রোমেলার স্বপ্ন

দেশপ্রেম (ডিসেম্বর ২০১১)

ম্যারিনা নাসরিন সীমা
  • ৬৭
  • 0
  • ৬৫
জ্বলন্ত চুলার উপরে মাটির হাঁড়িতে পানি টগবগ করে ফুটছে । হাঁড়ির তলায় কয়েকটা মিষ্টি আলু । রোমেলা এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে । কিন্তু তার মন ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা অলিগলিতে । আগুনের লালচে আভায় তার মুখটা লাল হয়ে উঠেছে।
ও বৌমা ।
শাশুড়ী আম্বিয়া বেগমের ডাকে সে কোন সাড়া দেয় না, বরং মুখটা আরো নীচু করে ফেলে । রোমেলা তার চোখের জল কাউকে দেখতে চায় না ।
সাড়া না পেয়ে আম্বিয়া বেগম উঠান থেকে রান্না ঘরে উঠে আসে ।
তুমি আবার কানতিছ ? তোমারে না কতবার কইছি এম্বা করি কানবা না । আমার মনি ফিরে আসবি । একটু এগিয়ে এসে শাশুড়ী পরম মমতায় রোমেলার চোখের জল মুছে দেয় আর বলতে থাকে, বৌমা এম্বা করি যদি কান্দ তালি তো তোমার প্যাটের মনিটা বাচপিনানে ।

এতসময় ধরে রোমেলা যে ধৈর্য্য ধরে ছিল পেটের সন্তানের কথায় তার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে দুচোখে প্লাবন নেমে আসে । শাশুড়ীকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে, মা আমার কি হবি ? আমার মনি দুনিয়াতে আইসে কারে বাপ ডাকপিনে ?

আম্বিয়া বেগমের চোখ দিয়ে দর দর করে পানি পড়তে থাকে কিন্তু সে রোমেলাকে বুঝতে দেয় না ।সন্তানের চিন্তায় মা মনটা সারাদিন কেঁদে কেঁদে ফেরে কিন্তু বাচ্চা মেয়েটাকে শক্তি দিতে সব নিজের মনে চাপা দিয়ে রাখে । রোমেলাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে সে অনাগত আর একটা জীবনের উত্তাপ নেয় । যে উত্তাপ তাকে এখনো ভেঙ্গে পড়তে দেয়নি।

মাগুরা জেলার শ্রীপুর থানার ছোট একটা গ্রাম সোনাইতলা । সাতাশ-আটাইশ বছর বয়সের মজনু মিয়া কাঠের ব্যবসা করে । সেখান থেকে যে আয় হয় তা দিয়ে ছয় জনের সংসার মোটামুটি চলে যায় । গ্রামের স্কুলে কয়েক বছর যাওয়া আসা করেছিল তাতে করে কিছুটা লেখাপড়া জানে । তবে খুব চালাক । বছর পাঁচেক আগে বিয়ে করেছে ফরিদপুরের এক গাঁয়ের মেয়ে রোমেলাকে । এই পাঁচ বছরে কোন সন্তান হয় নি । এবারেই রোমেলার গর্ভে তার প্রথম সন্তান এসেছে । যেদিন বুঝতে পারে সে আর নিঃসন্তান থাকবেনা সেদিন তাদের ঘরে আনন্দের বন্যা বয়ে যায় ।
সুখেই কেটে যাচ্ছিল দিন । এর মধ্যেই বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা । গ্রামে গঞ্জেও তা ছড়িয়ে পড়ে । বাঙ্গালীর মর্যাদার লড়াই স্বাধীনতার সংগ্রাম । মজনু মিয়া অত্যন্ত চালাক ধরণের মানুষ । সাধারণত নিজ থেকে কোন ঝামেলায় জড়ায় না কিন্তু কেউ উসকে দিলে মানুষ খুন করতেও দ্বিধা করবে না । তবে তার সবচেয়ে বড় গুণ রোমেলাকে সে অসম্ভব ভালবাসে। রোমেলাও স্বামী ছাড়া নিজেকে কল্পনা করতে পারে না । রোমেলা যাকে না দেখে দুই দণ্ড থাকতে পারে না সে আজ দশ দিন যাবৎ নিখোঁজ । পাকিস্তানী মিলিটারি এক গভীর রাতে তাকে সহ আরো পাঁচ জনকে চোখ বেঁধে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গেছে। তার মধ্যে দুই জন ফিরে এসেছে আর তিন জন এখনো আসেনি। সবাই ধারণা করছে তাদেরকে মেরে ফেলেছে। যে দুইজন ফিরে এসেছে তারা কিছু বলতে পারে না । তবে তাদের সম্বন্ধে নানা ধরণের নানা কথা শোনা যাচ্ছে । রোমেলা বিশ্বাস করে না যে তারা মজনুকে মেরে ফেলেছে । তার বিশ্বাস সে ফিরে আসবে।

