বর্ষার মাঝামাঝি। খাল-বিল, বাড়ির আঙ্গিনা আর নিম্নভূমি অঞ্চলের রাস্তা-ঘাট সব বর্ষাজলের দখলে। এর মধ্যে দিনকয়েক দিবা-রাত্রি কোনো সময়ই বৃষ্টির কামাই নেই। এ টানা বৃষ্টিকে ধরে নেয়া যায় অসহায় মানবের কল্যাণে উপরওয়ালার কৃপা হিসেবেই। কারণ; বৃষ্টি শুরু হবার দিন থেকে গাঁয়ের আনাচে-কানাচে অশুভ লক্ষণের আনাগোনা অনেকটা কম।
গ্রামটি সেনগাঁও। গাঁয়ের পাশে অদুরেই বর্বর পাকি বাহিনীর ক্যাম্প। গাঁয়ের যুবকরা পূর্ব থেকেই গ্রামছাড়া। তরুণী-যুবতীরা গ্রাম না ছাড়লেও মাঝেমধ্যে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়। যখন পশ্চিমা নরপশুদের আগমনী বার্তা পায়, তখন নিজেদের সম্ভ্রম রক্ষাকল্পে তারা যে যার সুবিধামতো স্থানে নিজেকে আড়াল করে রাখে। কেউ কেউ হামাগুড়ি দিয়ে জঙ্গলে গা ঢাকা দেয়। আবার কেউ কেউ দল বেঁধে পানিতে ভেসে থাকা কলাগাছ নিয়ে বিলের মধ্যখানে আখ আর পাটের খেতে আশ্রয় নেয়। তাতেও মাঝে মাঝে রেহাই মিলে না তাদের। রাজাকারের দল কলওয়ালা নাও নিয়ে চষে বেড়ায় বিলের হেথা-হোথা। খুঁজে বের করে লুকিয়ে থাকা তরুণী-যুবতীদের। তারপর জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। বিনিময়ে পায় মনিবের একগাল হাসি মাত্র। এভাবে গাঁয়ের কতজন অবলা যে ঐ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তার হিসাব করাটাও দুঃসাধ্য।
বর্ষার এমন দিনে বৃষ্টির সুবাদে পাকি সৈন্যদের উৎপাত খানিকটা কমে যাওয়ায়, গাঁয়ের অসহায় মানুষগুলির মনে কিছুটা শান্তি আসে। যদিও অনাহারে-অর্ধাহারে তাদের দিনাতিপাত চলে। আর দুর্দিনে যারা অসহায় মানুষের জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করেন, তাদেরও বিপদের অন্ত থাকে না। পাকি ঠ্যা ঠ্যা বাহিনী খবর পেলেই তাদের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ে। মুক্তিবাহিনীকে খাদ্য সরবরাহ করে থাকে- এমন অজুহাতে ধরে ধরে মারে। সেই ভয়ে গাঁয়ের জনকল্যাণকামীদের মধ্যে যারা ভীতু, তারা নীরব ভূমিকায়। কেবল অতি সাহসী যারা, তারা ডিঙ্গি নায়ে ডাল-ভাত, রুটি, চিড়া-মুড়ি বোঝাই করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গোপনে বিলির কাজে ব্যস্ত। ফলে অসহায় কারো কারো ভাগ্যে দিনে দু’এক বেলা খাবার জুটে। যদিও কারো কারো ভাগ্যে দু’দিনেও একবেলা জুটে না। কারণ; অনেক বাড়ি আছে, যেখানে পাকি বাহিনীর অগোচরে সাহায্যের হাত বাড়ানোটা অসম্ভব। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্ভব হলেও, বিলেত ঘুরে মক্কা আসার মতো। বিশেষ করে যে বাড়িগুলো ক্যাম্পের নিকটবর্তী।
