বিনয় বাবুর সাথে দেখা করতে গিয়ে দেখা হলোনা, তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন, তার কোন খোঁজ কেউ দিতে পারলোনা। গ্রামের এক কোণে তার ছোট্ট একটি বাড়ি ছিল। সেটি এখন আর তার নেই। সেখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই জানা গেলো, এক সময় থাকতেন, তবে কবে, কোথায় গিয়েছেন তা জানেন না যারা বর্তমানে বসবাস করছেন। তাদের সঙ্গে বেশী ক্ষণ কথা বলার ইচ্ছা থাকলেও কথা আর বলা হলোনা, কারণ বোঝা গেল এ ব্যাপারে তারা কথা বলতে চাইছেননা। চলে এলাম সেখান থেকে। কিন্তু বিনয় বাবুকে আমার খুঁজে বের করা দরকার। কাকে জিজ্ঞেস করলে পাওয়া গেলো তা বোঝা যাচ্ছেনা।
বিনয় বাবুর আত্মীয়-পরিজন যারা ছিলেন তারা সবাই ¯^াধীনতরা যুদ্ধের আগে চলে গেছেন ভারতে। সেখানেই তারা বসবাস করছেন। কিন্তু বিনয় বাবু ভারতে যাননি। তিনি দেশের মায়া ত্যাগ করতে পারেননি। তিনি নাকি বলেছিলেন দেশ আমার মা, আমি আমার মাকে ত্যাগ করতে পারবোনা। তাই তার আর যাওয়া হয়নি। তিনি একা, সম্পুর্ণ একা পড়ে রইলে এদেশে, এদেশের ভিটে-মাটিতে। যে ভিটার মায়া তিনি ত্যাগ করতে পারেননি অথচ সেখানেই তাকে পাওয়া গেলোনা। বিনয় বাবু সম্পর্কে এতটুকুই জানা গেলো। কিন্তু বিস্তারিত আর কিছুই জানা গেলোনা।
সাংবাদিকতা করতে এসে জীবনে অনেক সংবাদ সংগ্রহ করেছে সজল কিন্তু বিনয় বাবুর বিষয়টি তাকে ভাবিয়েছে বারবার। যখন বিনয় বাবুর কথা সজল শুনেছে তখনই মনে হয়েছে এর ভেতরে কোন গল্প কিংবা কোন ইতিহাস লুকিয়ে যাছে। তাই সজল বেরিয়ে পড়ে সেই বিনয় বাবুর খোঁজে। তার ভিটেতে তাকে পাওয়া গেলোনা, তার গ্রামেও তাকে পাওয়া গেলোনা। কিন্তু হাল ছাড়লোনা সজল, সে অনবরত গ্রামের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত বিনয় বাবুকে খুঁজতে লাগলো। অনেককেই জিজ্ঞাসা করা হলো কিন্তু কেউ কোন কিছুই বলতে পারলোনা। আর গ্রামের কয়েকজন তরুণতো বলেই ফেললো তারা বিনয় বাবুর নাম পর্যন্ত শোনেনি। কি অদ্ভুত !
