একাত্তর সালের কথা । আগস্টের মাঝামাঝি সময় । একটি ই পি আর টি সির বাস চলছে ঢাকার উদ্দেশ্যে ।বাসের ভেতর নানান বয়সের নানান পেশার লোকজন । সবার চোখে মুখে এক অজানা আতঙ্ক ।বাম পাশের তৃতীয় সারির ডান পাশের সিটটিতে বসা এক তরুণ । বয়স ঊনিশ কি বিশ । সারা মুখে খোচা খোচা দাড়ি ।তরুণটির নাম সানি । সানি স্যার সলিমুল্লাহ এতিম খানায় বেড়ে উঠেছে । জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সে জেনেছে এ পৃথিবীতে তার আপন কেউ নেই । তার বাবা নেই, ভাই নেই, বোন নেই । সে শুধুই একা । ফলে কখন যে নিজ অজান্তে সে এই শহর এবং তার লোকজনকে একান্ত আপন করে নিয়েছে সে নিজেও জানে না ।আর তাই ২৫ শে মার্চ রাতের নরক যজ্ঞ সে সইতে পারেনি । চোখ ভরা জল বুক ভরা প্রতিশোধের আগুন নিয়ে ঢাকা থেকে পালিয়ে গিয়ে গেরিলার খাতায় নাম লেখিয়েছে সে । সেদিন দুপুর বেলা হঠাৎ করেই সানির মন ভাল হয়ে গেল । টানা দশদিন বৃষ্টির পর আগরতলা শহরে সূর্য উঠেছে । প্রায় এক সপ্তাহ আগে তার ট্রেনিং শেষ হয়েছে । হাইকমান্ড থেকে তাকে ঢাকায় ফিরতে বলা হয়েছে ।সেখানে গেরিলা কমান্ডার রুমীর নেতৃত্বে কাজ করবে সে ।আপাতত অ্যামবুশ অপারেশনের মাধ্যমে পাক বাহিনীকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তোলাই তাদের প্রধান কাজ ।কিন্তু গত সপ্তাহ জুড়ে অবিরাম বৃষ্টি ।একটিবারের জন্যও সূর্যের মুখ দেখা যায়নি ।আকাশ ছিল স্লেট রং মেঘে ভরপুর ।থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকেছে, মেঘ ডেকেছে । তাই তার যাত্রাও বিলম্বিত হয়েছে । আগরতলায় সানিদের ট্রেনিং এর দায়িত্ব ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর বাঙালি মেজর । নাম জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত । বর্ধমানের ছেলে । মধ্যবয়সি সদা হাসি খুশী মানুষ । ট্রেনিং এর ফাকে ফাকে সবাইকে নিয়ে জম্পেশ আড্ডা বসাতেন । আর প্রায়ই বলতেন, ‘দেশ কিন্তু মা, মায়ের সম্মান রক্ষা করার পবিত্র দায়িত্ব সন্তানের । আমার বিশ্বাস, বাংলা মা কোন কাপুরুষ সন্তান জন্ম দেয়নি ।আমি আশা করি, তোমরা তোমাদের অগ্রজ তীতুমীর, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেনদের ন্যায় জীবনের বিনিময় হলেও দেশকে রক্ষা করবে ।’ সানি বাসে বসে সে কথাই ভাবছিল ।আর প্রতিজ্ঞা করছিল যে করেই হোক পাকিস্তানি নর পশুদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতেই হবে । তার পাশের সিটে বসা এক ভদ্র মহিলা ।বয়স চল্লিশ-পঞ্চাশের মাঝামাঝি হবে। বেশ সাজগোজ করা ।কিছুক্ষন পরপর তিনি ঠোটে মৃদু রবীন্দ্র সংগীতের সুর তুলছেন, ‘আমারও পরাণও যাহা চায়, তুমি তাই, তুমি তাই…………’ সানি আশ্চর্য হয়, দেশের এই দুঃসময়েও কেউ এমন করতে পারে । মনে মনে ভাবে কিছু একটা বলবে তাকে । কিন্তু হঠাৎ করেই তার মনে পড়ে ট্রেনিংএ জ্যোতিস্যার বার বার মনে করে দিয়েছেন, কখনোই মাথা গরম করা যাবেনা ।কেননা কখনো কখনো হার জয়ের চেয়েও বেশী কল্যানকর হয়ে ওঠে । হঠাৎ করেই বাস-কন্ডাক্টরের আর্ত চিৎকার সানির ভাবনার জাল ছিন্ন করে । খাঁটি কুমিল্লার ভাষায় খানিকটা চাপাস্বরে সে বলছে, ‘ও খোদারে আ’রে খাইছে ।সামনে দি পাকসেনা গো চেকপোস্ট । আ’রেদি গাড়ি থামাইতে কইতেছে ।আল্লাহ জানে আইজক্যা কার কপালে দুঃখ আছে ।’দেখতে দেখতে পাক বাহিনী সমগ্র গাড়িটাকে ঘিরে ধরে । একে একে সবাইকে লাইনে দাড় করায় । লাইনের ঠিক মধ্যখানে সানি । তার সামনে মধ্যবয়সী ভদ্র মহিলাটি ।আচমকা পাকসেনাদের সাথে থাকা রাজাকারদের এক পান্ডা তাকে ইশারা করে বলে ওঠে, ঔই পোলা , সামনে আস ।মুহূর্তের মধ্য তার সমগ্র শিরা উপশিরা জুড়ে অচেনা এক বিদ্যুৎ খেলে যায় । মাথা ঘুরে ওঠে ।