তন্মধ্যে একটি হামিদ আলী বেপারীর বাড়ি। ক্যাম্প থেকে মাত্র পঞ্চাশ গজ দুরে। ক্যাম্পের এত কাছে থাকা সত্ত্বেও বাড়িটি এখনো অক্ষত। তা শুধু বাড়ির ধর্ণাঢ্য ব্যক্তি হামিদ আলীর বুদ্ধিমত্তা আর উদারতার কারণেই। অবশ্য ক্যাম্পের নিকটবর্তী অন্যান্য বাড়িগুলোতে সাহায্যের প্রয়োজন হলেও, এ বাড়িতে দরকার হয় না। কারণ; উপরওয়ালা হামিদ আলীকে যেমন দিয়েছেন ধন, তেমনি দিয়েছেন উদারতাপূর্ণ একটি মনও। তার অর্থ-বিত্ত যা আছে, তা এ বাড়ি এমনকি গোটা গ্রামের লোকজন কয়েক বছর বসে খেলেও শেষ হবার নয়। তিনিও মানবের কল্যাণে খোলা হাতে সব বিলিয়ে দিয়ে বেজায় আনন্দ উপভোগ করেন। বাড়ির সকলের চাহিদা মিটিয়ে, দুর-দুরান্তেও খাবার বোঝাই করা নৌকা পাঠান তিনি।
বাড়িটি টিকে থাকার পেছনে আরেকটি কারণও আছে। হামিদ আলী একদিকে মুক্তিবাহিনীকে এখান থেকে ক্যাম্পে আক্রমণ করতে বাঁধা দেন, অপরদিকে কথার যাদু দিয়ে পশ্চিমা বোকা বাহিনীকে বশ করে ফেলতেও সক্ষম হন। পশ্চিমা বোকা বাহিনী এ বাড়িতে এলেই হাতে পতাকা উল্টোভাবে উঁচিয়ে- পাকিস্তান জিন্দাবাদ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে স্লোগান দেন। আর বলেন- স্যার, ম্যায় মুক্তিবাহিনীকো হ্যামারা মকানকা পাছ বহেটনেকা মওকা ন্যাহী দিয়া। ইয়ে জমাকো খিঁচনেকা কাম মুজেহী দিজিয়ে। তারপর গাছ থেকে ডাব পেড়ে কঁচি ডাবের পানিও পান করান। খুশি হয়ে তারা যখন চলে যায়, তখন ক্ষোভে ফেটে পড়েন তিনি। পাকি পতাকা মাটিতে ছুড়ে ফেলে কয়েকশ লাথি মেরে তবেই ক্ষান্ত হন।
হামিদ আলীর এমন ভূমিকায় অনেকের মধ্যে কৌতুহলের শেষ নেই। কেউ তাকে বলে দুধের মাছি, আবার কেউ বলে কাপুরুষ। কারণ; ওসমান, হালিম আর অলি নামের তিন নওজোয়ানের পিতা তিনি। অথচ গাঁয়ের তরুণ-যুবক সকলে দেশমাতৃকার প্রেমে মত্ত হয়ে, যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার উদ্দেশ্যে, প্রাণ হাতে নিয়ে অজানার দিকে ছুটে গেলেও, তিনি তার তিন ছেলেকে যেতে দেন না। এরও কারণ আছে। তার দুর্বলতা- বড় ছেলের সন্তান সম্ভবা বউ। পশ্চিমা বোকা বাহিনীকে পটিয়ে এতদিন বাড়িটিকে টিকিয়ে রাখেন শুধু নাতি-নাতনীরই মুখ দেখার আশায়। তার ইচ্ছা- সময় ঘনিয়ে এলেই পুত্রবধুকে দুরের গাঁয়ে পিত্রালয়ে প্রেরণ করবেন। তারপর তিন ছেলেকে সঙ্গী করে পশ্চিমাদের ওপর জমে থাকা ক্ষোভ রুধির ধারার সাথে প্রবাহিত করবেন।