ঢাকায় চলে এলো সজল। পত্রিকা অফিসে বসে চিন্তা করতে লাগলো কি ভাবে খুঁজে পাওয়া যায় বিনয় বাবুকে। পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন দেওয়ার কথা ভাবলো সে কিন্তু পরক্ষণেই সে ভাবনা দূর করে দিলো। কারণ এতে কোন লাভই হবেনা। বরং পুনরায় গ্রামে যেতে হবে। গ্রামে গিয়ে আবার খুঁজতে হবে। গ্রামের কোন বয়োজ্যাষ্ঠ কাউকে জিজ্ঞেস করতে হবে। বিনয় বাবুকে খুঁজে বের করতেই হবে। আর এটাই হবে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ একটি সংবাদ।
পরদিন বিনয় বাবুর খোঁজে পুনরায় তার গ্রামে রওনা হলো সজল। কিন্তু গ্রামে না গিয়ে সে নেমে পড়লো শহরের একটি কলেজে। তার ধারণা হলো কলেজে গিয়ে কোন অধ্যাপককে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে হবে। ইতিহাসের অধ্যাপককে জিজ্ঞেস করলে কিছু না কিছু পাওয়া যেতে পারে। যেই ভাবা সেই কাজ। সজল ইতিহাসের অধ্যাপককে খুঁজে বের করলেন এবং তাঁকে বিনয় বাবুর কথা জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু ইতিহাসের অধ্যাপক তেমন কোন তথ্য জানাতে পারলেননা। তিনি জানালেন যে, তিনি বিনয় বাবু সম্পর্কে শুনেছেন কিন্তু তেমন কিছুই জানেনা। তবে একটা তথ্য তিনি দিতে ভুললেন না। আর সেটি হলো, তিনি বললেন যে, এ কলেজে পুরনো একজন পিয়ন আছে, তিনি রিটায়ার করেছেন কিন্তু এই কলেজে এখনো তিনি মাঝে-মধ্যে কাজ করেন। তাকে জিজ্ঞেস করলে কিছুটা তথ্য পাওয়া যেতে পারে। পিয়নের নাম মনসুর আলী। থাকেন কলেজের কোয়ার্টারের পেছনে ছোট্ট একটি ঘরে। সজল অধ্যাপককে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেলেন কলেজ কোয়ার্টার এর পেছনে। ঘরের সামনে নাম ধরে ডাকতেই এক মহিলা বেরিয়ে এলেন। সম্ভবত মনসুর আলীর স্ত্রী। কাকে চাই জিজ্ঞেস করতেই আমি মনসুর আলী সাহেবের কথা বললাম। তিনি বললেন যে, ওনি বাজারে গিয়েছেন, একটু পড়ে আসতে হবে। সজল চলে এলো। কলেজের বড় বট গাছটার নিচে বসে রইলো অনেকক্ষণ আর চিন্তা করতে লাগলো মনসুর আলীর কাছ হয়তো কোন তথ্য পাওয়া যেতে পারে।
বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সজল পুনরায় মনসুর আলী বাড়িতে গিলে কড়া নাড়ল। এবার বেরিয়ে এলেন বয়স্ক একজন পুরুষ। সজলের অনুমান ভুল হলোনা ইনিই মনসুর আলী। সজল তার পরিচয় দিলে মনসুর আলী ঘরের বারান্দায় ছোট্ট একটি চৌকিতে বসতে দিলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলে তার কাছে আসার প্রয়োজন। সজল কোন ভুমিকা না রেখে সরাসরি জিজ্ঞেস করে ফেললো বিনয় বাবুর কথা। মনসুর আলী কিছুক্ষণ সজলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর কিছু একটা না ভেবেই বলে ফেললো তিনি বিনয় বাবুকে চিনেননা। কিন্তু সজলের মনে হলো মনসুর আলী বিনয় বাবু সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেন। মনসুর আলী কোন কিছুই জানেনা বলে সজলকে জানিয়ে দিলো এবং সজলকে চলে যেতে বললো। মনসুর আলীকে একটু বিরক্তও মনে হলো। সজল কি করবে ভেবে পেলোনা। মনসুর আলীর বাড়ি থেকে চলে এলো সজল পুনরায় বট গাছের নিচে গিয়ে বসলো। সজল চিন্তা করলো যেভাবেই হউক মনসুর আলী কাছ থেকে তথ্য বের করতে হবে। সজল হাল ছেড়ে না দিয়ে ঠিক সন্ধ্যায় গিয়ে হাজির হলো মনসুর আলী বাড়িতে। মনসুর আলী দরজা খুলেই বিরক্ত মুখে তাকালো সজলের দিকে।
- কি ব্যাপার, তুমি আবার এখানে
- দেখুন, আমি আপনার ছেলের বয়সি, বিনয় বাবু সম্পর্কে আমি জানতে এসেছি, দয়া কলে যদি বলেন
- আমিতো বললাম তোমাকে বিনয় বাবু কে, কোথায় থাকেন এ সম্পর্কে আমি কিছুই জানিনা
- আপনি নিশ্চয়ই কিছুই জানেন
- বললামতো আমি কিছুই জানিনা : কেন বাপু আমাকে বিরক্ত করছো ?
