ভোর পাঁচটা বেজে পঁচিশ মিনিট। রমিজা বাসা থেকে বের হলো। উদ্দেশ্য বংশাল রোড ৩২ নম্বর বাসা। সে থাকে কেরানীগঞ্জ। তার বাসা থেকে বংশাল হেঁটে যেতে সময় লাগে প্রায় এক ঘণ্টা। সাড়ে ছয়টায় ৩২ নম্বর বাসার গেট খোলে। তাকে গেট খোলার সাথে সাথে বাসায় প্রবেশ করতে হয়।
রমিজা আমার গল্পের প্রধান চরিত্র। তার স্বামী নাই। নাই বলতে মারা যায় নাই। আর একটা বিয়ে করে বাড্ডা এলাকায় থাকে। রমিজা থাকে তার ছেলেকে নিয়ে। ছেলের নাম কাসেম। কাসেমের বয়স ছয় বছর। এই বছর তাকে প্রাইমারীতে ভর্তি করা হয়েছে। ফলে রমিজার খরচ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে রমিজা তিন বাসায় কাজ করতো। দুইটা ফ্যামিলি বাসা একটা ব্যাচেলর মেস। যে আয় হতো তাতে ভালোই চলতো কিন্তু এখন তাকে আরো একটা কাজ বেশি নিতে হয়েছে শুধু ছেলের জন্য। যা হোক রমিজা কাজ করে মানুষের বাড়ি বাড়ি। বাড়ির কর্ত্রীরা তাকে ডাকে কাসেমের মা।
-কাসেমের মা কালকে কাপড় ধোও নাই কিন্তু।
-কাসেমের মা তরকারিতে লবণ একটু কম দিবা।
-কাসেমের মা ঘর মুছনা কয়দিন।
৩২ নম্বর বাসার ৫’ম তলা। বাসার ছোট মেয়ের নাম জেরিন। এবার দশম শ্রেণীর ছাত্রী। স্কুলে যাবে। তাই তৈরি হচ্ছে।
জেরিন : খালা টেবিলে খাবার দাও তাড়াতাড়ি।
রমিজা : দিতাছি।
রমিজার খাবার দিতে দেরি হয়। এত আগে কখন ও জেরিন খাবার চায় না।
জেরিন : কৈই খালা, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে ।
জেরিনের মা : এত তাড়া কিসের। স্কুল শুরু হতে এখন ও দুই ঘণ্টা বাকি।
জেরিন : মা আজ স্কুলে আগে আগে যেতে হবে। পরশু নববর্ষ। বন্ধুরা মিলে আলোচনা করতে হবে কি কি করবো। খুব মজা হবে।
জেরিনের মা : সামনে পরীৰা সে দিকে খেয়ার দে। এই সব ফাজলামি বাদ দে।
জেরিন : মা, তুমি নববর্ষকে ফাজলামি বললা। so sad.
জেরিন একটু রাগ হবার ভান করে। জেরিনের মা আর কিছু বলে না। সে কি কম। সকাল বেলা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরে রমনায় সেও যায় পান্তা ইলিশ খেতে। বাসায় ও রান্না হয়। তারপর ও তাকে রমনায় যেতে হবে। অভ্যাস হয়ে গেছে।
রমিজার আটটার মধ্যে কাজ শেষ করে মেসে কাজ করতে যেতে হয়। সকালের রান্না। কিছু ছাত্র থাকে। আট জন। তাদের রান্না শেষ করে অন্য এক বাসায়। থালা বাসন মাজা, ঘর দুয়ার মোছা এর পর আবার মেসে। দুপুরের রান্না করা। আজ দুপুরে এসে দেখে বাজার হয় নাই। তার মনটা খারাপ হয়ে যায়। আজ তার একটু তারা ছিলো। ছেলেকে নিয়ে তার বাজারে যেতে হবে। ছেলে বায়না ধরেছে তাকে একটা সাদা পাঞ্জাবি কিনে দিতে হবে। একটা মাত্র ছেলে। বাবা থেকেও নেই। শত কষ্টের মধ্যে ও তাকে সুখী রাখতে চায় রমিজা। বাজার আনার কোন নাম নেই। রমিজা আর চুপ থাকতে পারে না। পাকের ঘর থেকে বের হয়। রুমের সবচেয়ে যে ছোট তাকে পায়।
রমিজা : রাজিব ভাই, বাজার করেন না? রান্না করা লাগবে না।
রাজিব : আজ তো আমার বাজার না।
রমিজা : কার বাজার ?