যেই ভাবনা, সেই কাজ। একদিন অভ্রদের কারাগার থেকে মুক্তি লাভের পর নীলাকাশ হেরি আলোর দেবতা উঁকি দিলে, হামিদ আলী সুযোগ বুঝে তার সন্তান সম্ভবা পুত্রবধুকে পিত্রালয়ে প্রেরণ করেন। সপ্তাহদুয়েক পরই নাতনী হবার সংবাদ পেলে, তিনি ছুটে যান পুত্রের শ্বশুর বাড়ি। নাতনীর চাঁদমাখা মুখখানা দেখে খুশিতে আত্মহারা হন। কিন্তু পরক্ষণেই তার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। নাতনীকে পিত্রালয়ে নিতে হবে, একথা মনে এলেই ভয়ে দেহখানি শিউরে ওঠে তার। ভয়ার্ত মনে সিদ্ধান্ত নেন- নাতনীকে স্বাধীন ভূখন্ডে ডানা মেলে উড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তার আগে গ্রামকে শত্রুমুক্ত করতে হবেই হবে।
তারপর হামিদ আলী নিজ ভূমে ফিরে আসেন। তিন ছেলেকে নিয়ে সভা করেন। এক এক করে পাকি সৈন্যদের কীভাবে নিশ্চিহ্ন করা যায়, তার ফন্দি আটেন। সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক বড় ছেলে ওসমানকে মুক্তিযোদ্ধা আর অসহায় মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত থাকার আদেশ দেন। নিজের জমিয়ে রাখা অর্থ, রবি মৌসুমে ঘরে তোলা ফসল সব কিছু উৎসর্গ করতে থাকেন দেশমাতৃকার বুকে সুখের তরী ভাসানোর আশায়। মেজ ছেলে হালিম আর ছোট ছেলে অলির হাতে বন্দুক তুলে দিয়ে বলেন- গাঁয়ের একটি অবলা যেন পাগলাকুকুরের কামড়ের শিকার না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবি। দরকার হলে জীবন দিবি। তারপর নিজে বেছে নেন অন্য কৌশল।
যুদ্ধ চলতে থাকে নীরব ভূমিকায়। ওসমান খাবার বোঝাই করা নৌকা নিয়ে প্রতিদিন দুর গাঁয়ে অসহায় মানুষের দারে দারে আর মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন আস্তানায় ঘুরে বেড়ায়। হালিম আর অলি অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে ঝোপের আড়ালে। আর হামিদ আলী মাঝে মাঝে নকল দাড়ি-গোফ লাগিয়ে ভিনদেশী ফকির সেজে, মুক্তিবাহিনীর খবর নিয়ে ঘুরে বেড়ান গাঁয়ের আনাচে-কানাচে। মাঝে মাঝে রাজাকারদের সাথে মিশে সুকৌশলে পাকিস্তানী ক্যাম্পেও কাটান। দেখভাল করেন- কোন রাজাকার, কোন সময়, কোন দিকে যায়? সুযোগ খুঁজতে থাকেন কখন পাকিদের একটা বিশাল অংকের ক্ষতিসাধন করা যায়।
এভাবে কয়েকটি দিন কেটে যায়। কিন্তু সবারই অজানা রয়ে যায় এ নীরব চার মুক্তিযোদ্ধার গল্প। রাজাকার তো দুরের কথা, গাঁয়ের একটি কাক-পক্ষিও কিছু উপলব্ধি করতে পারে না। এতে সুবিধাও কম হয় না তাদের। নীরব ভূমিকায় পাকি সৈন্যদের অনেক পরিকল্পনা পন্ড করার সুযোগ পায়। পাশাপাশি পাকিদের দুর্বল জায়গায় আঘাত করতেও সক্ষম হয়।
হামিদ আলী তিন ছেলেকে নিরাপদ দুরত্বে রাখলেও, নিজে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই মহৎ উদ্দেশ্য হাসিলের অপেক্ষায় থাকেন। একদিন প্রায় ধরা পড়ে যাবার উপক্রম হয়। ক্যাম্পে দরজায় কান পেতে পাকি বাহিনীর পরিকল্পনা শোনার সময় এলাকার চিহ্নিত রাজাকার আজিমদ্দির নজরে পড়েন তিনি। আজিমদ্দি হামিদ আলীকে দেখিয়ে এক পাকি ক্যাপ্টেনকে বলে- ও আদমী রাজাকার ন্যাহী হ্যায়, আপলোগোকা দুশমন হ্যায়।