বুড়ো শ্বশুর-শাশুড়ী । ছোট দুই ননদকে নিয়ে সংসার । সারাদিন ভয়ে থাকে কখন এ বাড়ীতে পাক হানাদার এসে হানা দেয় । ননদ দুইটা বাড়ীতে খুব একটা থাকেনা । এ বাড়ী ও বাড়ী পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায় । রোমেলা শুনেছে ওদের বয়সী মেয়েদের বড় বিপদ । শাশুড়ী তাকেও বলেছিল রাতে বাড়ীতে না থাকতে কিন্তু রমেলার জিদ, সে মরলে বাড়ীতেই মরবে। সে চলে গেলে স্বামী এসে যদি না পায় ? শাশুড়ী আর বেশী জোর করে নাই । বউটাকে সে নিজের মেয়ের মত ভালবাসে ।

দশরাত ধরে ঘুম নেই রোমেলার চোখে । সারারাত এপাশ-ওপাশ করে কাটায় । হাত বুলিয়ে পাশের খালি জায়গাটুকুতে কাউকে অনুভবের চেষ্টা করে । দু’চোখে বর্ষা নামে । তখন আকুল হয়ে সে পেটের উপর হাত রাখে । রাতভর গল্প করে কাটায় তার অনাগত ভবিষ্যতের সাথে । অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথা তার । কখনো বলে, মনি তুমি কেমন আছ ? আমার মত তোমারও তোমার আব্বার জন্য মন কান্দে, তাই না ? কানলি পারে তুমি কি কর ? তুমি তাড়াতাড়ি আসো । আমরা দুইজনে মিলে তুমার আব্বারে ফিরায়ে আনবানি । আজো সে তার পেটের উপর হাত রেখে গল্প করছিল প্রত্যুত্তরে তার মনি হাত পা নেড়ে জবাব দেয় । পেটে হাত দিয়ে রোমেলা সেটা অনুভব করে হেসে উঠে ।

হঠাৎ কিছু একটার শব্দে কান খাড়া হয়ে ওঠে রোমেলার । মনে হল ঘরের পিছনে পাতার উপর কেউ হাটছে । মৃদু খস খস আওয়াজ, ভয়ে রমেলার শরীর শিহরে ওঠে । একবার ভাবলো শাশুড়ীকে ডাক দিবে । কিন্তু, এতরাতে বুড়া মানুষটাকে আর জাগাতে চায় না । কিছুক্ষণ পরেই দরজায় খুব আস্তে করে শব্দ হল । রোমেলার বুকের স্পন্দন যেন বন্ধ হয়ে আসে । এই শব্দের সাথে সে গভীরভাবে পরিচিত । মজনু যাত্রাগান বা পালাগান শুনে গভীর রাতে বাড়ী ফিরলে এভাবে দরজায় শব্দ করে । সে একহাত দিয়ে বুক চেপে ধরে ভয়ে ভয়ে বলে,
কিডা ?
রমেলা, আমি, দোর খোল।
রোমেলা দরজা খোলার মত শক্তি হারিয়ে ফেলেছে । স্থবির হয়ে আছে তার দুনিয়া । সে কণ্ঠটা আবারো গভীরভাবে অনুভবের চেষ্টা করে।
রমেলা দোর খোলো না কেন ?
এতক্ষণে রমেলা সম্বিত ফিরে পায়। দ্র্বত কুপিটা জ্বালিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয় । নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না, সামনে দাঁড়িয়ে মজনু । সেই লম্বা এক হারা গড়ন, চওড়া বুক রমেলার ইচ্ছে হয় ওই বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে কিন্তু কিসের যেন একটা সংকোচ তাকে আটকে রাখে।
মজনু দ্র্বত ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। তার মধ্যে একটা ভয়, তাড়াহুড়োর ভাব । রমেলা সহসা কিছু বলতে পারে না । মজনু কোন কথা না বলে ঘরের এক কোণে রাখা কাঠের বাক্সে কি যেন লুকিয়ে রাখলো কিন্তু সেটা রমেলার দৃষ্টি এড়ালো না ।
এতদিন কনে ছিলে তুমি ? বলে রমেলা ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল।
এই কানতিছ ক্যান ? আমি তো ফিরে আইছি । ছিলাম একখানে, সব পরে কব । এখন শোন আব্বা-মা কেমন আছে ?
ভাল । সবাই ভাবতিছে তুমি মইরে গেছ।
আমি মরব ক্যান ?
আমারে মিলিটারিরা অনেক আদর যত্ন কইরে রাখছে। এখন আবার ক্যাম্পে ফিরি যাব। ঐখানে অনেক কাজ ? তুমি দরজা বন্ধ করে দাও । আর বাক্সের মধ্যে কিছু জিনিস রাখছি, সবসময় তালা দিয়া রাখবা । কেউ যেন টের পায় না । আমি আইছিলাম কাউরে কবার যাবা না ? আব্বা-মারেও না।
ওমা আবার কনে যাবা ? ও আল্লাহ ।
শুনছি মিলিটারিরা সব মাইনষেরে মাইরে ফেলে আর তোমারে আদর যত্ন করিছে ? কি কও ?
হঁ ওগো জন্যি কাজ করতিছি তা আদর যত্ন করবি নানে ? এত কথা কওয়ার সময় নেই , তুমি দোর বন্ধ কর কাইলরাতে আবার এই সময় আসপো ।
ওমা এখনি যাবা কিছু খাবা না ? ভাত আনি ?
