রহিম মুন্সী গ্রামের একজন প্রভাবশালী মানুষ। পূর্ব-পুরুষ জমিদার থাকায় সে হিসাবে সেও জমিদার। স্বচ্ছল ভাবে জীবন যাপন করছে রহিম মুন্সী। নামের শেষে মুন্সী পদবীটা তার গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকগুণ। গ্রামের বিচার-আচারে রহিম মুন্সীর বিরাট ভুমিকা থাকে। তিনি যুক্ত-তর্ক বিচার করে যে রায় দেন তাতে গ্রামের অন্যরা অনায়াসে মেনে নেন অথবা মেনে নিতে বাধ্য হন। রহিম মুন্সীর বাড়িতে কাজ করে হারেছ আলীা। বাড়ির ভাল-মন্দ, বাজার-সদাই, গরু-ছাগল দেখা সবই করেন হারেছ আলী। রহিম মুন্সীর খুবই বিশ্বস্ত হারেছ আলী। মাঝে-মধ্যে রহিম মুন্সীর সাথে হারেছ আলীও বিচারে যান। অর্থাৎ রহিম মুন্সীর সব কিছুর দেখাশোনা বিশেষ করে হারেছ আলীই করে থাকেন। হারেছ আলী সংসার নেই। বিয়ে করেননি কোনদিন। রহিম মুন্সীর বাড়িতে এসেছে সেই ছোট বেলা থেকেই। আছেন এখনো এখনাই। দু-একবার রাগ করে চলে গিয়েছিলেন বটে কিন্তু দু-একদিন পরেই চলে এসেছেন। একটা গভীর মায়া জন্মে গেছে রহিম মুন্সীর উপর, তার সংসারের উপর। তাই আর যাওয়া হয়নি কখনোই।
রহিম মুন্সী বাজারে যাবেন বলে ঠিক করলেন। সাথে হারেছ আলীকে নিয়ে যাবেন বলে ঠিক করলেন। তাই ডাকলেন হারেছ আলীকে
হারেছ, ও হারেছ আলী
জ্বি মুন্সী সাব, এই আইয়া পড়ছি
এত জোড়ে জোড়ে ডাকতে হয় কেন হারামজাদা, একবার ডাকলে কাছে আসিসনা কেন ?
এক ডাকেইতো আইলাম, তা কি কইবেন কন
আমার সাথে বাজারে চল, অনেক কিছুই কেনার আছে। তোর কাছে কিনে দিয়ে দেব, তুই চলে আসবি। আমি বাকী কাজটা সেড়ে আসবো।
জ্বে আইচ্ছা মুন্সী সাব
দুজনেই বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। রহিম মুন্সীর সাথে হারেছ আলীও চলছে রাস্তা ধরে।
আচ্ছা হারেছ আলী, তুই সেই যে, আমার বাড়িতে এসেছিস, তা আজো পর্যন্ত তোদের বাড়িতে গেলিনা, কারণটা কিরে হারেছ
মুন্সী সাব, সেই ছোটকাল থেইকা আপনের লগে আছি, আপনার প্রতি একটা ভালবাসা জন্মায় গেছে মুন্সী সাব। আপনারে ছাইড়া যাইতে মন চায়না মুন্সীসাব। আপনেই আমার মা-বাপ।
তাতো বুঝলাম, ওখানে তোর ভাইয়েরা আছে, বাবা-মায়ের ভিটে আছে
তা আছে মুন্সী সাব। মন চাইলে মাঝে-মইধ্যে ভাই-বোনগো দেইখা আসি। ছোড বেলায় বাবা-মা হারায়া আপনের কাছেই আছি। আপনারে ছাইড়া যাইতে ইচ্ছা করেনা মুন্সীসাব। বড় মায়া জইমা গেছেগা মুন্সীসাব। তা মুন্সীসাব হঠাৎ কইরা এই কথা কইতাছেন কেন মুন্সীসাব।
না এমনিই বললাম, আচ্ছা তাড়াতাড়ি চল
পথে যেতে যেতে অনেকের সাথে দেখা হয়, কথা হয়। তাই পথ চলতেও দেরী হয়ে যায়। বাজারে পৌঁছতেও অনেক দেরী হয়ে যায়। বাজারে গিয়ে মধু মিয়ার আড়তে বসতেই মধু মিয়া বলে উঠলো
মুন্সী সাব, ভালা আছেননি
আছি, ভাল, তা তুমি কেমন আছো
বেশী ভালানা মুন্সী সাব
কেন তোমার আবার কি হয়েছে
আমার কিছুই হয় নাই
তাহলে তুমি ভাল নেই কেন ?