হামিদ আলীর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। জীবনের শেষ মুহূর্ত বুঝি এখানেই। তবু রক্ষা পেয়ে যান তিনি। কারণ; ঐ পাকি গর্ধব হামিদ আলীর পক্ষ নেয়। আজিমদ্দিকে সজোরে থাপ্পর মেরে বলে- শালেহ্ গাদ্দার, বেঈমান। আদমীকো জান পহছেনুমে গলদ করতা হ্যায়। উহ্ আদমী বহুতহী আচ্ছা হ্যায়, হামারা দোস্ত হ্যায়।
আজিমদ্দি চামচাগিরির ফল হিসেবে থাপ্পর পেয়ে চলে যায় অন্যদিকে। হামিদ আলী দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে চুপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকেন। ভাবেন- জীবনের অন্তিমক্ষণে পৌঁছেও যখন রক্ষা হলো, এইতো সুযোগ। একদল হিংস্র পশুকে বোকা বানিয়ে পানিতে ডুবিয়ে মারা যাবে। পরক্ষণে ভাবনার সমাপ্তি ঘটিয়ে নির্বোধ পাকি ক্যাপ্টেনকে বলেন- স্যার, হাম লোগোকা মকানকা পীছে মে এক জঙ্গল হ্যায়। উহ্ জঙ্গলমে মুক্তিফৌজ চুপা হুয়া হ্যায়।
চোখ কপালে উঠে যায় ক্যাপ্টেনের। বলে- আবি চলিয়ে। মুক্তিফৌজকো কতল করকে ওয়াপ্যাচ আয়েগা।
হামিদ আলী আরো বাড়িয়ে বলে- আচ্ছি বাতই হ্যায় স্যার। ইয়ে বহুত বড়া মুক্তিফৌজকা ঠিকানা হ্যায়।
মুহূর্তের মধ্যে পাকি সৈন্যদের পনের সদস্যের একটি অপারেশন টিম গঠিত হয়। হামিদ আলী দলের সামনে থেকে এগিয়ে চলেন দ্রুত গতিতে। চোখে তার আগুন জ্বলে। লাখো বাঙালির রক্তের বদলা নিতে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ চলে। প্রতিশোধের আগুন নেভানোর নেশায় মত্ত হয়ে তার গতি আরো বেড়ে যায়। পাকি সৈন্যদের বলেন- জোর কদমচে চলে, আজ মউতকা ঘণ্টে বাজায়েগা।
এ কথা শুনে পাকি বাহিনীর গতি আরো বেড়ে যায়। তারা হিংস্র হয়ে ওঠে আরো কয়েকশ গুন। এভাবে চলতে চলতে হামিদ আলী তার পুকুর ঘাটে গিয়ে সবার গতি রোধ করেন। অপারেশন টিমের ক্যাপ্টেন বলে- কাহা হ্যায় গাদ্দার আজাদ ফৌজ?
ওদার জঙ্গলকা বীছমে হ্যায়। ম্যায় আপলোগোকে ওদার কিস্তিমে ছড়াকে লে জায়েঙ্গে।
আচ্ছে হ্যায়। জলদি করো! জলদি চলো।
হামিদ আলী তার ঘরের পেছন থেকে লম্বা একটি বাঁশ নিয়ে আসেন। যার গোড়ার অংশটি আগের দিন খুব সরু করে রাখা হয়। তারপর এক এক করে পাকি সৈন্যকে নৌকায় ওঠার আমন্ত্রণ জানান। সবাই ওঠে গেলে বাঁশে মৃদু ভর দিয়ে নৌকাটা পুকুরের মধ্যখানে নিয়ে যান। নৌকায় পাতানো কাঠের একটা অংশ তুলে এক পাকি সেনা সদস্যের হাতে দেন। ডানে-বায়ে তাকিয়ে দুই ছেলের অবস্থান বুঝে নিয়ে, হাতের বাঁশটি দিয়ে নৌকার তলদেশে সজোরে আঘাত করেন। সাথে সাথে ঝাঁপিয়ে পড়েন পানিতে। এক ডুবে ঝোপের আড়ালে গিয়ে চোখ আর নাক ভাসান। দেখতে পান- নির্বোধ অপারেশন টিম হালিম আর অলির গুলি খেতে খেতে কীভাবে তলীয়ে যায় বর্ষাজলের গভীরে।