আনা লাগবি না । বাইরে আমার জন্যি লোক দাঁড়ায় আছে। বলে যেমন ঝড়ের মত এসেছিল তেমনি ঝড়ের মত বের হয়ে যায় মজনু । খোলা দরজার সামনে কছু সময়ের জন্য হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রমেলা । মানুষটার মধ্যে কোথায় যেন একটা পরিবর্তন । এ পরিচিত সেই প্রেমিক পুরুষ নয়, যে তাকে দেখা মাত্র পাগলের মত বুকে জড়িয়ে ধরার কথা । খুব অবাক হল সে । যে স্বামী তাকে পাগলের মত ভালবাসে । সে দু দণ্ড কথা বলার সময় পেল না ? রমেলা রাগে অভিমানে ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে ।
হঠাৎ করে পিঠে আলতো র্স্পশে চমকে উঠে রমেলা, আম্বিয়া বেগম কখন এসেছে সে টের পায়নি । বৌমা মজনু আইছিল না ? আমার সাথে দেখা না কইরেই কেম্বা গেল ?
কই মা আসিনি তো ?
মা রে , আমি আমার মনির গলা চেনবনা ? আমি জানি আইছিল । কি কলে ? সব ঠিক আছে তো ?
মা, আপনি যেন কারো কবেননা । সে নাকি মিলিটারিগের ক্যাম্পে থাকে তারা নাকি তারে অনেক আদর যত্ন করে । কেম্বা মা ? আর্মিরা বোলে সবরে মাইরা ফালায়। আমার কিন্তু ভাল ঠেকতেছেনা মা।
আম্বিয়া বেগম কিছু না বলে উঠে চলে যায়। যে ছেলে তাকে একদিন না দেখে থাকতে পারেনা সে এতদিন পরে বাড়ি এসে বাবা মাকে না দেখে কিভাবে চলে গেল সে ভেবে পায়না ।
কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল মনে নেই রোমেলার । ঘুম থেকে উঠে দেখে অনেক বেলা হয়েছে । কাল রাতের ঘটনা তার কাছে স্বপ্নের মত মনে হয় । অকস্মাৎ তার একটা কথা মনে পড়ে যায় । দ্রত সে ঘরে গিয়ে কাঠের বাক্সটা খোলে । মজনু এই বাক্সে কি যেন রেখেছিল। বাক্সে শীতের কিছু কাপড় আছে সেগুলো এক ঝটকায় সরিয়ে ফেলে যা দেখে তাতে সে আঁতকে উঠে। লম্বা কি যেন একটা যন্ত্র । না চিনলেও বুঝতে পারে এটা একটা অস্ত্র, চৌধুরী বাড়িতে সে দেখেছে । ও বাড়ির বড় বউ বলেছিল এটা দিয়ে নাকি গুলি করে মানুষ মেরে ফেলা যায় । সাথে একটা পোটলায় কিছু টাকা, সোনার চেইন, কানের দুল । রোমেলা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় । তার আর বুঝতে বাকি থাকে না কিছু । মজনু পাকিস্তানী মিলিটারিদের জন্য কাজ করে । মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে রোমেলা তেমন কিছু না জানলেও এটুকু বুঝে যে পাকিস্তানীরা এদেশের ভাল চায় না । তারা এদেশের মানুষদের মেরে ফেলছে । মহিলাদের আব্রু নষ্ট করছে, আর তাদের কাজে এদেশের কিছু লোক সাহায্য করছে যাদেরকে রাজাকার বলে । রোমেলা জানে রাজাকারদের সামনে লোকে কিছু বলতে সাহস না করলেও আড়ালে সবাই গালাগালি করে, অভিশাপ দেয় । রোমেলা নিজেও রাজাকারদের ঘৃণা করে । সে গ্রামের গরিবের মেয়ে হলেও বাড়ির পাশের স্কুলে কিছুদূর পড়েছে । চৌধুরীদের বাড়িতে গিয়ে যখন মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি শুনে মনে হয় সে নিজে যদি যুদ্ধ করতে পারত । চৌধুরী বাড়ির পাঁচ ছেলে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে । এই গ্রামে দুইজন রাজাকার আছে ওদেরকে দেখলে রোমেলার থুতু ছিটাতে ইচ্ছে হয় । সেই রোমেলার ঘরের মানুষ কিনা রাজাকার ? উহ! তার বুকের ভিতরে যন্ত্রনায় মোচড় দিয়ে ওঠে । সে আর ভাবতে পারেনা । কাঠের বাক্স দ্র্বত বন্ধ করে তালা লাগিয়ে রেখে ঘরের বাইরে চলে আসে ।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে বারবার তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে অস্ত্র, মেয়েদের গলার চেইন, কানের দুল । তার স্বামীর ভয়ঙ্কর চেহারা । রাজাকার! তাকে সবাই বলবে রাজাকারের বউ তার বাচ্চাকে সবাই বলবে রাজাকারের বাচ্চা! এখন বুঝতে পারে মৃদু প্রদীপের আলোয় রাতে তার স্বামীর যে চেহারা, চোখের দৃষ্টি সে দেখেছে সেটা তার পরিচিত নয় কেন । এ এক নতুন মানুষ যার মধ্যে মায়া দয়ার লেশমাত্র নেই।
