অঙ্কিতার জীবনের একেকটি অংশ কেটেছে একেক স্থানে । তার জন্ম হয়েছিল রাজশাহীতে ৩০ ডিসেম্বর, ১৯৯৫ সালে। বাবা ওয়াজউদ্দিন করিমের সরকারী চাকরীর জন্য জন্মের মাত্র তিন মাস পরেই তাকে চলে যেতে হলো পাবনায়। পাবনা পাগলদের বা শুদ্ধ ভাষায় বিকৃত বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদের হাসপাতালের জন্য বিখ্যাত। এই হাসপাতালের কাছেই একটি দুই রুমের বাসা ভাড়া নিলেন করিম সাহেব। বাসার জানালা দিয়ে পাগলাগারদের পাগলদের চলাফেরা দেখা যায়। তাই এ রকম বলা যায় যে , পাগলদের মাঝেই বড় হয়েছে অঙ্কিতা। তাই সেই সূত্রে অঙ্কিতা চঞ্চল। কিছুটা পাগলামিও করে। পাগলদের মাঝে থাকতে থাকতে তার কেমন যেন ভালোবাসা হয়ে গেল পাগলদের সাথে। তার চিন্তায় কেন জানি মিশে গেল যে, পাগলরাই প্রকৃত মানুষ। কেননা তারা কখোনই মানুষকে ঠকায় না, তার যে বড় কথা , মিথ্যা কথা বলে না। অঙ্কিতাও হয়ে গেল সেরকমই; সে পাগলদের বানিয়ে ফেলল নিজের আদর্শ। সেই জন্য সে কাউকে ঠকাতে পারে না, মিথ্যা বলে না। সে শুধু জানে, যে মানুষ পাগল নয়, তাকে ত পাগল ই বলা উচিত নয়।
এভাবে অঙ্কিতা পাঁচটি বছর কাটিয়েছে একরকম পাগলদের সান্নিধ্যে। সে সব সময় প্রচুর ভালবাসা পেয়েছে তার পরিবার থেকে, কিন্তু তার মনে রয়ে গেছে সেই পাগলদের ছাপ,সেই আদর্শ-মানুষকে ভালবাসা। তবে এই আদর্শ আরো কিছুটা যেন বিধৃত হয়েছে। তার মানবপ্রেম যেন জীবপ্রেমে পরিণত হয়েছে। ২০০০ সালের মে মাসে আবার বাবার চাকরিসূত্রে ঢাকা আসা অঙ্কিতার। সেই সময় পাগলদের হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে সে কতোটা কেঁদেছিলো তা বলা বোধ হয় সম্ভব নয়।
ঢাকায় যখন আসে তখন অঙ্কিতার বয়স ৫-৬ এর মাঝে। তাই বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পালা। ভালোভাবেই ভর্তি হল বাংলাবাজার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। রোল হলো ১৭; তবে এর অর্থ কিছুই বুঝত না অঙ্কিতা। সে শুধুই জানত, তার পৃথিবীতে স্বজন বলতে আছে সেই পাবনার পাগলগুলো-আর কেউ নয়। এমনকি মা-বাবাও নয়।
তবু আর কী করার! মা-বাবার চাপের মুখে শত কান্নাকাটির পার করে স্কুলে যেতেই হত অঙ্কিতার। আফসানা ম্যাডামের মধুমাখা কথা বা জলিল স্যারের রুক্ষ মেজাজ তাকে পড়ালেখার দিকে টানতে পারছিলো না। তার মনে কেবল একটিই প্রশ্ন, “কেন পাগলদের মতো ভালো মানুষদের বন্দি করে রাখতে হয়? তাদের প্রতি এরূপ অত্যাচার কেন?” এর উত্তর পায় না অঙ্কিতা।তবে যতই দিন গেল অঙ্কিতার মনে পাগলদের জন্য ভালোবাসা সময়ের আড়ালে লুকিয়ে যেতে লাগলো।
প্রথম সাময়িক পরীক্ষা শেষে ফলাফল; কোনো বিষয়েই অঙ্কিতা ৭০-র উপর পায় নি। বাংলাতে সর্বোচ্চ ৫৮ পেয়েছে, আর সর্বনিম্ন গনিতে-৪১। এই ফল হাতে নিয়েই অঙ্কিতা বিদ্যালয় হতে ছোট ছাই রঙের ফ্রক পড়ে গুটি গুটি পায়ে বের হচ্ছিল। মা’র হাত ধরে সে গেট হতে বের হল, বাসায় যাবে। কিন্তু সেদিন একটি রিকশাও পাওয়া গেল না। সুতরাং কাঁটা গাঁয়ের উপর নুনের ছিটার মতো, বাজে ফলাফলের পর কাঠ-ফাটা রোদে হেঁটে যেতে হল অঙ্কিতাকে। হাঁটছে, হাঁটছে... হটাৎ-ই অঙ্কিতার চোখে সাদা, ছোট, চতুষ্পদী, লেজবিশিষ্ট একটি প্রাণী ধরা পড়ল। প্রাণীটি বসেছিলো আর একটি অর্ধপূর্ণ পানির বোতল হতে পানি পান করবার চেষ্টা করছিলো। আর এমন সময়, অঙ্কিতার মা পাশের একটা দোকানে গেলেন, কী যেন কিনবেন! অঙ্কিতা যে পাগল তথা