মুহূর্তের মধ্যেই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে গাঁয়ের সর্বত্র। সাথে সাথে ক্যাম্পেও খবর চলে যায় রাজাকার আজিমদ্দির মাধ্যমে। ক্যাম্প থেকে এক এক করে পাকি সৈন্য এসে জমায়েত হয় হামিদ আলীর বাড়ি। খুঁজতে থাকে হামিদ আলীকে। ঘরে ঘরে তল্লশি চালিয়ে কয়েকজন ষাটোর্ধ বৃদ্ধা আর তের চৌদ্দ বছর বয়সী এক মানসিক প্রতিবন্ধী ছাড়া কিছুই তারা খুঁজে পায় না। কারণ; হামিদ আলী সকলকে আগে থেকেই সাবধান করে দিয়ে যায়। অবশেষে সকলকে বাদ দিয়ে ঐ মানসিক প্রতিবন্ধীর ঘাড়েই চেপে বসে পাকি সৈন্যরা। এক নির্বোধ পাকি সৈন্য বলে- উহ্ শালেহ্ স্টুডেন্ট গাদ্দার হ্যায়। শালেহ্ হামলোগোকি ওপার কাররাওয়াই করনেকা কোশেষ কিয়া।
এ কথা শুনে আজিমদ্দি প্রতিবন্ধী ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করে- এই ছেমরা ক, হামিদ আলী কোনাই গেছে? নাইলে আইজ গুলি দিয়া তোর পেট ফুডা কইরা দিমু।
বেচারা শুকুর আলী পেটে হাত দিয়ে বলে- এই পেট নিয়া বেক মাইনষে আমারে আজে বাজে কতা কয়। দেন ফুডা কইরা দেন। আমার উজুনডা একটু কইম্মা যাউক। শেষে হা...হা... করে হাসতে থাকে। এ হাসি দেখে এক পাকি সৈন্য বন্দুক তাক করে তাকে গুলি করার জন্য। শুকুর আলীর দাদি দৌড়ে গিয়ে আজিমদ্দির পায়ের উপর পড়ে। বলে- অরে মারিস না আজিমদ্দি। আল্লার আরশ কাইপা উডব, অ পাগল, অচেতন এক মাছুম বাচ্চা।
আজিমদ্দি বৃদ্ধাকে লাথি মেরে সরিয়ে দেয়। সবার সামনে ঘোষণা করে হামিদ আলীর সন্ধান দিতে পারলেই শুকুর আলীকে ছাড়বে, অন্যথায় গুলি করে ওকে পানিতে ফেলে দিবে। কিন্তু রাখে আল্লাহ, মারে কে? আজিমদ্দির ঘোষণার পর মুহূর্তেই দেখা যায় এক বৃদ্ধ লাঠিতে ভর করে হামিদ আলীর বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বৃদ্ধের মুখভর্তি সাদা দাড়ি, পরণে জোড়াতালি দেয়া ধুসর রঙের পাঞ্জাবী। পাকি সৈন্যরা ঐ বৃদ্ধকে লক্ষ্য করে বন্দুক তাক করলে আজিমদ্দি বাঁধা দেয়। বলে- ন্যাহী, বন্দুক মাত চাহিয়ে। মালুম হোতা হ্যায় দারবিশ হ্যায়। এছকি পাস হামিদ আলীকা বারে মে বহুত ইনফরমেশান লে ছেকেগা।
পাকি সৈন্যরা বন্দুক নামিয়ে নেয়। আজিমদ্দি বৃদ্ধকে কাছে ডেকে আনে। বৃদ্ধ কাছে এসে কাঁপা কণ্ঠে বলে- বাজি, হামিদ আলীরে দরকার। হে কি বাড়িত নাই? আমারে কাইল আইতে কইছিল।
আজিমদ্দি মুচকি হাসি দিয়ে পাকি সৈন্যদের দিকে তাকায়। তারপর বৃদ্ধকে বলে- কয়টায় আইতে কইছিল আর ক্যান কইছিল ?
বাজি, কইছিল দুপুরে আওনের লেইগা। কিন্তু ক্যান কইছিল তা কওন যাইব না!
