বেকার যুবকের কত কষ্ট আর কত প্রাপ্তি! কষ্টের কথা বুঝলেও প্রাপ্তি শব্দটা সকলের কাছে রহস্যময় শুনাবে । তবুও বলি রুটিন অফিস, জীবন, বাচ্চা, বউ, পাটি, সংসার, যান-জট আর অফুরান সময় যারা অতিক্রম করা যায়, তারা বুঝবে না বেকার জীবনের প্রাপ্তি কত । এই আমি যখন নিরিবিলি জোছনায় ঘুরে বেড়াই অথবা সারাদিন চাকরির আশায় স্বপ্ন বুনি.... নিত্য নতুন খোয়াই জুতার তলা, হাজার মানুষের উৎকণ্ঠা আর মাঝে মাঝে গাছের ছায়াকে ছোট বড় হতে দেখি তখন বুঝে যাই মানুষের জীবনে ছোট-বড় ব্যাপারগুলো এই গাছের ছায়ার মতোই । ছোট বেলায় মা বলতেন - আমার ছেলে একদিন অনেক বড় মানুষ হবে । অথচ সূর্যি মামা আমার অবস্থানে তার আলো পোঁছাতে পারল না । অনেক ছায়ার নীচে ছায়াঘেরা সুশীতলটায় আমার ছায়ারা কোনোদিন ছোট বড় হলা না । পকেট হাতড়ে কয়েকটা কড়ি খুঁজে বেড়াই এক কাপ চায়ের নেশায় । মা’র হাতের সেই চা!কত দিন মা’র হাতের চা খাই না ! তখন আমার জীবনের প্রাপ্তিগুলো স্পষ্ট হয়, ইচ্ছেমত চা খেতে পারি না বলেই তো- মা’র বানানো চায়ের স্বাদ মুখে লেগেই আছে । আরেকটা প্রাপ্তি আমার আছে । বেকার বলে, এই সমাজের ভয়াবহতার সাথে আমার আত্মা এখনো মিশে যায় নি । সেই গল্পই বলব । মোবাইলে আমার বন্ধুটি ওর অফিসের ঠিকানা বলছিল ।..... ইন্টার্ভিউ ২৮ তারিখে । হাফিজ নেবে আমার ইন্টার্ভিউ ? আমার স্কুল জীবনের বন্ধু হাফিজ ! পড়াশুনায় একটু দুর্বল ছিল বলে রেজাউল স্যার ওকে বিকৃত নামে ডাকতো । পথের আশেপাশে পড়ে থাকা কাগজ খুঁজছিল আমার চোখ । বেকার দু চোখে চশমাও কেমন বেমানান । ভাগ্যিস মা বেঁচে নেই । বেকারদের চোখে চশমা অন্যের কাছে হাস্যকর হলেও মায়েদের আত্মায় তা ক্ষত হয়ে বাজতে থাকে । বন্ধুকে অস্থির বিনয়ের সাথে অনুরোধ করলাম - ঠিকানাটা পুনরায় বলতে । খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠল বন্ধুজন । অথচ ছাত্রজীবনে কতদিন তাকে পড়িয়েছি !ক্যালকুলাস, স্থিতি-গতিবিদ্যা ওর মাথায় ঢুকতো না বলে আমার আরো মায়া হতো ! বলল সে বেকার মানুষ ব্যাটা! সারাক্ষণ তোর হাতে ফাইল থাকবে -ফাইলে থাকবে সাদা কাগজ । এত ক্যালাস হলে- জীবনে কি কিছু হব? জীবনে আমার কিছু হলাও না- বাবার কোনা ভাই, বোন নেই । মা-ও ছিল নানার একমাত্র মেয়ে । খুটিশূন্য আমার জীবন ! কুঁড়িয়ে পাওয়া একখণ্ড পোস্টকার্ডে ফাঁকা জায়গা খুঁজছিলাম । আমার মান্যবর বন্ধুটি তার প্রতিষ্ঠানের নাম বলছে-হাইটেক---১৬, এলিফ্যান্ট..... বাঁকি শব্দগুলো আমি আর শুনি নি । পোস্টকার্ড পড়ছিলাম --- ‘মা এই স্কুলের সিলেবাস বাংলাদেশের অন্যান্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের মতোই । আমি আরশোলা কত ভয় পাই ! আর ওরা যখন বাংলায় কথা বললে হাসাহাসি করে -অভদ্র ভাবে ; তখনই আরশোলা আমার হার্টের ভেতর ঢুকে যায় । তুমি যে বাংলায় কথা বলো ! তোমাকে দেখতে পারি না -- এজন্য আরশোলাটা আমার ছোট্ট হৃদপিণ্ডটা খেয়ে ফেলে । শুধু ভয় লাগে ।