কোন কিছু হুনেননাই
কি শুনবো, কি হয়েছে
যুদ্ধ মনে লয় শুরু হইয়া গেলো
যুদ্ধ, তা হঠাৎ করে যুদ্ধ কেন ? কার সঙ্গে কার যুদ্ধ
যুদ্ধ না হইলে এই দেশে স্বাধীন হইবো কেমনে ?
আসল কথাডা কও, কার সাথে কার যুদ্ধ
কার সাথে আবার, পাকিস্তানের সাথে বাঙ্গালীর যুদ্ধ
তুমি আমার হাসালে মিয়া, পাকিস্তানের সাথে বাঙ্গালীর আবার কিসের যুদ্ধ ?
স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ মুন্সীসাব
আরে মিয়া দেশ স্বাধীনের আবার কি দরকার ? দেশতো ভালই চলছে।
দেশ ভাল চলতাছেনা মুন্সী সাব, দেশ ভাল চলতাছেনা
কেন, দেশ ভাল চলছেনা কেন ? তুমি কি ভাল আছোনা, তোমার কি কোন সমস্যা হচ্ছে
সমস্যা শুধু আমার না, গোটা দেশেই এখন সমস্যা। পাকিস্তানিরা মনে লয় আমাগো ভালা থাকতে দিবনা মুন্সীসাব।
আরে মিয়া পাকিস্তানিরা আবার কি দোষ করলো
পাকিস্তানিরা এই দেশের নিরিহ মানুষদের উপর অত্যাচার করতাছে মুন্সী সাব। দেশের মধ্যে এহন স্বাধীনতা দরকার। আমরা আর পরাধিন থাকতে চাইনা। আমরা এইবার স্বাধীন হমু। মুন্সী সাব দেইখেন আমরা স্বাধীন হমুই।
চুপ করো মিয়া, কি আছে বাঙ্গালীর, না আছে অস্ত্র, না আছে গোলা-বারুদ, লাঠি-বাঁশ দিয়া কি আর স্বাধীনতা আসবো
আসবো, আসবো মুন্সী সাব। লাঠি-বাঁশ দিয়াই পাকিস্তানি খেদান যাইবো, যদি মনোবল থাকে, যদি মায়ের প্রতি ভালবাসা থাকে, যদি দেশের প্রতি ভালবাসা থাকে। স্বাধীনতা আসবোই মুন্সীসাব।
রহিম মুন্সী আর কোন কথা বলতে পারলোনা। হারেছ আলী পাশে বসে সব কথাই শুনলো। হারেছ আলীর মনের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতা শব্দটি বারবার দোলা দিচ্ছিল। মাকে ভালবাসা এই কথাটি খুব বেশী করে দাগ কাটছিল হারেছ আলীর মনের মধ্যে। রাগে গজগজ করতে কোন বাজার-সদাই না করেই রহিম মুন্সী আর হারেছ আলী বাড়ির দিকে রওনা হলো। মধু মিয়ার দোকানের কথাগুলো শুনে আর বেশীক্ষণ থাকতে ইচ্ছে হলোনা রহিম মুন্সীর। তাই বাজার না করেই রহিম মুন্সী বাড়ির দিকে রওনা হলো।
মুন্সী সাব বাজার না করাই চইলা আইলেন যে
চুপ কর হারামজাদা
না কইছিলাম যে, মধু মিয়া যে কইলো মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতা
চুপ কর হারামজাদা
কেন মুন্সী সাব, চুপ করুম কেন, পাকিস্তানিরা অত্যাচার করবো আর বাঙ্গালিরা সহ্য করবো, এইডা হয় নাকি ?