রাজিব : শিমুল ভাই।
রমিজা : কৈই ? বাজারে কি গেছে?
রাজিব : তাতো বলতে পারবো না।
রমিজা : না গেলে আপনি যান।
রাজিব : আমার তো পরীৰা। আমি কি ভাবে যাব।
রমিজা : কিছু একটা করেন। আমার একটু তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে।
রাজিব : কেন? আপনার স্বামী আবার ফিরে আসছে নাকি?
রমিজা : সব সময় ফাজলামি করবেন না। ছেলেকে নিয়া বাজারে যাব। ছেলের নববর্ষের ডেরেজ কিনতে
হবে।
রাজিব : ওরে আল্লাহ, আপনার আবার নববর্ষের ড্রেস ও কেনা লাগে।
রমিজা : নববর্ষ কি শুধু বড়লোকগে?
রাজিব : না, তা না কিন্তু; আমার কোন নববর্ষ নাই। আমি কোন দিন ও নববর্ষের দিন ঘর থেকে বের
হই না।
রমিজা : আপনার জন্য তো আর পৃথিবী বসে থাকবে না। কথা না বাড়াইয়া বাজারে যান।
স্কুলের বারান্দায় দাড়িয়ে পাঁচ বান্ধবী। কথা বলছে। সবার মুখেই একটা হাসির আভা। সুমাইয়া আজ স্কুলে আসে নাই। আসলে ছয় জন হইত। জেরিন কথা বলছে সবার থেকে বেশি।
জেরিন : সুমাইয়া আসে নাই কোন সমস্যা না। আমি ওকে ফোন করে সব জানিয়ে দেব।
তাপসি : তাহলে সুমাইয়াকে জানানোর দায়িত্ব তোর। এখন কথা হচ্ছে সবার এক রকম জামা হতে হবে,
এক রকম স্যান্ডেল সব সব এক রকম। ঠিক আছে?
সোনিয়া : ঠিক তো আছে কিন্তু সব তো কিনতে হবে আগে তাই না।
জেরিন : অবশ্যই কিনতে হবে। বিকেলে সবাই স্কুলের সামনে চলে আসবি। বেশি না মাত্র হাজার দুই
টাকা আনলেই চলবে। একটা সাদা শাড়ি, চুরি কিছু কসমেটিক্স এই তো। নাকি?
এতৰন আশা কোন কথা বলে নাই। এবার কথা বলে।
আশা : দুই হাজার টাকা। এত লাগবে কেন? তিন - চারশ টাকার একটা শাড়ি কিনলেই তো হয়।
জেরিন : কিনলে হয় কিন্তু এত অল্প দাম!
আশার মনটা খারাপ হয়ে যায়। দুই হাজার টাকা তার বা তাদের জন্য অনেক কিছু। দশ টাকার জন্য বাবার কাছে দশ বার চাইতে হয়। সে বুঝে তার বাবার অবস্থা খুব একটা ভালো না। হয়তো চার পাঁচশ টাকা দিলেও দিতে পারে কিন্তু দুই হাজার টাকা এটা অসম্ভব। হত বছর আশা ঘর থেকে বের হয় নাই। সবাই নববর্ষে নতুন জামা পরে বের হয় বিশেষ করে তার বন্ধুরা সেখানে সে? এবার ও হয়তো হবে না। আচ্ছা নববর্ষের জন্য নতুন জামা লাগবে কেন। আশা আৰেপ করে। সে কেন মধ্যবিত্ত ঘরে জন্ম গ্রহণ করলো। নিম্নবিত্ত হলেও চলতো বা উচ্চবিত্ত। কিন্তু মধ্যবিত্ত? না পারে সামনে যেতে না পারে পিছে।
রমিজা তিনটার দিকে বাসায় আসে। এক বাটি খাবার নিয়ে। মেস থেকে সে দুপুর আর রাতের খাবার আনে। সে আর তার ছেলে ভাগ করে খায়। আজ কাসেম আগে আগেই বাসায় চলে এসেছে। প্রতিদিন প্রথমে দেখা হলেই বলে - মা খাবার দাও, খিদা লাগছে। আজ আর খাবার কথা বলে না।
কাসেম : মা এত দেরি করলা ক্যা?