- আমি আন্তরিক ভাবে দু:খিত আপনাকে বিরক্ত করার জন্য, কিন্তু এ কাজটা আমাকে করতেই হবে, বিনয় বাবু সম্পর্কে আমাকে জানতেই হবে
- আরে বাবা, আমি কিছু জানলেতো তোমাকে জানাবো, তুমি খামাখা আমাকে বিরক্ত করছো
- বাবা, আপনি নিশ্চয়ই কিছু না কিছু জানেন, যতটা জানেন ততটা বললেই হবে।
মনসুর আলী অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সজলের দিকে। সজলের মুখে বাবা ডাক শুনে তার বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো। চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। চোখ দিয়ে দু-ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। তারপর সজলকে অবাক করে দিয়ে সজলের হাত দুটো ধরে বললো, বসো
সজল চৌকির উপর বসে পড়লো। এর মধ্যে ঘরের ভেতর থেকে দু কাপ চা চলে এসেছে সজলের সামনে। চায়ের সাথে কিছু মুড়িও আছে। মনসুর আলী বললো
- চা খাও বাবা। ঘরে আর তেমন কিছুই নেই যে, তোমাকে খেতে দেবো।
- আমার জন্য আপনি এতো ব্যস্ত হবেন না, যে পরম যতেœ চা খেতে দিয়েছেন তাতেই আমি ধন্য।
সজল চায়ের কাপে হাত দিতেই বিদ্যুতের বিদায় ঘটলো। ভেতরে-বাইরে সব জায়গায়ই অন্ধকার। কিছুক্ষণ পর মনসুর আলীর স্ত্রী একটি হারিকেন দিয়ে গেলেন। হারিকেনের মৃদু আলোতে মনসুর আলীর চেহারাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মনসুর আলী কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। কি ভাবছেন বোঝা গেলোনা। কিছুক্ষণ চুপচুপ থাকার পর হঠাৎ করেই তিনি শুরু করলেন
বিনয় আর আমি ছোট বেলায় বেশ ভালো বন্ধু ছিলাম। দুজনে এক সঙ্গে স্কুলে যেতাম, নদীতে সাঁতার কাটতাম, গাছের মগডাল থেকে পাখি ধরতাম, বিলে গিয়ে মাছ ধরতাম। আমাদের দুজনের সংসারেও খুব মিল ছিল। ওদের পুজোয় আমরা যেতাম আবার আমাদের ঈদেও ওরা আমাদের বাড়ি আসতো। খুব ভাল লাগার দিন কাটিয়েছি আমরা। আমাদের মধ্যে আবার প্রায়ই ঝগরা হতো, আবার মিটেও যেতো। একবার আমরা ঝগরা করে দশ দিন পর্যন্ত কথা বলিনি। আমরা লেখা-পড়ায় খুব একটা ভালা না হলেও কখনো ফেল করিনি। আমাদের এ বন্ধুত্বে অনেকেই হিংসে করতো আবার অনেকেই বলতো আমরা দুই ভাই। এমনি করেই আমাদের দিনগুলো কাটছিল। আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম ভবিষ্যতের দিকে। বিনয়ে বাবা মা ছাড়া আর এক দাদা ও এক দিদি ছিল। আত্মিয় ¯^জনও কিছু ছিল। ওদের পাড়ায় অনেক হিন্দু পরিবার ছিল। তবে হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে অনেক সখ্যতা ছিল। কিন্তু কি হলো জানিনা হঠাৎ একদিন হিন্দু আর মুসলমানদের মধ্যে ঝগড়া বেঁধে গেলো। কি নিয়ে ঝগড়া বাঁধলো আমরা বুঝলাম না। দু পক্ষের লোকজনেরই ক্ষতি হয়েছিলো। আমি চেষ্টা করেছিলাম বিনয়ের পরিবারকে রক্ষা করতে। বিনয়কে আমার বাড়িতে এনে রেখেছিলাম। এ ঘটনার পড় বিনয়ের পরিবার সিদ্ধান্ত নিলো যে, গ্রামের সব হিন্দু পরিবারসহ এদেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাবে। আমি বিনয়ের বাবা-মাকে অনেক বোঝালাম। কিন্তু