সময় তার আপন গতিতে চলে । রোমেলার শ্বশুর নিতান্তই বৃদ্ধ । বেশি চলাফেরা করতে পারে না । শুয়ে বসে থাকে । ঘরে যেটুকু খাবার ছিল শেষ । রোমেলার কাছে কিছু জমানো টাকা ছিল সেটাও শেষ । তিন বেলার মধ্যে একবেলা, শুধু রাতে তারা পেট পুরে ভাত খায় । সেখান থেকে যেটুকু বাঁচে সকালে পান্তা করে পিয়াজ মরিচ ডলে খেয়ে ফেলে । দুপুরে মিষ্টি আলু সিদ্ধ । হঠাৎ করে মিলিটারি এসে মজনুকে ধরে নিয়ে যাওয়াতে ঘরে তেমন কোন টাকা পয়সা রেখে যেতে পারে নাই । কালরাতে মজনু কিছু টাকা রেখে গেছে মনে পড়তেই একটা আশার আলো দেখে রমেলা । কিন্তু পরক্ষনেই টাকার উৎস মনে পড়তেই ঘৃণায় মুখ কুঁচকে আসে । না খেয়ে মারা গেলেও সে ওই টাকা সে ধরবে না ।
ঘরের পিছনে আম্বিয়ার লাগানো কিছু আলু, সবজি হয়েছে বলে কোন রকমে দিন চলে যাচ্ছে । আম্বিয়া বেগমের মন আজ ভীষণ খারাপ । দশদিন পরে ছেলে আজ বাড়ীতে আসলো । যে ছেলের জন্য এই দশদিন গোপনে কাঁদতে কাঁদতে তার বুকটা শুন্য হয়ে গেছে সেই ছেলে বাড়ীতে এসেও বুড়ো বাপ মায়ের সাথে দেখা করলো না ? ছেলের উপর অভিমানে বুকটা আম্বিয়ার ফেটে যেতে চায় । কিন্তু সে কিছুই বলে না দীর্ঘশ্বাসটাও চেপে রাখে ।
আজ রাতে রোমেলা ছেলের সাথে কথা বলে না । গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করে কখন দরজায় পরিচিত টোকা পড়বে সেই আশায় । কিন্তু তার অপেক্ষার আর শেষ হয়না । এইভাবে কয়েক রাত কেটে যায় মজনু আর আসে না । ভিতরে ভিতরে রমেলা উৎকণ্ঠিত হয়ে ওঠে । ওদিকে নানাজনে নানা খবর আনে রমেলাকে শুনিয়ে যায় । টিউবওয়েলে যখন পানি আনতে যায় মহিলারা আজকাল অন্যরকম ভাবে তাকায় । কথা বলতে চায় না । সেদিন স্পষ্ট শুনল কে যেন বলছে রাজাকারের বউ । লজ্জায় রোমেলার মরে যেতে ইচ্ছে হয় । মানসিক যন্ত্রনায় রোমেলার দিনগুলো নীল হতে থাকে।
মজনু নিজের গ্রামে না আসলেও আশে পাশের গ্রামের যুবকদেরকে পাক হানাদারদের হাতে তুলে দিতে সহয়তা করে । কিছুদিন আগে নাকি এক মেয়েকেও তুলে দিয়েছে তাদের হাতে । রোমেলা, তার শাশুড়ী ঘর থেকে বের হয় না লজ্জায় । স্বামীর প্রতি রোমেলার এক ধরণের ঘৃণা ক্রমেই দানা বেঁধে জমা হতে থাকে আর একটু একটু করে ঘৃণার দানাটা বড় হতে থাকে ।
রোমেলা প্রতি রাতে অপেক্ষা করে কখন মজনুর হাত দরজায় স্পর্শ করবে । একরাতে অপেক্ষার পালা শেষ হয় । গভীর রাতে টোকা পড়ে দরজায় । রোমেলা ধীর স্থীরভাবে দরজা খোলে কিন্তু মজনুর পথ আটকে রাখে শান্ত কন্ঠে বলে, তুমি ঘরে ঢুকতি পারবা না । এই ঘরে রাজাকার ঢোকবে না । যেখানে গিছাও চইলে যাও ।
মজনু নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না । চাপা কন্ঠে ধমক দেয়,
দোর ছাড় কচ্ছি রোমেলা।
ছাড়বনা । কি করবা কর ।
কি করব ? দেখবি কি করব ? বলে রোমেলা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ঘরে ঢুকে যায় মজনু । এবার রোমেলা অন্য পথ ধরে । দুই হাত ধরে মজনুর পা চেপে ধরে কেঁদে ওঠে,
তোমার দুইখান পাও ধরি , তুমি ওই রাস্তা থেকে সইরে আসো । দেশের সাথে শত্রুতা কইরো না । শুনলাম তুমি শ্রীপুর গ্রামের রমিজ আর মনসুররে মিলিটারিগের কাছে ধরায়ে দিছ । আবার শুনলাম ওগো বৌগেরও তাদের হাতে তুলে দিছ । আল্লাহর দোহায় এসব বন্ধ করো । তোমার বাচ্চা আমার পেটে । আল্লাহ তার ভাল করবি না ।
মজনু ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নেয় । খবরদার আমার বাচ্চার দোহায় দিবিনে । আমি যদি ওদের না ধরায়ে দিতাম তালি আমার বোইনগের এরা তুলে নে যাবে, তোরে তুলে নে যাবে ।
নিক । আমাগের তুলে নিক তাও তুমি মাইনষের এত বড় ক্ষতি কইরো না । আল্লাহ্‌র অভিশাপ লাগবে । আমি, মা , ঘরের বাইর হতি পারিনে । সকলে রাজাকারের বৌ, রাজাকারের মা কয়ে ডাকে ।
ডাকুক , পরে বোঝবেনে ।
কি বোঝবে ? আমার দেখা লাগবি । তুমি এইসব অস্ত্র, সোনা কই পাইছ ? লুট কইরে আনছ, তাই না ?