মানুষকে ভালোবাসতো, তা যেন আরেক ধাপ এগিয়ে গেল। তার মধ্যে সেই প্রাণীটির জন্য কেমন এক ভালোবাসা জন্মালো। সে নিতান্ত ছোট প্রাণীটিকে ধরে তার পাইপওয়ালা ফ্লাক্স হতে পানি খাওয়ালো। সে জানতোও না যে প্রাণীটি আসলে কী! অথচ তার যেন তাদের মধ্যে জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্ক। ওর মা আসার সাথে সাথেই সে বায়না ধরল সে প্রাণীটিকে বাসায় নিয়ে যাবেই। এমন ফলাফলের পর যদি বায়না পূরণ না হয় তাহলে মঅন ভেঙ্গে যাবে; এই আশঙ্কায় অঙ্কিতার মা প্রাণীটিকা নিয়ে গেল।
বাসায় নেবারও প্রায় দু’দিন পর অঙ্কিতা জানতে পারলো প্রাণীটির নাম “বিড়াল” যা মিউ মিউ নামক আজব আওয়াজ করতে পারে। তবে অঙ্কিতা এটিকে ডাকে “বিলাল” বা কোনো সময় “বিরার”; সঠিক উচ্চারণটা করতে অঙ্কিতার খুব কষ্ট হত, তাই সে ঠিক করল “বিলাল” বা “বিরার” যা-ই হোক না কেনো , সে এটিকে ডাকবে “কিটি”। কোত্থেকে এ নাম এনেছে সে নিজেও জানতো না।
পাগলদের নিয়ে যে সংসার গড়েছিল অঙ্কিতা তা কিটির আগমনে পর্দার আড়ালে ঢেকে গেল। কিটিকে যেন সে কলিজার টুকরার চেয়েও বেশি ভালোবাসে। কিটি যেন তারই অংশ। সে কিছু খায় তো তার অর্ধেক দেয় কিটিকে। এক বছরে ছোট কিটি অনেক বড় হয়েছে। তাই সে একটি বিছানা ও কিছু শ্যাম্পু-ট্যাম্পুর বায়না ধরলো মা’র কাছে। কিন্তু তার মা বলল, যদি সে পড়ালেখায় ভাল করতে পারে, তাহলে তার আবদার পূরণ করা হবে।
২য় শ্রেণীর ১ম সাময়িক পরীক্ষায় এক বিষয় ছাড়া সব বিষয়েই ৯০-এর উপর পেলো অঙ্কিতা। আর কথামতো সে পেয়ে গেল একটি বিড়ালের বিছানা, এন্টিবায়োটিক শ্যাম্পু, সাবান আর বিড়ালের যা লাগে তার সবই। সবচেয়ে মজার জিনিষ হল, সে একটা পটিও কিনলো।
খুবই আনন্দে কাঁটছিলো অঙ্কিতা আর তার কিটির ছোট সংসার। এর মধ্যেই এক সকালে সে দেখতে পেল- তার কিটি মাটিতে কাত হয়ে পরে আছে। তার নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। তাই সে আবার চোখ কচলিয়ে দেখল- তার চোখ তাকে ভুল বলে নি। সে কিটিকে ধরে দেখল, তার সারা শরীর শক্ত ও ঠাণ্ডা হয়ে আছে। মুহূর্তের মধ্যে অঙ্কিতার মন যেন ভেঙ্গে গেল, সে যেন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। এ পর্যন্ত কাউকে মরতে দেখেনি সে। কিন্তু তার প্রিয় মারা যেতে দেখে সে হতবিহ্বল হয়ে গেল।
কীভাবে মারা গেল কিটি? এই নিরীহ প্রাণীটির সে নির্দেশিকা বই দেখে দেখে সেবা করেছে। নিজের চেয়ে বেশি খেয়াল রেখেছে। সবসময় কিটিকে কোন পশু হিসেবে নয়, আপঞ্জনের মত করে ভালোবাসেছে।
কিন্তু একি হল! তার মনে সন্দেহ হতে থাকে। তার কেন যেন মনে হল এ মৃত্যু কোন স্বাভাবিক মৃত্যু না। কেউ হয়তো কিটিকে মেরে ফেলেছে! পরক্ষণেই সে লক্ষ্য করল, আগের দিন রাতেও ইঁদুর মারার বিষের বোতলটি পূর্ণ ছিল, কিন্তু এখন প্রায় খালি। কোথায় গেল বাকি বিষটা? অঙ্কিতা যেন সব বুঝে গেল, তার মা কখনই কিটিকে সহ্য করতে পারত না, তাই হয়তো তার মা-ই ......
অঙ্কিতার খাপছাড়া জগৎ যেন তার জন্য দুর্বিষহ হয়ে গেল। এই নিরীহ প্রাণীটির হত্যা তার মন থেকে নিজের প্রাণের মায়া পর্যন্ত কেড়ে নিল। আর সে রাতেই বিষের বোতলের বাকিটা শেষ করে ফেলল অঙ্কিতা, আর তার সাথেই শেষ হয়ে গেল ঐ কোমল মনের ও জীবপ্রেমী মানুষ্টির জীবন; যা আর কখোনই ফিরে আসবে না, কখোনই না.....
০৮ মার্চ - ২০১১
গল্প/কবিতা:
২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