কোন লাভ হলোনা। তারা অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল ভারতেই চলে যাবে। কিন্তু বাঁধ সাধলো বিনয়। ও না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। কোন ভাবেই ওকে দেশ ছাড়ার কথা বলা গেলনা। ও শুধু একটা কথাই বললো মাতৃভুমি ছেড়ে ও যাবেনা। একা থাকলেও এখানেই থাকবে। দেশের মায়া ও ত্যাগ করতে পারেনি। দেশকে ভালবেসে, দেশের ভিটেকে ভালবেসে, দেশের মাটিকে ভালবেসে বিনয় রয়ে গেলো দেশে। কিন্তু বিনয়ের বাবা-মা আর ¯^জনরা চলে গেলো ভারতে। বিনয় ওদের বাড়িতে একা একা রয়ে গেলো। নিজের ভিটের প্রতি এতো মায়া আমি আর কখনো দেখিনি।
বিনয়ের ভিটে দখল নেয়ার জন্য অনেকেই চেষ্টা করেছে। নিজের ভিটে রক্ষার জন্য বিনয় চেষ্টার কোন ত্রæটি করলোনা। আমিও ওর সাথে মিলে ওর ভিটে রক্ষায় সচেষ্ট হলাম। সে যাত্রায় ভিটে রক্ষা করা গেলো। কিন্তু দখলকারিদের চোখা রাঙ্গানো বন্ধ হলোনা। কোন না কোন উপায়ে তারা বিনয়কে ভয় দেখাতো লাগলো। কিন্তু বিনয় ভয় পাওয়ার লোক নয়। ও শুধু একটা কথাই বললো “নিজের মাটি, নিজের ঘর, নিজের ভিটে আর নিজের দেশ রক্ষা করতে যদি নিজের প্রাণ বিশর্জন দিতে হয় তাতেও সে রাজি”। আমি কেন জানি এ কথার মধ্যে দেশের ¯^াধিনতার গন্ধ পেলাম।
পঁচিশে মার্চ ঢাকায় যখন ইয়াহিয়া বাহিনি তান্ডব চালালো তার পরদিন আমরা দুজনেই সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা যুদ্ধে যাবো। এ ব্যাপারে গ্রামের আর কয়েকজন যুবককে উদ্বুদ্ধ করলাম। কয়েকজন রাজি হলো, কয়েকজনকে রাজি করানো গেলোনা। যে কয়জন রাজি হলো তাদেরকে নিয়েই আমরা রওনা হলাম যুদ্ধে। কিন্তু কোথাও যাবো, কি করবো, কোথায় প্রশিক্ষণ নেবো তা আমাদের জানা ছিলনা। বিনয় আমাদের পথ দেখালো, ও আমাদের ভারতে নিয়ে গেলো, কিছুদিন ওদের বাড়িতে রাখলো, তারপর আমরা ক্যাম্পে যোগ দিলাম। ট্রেনিং শেষ করে এক মুহুর্ত দেরী না করে আমরা চলে এলাম মাতৃভুমিতে। বিনয়ের বাবা-মা বিনয়কে রেখে দেওযার জন্য অনেক চাপাচাপি কররো, কিন্তু বিনয় কোন কিছুই শুনলোনা। শুধু একটা কথাই বললো “মাগো, তোমার সম্মান রক্ষা করতে হবে, তোমার জন্ম ভিটাকে রক্ষা করতে হবে, মাতৃভুমিকে শত্রæমুক্ত করতে হবে”।
বিনয়ের মধ্যে যে ধরণের দেশপ্রেম আমি দেখেছি তা এই গ্রামের আর কারো মধ্যে দেখিনি। যুদ্ধ শুরু হলো, বিনয়ের বুদ্ধি আর সাহস আমাদের আরো বেশী করে সাহসী করে তুলেছিলো। কয়েকটা ব্রীজ উড়িয়ে দিতে ওর ভুমিকাই ছিল মূখ্য। সম্মুখ যুদ্ধে ওর হাতের নিশানা ছিল দেখার মতো। এভাবে যুদ্ধ করতে করতে আমরা ¯^াধীন হই। মূলত বিনয়ের জন্য আমাদের গ্রামটি আমরা শত্রæমুক্ত করতে পারি। বিনয় এই গ্রামের ¯^াধিনতার প্রতিক। দেশ ¯^াধিন হওয়ার পর বিনয় গর্ব করে বললো আমি আমার ভিটে-মাটি শত্রæমুক্ত করতে পেরেছি। যুদ্ধ শেষে যখন সবাই সার্টিফিকেট নেয়ায় ব্যস্ত তখন বিনয় বলেছিলো, “মাতৃভুমিকে শত্রæমুক্ত করেছি, দেশের ¯^াধীনতায় ভুমিকা রেখেছি, দেশতো মা, মাকে রক্ষা করতে পেরেছি, এর বিনিময়ে কোন কিছুই চাইনা”। তাই ও আর কোনদিন সার্টিফিকেট নেয়ার ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখায়নি, আমিও না।