মজনু কিছুটা থমকে যায় । এ এক নতুন রমেলা।
তার মানে আমি কি করি , কই যাই সব তোমার জানা লাগবি ?
হ্যাঁ, লাগবি ।
রোমেলার চোখ দিয়ে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ যেন তীরের মত ছুটে আসছে । এবার মনে হল মজনু একটু ভড়কে যায় । রমেলার হাত ধরে টেনে এনে বসায় । অসম্ভব চালাক মানুষ মজনু । কখন কি করতে হবে বুঝে । এসব মস্তিষ্ক ভাল কাজে যেমন শ্রেষ্ঠ তেমনি খারাপ কাজেও অতি নিকৃষ্ট মানুষে পরিণত করতে পারে ।
শোন রোমেলা, যাগো কবার কোক, আমি আর সরে আসতি পারবো না। তালি ওরা আমারে মাইরি ফেলাব, সাথে তোগো । আমাগের সামনে আবুবকর , ইস্রাফিল আরো কত মাইনষেরে মাইরে ফেলিছে । ওগো কথায় রাজি না হলি আমারেও বাঁচায়ে রাখতনা । এই দ্যাখ আমারে ওরা কেমনে মারছে । বলে শার্ট খুলে দেখায় সেখানে ঘা দগদগ করছে ।
রোমেলা আঁতকে ওঠে । বলে ইশ! দাঁড়াও হলদি লাগায়ে দেই । রোমেলা হলুদ গুলে পরম যত্নে লাগায় আর বুঝাতে থাকে বলে, দেখ, তোমার জন্যি কত মানুষ মইরে যাবে । দেশটা ওরা দখল কইরে নেবে । আর দেশ স্বাধীন হলি তোমারে সগলে রাজাকার কবে আর মণিরে রাজাকারের বাচ্চা । তুমি ওই রাস্তা ছাইড়ে দ্যাও । আমাগের কপালে যা আছে হবে । দেশটা তো বাচপি । এই দেশের মানুষ ওগো সাহায্য না করলি ওরা বেশিদিন টিকতি পারবি না ।
মজনু চুপচাপ শুনে বলে , তা আর সম্ভব না । বাদ দ্যাও ওসব চিন্তা করা লাগবি না । এই নাও কিছু টাকা সদায়পাতি করবা ।
রমেলা ঘৃণায় মুখ বিকৃত করে ফেলে । এগুলোতো সব মাইনষের বাড়িতে লুট করা টাকা, এগুলো আমার কিছু দরকার নেই ।
চুপ, মাইয়ে মানুষ হইছিস, মাইয়ে মানুষের মত থাক । বেশী মাতবরী করবি না । মাইরে ফেলব ।
রোমেলা কথা শুনে আহত হয় কিন্তু সেও দমবার পাত্রী নয় । আরো শক্ত হয়ে বলে , আমারে তুমি যা ইচ্ছা হয় কর কিন্তু ওই রাস্তায় আর যাইয়ো না ।
চুপ কর বাইরে মিলিটারি আছে । টের পালি আর আস্ত রাখপিনা । আমি ওগো জন্যি ভাল কাজ করি বলেই মেজর আমারে টাকা পয়সা দেয় বাড়িতে আসপার দেয় । আমারে বিশ্বাস করে । সেই বিশ্বাস নষ্ট করতি পারব না । আমার সময় নেই আজ রাইতে অনেক কাজ আছে । যাই, আব্বা মায়ের দিকে খেয়াল রাখিস । বলে দ্রত বের হয়ে যায় । রোমেলা অসহায়ের মত সেদিকে তাকিয়ে থাকে ।
রাত যত বড় হোক আর অন্ধকার হোক না কেন, সূর্য যত দেরীতেই উঠুক, সব রাতেরই শেষ আছে । রোমেলার বিনিদ্র রজনীও ভোর হয় । একটু বেলা হলে সে পাশেই চৌধুরী বাড়ীতে যায় । কায়েস চৌধুরী ডাক্তার ছিলেন । গ্রামের মানুষের জন্য অনেক করেছেন তিনি । ফ্রি চিকিৎসা পথ্য সব দিয়েছেন । যার কারণে গ্রামের মানুষ তাকে খুব শ্রদ্ধা করত। এখন তিনি বেঁচে নেই তবে তার ছেলেরা সুনাম অক্ষুন্ন রেখেছে । তারা পাঁচ ভাইয়ের সবাই মুক্তিযোদ্ধা । এলাকার মানুষ এই বাড়ীকে আলাদা সম্ভ্রমের চোখে দেখে । রোমেলা মাঝে মাঝে সে বাড়িতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনে । শুনতে শুনতে সে অন্য দুনিয়ায় চলে যায় । চৌধুরী বাড়ির সবাই রমেলা কে খুব আদর করে কিন্তু আজ সবাই কেমন যেন চিনতে পারছেনা এমন ভাব । রোমেলা এর কারন বুঝতে পারে । পুরুষরা কেও বাড়িতে নেই । চৌধুরীর স্ত্রী রোমেলাকে কাছে ডেকে নিয়ে বসায় । বলে , মজনু বাড়িতে আসে না ?