তোকে কিন্তু চুপ করতে বলেছি
না মুন্সীসাব এহনতো চুপ থাকার সময় না। আপনে গ্রামের মুরুব্বি, আপনেরে আগায়া আসতে হইবো সবার আগে।
চুপ না করলে কিন্তু তোর কপালে কিন্তু শনি আছে
আপনে চুপ করেন মুন্সীসাব
মধু মিয়া আর হারেছ আলীর কথাগুলো রহিমা মুন্সীর কানে বিষের মতো লাগছিলন। আর বারবার কানের মধ্যে কথাগুলো বাজছিল। তাই মনের জ্বালা মিটানোর জন্য আচমকা হারেছ আলীর গালে চড় বসিয়ে দিলো। অবাক হয়ে গেলো হারেছ আলী। মুন্সীসাব কেন এই কাজটা করলো হারেছ আলী বুঝে উঠতে পারলোনা।
আরে হারামজাদা, স্বাধীনতার তুই কি বুঝবিরে, পাকিস্তানিরা কত সুন্দর করে দেশ চালাচ্ছে আর বাঙ্গালিরা স্বাধীনতা স্বাধীনতা করে মাথা খারাপ করে ফেলছে। আরে বেটা যুদ্ধ কি অত সহজরে ? কি আছে বাঙ্গালির, না আছে অস্ত্র না আছে গোলা-বারুদ। যুদ্ধ করতে অস্ত্র লাগে বেটা।
হারেছ আলীর মুখে কোন কথা নেই। সে চুপচাপ হেটে যাচ্ছে। তার মাথায় শুধু মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতা শব্দগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। এদিকে রহিম মুন্সীর মনটাও ভাল নেই। সে অন্যভাবে চিন্তা করছে। তার ধারণা বাঙ্গালিরা ভুল করছে। পাকিস্তানিরা খুব ভালভাবে দেশ চালাচ্ছে। এদেশে স্বাধীনতার কোন প্রয়োজন নেই।
বাড়ি এসে হারেছ আলী চুপচাপই রইলো। কারো সঙ্গে কোন কথাই বললোনা সে। সে শুধু ভাবছে কিভাবে মুক্তিযুদ্ধ হবে। কিভাবে স্বাধীনতা আসবে। পাকিস্তানিরা যে অত্যাচার করছে তার জবাব অবশ্যই দিতে হবে। যুদ্ধ করতে হবে যুদ্ধ। যুদ্ধ ছাড়া আর কোন উপায় নেই। মায়ের দেশকে বাঁচাতে হবে। মাকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু হারেছ আলী কি করবে সেটাই বুঝতে পারছেনা। আর কোন কিছু চিন্তা না করে হারেছ আলী সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো সে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করবে। যেভাবেই হোক দেশের জন্য কিছু করতেই হবে। হঠাৎ রহিম মুন্সীর ডাকে হারেছ আলী সম্বিৎ ফিরে এলো।
হারেছ আলী, ঐ বেটা হারামজাদা হারেছ আলী
জ্বি, মুন্সীসাব
কি ব্যাপার, তুই এমন করে কি ভাবছিস ?
এমনিই মুন্সীসাব
তোর কি হয়েছে ?
কিছুই হয়নাই মুন্সীসাব।
শোন তোকে আমি চড় মেরেছি এই জন্য তোর মন খারাপ
না মুন্সীসাব
তাহলে
মুন্সীসাব, দেশের জন্য মনডা কান্দে, মায়ের জন্য মনডা কান্দে মুন্সীসাব
আরে বেটা তোর মায়তো আর বেঁচে নাই
আছে মুন্সীসাব
আছে, তাহলে এতদিন মিথ্যে বলেছিলি কেন ?