মা : আমি তো এই টাইমেই আসি। ক্যারে?
কাসেম : পাঞ্জাবি কিনতে যাবা না।
মা : যাব তো কইছি। এত ব্যস্ত হবার কি আছে। খিদা লাগে নাই।
কাসেম : না লাগে নাই। পাঞ্জাবির খিদা লাগছে।
মা : তাড়াতাড়ি খা তারপর যাবানি।
কাসেম : মা?
মা : কি।
কাসেম : ঐ দিন কিন্তু বড় একটা ইলিশ মাছ রানবা। আমার স্কুলের আপা কইছে ঐ দিন সকালে ইলিশ
মাছ দিয়া পান্তা ভাত খাইতে হয়।
মা : ঠিক আছে, এখন ভাত খা। বিকালে আবার কাজে যাইতে হবে।
কাসেম : ক্যা, পাঞ্জাবি কিনতে যাবা না।
মা : যাব কইলাম তোরে বাপ। তাড়াতাড়ি খা।
কাসেম যেন এক নিঃশ্বাসে সব ভাত খেয়ে ফেলতে চায়। ঈদ ছাড়া সে কখনও নতুন জামা পায় না। জামার দামটা তার কাছে কোন বিষয় না। নতুন একটা জামা হইলেই হলো। নতুন জামা মানে তার কাছে ঈদ। নববর্ষ নিয়ে তার কোন স্বচ্ছ ধারনা ও ছিল না। নববর্ষে যে সাদা পাঞ্জাবি গায়ে দিতে হবে তা সে জেনেছে তার এক স্কুলের বন্ধুর কাছ থেকে। সে নতুন একটা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে এসে বলেছে এটা তার নববর্ষের পাঞ্জাবি। নববর্ষের দিন পরবে। আগেই পরে এসেছে বন্ধুদের দেখানোর জন্য। সাধারণত এই স্কুলে কোন সচ্ছল পরিবারের সন্তান পড়ে না। সবাই নিম্নবিত্তের। এদের এতটুকু আনন্দই যেন অনেক। কাসেম আজ তার মার সাথে নতুন জামা কিনতে যাবে। রমিজা তার টাকার পুটলায় হাত দেয়। সে টাকা গোনে। তিনশত আশি টাকা আছে। ছেলেকে নিয়ে যাবে গুলিস্তান।
জেরিন আর তার মা কথা বলছে।
জেরিন : মা আমাকে দুই হাজার টাকা দাও। একটা শাড়ি কিনতে হবে।
মা : শাড়ি কিনে কি হবে?
জেরিন : কি যে বল। একদিন পরই তো নববর্ষ। আমরা ঠিক করেছি শাড়ি পরে এবার রমনায় যাব।
মা : ঠিক আছে, তা যাবি কিন্তু শাড়ি তো পরবি একদিন তাই না?
জেরিন : হ্যাঁ।
মা : তাহলে দুই হাজার টাকার কি দরকার?
জেরিন : মা! আমার বান্ধবী সোনিয়া কম করে হলেও পাঁচ হাজার টাকার বাজার করবে। বুঝছো।
মা : বুঝলাম, কখন লাগবে?
জেরিন : এখনই।
মা : এখনই? তুই একা যাবি নাকি সবাই?
জেরিন : সবাই। ও'হো ভাল কথা মনে পরছে। সুমাইয়াকে একটা কল দিতে হবে।
জেরিন টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিয়ে কানে ধরে।
রিং হচ্ছে।
সুমাইয়ার মা রিসিভার তুলে।
সুমাইয়ার মা : হ্যালো, কে বলছেন?
জেরিন : আন্টি আমি জেরিন। সুমাইয়া আছে।
সুমাইয়ার মা : হ্যাঁ আছে।
জেরিন : ও আজ স্কুলে গেল না কেন আন্টি?