কি বলবে রোমেলা ? বলে, না ।
বাড়ি আসলে বুঝাইয়ো । সে কত খারাপ কাজ করতিছে তুমি জান ? আমার তো ভয় লাগতিছে আমার ছেলেগের খোঁজ না দিয়ে দেয় । তোমরা আমার অনেক নুন খাইছ নিমকহারামি যেন কইরো না । কত লোকের সর্বনাশ করতিছে জান ? দেশের সাথে গাদ্দারি আল্লাহ সহ্য করবি না । মা বোনদের হায় লাগবে ওর ।
রোমেলা মাথা নিচু করে বসে থাকে কিছু বলে না । চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে । কিছুক্ষন পর চোখ মুছে মাথা সোজা করে । চৌধুরীর স্ত্রীর চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে স্পষ্ট করে বলে, চাচিমা আপনার ছেইলেগ নিয়ে চিন্তা করবেন না । আমি তাগো কোন ক্ষতি হতি দেবনা । দেশের সাথেও গাদ্দারি করতি দেবনা ।
চৌধুরী গিন্নি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রোমেলার চোখের দিকে । সে চোখ থেকে এক ধরণের আলো ঠিকরে বের হচ্ছে । পুরো মুখ কি এক অজানা আলোয় উদ্ভাসিত । রোমেলাকে সবসময় সে শান্ত মেয়ে হিসাবে চেনে কিন্তু এ রোমেলা অন্য কেউ ।
চৌধুরী বাড়ি থেকে ফিরে আসার সময় রোমেলা বাংলাদেশের ছোট একটা পতাকা চেয়ে নিয়ে আসে সেটা তার ঘরে লুকিয়ে রাখে ।
আম্বিয়া বেগম কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না । রোমেলা খাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছে । সাত মাসের বাচ্চা পেটে । সারাক্ষন মন খারাপ করে থাকে । শরীর দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে । এভাবে চললে বাচ্চার কি হবে কে জানে ? আম্বিয়া অনেক চেষ্টা করেও কিছু করতে পারছে না । রোমেলা মুখে একটা কথা সে রাজাকারের বউ হয়ে বেঁচে থাকতে চায়না । তার বাচ্চাকে সবাই রাজাকারের বাচ্চা বলবে এটা সে মানতে পারে না । আম্বিয়া নিজেও অনেক মনঃকষ্টে আছে । তার ছেলের জন্য আশেপাশের গ্রামের অনেক মানুষের ঘরে আগুন লেগেছে । পুরুষদের অনেক কে মেরে ফেলেছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী । মহিলাদেরকে তারা ধরে নিয়ে গেছে । তাদের কপালে কি হয়েছে আল্লাহ জানে । আম্বিয়া বেগম বুঝে তার ছেলের মত দেশের মানুষেরা যদি ওদের সাহায্য না করত তাহলে বিদেশী মিলিটারি কিছুই করতে পারতনা । ছেলের কথা মনে হলে একদিকে যেমন সন্তান বলে কষ্ট হয় অন্যদিকে এমন কুলাঙ্গার ছেলে জন্ম দেওয়ার জন্য নিজের উপর ঘৃণা হয় ।
রোমেলা বিছানায় নির্জীব হয়ে পড়ে আছে । অনেক দিন হল মজনু আর আসে নাই । গ্রামের লোক সবাই জানে মজনু এখন গ্রামের মানুষের শত্রু । সে ছাড়া আর দুইজন রাজাকার আছে এ গ্রামে । বাকি সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে । রোমেলা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে যেভাবেই হোক মজনুকে ওই রাস্তা ফেরাতে হবে , গ্রামের মানুষকে বাঁচাতে হবে ।
বৌমা ! রোমেলার চিন্তায় ছেদ পড়ে ।
একটু কিছু খাও নালি শরীর আরও খারাপ হয়ে যাবি ।
আমার কিছু খাবার মন নেই মা ! আপনি খান ।
বৌমা এইরাম করলি কেমনে চলবি ? মজনুর কথা আর চিন্তা করা লাগবি না । ও যা ইচ্ছা করুক । আমাগের জন্যি ও মইরে গেছে । তুমি উঠ ।
ঠাণ্ডা হও । ইবার মজনু আসলে আমারে ডাক দিবা । আমি বুঝায়ে দেখি কি কয় ।
আম্বিয়া বেগম চলে যায় । রোমেলা আকাশ পাতাল ভাবতে থাকে । যত কঠিন আর কষ্ট হোক সে এবার আর কিছুই মানবে না ।
রোমেলা মজনুর আসার অপেক্ষায় থাকে এর মধ্যে মজনু মানুষের অনেক ক্ষতি করে ফেলেছে আর ক্ষতি করে করতে দেওয়া যাবে না । অবশেষে এক রাতে মজনু আসে । এসেই বলে , রোমেলা মেজর স্যার আমারে আজ ছুটি দিছে । আজ বাড়িতে থাকপ ।
তুমি তালি শয়তান গো দল ছাড়বা না ?