আজিমদ্দি রেগে ওঠে। বুড়োর ঘাড় চেপে ধরে বলে- ক্যান কওন যাইব না? এই বুড়া, বন্দুক দিয়া দরবেশগিরি ছুডায়া দিমু। ক, ক্যান আইতে কইছিল।
বৃদ্ধ বলে- বাজি, বড্ড শরমের কতা, হেগরে হরায়া দেওন যায় না।
আজিমদ্দি দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধাদেরকে হাতের ইশারায় যার যার ঘরে চলে যাবার হুকুম করে। সবে এক এক করে ঘরের দিকে রওয়ানা হয়। শুধু রয়ে যায় দু’জন বৃদ্ধা। একজন শুকুর আলীর দাদি, অপরজন হামিদ আলীর স্ত্রী হাফেজা খাতুন। আজিমদ্দি দু’জনকে দেখে চেচিয়ে ওঠে- আপনেরা যাইবেন, না গুলি কইরা অরে পানির মইধ্যে ছাইরা দিমু?
ভয়ার্ত মনে শুকুর আলীর দাদি প্রস্থান করে। হাফেজা খাতুন দরবেশের দিকে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থাকার পর মৃদু হাসি দিয়ে চলে যায় ঘরের দিকে। আজিমদ্দি তাকিয়ে থাকে হাফেজা খাতুনের চলে যাওয়া পথের দিকে। ক্ষণপর দরবেশের দিকে মন ফিরিয়ে নেয় সে। বলে- এইবার কন, ক্যান আপনেরে আইতে কইছিল।
বৃদ্ধ বলে- কয়দিন ধইরা হে একটা ওসুধ খায়। জোয়ানি শক্তিবর্ধক ওসুধ। হেইডা খায়া বুড়াকালেও নাহি হের মনে বিয়া করার সাধ জাগে। আমারে কইছিল একটা শক্ত দাওয়াই লইয়া আইতে। যা খাইলে এক রাইতেই পঁচিশ বছইরা জোয়ানের মতো দশটা বাসরে যাওনের ক্ষমতা অইবো হের।
কথা শুনে আজিমদ্দির তলপেট গরম হয়ে যায়। ভাবে- গতকাল যে কয়টা তরুণী ক্যাম্পে নেয়া হয়েছে, সেখান থেকে একটার ভাগতো তারও পাবার কথা। তার আগে দরবেশের কাছ থেকে এমন একটা দাওয়াই পেলে তো সুখের অন্ত নেই। আর মনিবদের এ দাওয়াই ধরিয়ে দিতে পারলে টাকাও কামাই হবে মেলা। অবশেষে ভাবনার সমাপ্তি ঘটিয়ে সে পাকি ক্যাপ্টেনের কানে কিছু একটা বলে। শুনে পাকি ক্যাপ্টেন খুশিতে মেতে ওঠে। পরে এক কান, দু’কান করে সব পাকি সৈনিকদের মাঝে কথাটা বিলি হয়। সবাই খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়। আজিমদ্দিও মনিবদের খুশি দেখে হেসে কুটিকুটি হয়। পাকি ক্যাপ্টেন দরবেশকে বলে- ইয়া দারবেশ, হার আদমিকো এক এক করকে দাও।
বৃদ্ধ তার ঝোলা থেকে লাল-নীল দু’টি কৌটা বের করে। লালটি দেখিয়ে বলে- ইয়ে খানেছে বহুত জলদি কাম খতম হোগা। নীলটি দেখিয়ে বলে- আওর ইয়ে খানেছে কাম হোগা আহেস্তা আহেস্তা। আপ কোনটু খায়েগা?
পাকি ক্যাপ্টেন নীল কৌটা হাতে নিয়ে বলে- শালেহ্ দারবেশ, জলদি কাম হোনেকা বাদ এছ ওয়াকত্ জায়েগন কাহা? আহেস্তা আহেস্তা কাম হোতা হ্যায়, হামারা ইয়ে খায়েগা।
তারপর কৌটা খুলে জনপ্রতি একটি করে বড়ি বিতরণ করে। বাকী থেকে যায় তিনজন। আজিমদ্দি আর দুই পাকি সৈন্য। তিনজনেরই আফসোস হয়। দরবেশ বহু তল্লাশি করেও তার ঝোলা থেকে নীল বড়ি খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়। আজিমদ্দি অধৈর্য হয়ে বলে- আমাকে লাল বড়িই দেন দরবেশ। দুই পাকি সৈন্য আজিমদ্দিকে দুরে সরিয়ে বলে- ন্যাহী, পহেলে হামলোগোকো দি জিয়ে। আগার খতম্ হো জায়েগা তো ফির মিলেগা কাহা ?