এই সম্পূর্ণ নিরস্র অবস্থায় এখন কী করবে সে ।কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ভদ্র মহিলাটি চিৎকার করে ওঠে, ‘এই ওকে তোমরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছ ।ও আমার ছেলে । সরকারী কাজে ঢাকায় যাচ্ছি । চারদিকে নানা রকম গন্ডগোল । তাই ওকে সাথে করে যাচ্ছি ।এই নাও আমার আইডি ।’ মহিলার সাহস দেখে অবাক হয় সবাই ।আরও আশ্চর্যের বিষয় এই যে, কার্ডটি দেখে অনেকটা চমকে ওঠে সেনাদের সাথে থাকা পাকিস্তানি অফিসারটি ।নিজে এগিয়ে এসে দুঃখ প্রকাশ করে ভদ্র মহিলার কাছে । তাদের গাড়িটাও ছেড়ে দেয় খুব তাড়াতাড়ি । পরে অবশ্য সানি জানতে পারে ভদ্রমহিলা তথ্য মন্ত্রনালয়ের একজন মাঝারি গোছের কর্মকর্তা । সরকারী কাজে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় যাচ্ছেন ।যদিও কিছুক্ষন আগে এই অচেনা মহিলাটিই তাকে এক কথায় দ্বিতীয় জীবন দান করেছে ।তবু কী এক তীব্র সংকোচে সারাটি পথ জুড়ে তার সাথে কোন কথাই বলতে পারেনি সে ।শুধু অচেনা এক মাতৃমূর্তির স্নিগ্ধ অনুভূতি অনুভব করেছে সারাট পথ । তার পরবর্তী দুমাস খুবই ঘটনাবহুল ।একের পর এক সফল অভিযান পরিচালনা করে সানি ও তার গ্রুপ ঢাকা শহরে পাক সেনাদের সদা তটস্থ করে রেখেছে ।এক সন্ধ্যা বেলা সানি ও তার সহযোদ্ধারা নীলক্ষেতে একটি বিদ্যুতের সাবস্টশেন উড়িয়ে দিয়ে বনানী ফিরছিল ।এমন সময় পাক সেনাদের একট জিপ তাদের পিছু নেয় । জিপের পিছনের গ্লাস ভেঙে গুলি ছোড়ে সানি ও তার সহযোদ্ধা জামী ।পাকসেনাদের জিপটি উল্টে যায় ।কিন্তু শত্রুর একটি বুলেট সানির বুকে লাগে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাড়ি থেকে রাস্তায় ছিটকে পড়ে সে।চোখ দুটি ভীষন টানছিল তার । সে দেখে সারা শহর তাকে নিয়ে চর্কি ঘুরছে ।তীব্র যন্ত্রণায় নিজ অজান্তেই জীবনে প্রথম বারের মত ডেকে ওঠে মা ।তখুনি একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পায় সে । সেই মধ্যবয়সী মহিলার কোলে সে শুয়ে আছে ।মহিলাটি পরম মমতায় তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ।চরম এক স্বর্গীয় স্পর্শে পরম নিশ্চিন্তে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়ে সানি ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
রওশন জাহান
মুগ্ধ হয়ে গেলাম. .মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার. এই বিষয়ের উপর যেকোন আবেগী লেখা আমার মন ছুয়ে যায়. আপনি হতাশ না হয়ে লিখতে থাকুন .একটা সময় আসবেই আপনি ভালো করবেন.
নাজমুল হাসান নিরো
গল্পটি পড়েই বোঝা যায় মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রক্ষাপট সম্পর্কে লেখকের ধারনা খুব গভীর। লেখাতে গভীর আবেগ আছে এবং তা প্রকাশ হয়েছে খুব ঝরঝরে এবং সাবলীলভাবে। কিন্তু গল্পের কাহিনীটা যে আমাকে আবেগপ্রবণ করে তুলল!
সূর্য
আমাকে যে কয়টি বিষয় খুব বেশী আবেগী করে তোলে, চোখের কোনে জলের নহর খুলে দেয়, মুক্তিযুদ্ধ তার একটি আর একটি হলো মা......... গল্পটা বেশ ভালো হয়েছে। আমি জানিনা অন্যরা কি করবেন, তবে আমি কোন লেখায় (যেটা আমি পড়েছি) যোগ্য ভোট দিতে কার্পন্য করিনি.....
শিশির সিক্ত পল্লব
তখুনি একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পায় সে । সেই মধ্যবয়সী মহিলার কোলে সে শুয়ে আছে ।মহিলাটি পরম মমতায় তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ।চরম এক স্বর্গীয় স্পর্শে পরম নিশ্চিন্তে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়ে সানি .....চরম.....ভাল লাগল খুব...........
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।