শয়তান মানে ? দেখ রমেলা অনেক দিন পর বাড়িত আইছি খবরদার আমার মেজাজ খারাপ করবিনে ।
ঠিক আছে তুমি যদি আমার কথা না শোন তালি আমি বিয়ান বেলায় বাপের বাড়ি চইলে যাব তুই যাবি নে তোর লাশ যাবে ।
লাশ গেলি যাবে । তাও আমি তোমারে এই শয়তানী কাজ করতি দেবনা ।
ও মজনু কন আসলি মনি ? বাপ মার কথা একদম ভুইলে গেলি ? আম্বিয়া বেগম এসে ঘরে ঢোকে ।
না, মা । আমি তো আসতি পারিনে আজকে ছুটি দিছে ।
মণিরে তুই আর যাস নে । মানুষ আমাগের দেখলি থুথু দেয় । তোর বাপ এত ভাল মানুষ তুই কেন এম্বা হলি । তোর বাপ কিছু জানে না । জানলি মইরে যাবে ।
মা তুমিও প্যাচাল পাড়তিছ ? তালি আমি যাই । আমি কাজ ছাড়তি পারবনা । আমি অন্যায় করতিছিনে । মেজর সাহেব কইছে আমি ধর্মের জন্যি কাজ করতিছি ।
মানুষ মারা কোন ধর্মের কাজ ? রমেলা চাপা স্বরে বলে ওঠে ।
চুপ কর ! ধর্মের তুই কি বুঝিস ?
আমি বুঝি , তুমি যে কাজ করতিছ সে ভাল কাজ না ।
মা ওরে চুপ করতি কউ নাহলি কিন্তু খুন করব ।
রমেলা বুঝে রেগে গিয়ে লাভ নেই ।
আম্বিয়া বেগম আর রমেলা অনেক সময় নিয়ে মজনুকে বুঝানোর চেষ্টা করে কিন্তু মজনু নাছোড় । এক কথা বলে দেয় সে একাজ ছাড়বে না । রমেলার মন ভীষণ খারাপ হয়ে যায় । গুম হয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকে । তবে মজনু তার সাথে বেশি খারাপ আচরণ করেনা । পরিবারের কাছে মজনু অনেকটাই নম্র । কিন্তু পাক হানাদারদের সাথে যখন থাকে তখন তাদের মতই হায়েনা হয়ে যায় । দয়ামায়াহীন পাষণ্ড ।
রাত গভীর রোমেলা বারান্দায় বসে আছে । অন্ধকার রাত , তার জিবনের মতই । অনেক ভাল ভাবেই তো তাদের দিন কাটছিল । কেন এমন হল ? তার স্বামী কোনদিন এত খারাপ হবে সেটা তো কল্পনাও করেনি । অনেক রাত হয়েছে । মজনু ঘরে ঘুমাচ্ছে । রোমেলা ভাত তরকারি গরম করে । চোখ দিয়ে তার অঝোর ধারায় পানি পড়ছে । কতদিন পরে সে তার প্রিয় স্বামীর জন্য নিজের হাতে ভাত সাজাচ্ছে । আজই শেষ বারের মত তার স্বামীকে ভাত খাওয়াবে । চোখ ভাল করে মুছে রোমেলা ঘরে ঢোকে । ভাতের প্লেট পানি ইত্যাদি সাজিয়ে আস্তে করে মজনুকে ডাকে ।
মজনু উঠে হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসে ।
আইচ্ছা আমাগো যদি গেন্দা হয় তালি কি নাম রাকপো ? আর যদি গেন্দি হয় ?
মজনু হটাৎ করে এই প্রশ্নে অবাক হয়ে বলে , আগে হোক পরে দেখা যাবিনে ।
মজনু খাওয়া শুরু করলে রোমেলা এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে । মুখে গভীর বিষাদ । মজনুর খাওয়া প্রায় শেষের দিকে । খাওয়া থামিয়ে মজনু হটাৎ বুক চেপে ধরে, তার শ্বাস আঁটকে আসছে । বুকে প্রচণ্ড জ্বালা করছে । হাঁসফাঁস করে বলে, রোমেলা আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতিছে ক্যান ? বুক জ্বালা করে করতিছে ক্যান ? বলতে বলতে সে শুয়ে পড়ে ।
রমেলা মজনুর মুখের কাছে মুখ এনে পরম ভালবাসায় কপালে একটা চুমা দেয় , চোখের পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেয় পুরো মুখ । ধীরে ধীরে বলে, আমারে মাপ কইরে দিও । আমি অনেক চেষ্টা করছি তোমারে ফিরাইতে পারিনি । এই ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না । তুমি বাইচে থাকলি আরও মানুষ মরবি । দেশের মানুষ তোমারে রাজাকার কবি, আমারে তার বউ । সারা জীবন আমার বাচ্চা মাইনষের গালাগালি শুনবি আমি তা দেখতি পারব না । পৃথিবীর মানুষ জানবি না , আমার আল্লাহ জানবি আমি অনেকগুলো মাইনষের জান বাঁচালাম । আমার প্যাটে যদি তোমার বাচ্চা না থাইকতো তালি আমিও তোমার সাথে চইলে যাতাম । আমার মণিরে আমি একজন ভাল মানুষ বানাব মুক্তিগো মত । সে দেশের জন্যি জান দেবে ।
