ধনী ব্যক্তিদের একজন। তার দাপটে শ্রমিকরা কাজের এতোটুকু এদিক ওদিক করে না, করতে পারে না। ওর মুখের দিকে তাকাতে তার কর্মচারীরা কয়েকবার ভাবে, দূর থেকে দেখেই পথ ছেড়ে দাঁড়ায় সেই মিনহাজ সরকার আজ মেয়ের ভুল ভাবনা, ভুল কথায় অসহায় বোধ করছে। কী করে বুঝাবেন তিনি, এ রকম ইচ্ছা তার বা ভাগ্যলিপির কখনই ছিলো না। হয়ও নি।
তরী ছাড়া কেউ নেই তার। তরীর যত্নের যাতে কোন ত্রুটি না হয় সেজন্য কোন সন্তান নেন নি তিনি। তরীকে নিজের মনের মতো বড়ো করে তুলতে চেয়েছেন। ব্যবসা চালাতে যাতে কোন অসুবিধা না হয়, সে জন্য সব রকম শিক্ষা দিতে চেষ্টা করেছেন। ওকে তো কখনও বুঝতেই দেন নি তরী ওর মেয়ে নয়। তা ছাড়া নিজেরও তো কখনও মনে হয় নি, তিনি তরীর বাবা নন।
তরীর মা, ভাগ্যলিপি যখন ক্লাস নাইনে পড়ে তখন জসিমউদ্দিন নামে একজনের সঙ্গে বিয়ে হয়। বিয়ের সময় জসিমউদ্দিন ঢাকা ইউনিভার্সিটির শেষ বর্ষের ছাত্র। পড়া শেষ করে একটা ব্যাঙ্কে চাকরি নেয়। চাকরি সে ঠিকই নেয় কিন্তু যৌতুকের জন্য বাবা আর মেয়েকে চাপ দিতে থাকে। মাঝে মধ্যে যৌতুকের জন্য তরীর গায়েও হাত তুলতে থাকে। যৌতুকের কথা বলাতে ভাগ্যলিপি ওর স্বামীকে একদিন বলেছিলো, তুমি না রাজনীতি করো, তা হলে যৌতুক চাও কেনো ? তোমরা তো সব সমাজের খারাপের বিরুদ্ধে কাজ করো, তাহলে---
স্বামী রেগে গিয়ে বলেছিলো, রাজনীতি আর যৌতুক এক হলো! তাছাড়া, রাজনীতি করলে যৌতুক নেওয়া যাবে না একথা কে বলেছে ? স্বামীর সঙ্গে কোন বাকবিতণ্ডায় জড়াতে চায় নি ভাগ্যলিপি। তাই কিছু বলে নি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। তরী যখন দুই মাসের গর্ভে তখন ঢাকা গিয়ে আর ফিরে আসে নি জসিম। খোঁজ করে জানতে পেরেছিলো, একটা বিয়ে করেছে জসিম। শ্বশুরের টাকায় চলে গেছে আমেরিকা। ভালো আছে কি নেই তা আর জানতে ইচ্ছা হয় নি ভাগ্যলিপির। খুব কষ্ট পেয়েছিলো ভাগ্যলিপি।
দেখতে দুর্গার মতো ভাগ্যলিপির বয়স তখন আঠারো। গরীব স্কুল মাস্টার বাবার, জামাতার যৌতুকের টাকা দেওয়ার মতো সামর্থ্য ছিলো না। বাবা ভাবতেন, ভাগ্যলিপির এই অবস্থার জন্য তিনিই দায়ী। অসহায়ের মতো শুধু ওর দিকে তাকিয়ে থাকতেন। বলতেন, পারলাম না রে মা, তোকে সুখী দেখতে পারলাম না।
বাবা যুদ্ধে গিয়েছিলন। যুদ্ধে তার পায়ে গুলি লাগে। পঙ্গু পা নিয়ে আবার কাজে যোগ দিয়েছিলেন ওর বাবা।
পা গিয়েছে বলে কোন দুঃখ ছিলো না মাস্টারের। দুঃখ ছিলো একটাই, যুদ্ধ তার স্ত্রীকে বোবা বানিয়ে দিয়েছিলো। তবে সে দুঃখ খুব বেশী দিন তাকে সহ্য করতে হয় নি। ভাগ্যলিপির জন্মের সময়ই মারা যান তিনি।