বৃদ্ধ তার ঝোলা থেকে লাল কৌটা বের করে। মনে মনে বলে- আহারে আজিমদ্দি, তুই যে আমার পাড়াত ভাই। তাই তরে কষ্ট দিতে আমার মন কাঁদে। তারপর দুই পাকি সৈন্যকে বলে- শ্রেফ হ্যায় দুটো। আপলোগ লি জিয়ে। উসকো দেনেকা জরুরাত ন্যাহী হ্যায়।
দুই পাকি সৈন্য তড়িঘড়ি বড়ি দু’টি ছিনিয়ে নেয়। আজিমদ্দি মনোকষ্টে অজানা কোন খেয়ালে ডুবে যায় নীরবতার গভীরে। তার নীরবতা দেখে দরবেশ বলে- কিরে বাবা, চিন্তা কি তর? প্রভুরে খুশি করালেই ত অয়। চিন্তা নাই। দরকার অইলে হামিদ আলীর লেইগা রাহা আসল দাওয়াইডাই তরে দিমু। অহন আমার পয়সা দে।
আজিমদ্দি মনিবের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। মনিব পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করে দেয়। আজিমদ্দি তা নিজের পকেটে পুরে রাখে। দরবেশকে বলে- আগে আমার ডুজ চাই, তারপর আপনের ট্যাকা দিমু। দরবেশ হা করে তাকিয়ে থাকে আজিমদ্দির দিকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দরবেশের বড়ির ক্রিয়া শুরু হয়। পাকি সৈনিকদের মধ্যে যারা নীল বড়ি খায়, তারা ক্যাম্পে যাবার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। দরবেশের বড়ি তাদের দেহে মরণকামড় দিলেও, মনে যৌবনের ঝড় তুলে দেয়। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যাপ্টেন তার দলবল নিয়ে ক্যাম্পের দিকে রওয়ানা হয়। ক্যাপ্টেনের হাতে তখনো মানসিক প্রতিবন্ধী শুকুর আলীর হাতটি ধরা। সে শুকুর আলীকে টেনে-হেছড়ে এগিয়ে যেতে থাকে। আজিমদ্দি ক্যাপ্টেনকে বলে- স্যার, উনকে ল্যাকে কেদার যা রাহা হ্যায়। ওহতো লারকী ন্যাহী হ্যায়।
পাকি ক্যাপ্টেন শুকুর আলীর হাত ছেড়ে দেয়। শুকুর আলী দৌড়ে গিয়ে তার দাদির কোলে মাথা রাখে। ক্ষাণিক পরে দরবেশ জোর গলায় আওয়াজ করে- বাবা হালিম..... অলিকে নিয়ে চলে এসো। বিবি হাফেজা, সবাইকে বল ঘর থেকে বের হতে। বাড়িটাকে মনে হয় আর টিকিয়ে রাখা যাবে না।
ডাক শুনে একে একে সবাই ঘর থেকে বের হয়ে যায়। ততক্ষণে দরবেশ তার বেশ পরিবর্তন করে হামিদ আলীর মাঝে হারিয়ে যায়। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে হামিদ আলীর দিকে। শুকুর আলী তার পেট দেখিয়ে বলে- দাদা, দরবেশ না আইলে কত বালা অইত। আমার পেটটা হেরা পুডা কইরা উজুন কমাইতে চাইছিল। বজ্জাত দরবেশটা অহন ভাইগ্গা গেছে ?