মজনু কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে শোনার চেষ্টা করে । তার শরীর যন্ত্রণায় দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে । বহু আগেই শরীরে বিষ ক্রিয়া শুরু হয়েছে । কড়া বিষ । কিছু সময়ের মধ্যে মজনুর শরীর নির্জীব হয়ে যায় । রোমেলা পাথরের মূর্তির মত তার মৃত ভালবাসার পাশে বসে থাকে । মুখে কোন অভিব্যাক্তি নেই শুধু দু’চোখ বেয়ে দরদর করে পানি ঝরছে ।
দীর্ঘক্ষণ পর রোমেলা চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায় বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা লালসবুজ পতাকা বুকের উপর শাড়ীর ভাঁজের মধ্যে নিয়ে রাস্তায় নামে । চারদিকে তখনো অন্ধকার । সামনের পথ অজানা । তবুও রোমেলা চলতে থাকে ।
কিছুদূর যাওয়ার পর পূর্ব আকাশ ফর্সা হয়ে আসে দিগন্তরেখায় আলো দেখা দেয় । সেই আলোক পথে রোমেলা সামনের দিকে এগিয়ে যায় আর স্বপ্ন দেখে ।একদিন দেশ স্বাধীন হবে, সে দেশে তার সন্তান জন্ম নেবে । মানুষকে ভালবাসবে দেশকে ভালবাসবে । রোমেলা পেটের উপর হাত রেখে তার স্বপ্নকে অনুভব করে । পূর্ব আকাশে লাল টকটকে সূর্য উঠেছে । সেদিকে তাকিয়ে সে আবারো পথ চলা শুরু করে...........।।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ম্যারিনা নাসরিন সীমা লেখক পাঠক বন্ধু , অসংখ্য ধন্যবাদ আমার গল্প পড়ে অনুভূতি প্রকাশ করার জন্য । আপনাদের সুন্দর সুন্দর মন্তব্যে আমি অভিভূত । সবার জন্য শুভকামনা ।
নিরব নিশাচর এদেশে অনেক রমেলা ছিল এক সময় ... একেবারে ভিন্ন স্বাদের একটি গল্প পরলাম... মজনুর মত দেশদ্রোহীদের এখনো এভাবে মারা উচিত... চমত্কার গল্প অপু, চমত্কার প্রকাশ ভঙ্গী...
মোঃ শামছুল আরেফিন গল্পে একই সাথে অসীম ধৈর্য এবং একই সাথে প্রখর স্বামী ভক্তের পরিচয় দিয়েছে রোমেলা। স্বামীকে অনেক ভালবাসত সত্য। কিন্তু তা নিশ্চয়ই নিজ দেশকে ভালবাসার উর্ধে নয়। তবুও অনেক চেষ্টা করেছে সে মজনুকে সঠিক পথে ফেরাতে। এত চেস্টার পরেও মজনু যখন রাজাকার হয়ে বাঁচতে চাইল তখন তাকে বাঁচতে দেয়া উচিত হবে কেন? ঠিক কাজটি করেছে রোমেলা। খুব ভাল গল্প লিখেছেন আপু। আমাদের নারীরাও যে যুদ্ধে পরোক্ষভাবে অংশগ্রহন করেছিল তা যেন আবার মনে করিয়ে দিলেন। গল্পে বর্ণনা খুব ভাল লেগেছে। তবে কিছু কিছু যায়গায় মনে হয়েছে ছটগল্পের তুলনায় বেশি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অনেক ভাল লিখনে আপনি। তবে আপনার কাছ থেকে সেরা লেখাগুলো যে খুব শীগ্রই পাব সে আশা বুকে ধারণ করতেই পারি। আপনার লেখাই তাই বলে। এখনও দেয়ার আছে অনেক কিছু। ভাল থাকবেন।
আহমাদ মুকুল আপনার লেখা বরাবরই মন কাড়ে। এবারের গল্পে কাহিনীর অভিনবত্ব বাড়তি মাত্রা যোগ করলো। এ রকম অনেক অনেক ভালো লিখুন।
অজয় এই দুবার পড়েছি ভালো লাগা রেখে গেলাম গল্পের শিরোনামে
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি হুমমম.. চা খেতে খেতে গল্পটা এতক্ষন পড়ছিলাম। কিহয় কিহয় করতে করতে গল্পটা শেষ করে হৃদয়ে একটা পরিতৃপ্তির শীতল হাওয়া বয়ে যেতেই মনে হলো গরম চায়ে এবার গলাটা ভিজিয়ে মুডটা ফিরিয়ে আনি। কিন্তু চা ভর্তি কাপটা কখন যে আরো শীতল হয়ে বসে আছে চুমুক দিয়েই তা টের পেলাম।এই যদি হয় অবস্থা সীমা আপু। তা হলে তো তাড়াহেড়াই ভালো।একজন লেখকের লেখার মাঝে পাঠককে ধরে রাখার ক্ষমতা তার সবচে বড় গুন। আপনার মধ্যে তা প্রবল। শুভকামনা রইলো সেই সাথে প্রাপ্যটাও..........
ম্যারিনা নাসরিন সীমা গল্প পড়ে অনুভূতি জানানোর জন্য লেখক পাঠক বন্ধুদের ধন্যবাদ । আযহা ভাই আপনার মুক্তির মিছিল কবিতাটা পড়ার ইচ্ছা থাকল ।
প্রজাপতি মন অদ্ভূত সুন্দর গল্প। রাজাকারের বাড়িতেও এমন দেশপ্রেমিক থাকতে পারে আপনি তা করে দেখালেন। ভালো লাগলো অনেক।
তৌহিদুল ইসলাম এত অসাধারণ গল্পটা পড়ার পর সব কমেন্ট গুলো কেমন সাধারণ মনে হচ্হে....... তাই কোনো কমেন্ট দিতে পারছিনা ............শুধুমাত্র সুভো কামনা ই থাকলো !!

০৩ মার্চ - ২০১১ গল্প/কবিতা: ২০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