সুমাইয়ার মা : ওর মাথা ব্যথা করতে ছিলো।
জেরিন রিসিভার কানে ধরে রাখে। ও পাশে সুমাইয়ার মা সুমাইয়াকে ডাকে।
জেরিন : হ্যালো সুমাইয়া।
সুমাইয়া : হ্যাঁ জেরিন কি খবর।
জেরিন: খবর আছে । শোন, দুই হাজার টাকা নিয়ে বিকেল পাঁচটায় স্কুলের সামনে চলে
আসবি ।নববর্ষের জন্য শাড়ি কিনতে যাব।
সুমাইয়া : তাই। শাড়ি পরবি এবার । খুব মজা হবে । ও শোন আশা কি আসবে ।
জেরিন : জানি না। বললো তো আসবে।
সুমাইয়া : আমি জানি ও আসবে না । শাড়ি কেনার আইটেমটা বাদ দিলেই পারতি। যে যা পারে
পরে আসতো ।
জেরিন : দূর এটা কি হয় নাকি । চলে আসিস। পাঁচটার ভেতর ঠিক আছে।
সুমাইয়া : ঠিক আছে ।
জেরিন : মাথা ব্যথা করছে।
সুমাইয়া : আরে দূর। মাথা ব্যথা আবার কখন হলো।
জেরিন : ও ফাকি বাজ। রাখি।
সুমাইয়া : রাখ।
রমিজা রাতের রান্না করার জন্য আবার মেসে এসেছে। এখন শুধু ভাত রানলেই চলবে আর দুপুরের তরকারি ও ডালটা একটু গরম করতে হবে।আজ আসতে রাত হয়ে গেছে। ছেলেকে বাসায় দিয়ে তারপর আসতে হয়েছে।
রাজিব পড়ছে। শিমুল ভাই পত্রিকা দেখছে। রুমের বাকি সবাই টিউশনিতে। রমিজাকে দেখে প্রথমে রাজিব কথা বলে ।
রাজিব : খালা এক মগ পানি গরম করে দেন ।
রমিজা : কেন ?
রাজিব : জানেন না কেন। চা খাব।
শিমুল : আজ বাজার কি তুমি করেছো?
রাজিব :হ্যাঁ। আপনার বাজার ছিলো। কি যে করেন না।
শিমুল : ভাই, ইলিশ মাছ কি কিনছো?
রাজিব : না।
শিমুল : কেন কিনলা না ভাই। কাল কি কেনা যাবে। যে দাম বাড়ছে রে বাবা।
রমিজা :শিমুল ভাই জামা কাপড় কিছু কিনলেন না?
শিমুল : না। গত বছররে একটা সর্ট পাঞ্জাবি আছে এবার ঐ টা দিয়া চালিয়ে দিবো। কি রাজিব, এই
বার ও কি ঘর থেকে বের হবা না।
রাজিব :না ভাই। আপনার মত অত সুখ আমার নাই।
শিমুল :কি যে বল। এটা আমাদের প্রাণের উৎসব। এই সব উৎসবে এ্যাটেন্ড করবা না তো কি করবা।
রাজিব :কিন্তু উৎসবকে আমরা শ্রেণী বিন্যাস করে ফেলেছি।চিন্তা করেন আমরা বছরে একদিন দুইশ টাকা
প্লেট দিয়া পান্তা ইলিশ খাই কি মজা মাইরা। আর আমাদের পাশের মানুষ দিনের পর দিন
পান্তা ভাত ও কপালে জুটাতে পারে না। চিন্তা করা যায়।
শিমুল : তুমি তো দেখি সমাজ সেবকের মত কথা বলতেছো। এই সব কথা কারা বলে জান। যারা
চালবাজ সমাজ সেবক তারা।
রমিজা : না, রাজিব ভাই হক কথা বলছে। আমার ছেলেকে প্রতিদিন ই শুকনা মরিচ দিয়ে পান্তা ভাত
খাইতে হয়।সকালে রান্না করতে পারি না। রাতের ভাত রেখে দিতে হয়। মাঝে মাঝে একটা
ডিম ভাইজা দেই।
শিমুল :থাক থাক আপনাকে আর ভাষণ দেওয়া লাগবে না রান্না করতে যান। রাজিব, মিলে টাকা থাকলে
তিনশ টাকা দেও। একটা ছোট খাট মাছ নিয়ে আসি। তা না হলে কাল কিনতে গেলে ছয়
সাতশ লাগবে।
রাত আট টার দিকে রমিজা বাসায় ফিরে। সারা দিনের এক ক্লান্তিকর পরিশ্রমের পর শরীরের কথায় বিছানায় পা এলিয়ে দেয়। কাসেম মাকে জড়িয়ে ধরে পাশে শুয়ে পরে।