ভেতরে কি যেন ছটফট করে ঘুরে বেড়ায় । শুধু মনে হয়-তোমাকে না দেখতে পেলে আমি তাড়াতাড়ি মরে যাব । ক্লাস ফোরের একই সিলেবাস----তবু আমি চেন্নইয়ে----। কেন ? কেন মা !'' ডাকবিভাগের রানারের থলে থেকে কি এখানে পোস্টকার্ডটি পড়ে গেছে ? তার মা কি পড়ে ফেলে দিয়েছেন পোস্টকার্ডটি? তাই কি হয় ? তারপর ঠিকানা ধরে এগিয়েছি । মফস্বল শহরের একতলা বিশাল বাড়ি । গৃহকর্তা মতো একজন এলে জিজ্ঞাসা করলাম মিসেস শ্রাবন্তীর একটা চিঠি ! বিরক্তি সহকারে তিনি জানালেন ভাইয়াকে তালাক দিয়ে তিনি ঢাকায় । বড় চাকুরী করছেন । তার ছেলের চিঠিটা তাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলাম । মশায় আপনি তো মহা বিরক্তিকর লোক । ছেলে একটা ঝামেলা ছিল বলে তো তাকে চেন্নাই পাঠানো হয়েছে । শ্রাবন্তী আর ভাইয়া মিলে ভাগাভাগি করে মাসে মাসে টাকা পাঠাচ্ছে---- ব্যস ! দেন তো চিঠিটা-- দেখি । না, না ! ঠিক আছে- আমি দেখছি-.. বলে পালিয়ে এসেছি । রুটি-মাংস আর মানুষের লালসার লেলিহান ঘাম-গন্ধে কেমন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছ এই সমাজ । রুটিন জীবন, অভিনয়, মেকী হাসির আড়ালে মানুষ শুধু মানুষের মাংসের গন্ধ খুঁজে বেড়ায় এখানে । তালাকের উৎসবে শিশুরা কালীপূজার পাঠা । মাংস স্বাদে পুরুষকে অধিকার প্রদান করা নারীর কাছে সন্তানকে ভুলে থাকার সাধনা এখানে নিপুণ। অথবা নিপুণ অভিনয়ের আড়ালে নিজ সত্ত্বা/ সন্তানকে ভুলে যাবার জন্য ঘাম গন্ধে বিলীন হয়ে যাওয়া ? পয়সার অভাব ভাগ্যিস প্রকট আমার । না হলে এসব ফরমালিন মাখা দেশভর্তি আপেল-আম খেয়ে কবে জীবিত লাশ হয়ে যেতাম ! বিয়ে-তালাক,লিভ টুগেদার, সেপারেশন এই শব্দগুলোর কোনাটার জন্যই প্রস্তুতির সামর্থ্য অথবা যোগ্যতা নেই আমার । ঘৃণা এবং ভালোবাসা এই শব্দগুলোর সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত বলে ; ভালোবাসা অথবা ঘৃণা জানানোর সাহসটুকুও নেই । থাকলে হয় তো হয়ে যেতাম আস্ত মমি । কপি করা মানুষের হুবহু লাশের মমিতে অনেক রাসায়নিক যৌগ থাকলেও আত্মা থাকে কি ? প্রাপ্তি আমার এই- এই ভয়াবহ সামাজিকতায় আমার জীবন অথবা আত্মা কোনাটাই সংশ্লিষ্ট নয় । চাকুরী পাওয়ার মতো সামান্য পথ অতিক্রম করাও আমার জন্য দুঃসাধ্য । অথচ সেই চেন্নাই গিয়েছিলাম । ছেলেটার নাম ঠিকানা বলতেই বিস্মিত চোখে এক শিক্ষক আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ওহ ! আপনি কি তার বাবা ? কী আশ্চর্য ! বোকা লোক । বেকার মানুষ বাবা হয় কীভাবে ? আমাকে উত্তর দেবার সুযোগ না দিয়ে তিনি বললেন আসুন আমার সাথে । স্কুল-প্রধান তড়িঘড়ি আমার দিকে মনোযোগ দিলেন । এই না হলে --- বাবার মন ! আপনার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি । আমরা দুঃখিত । আপনারা কেমন মানুষ বলুন তো? একটা সেল নাম্বার দিয়ে রেখেছেন সেটা বন্ধ রাখেন! মেইল এ্যাড্রসও নেই -----। খুব বদনাম হয়ে গেল । হার্টের সমস্যা নিয় বাচ্চাটাকে দেশের বাইরে পাঠানো কি উচিৎ ---? আপনি কেমন বাবা মশায় ? আমতা আমতা করে বললাম না মানে ------জি------ যাহোক পেপারসগুলো রেডি করেছি । আজকেই পোস্ট করার কথা । ওগুলো আপনাকে হ্যান্ড ওভার করছি? আমার মুখ ফসকে হঠাৎ বেরিয়ে গেল ইয়ে---- আমার ছেলে---মানে---কোনো সমস্যা ? সব সমস্যার ওপার সে । আরে মশায় ! কেমন বেকায়দা বলুন ! পেপারে রিপোর্ট এসেছে এই স্কুল আরশোলায় ভরা ! আরশোলার ভয় পেয়ই মারা গেল বাচ্চাটা । কী যে ঝামেলায় পড়েছি। আরশোলা ? হ্যাঁ--- ! আচ্ছা ও কি বাসায় আরশোলা নিয়ে কিছু বলতো ? আমি এতক্ষণে কখন শিশুটার বাবা হয়ে গেছি । বললাম হ্যাঁ-----। আরশোলা সে ভয়ই পেত । অবাক হয়ে যাই ---- সে শুধু বলত --- আমার বুকের ভেতর আরশোলা ঢুকেছে । আর শুধু ওর মাকে ডাকত। যেন ওর মা এলেই আরশোলাটা ভয়ে ওর বুক থেকে বের হয়ে যাবে । এখন ----? দেখুন মিস্টার ! আপনার ছেলেকে বাঁচানোর চেষ্টায় কোনা ত্রুটি করি নি । আরশোলার ভয় দূর করার বুদ্ধি না পেয়ে ওকে আমরা ডাক্তারের কাছে নিয়েছিলাম । ডাক্তার হার্ট টেস্ট করে বলল ওর জরুরী বাইপাস সার্জারি করতে হবে । প্রাণফাটা কান্না বেরিয়ে এল আমার ভেতর থেকে । বললাম কী বলছেন আপনি ? আমরা আপনাকে শুধু সরি বলতে পারি । অপারশন থিয়েটারে নেওয়ার আগে বন্ড সইটা আমিই দিয়েছি । আপনি ব্যাপারটা মেনে না নিলে-বিপদে পড়ে যাব । স্কুলের খুব বদনাম হয়ে গেল ! সবাই পত্রিকার রিপোর্ট পড়ে অযথাই ভাবছে, স্কুলটায় তেলাপোকা ভর্তি । যে সব বাচ্চারা তেলাপোকা ভয় পায় তাদের বাবা-মা বাচ্চাগুলোর টিসি নিয়ে নিচ্ছেন । আমার ছেলে------- আমার ছেলে ? হাসপাতালে ? এত ছোট বাচ্চা! বাইপাস সার্জারি সইতে পারে ? জানেন এক শিক্ষিকা আপনার ছেলের অসাধারণ কিছু গুনের কথা বলতো। হুল্লোড় মাততো না সে । পড়াগুলো ট্র্যাকে রাখতো না । অথচ অবাক ব্যাপার সে পরীক্ষায় অসাধারণ ফলাফল করত । প্রথম হতো । আর রেজাল্ট হয়ে গেলেই---ওর বুকের আরশোলার অত্যাচার বেড়ে যেত । মাস্টার সাহেব-আমার ছেলে? ওর ধারণা পরীক্ষা শেষ হলেই ওর মা আর আপনি আসবেন । ভালো রেজাল্ট হলে তবেই বাড়ি ফেরা হবে ওর । ছোট বাচ্চা-কী অদ্ভুত শান্ত ! বড় হয়ে ও অসাধারণ এক কবি হতো --- কেন ? অসংখ্য কবিতা দিয়ে খাতা ভর্তি করে রেখেছে---এই যে দেখুন ওর লেখার খাতা । ‘এক বছর শেষ । আমি প্রথম হয়েছি । এবার বাড়ি ফিরব আমি- তাই না মা ? তুমি আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেব গল্প বলে বলে । আমাদের বাসার পাশে বড় গাছটায় খরগোশটা কি এখনো ঘুরে বেড়ায় ? এবার বাসায় এলে খরগোশটা কিন্তু আমাকে দেবে । কিন্তু মা ! বাসায় যেন কোনো তেলাপোকা না থাকে । দ্যাখো না তেলাপোকাটা আমার বুকের ভেতরে ঢুকে কেমন ভয় দেখায় । আমার দম আটকে আসে মা !'' চলুন-হিমঘরে ওর লাশটা আছে ----- আমি চেয়ারের হাতল শক্ত করে ধরে দাঁড়ালাম । অনুভূতিহীন শরীরকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো এদিক সেদিক কমান্ড করলাম । আমার বুকের ভেতর এক তেলাপোকা কুঁড়ে কুঁড়ে চঞ্চু- নল দিয়ে ঠুকরে চলছে অলিন্দের সব অলি-গলি । মৃত সন্তানের বাবা হয়েছি আজ-বেকার জীবনে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী আছে !
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
শাহেদুজ্জামান লিংকন
পয়সার অভাব ভাগ্যিস প্রকট আমার । না হলে এসব ফরমালিন মাখা দেশভর্তি আপেল-আম খেয়ে কবে জীবিত লাশ হয়ে যেতাম !
কী ব্যতিক্রমী প্রকাশ! আমি আপনার লেখা ইত্তেফাকে পড়েছি।কালি ও কলমের জৈষ্ঠ্য সংখ্যায়ও আলোচনা পড়লাম। এই গল্পটা এর আগে পড়লেও ভুলে কমেন্ট করা হয় নি। অনেক অনেক শুভকামনা আপনার প্রতি।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।