মুন্সীসাব, এই দেশটাই আমার মা
চুপ কর হারাজমজাদা, তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। শোন আমি যেটা বলি মন দিয়া শোন
বলেন মুন্সীসাব
শোন, আমি একটা বিষয় নিয়ে চিন্তা করেছি। পাকিস্তানিদের সাথে বাঙ্গালিরা কোনদিনও পারবেনা। যুদ্ধ হউক আর যাই হোক, বাঙ্গালিদের অত সাহস নেই যে, পাকিস্তানিদের সাথে লড়বে।
না মুন্সীসাব, বাঙ্গালীদের যেমন সাহস আছে, তেমনই আছে মায়ের প্রতি ভালাবাসা। আর আছে দৃঢ় মনোবল। এই দিয়াই হইবো মুন্সীসাব। আপনারা যারা মুরুব্বি আছে তারা সাহস যোগাইবেন
আমারতো আর খেয়ে-দেয়ে কোন কাজ নেই আমি বাঙ্গালিদের সাহস যোগাবো।
তাইলে আপনে কি করবেন মুন্সীসাব
আমি পাকিস্তানিদের পক্ষ নেব।
এইডা আপনে কি কইলেন মুন্সীসাব। আপনে পাকিস্তানিদের পক্ষ লইবে। দেশের লগে বেঈমানি করবেন
আরে বেডা পাকিস্তান আমার দেশ, আমি পাকিস্তানের সাথে বেঈমানি করবো কিভাবে
আপনে ভুল করছেন মুন্সীসাব
আমি ভুল করছি, তুই আমাকে জ্ঞান দিচ্ছিস, হারামজাদা। শোন আজ থেকে আমরা পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করবো। তুই আমার সাথে সাথে থাকবি।
আমি পাকিস্তানিদের পক্ষে কোনদিনও কাজ করবোনা। আমি যুদ্ধ করবো--, আমি যুদ্ধ করবো---
তোর মাথাটা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে
মাথা আমার ঠিক আছে মুন্সীসাব। বরং আপনের মাথাই খারাপ হইয়া গেছে
কি বললি তুই, আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে
জ্বি মুন্সীসাব, আপনের মাথা খারাপ হইয়া গেছেগা। যেই লোক নিজ দেশের সাথে বেঈমানি করে, যেই লোক মায়ের সাথে বেঈমানি করে, যেই লোক দেশের স্বাধীনতা চায়না, আসলে তার মাথাই খারাপ হইয়া গেছেগা।
হারেছ আলী, চিৎকার করে উঠে রহিম মুন্সী
চিৎকার কইরেন না মুন্সীসাব। সারা জীবন আপনের নুন খাইছি। আপনার লাইগা মায়া জন্মায়ছিলো। কিন্তু সেই মায়া এক নিমিষেই দুর হইয়া গেছেগা মুন্সীসাব। তাই আইজ আর আপনের লগে থাকতে পারলনামনা মুন্সীসাব। আমি যুদ্ধ করমু, দেশ স্বাধীন করমু।
কি তুই যুদ্ধে যাবি, দ্বারা তোকে যুদ্ধে যাওয়াচ্ছি
রহিম মুন্সীর মাথা গরম হয়ে যায়। মাথায় রক্ত চড়ে যায়। দেরী না করে দৌড়ে গিয়ে বাড়ির ভেতর থেকে তার বন্দুকটি নিয়ে আসে।
শোন হারেছ, এখনো সময় আছে, আমার সাথে কাজ কর, নাহলে তোকে আজ আমি শেষ করে ফেলবো
আমি মরতে ভয় পাইনা মুন্সী সাব। যদি আইজ মরতে হয় তাইলে এই মরাটা হইবো দেশের জইন্য মরা। যুদ্ধে না যাইতে পারলাম, দেশের জইন্যতো জীবন দিতে পারলাম।
রহিম মুন্সীর মাথায় রক্ত চড়ে উঠে। সে বন্দুকের ট্রিগারে চাপ দিয়ে বসে। সাথে সাথে একটি গুলি হারেছ আলী বুক ভেদ করে যায়। সাথে সাথে হারেছ আলী মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। হাত দিয়ে একটু মাটি তুলে চুমু খায়। তারপর বলে উঠে ‘এই দেশটা স্বাধীন হইবোই... স্বাধীন হইবোই’।