¯^াধীনতার পর ভালই চলছিলো আমাদের দিনকাল। যুদ্ধের সময় বিনয়ের ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো। সেই পোড়া ঘর-বাড়িকে বিনয় একা হাতে ঠিক-ঠাক করলো। নিজের যে জমিগুলো ছিল সেগুলোতে চাষ করা শুরু করলো। নতুন এক জীবন শুরু হলো বিনয়ের। বিনয়কে বলেছিলাম আমাদের বাসায় এসে থাকতে। কিন্তু বিনয়কে রাজি করানো যায়নি কখনোই। আসলে নিজের ভিটেকে ও কখনেই হারাতে চায়নি।
কিছুদিন পরের ঘটনা। ¯^াধীনতার কয়েক বছরের পরের ঘটনা। দেশের পট অনেকটাই পরিবর্তন ঘটে গেলো। একাত্তর থেকে পঁচাত্তর অনেক ঘটনাই ঘটলো, ¯^াধীনতরা বিরোধিরা এদেশে তাদের ছায়া ফেলতে শুরু করলো। এর মধ্যে একদল দুবৃত্ত, তারা নব্য ধনি, যুদ্ধের সময় এদের ভুমিকা ছিল বিতর্কিত, তারা বিনয়ের বাড়ি-ঘর দখল করে বসলোা। কেন দখল করলো কিছুই বললো না। বিনয় প্রতিবাদ করলো, কিন্তু কোন লাভ হলোনা, থানায় গেলো কোন লাভ হলোনা, গ্রামের মুরুব্বিদের কাছে গিয়েছে বারবার কোন লাভ হয়নি। উপরন্তু বিনয়কে বিভিন্ন ভাবে অপবাদ দেয়া হলো, ভয় দেখানো হলো। কিন্তু বিনয় ভয় পাবার ছেলে নয়। সে জোড়ালো কণ্ঠে প্রতিবাদ করলো। কিন্তু দখলকারি দুবৃত্তরা দলবল নিয়ে বিনয়ের উপর বারবার হামলা করলো, কেউ কোন প্রতিবাদ করলোনা। আমরা চেষ্টা করেছি, বারবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছি।
একদিন রাতের বেলা বিনয়ের উপর প্রচন্ড আঘাত করা হলো। অচেতন অবস্থায় আমরা ওকে খুঁজে পেলাম ওরই জমিতে। আমি ওকে বাসায় এনে সেবা করে সুস্থ্য করে তুললাম। সুস্থ্য হয়ে যে কথাটি বললো “এই দেশ, মাটি শত্রæমুক্ত করার জন্য যুদ্ধ করেছি, নিজের জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছি, দেশ পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হলো ঠিকই, দেশ ভিনদেশী শত্রæদের কাছ থেকে মুক্ত হলো ঠিকই, কিন্তু নিজের ¯^জনদের কাছ থেকে নিজের ভিটে রক্ষা করতে পারলামনা।” এই বলে অঝোরে কেঁদে ফেললো বিনয়, তারপর আমাকে নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে নিজের ভিটেয় গেলো, নিজের ভিটোর খানিকটা মাটি তুলে নিলো একটা পোটলায়, তারপর চলে গেলো বাবা-মায়ের কাছে।
সজলের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো মাটিতে। মনসুর আলী কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো। মনসুর আলীর স্ত্রী বিনয়ের একটা ছবি এনে দিলে সজলের হাতে, সজল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলে ছবিটার দিকে। তারপর দাঁড়িয়ে ছবিটাকে একটা স্যালুট করলো সজল। বাইরে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক, বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে। মনের মধ্যে বিষন্নতা নিয়ে সজল বেরিয়ে এলো ঘর থেকে, তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ.........।