বাবার গুলিবিদ্ধ পায়ে যন্ত্রণা হতো আগে থেকেই, হাড্ডিতে চির ধরেছিলো। যন্ত্রণা বেড়ে যাওয়ায় অপারেশনের প্রয়োজন ছিলো কিন্তু অপারেশনের টাকা না থাকায় অপারেশন করাতে পারে নি। ওর বাবা কখনও মুক্তিযোদ্ধা ভাতা নেন নি, এই অবস্থায় ভাতা পাওয়া এবং চিকিৎসার সুব্যবস্থার জন্য মন্ত্রণালয় বরাবর দরখাস্ত করেছিলো। ভাতা পেয়েছিলো, পেয়েছিলো চিকিৎসার জন্য অনুদান। কিন্তু সে ভাতা, সে অনুদান নেওয়ার সৌভাগ্য হয় নি ওর বাবার। মেয়ের এই অবস্থাও বাবাকে আর দেখতে হয় নি। তার আগেই নিরন্তর সুখের দেশে চলে গিয়েছিলেন তিনি। মায়ের অবর্তমানে বাবাই ছিলো ভরসা, সে বাবাও চলে গেলে খুবই অসহায় হয়ে পড়ে ভাগ্যলিপি।
মা নেই, বাবাও নেই। স্বামী থেকেও নেই। বড়ো ভাই এর একটা মুদির দোকান। দুই সন্তান তার। অল্প আয়ের সংসারে ভাবী নতুন উপদ্রব মনে করে ওকে। উঠতে বসতে নানা ধরণের কথা শুনাতে থাকে। কিন্তু কোথায়, কার কাছে যাবে ভাগ্যলিপি ? শুধু তো নিজে না, সঙ্গে আছে আরেক জন।
কিছু একটা কাজ না করলে হয় না তাই নকশিকাঁথা সেলাই করে বিক্রি করতে চাইলো। কিন্তু সুবিধা করতে পারলো না। কারণ মধ্যস্বত্বভোগি। নকশিকাঁথার যে দাম হয় তার অর্ধেকের বেশীই নেয় মধ্যস্বত্বভোগি। তবুও কাঁথা সেলাই করে চলছিলো কোনরকম। কিন্তু যতো সময় এগিয়ে আসে ততো শরীরও খারাপ হতে থাকে। ভাবীও কোন কাজে ছাড় দিতে চায় না। ভাগ্যলিপিও মুখ বন্ধ করে সংসারের সব কাজ করে।
ভাগ্যলিপি যতোই মুখ বন্ধ করে থাকুক, যতোই ভাবীর কাজ করে দিক ভাগ্য ওর সহায় হলো না। এক দিনের জ্বরে মারা গেলো ভাই। ভাবী আর ওকে রাখতে চাইলো না। ভাবী বাড়ি থেকে বের করে দিতে দিতে বললো,
তুমি অপয়া! তোমার জন্মের পর তোমার মা মারা গেছে। তোমার জন্য আমার স্বামীর লেখাপড়া হয় নি, তোমার জন্য আমার ছেলে মেয়ে মানুষের কাছে যেতে পারে না। তা ছাড়া কেউ না বললেও আমি জানি, তুমি পাকি-বাহিনীর কারও একজনের সন্তান। তোমার বাবার ঠিক নেই। তোমাকে ওরা যতোই নিজের মেয়ে, নিজের বোন বলুক, আমি কখনও বলবো না তুমি বাবার মেয়ে, আর ওর বোন। এর চেয়ে ভালো হবে তুমি চলে যাও।
কোথায় যাবো ভাবী! আমি তো এই গ্রামের বাইরে কখনও যাই নি, কোন শহর বন্দর চিনি না ভাবী। তুমি আমাকে দয়া করো। ভাগ্যলিপির অনুনয়ে কোন কাজ হয় না। ওর ভাবী আরও কঠোর হয়। বলে,
শোন, চোখের পানিতে কোন লাভ নেই। তুমি বাবার মেয়ে না, এই বাড়িতে তোমার কোন অধিকারও নেই। এতোদিন খেয়েছো,পরেছো এই তো ঢের। আর কী চাও ?
বাড়ি থেকে বের করে, দরোজা বন্ধ করে দেয় ভাবী।
ভাগ্যলিপি, বাবা-মায়ের কবরে অনেকক্ষণ কাঁদলো। কিন্তু কাঁদলে কী হবে! ওরা তো কেউ ওকে স্বান্তনা দিতে আসবে না। স্বান্তনা দিতেও পারবে না। খেতে-পরতেও দিতে পারবে না তারা। বাবা-মায়ের কবরের পাশ থেকে উঠে আবার বাড়ির দরোজায় ধাক্কা দেয় ভাগ্যলিপি।
দরোজা খোল ভাবী। আমাকে, আমার বাচ্চাটা পৃথিবীতে আসা পর্যন্ত থাকতে দাও। এই অবস্থায় কোথায় যাবো আমি ?