কাসেম : মা ও মা কাল একটা ইলিশ মাছ কিনবা।
রমিজা :ঠিক আছে, কিনবানে।
কাসেম : বড় একটা।এই দেখ এত বড়। হাত দিয়ে মাছের সাইজ দেখায় সে তার মাকে, মা হাসে।
রমিজা : এত বড় মাছ কি পাওয়া যায় রে।
কাসেম : ঠিক আছে এতটুক একটা আনবা। হাত দিয়ে আবার ও মাছের সাইজ দেখায়।
রমিজা : ঠিক আছে, আনবো কইলাম তো। এখন ঘুমা।
কাসেম : কতদিন ইলিশ মাছ খাই না।
রমিজা : চুপ কর এখন ঘুমা।
রমিজা ঘুমিয়ে পরে। কাসেম স্বপ্ন দেখতে থাকে সে বড় বড় তিন টুকরা মাছ খাবে। মাথাটা ও খাবে। অনেক আগে এক বার ইলিশ মাছ খাইছিলো। মা আনছিলো কোন বাসা থেকে যেন। ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পরে। একটা রাত শেষ হয়। আবার নতুন করে সূর্য উকি মারে আকাশের বুকে। রমিজা উঠে পরে আর একটা ক্লান্তিকর দিন শুরু করার জন্য।
সকাল ছয়টা বেজে পঁচিশ মিনিট। রমিজা ৩২- নম্বর বাসার ৫ম তলায় সকালের রান্না চড়িয়ে দিয়েছে। জেরিনের মা রান্না ঘরে আসতে পারে না। একটা কাজের মেয়ে আছে সে রুটি বানাতে পারে না তাই রমিজার কাজ হলো সকালের নাস্তা তৈরি করা।আর ঘর দোর মোছা। জেরিনের মা এগিয়ে আসে রান্না ঘরের দিকে।
- কাসেমের মা,আজ একটু দেরি কইরা যাই ও। তোমার ভাই বাজারে গেছে। বাজারটা একটু গুছাইয়া দিয়া যাইও। পিচ্চি একা পারবে না।
জেরিনের মা কাজের মেয়েকে পিচ্চি বলে ডাকে। আসলেই মেয়েটা পিচ্চি। বয়স আর কত। দশ কি এগারো। রমিজা কিছু বলে না। দেরি হলে আবার ছেলে কয়টা না খাইয়া থাকবে। বিশেষ করে তার খারাপ লাগে রাজিবের জন্য। ছেলেটার পকেটে কখনোই বেশি টাকা থাকে না। খুব হিসাব করে চলতে হয় তাকে। সবাই হোটেলে খাইলে ও তাকে না খেয়ে থাকতে হয়। রমিজা তাড়াতাড়ি কাজ করার চেষ্টা করে।
জেরিনের বাবা বাজার নিয়ে আসে। অনেক জিনিস, তার মাঝে ইয়া বড় সাইজের দুইটা ইলিশ মাছ উকি দেয়। মাছ দুইটা কাটার দায়িত্ব পরে রমিজার উপর। রমিজা মাছ কোটে। তার ছেলের জন্য এখান থেকে দুই টুকরা মাছ নিতে পারলে হতো। কিন্তু কি ভাবে। দুই টুকরা চুরি করলে কেউ টের পাবে না। কিন্তু চুরি তার স্বভাবে নাই। সে কি চেয়ে দেখবে। না চাইতে তার লজ্জা লাগে। তার স্বামী অন্য জায়গায় বিয়া না করলে তাকে আজ পরের বাসায় কাজ করতে হতো না। না সে চাবে না। তার কাছে এখন ও দুইশ টাকার মত আছে। রাতে বাসায় যাবার সময় ছোট একটা মাছ কিনে নিলেই হবে। ছোট একটা মাছের দাম আর কত হবে। সর্বোচ্চ দেড়- দুইশ। ছেলেকে সে খুশি দেখতে চায় সব সময়। গরিব হতে পারে কিন্তু তার মন আছে।
জেরিনের দুই বান্ধবী বাসায় এসেছে। ফিস ফিস করে কথা বলছে। আশা শাড়ি কিনতে যায় নাই। সবাই মিলে ঠিক করেছে আশাকে একটা শাড়ি উপহার দেবে। সেটা কি ভাবে দিবে তা বুঝতে পারছে না। শাড়িটা ও কেনা হয় নাই। আজ বিকালের মধ্যে শাড়ি কিনে আশাকে দিয়ে আসতে হবে। কিন্তু কথা হচ্ছে আশা কি শাড়িটা নিবে। বন্ধুরা তো বন্ধুকে উপহার দিতেই পারে।