শুকুর আলীর কথার দিকে হামিদ আলীর খেয়াল থাকে না। সবার উদ্দেশে বলে- যার যা কিছু সম্ভব সঙ্গে নিয়ে কেটে পড়তে হবে। সুর্য ডুবার আগেই বাড়ি ছাড়া চাই সবার। ঐ কুকুরের দল এখনই ছটফট শুরু করে দিয়েছে। রাতেই সব কয়টা মারা পড়বে। তার বদলা নিতে বাড়িটা বোমা মেরে উড়িয়ে দিবে ওরা।
কথাটা বলে হামিদ আলী আর বসে থাকে না। পরক্ষণে হালিম আর অলিও এসে হাজির হয়। দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে হামিদ আলী নিজের ঘর থেকে কলসি ভর্তি টাকা আর পরিবারের জন্য যতটুকু সম্ভব খাবারের বস্তা নিয়ে দু’টি নৌকা বোঝাই করেন। অন্যরাও যার যার সাধ্যমত সামানা নিয়ে জড়ো হতে থাকে বাড়ির পেছনের দিকে শেষ প্রান্তে। যেখানে অনেকগুলো নৌকা পূর্ব থেকেই নোঙর করা।
বিকেলের মধ্যেই সব গোছানো শেষ। তরুণী-যুবতী আর গৃহবধু মিলিয়ে একটি নৌকা ডুবে ডুবে ভাব। পিচ্চি ছেলে-মেয়ে আর বুড়া-বুড়ি নিয়ে একটি নৌকা বোঝাই। বাকী নৌকাগুলিতে খাবার আর মূল্যবান জিনিসপত্র। সব মিলিয়ে দশ বারোটি নৌকা হামিদ আলীর নেতৃত্বে ছুটে চলে। উদ্দেশ্য, আপন গ্রাম থেকে দুরে সরে ক্ষণিকের জন্য বেঁচে থাকা।
সেদিন সন্ধ্যার মধ্যেই খবর ছড়িয়ে পড়ে ক্যাম্পে পঁচিশ পাকি সৈন্য ইঁদুর মারার বিষ খেয়ে নিহত। গভীর রাতে দেখা যায় ক্যাম্পের খুব নিকটে ধাউ ধাউ করে আগুনের শিখা উড়ছে। বোমার আঘাতে সৃষ্ট আগ্নিকুন্ডের প্রখরতা এতটাই বেশি যে, মেঘমুক্ত আকাশের উজ্জল নক্ষত্রও চোখের জালে আটকাতে পারে না কেউ। দুর গাঁয়ের হাজার হাজার জনতা মাথা উঁচিয়ে দেখে উদিয়মান অগ্নিকুন্ড। পূর্বপুরুষদের হাতে গড়া বাড়ি যে ক্ষণিকের ব্যবধানে জ্বলে-পুড়ে ছাই, তা উপলব্ধি করতে পেরে হামিদ আলীর অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। তার তিন ছেলে ওসমান, হালিম আর অলিও অশ্রুবিসর্জন দিতে থাকে। সাথে অন্যরাও ডুকরে ডুকরে কাঁদে।
পরক্ষণেই হামিদ আলী নিজের কান্না হজম করে নেয়। কারণ; নিজের দুঃখের চেয়ে অন্য কারো দুঃখই তার হৃদয়কে ভেঙ্গে চৌচির করে দেয়। তাই সবার উদ্দেশে জোর গলায় বলে- ঐ, তোরা কাঁদছিস কেন? পুড়ছে পাকিস্তানের সম্পত্তি। জ্বলে-পুড়ে শেষ হলে বৃষ্টি যখন সব ধুয়ে নিবে, তখন অবশিষ্টটা হবে আমাদের সম্পদ। যে সম্পদের নাম হবে স্বাধীনতা। স্বাধীনতার মতো কঠিন সম্পদ থাকলে, জীবনে আবার সবই ফিরে আসবে।
সবাই অশ্রু মুছে মনকে শক্ত করে নেয়। গভীর রাতেও কারো চোখে ঘুমের আনাগোনা নেই। অবশ্য চোখে ঘুম এলেও তো বিপদ। জায়গা কোথায় ঘুমাবার? দুর গাঁয়ে বিলের মধ্যখানে খোলা গগনতলের ভাসমান তরীই যে তাদের বর্তমান বসতঘর। তাই বিকল্প বসতঘরে সবাই আটসাট হয়ে নীরবতা নিয়ে বসে থাকে। সেই নীরবতার মাঝে অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকে কখন আসবে সোনালী সকাল। যে সকালে উঁকি দিবে স্বাধীনতার সুর্য।