জাহান্নামে যাও না হয় স্বর্গে যাও, যেখানে খুশি সেখানে যাও। আমার কাছে না।
ভাবী দরোজা খোলে নি। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে বের হয় ভাগ্যলিপি। সে হাঁটতে থাকে, সঙ্গে হাঁটে তার অনাগত সন্তান। হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়ায় মিনহাজ সরকারের বাড়ির সামনে।
মিনহাজ সরকারের বাবার বাড়ি। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর কেউ থাকে না। কেয়ার-টেকার আছে একজন। মাঝেমধ্যে এখানে আসে মিনহাজ সরকার।
ও আর চলতে পারছিলো না। এদিকে বৃষ্টিও নেমেছে। চুপচাপ বাইরের সিড়িতে বসে থাকে। বসে বসে একসময় ঘুমিয়ে যায়। এই বৃষ্টির মধ্যে মিনহাজ সারকারও জরুরী ব্যাঙ্ক লোন নেওয়ার জন্য বাড়ির দলিলের প্রয়োজন হওয়ায় বাড়ি এসেছে। গাড়ি থেকে নেমেই দারুণভাবে চমকে ওঠে সে!
কী জানি কী মুসিবত! ওর অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি ড্রাইভারকে ডেকে ওকে ঘরে নিয়ে এসে শুইয়ে দেয়। তারপর থেকেই ভাগ্যলিপি এখানে।
এরপর তরীর জন্ম। গার্মেন্টস এ চাকরি। কেটে যায় পাঁচ বছর। ভাগ্যলিপির সঙ্গে মিনহাজের বয়সের পার্থক্য অনেক তবুও তরীর কথা চিন্তা করে মিনহাজের বিয়ের প্রস্তাব এবং বিয়ে।
ভাগ্যলিপির তো এতক্ষণে ফিরে আসার কথা। ফিরছে না কেন ?
মনে মনে অস্থির হয়ে ওঠে মিনহাজ। তরীকে কিছুতেই আটকাতে পারছে না সে। এখন প্রয়োজন ওর মায়ের।
তরী, আবার ব্যাগটা হাতে নিয়ে পা বাড়ায়। ঠিক তখনই দরোজায় এসে দাঁড়ায় তরীর মা। মেয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
কী ব্যাপার, যাচ্ছিস কোথায় ?
আমার বাবার কাছে। তরী অনমনীয়।
বাবার কাছে! তোর বাবা তো এখানে। মা অবাক।
আমার আসল বাবার কাছে।
আসল-নকল সে আবার কী ?
আমার বাবা, যিনি আমাকে জন্ম দিয়েছেন।
ভাগ্যলিপি আবার রেগে যায়। বলে,
তরী, তোমাকে জন্ম দিয়েছি আমি। সন্তান জন্ম দেয় মা, আর বড়ো করে তোলে মা এবং বাবা উভয়েই। সেই আসল বাবা যে লালন-পালন করে। তুমি কী জানো কতদিন তোমার এই বাবা তোমার জন্য না-খেয়ে থেকেছে, তোমার অসুখের সময় কতদিন সে রাত জেগেছে, উদ্বিগ্ন থেকেছে, চোখের জল ফেলেছে। কতো রোদ, কতো বৃষ্টি মাথায় করে, কতো রক্ত জল করা উপার্জনে তোমার এই বেড়ে ওঠা, তুমি কি একবারও ভেবে দেখেছো।
তরী তবুও নির্বিকার। বলে,
তবুও তো উনি আবার বাবা নন। যেমন তুমি, তোমার বাবার মেয়ে নও। তুমি কোন এক পাকিস্তানি আর্মির সন্তান। তুমি জন্ম পরিচয়হীন। কিন্তু আমি তো জন্ম পরিচয়হীন না যে আমাকে অন্যের পরিচয় বহন করতে হবে !