রাজিবের কাছে রাজিবের দুই তিন জন বন্ধু কল দেয়। তাদের সাথে বের হবার জন্য। রাজিব না করে দেয়। রাজিবের ভাল লাগে না। সব যেন সাজানো নাটক মনে হয়।একবার মানি ব্যাগটা খুলে দেখে তারপর সেটা আবার নির্দিষ্ট স্থানে রেখে দেয়। তার এখন একটা টিউশনি খুব দরকার।
রমিজা রাতের রান্না শেষ করে বাসার দিকে রওনা দেয়। যাবার সময় তাকে নয়াবাজার যেতে হবে।একটা ইলিশ মাছ কেনার জন্য। সে বাজারের মাছের বাজারে প্রবেশ করে। অনেক ইলিশ মাছ দেখে কিন্তু ছোট সাইজের ইলিশ মাছ কোথায়। সব মাছই তো বড় বড়। ছোট মাছ গেল কৈই। ছোট মাছ কি এখন পাওয়া যায় না।
মনে এক রকম হতাশা, লজ্জা, ৰোভ নিয়ে রমিজা বাসার দিকে রওনা দেয়। ছেলের কাছে সে কি জবাব দিবে। রমিজার চোখ ফেটে অশ্রু বেরিয়ে আসে। সে তার স্বামীকে গাল দিতে থাকে। তার কথা খুব মনে পড়ে। বাসায় সে আজ ইচ্ছা করেই দেরি করে যায়।বাসায় ফিরতে তার কেমন যেন একটা ভয় করে। লজ্জা পাবার ভয়। উত্তরহীন প্রশ্নের সম্মুখীন হবার ভয়।
রমিজা বাসায় ফিরে দেখে কাসেম দুপুরের বাসি খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে গেছে। রমিজা আস্তে করে তার পাশে শুয়ে পরে। সারা রাত তার ঘুম হয় না।
জেরিন অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠেছে। তার সকল বান্ধবীকে কল দেওয়া হয়ে গেছে। সবাই রেডি হচ্ছে। আশাকে শাড়িটা দিয়ে আসা হয়েছে।আশার সাথে কথা বলা যাচ্ছে না। আশার মোবাইল নাই। তার বাবা বাড়িতে নাই। তাকে সাতটার মধ্যে জেরিনের বাসায় আসার কথা। এখন ও আশা আসছে না।
রাজিব ঘুম থেকে উঠছে না।এখনও শুয়ে আছে। রুমের বাকি সবাই ঘুম খেকে উঠে রমনার উদ্দেশ্য রওনা দিয়েছে। দুই এক জন মোবাইলে তাদের বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করছে। কেন জানি রাজিবের চোখ থেকে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো। রাজিব নিজেও তা জানে না।
কাসেম ঘুম থেকে উঠে কান্না শুরু করছে। সে আজ ইলিশ মাছ ছাড়া ভাত খাবে না। প্রায়ই সে মরিচ দিয়ে পান্তা খায়। আজ তার ইলিশ মাছ লাগবেই। রমিজা বললো - বাবা তোরে ডিম ভাইজা দেই।
কাসেম : না, ডিম খাব না। ইলিশ মাছ খাব।
রমিজা : পাব কৈ? আমারে বেচলেও একটা ইলিশ মাছ হইবো না।
কাসেম : না, আমি ইলিশ চাই।
রমিজার খুব কান্না পায়। গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করে। কিন্তু পারে না। জেরিনদের বাসার দিকে রওনা দেয়।ওদের ওখান থেকে আনা যায় কিনা,তা না হলে মেস থেকে এক টুকরো ইলিশ মাছ আনবে সে।
০৫ মার্চ - ২০১১
গল্প/কবিতা:
২৯ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