এবারে মিনহাজ ধমকে ওঠে।
চুপ, একদম চুপ। তোমার মা সম্পর্কে খারাপ কথা বলতে তোমার মুখে আটকাচ্ছে না।
না। তরী একরোখা, জিদ্দি মেয়ের মতো জবাব দেয়।
মিনহাজ, প্লিজ।
কথা বলে ভাগ্যলিপি। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মেয়ের উদ্দেশ্যে খুব শান্ত অথচ দৃঢ়ভাবে একটা একটা শব্দ থেমে থেমে উচ্চারণ করে।
আমি, পাকি-আর্মির সন্তান নই। আমি যুদ্ধের সন্তান। আমার মা, বীরাঙ্গনা না, আমার মা
মুক্তিযোদ্ধা। আমার মা, আমার গর্ব। আমার মা দু’জন পাকি-আর্মিকে মেরে আমাকে জন্ম দিয়েছে। আমি এমন মায়ের সন্তান, এ আমার সবচেয়ে বড়ো অহংকার।
এ তোমার মিথ্যা গর্ব, মিথ্যা অহংকার। তুমি মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে নও, তুমি বীরাঙ্গনার সন্তান। যার এই সমাজে ঠাঁই হয় নি, তার সন্তান।
শোন তরী, আমি কখনও আমার মা-কে বীরাঙ্গনা ভাবি না। আমার মা-সহ দেশের সকল সম্ভ্রমহারা মায়েদের আমি বীরাঙ্গনা ভাবি না, বলিও না। আমি ভাবি তারা মুক্তিযোদ্ধা। আমি বলিও তাই। তারা অপাংক্তেয় নয়, তারা পূজেও। দেখে নিও একদিন এই বীরাঙ্গনা খেতাব উঠিয়ে দেয়া হবে, তাদের বলা হবে মুক্তিযোদ্ধা।
যাক গে এসব কথা। তুমি তোমার বাবার কাছে যেতে চাচ্ছো, যাও। কিন্তু তিনি থাকেন কোথায় ?
রংপুর। মায়ের প্রশ্নের জবাব দেয় তরী।
তুমি একা যেতে পারবে ? ভাগ্যলিপি জিজ্ঞেস করে মেয়েকে।
না, না ও পারবে না। কখনও তো একা দূরে কোথাও যায় নি ও। মেয়ের একা যাওয়ার কথায় আঁতকে ওঠে মিনহাজ।
আমিই পৌঁছে দিয়ে আসি। কি বলিস বাবা।পরের কথাগুলি তরীকেই বলে মিনহাজ।
তরীকে নিয়ে চলে গেলো মিনহাজ। ওদের চলে যাওয়া পথের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে ভাগ্যলিপি। বুকের ভেতর ফুঁসে ওঠে এক কান্নার সাগর। ওর চোখের সরসী ভরে ওঠে জলে। তারপর ফোটায় ফোটায় গড়িয়ে পড়তে পড়তে কান্নার বাঁধ ভেঙে ভাসিয়ে নিয়ে যায় ওকে। ভাগ্যলিপি খুব কাঁদলো। কাঁদতে কাঁদতে ঈশ্বরকে বলল, আমার ভাগ্যটা এমন কেন ঈশ্বর ? এমন কেন ? আমার দোষ কোথায় ? আমার মায়েরই বা কী দোষ ? বলো ঈশ্বর, বলো।
ভাগ্যলিপি জানে ঈশ্বর তার কথার জবাব দিবে না, দিতেও পারবে না। তাহলে ভাগ্যলিপি কী হেরে যাবে ? তাই কখনও হয় ? জীবনের কাছে যে কখনও হার স্বীকার করে নি, মানুষের কথাকে যে কখনও পাত্তা দেয় নি, সে কি আজ তার মেয়ের কথায় জীবনের কাছে পরাজয় মেনে নিয়ে অসহায় বসে থাকবে ?
না, তা কখনও হতে পারে না। জীবনের কাছে, এই সমাজের কাছে যে কখনও হারে নি, সে কখনও হারতে পারে না। তার মেয়েকে তার কাছে ফিরে আসতেই হবে। আসতেই হবে।
সারারাত এভাবে বসে থাকে ভাগ্যলিপি। সকালবেলা, মা ডাকে চমকে ওঠে ভাগ্যলিপি।
মা, আমাকে মাফ করো। আমি ভুল করেছি, ভুল হয়েছে আমার, মা।
ভাগ্যলিপির বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তরী। মেয়েকে দু’হাতে জড়িয়ে নেয় ভাগ্যলিপি। কোন কথা বলে না ও। সে তার সমস্ত স্পর্শের মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দেয় ও একজন মা। মায়ের কোন আবিলতা থাকতে পারে না। মা হলো নিষ্পাপ এক অহংকারের ইতিহাস।