একজন গর্বিত বাবা

গর্ব (অক্টোবর ২০১১)

ম্যারিনা নাসরিন সীমা
  • ৯৪
  • 0
  • ৭৪
( মিথিলা ভাবে,ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার,ব্যারিস্টার কিছুই নয় তার সন্তানরা যেন হয় অপুর মতই । তবেই তারা হতে পারবে তার গর্ব, দেশের গর্ব ... )


পাখির কিচিরমিচির শব্দ ভেসে আসছে পাশের বাঁশ ঝাড় থেকে । খোলা জানালা দিয়ে আবছা আলোর আভাস। মিথিলা চোখ একটু করে খোলে আবার বন্ধ করে ফেলে । ভোরের এই মিষ্টি সময়টুকু মিথিলার ভীষণ প্রিয় । শহরের ঘিঞ্জি সব বাসা বাড়ীতে যেখানে মানুষ ঠিকমত শ্বাস নিতেই পারেনা, সেখানে পাখপাখালির কূজনে ঘুম ভাঙ্গা তো বিশাল ভাগ্যের বিষয় ! গাজীপুর জেলার ছোট্ট শহরের এই বাড়ীটাতে মিথিলা আজ তিন বছর ধরে বাস করছে । একই পাঁচিলের মধ্যে পাঁচটা বাড়ি ।একপাশে বাঁশ ঝাড় তার পাশে ছোট্ট একটা পুকুর , যে পুকুরে লাল শাপলারা বাস করে বারমাস । এসবকিছু মিথিলাকে তার ছেড়ে আসা প্রিয় গ্রামকে মনে করিয়ে দেয় । প্রভাতের এই সময়টাতে তাই সে কিছুটা নস্টালজিয়ায় ভোগে । ফিরে যায় ফেলে আসা দিনগুলিতে ।

দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকায় মিথিলা । সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে । দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে নেয় । এরপর মিউজিক সিস্টেম এ রবীন্দ্র সঙ্গীতের সিডি চালিয়ে সাথীকে নিয়ে নাস্তা তৈরি করে । ফাঁকে ফাঁকে বড় ছেলে অভ্রকে হাঁক দিতে থাকে ।
অভ্র উঠ , হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বস ।
কিন্তু কে শোনে কার কথা ! অভ্র উঁ বলে আবার পাশ ফিরে শোয় । অগত্যা তাকে টেনে তুলে ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে হাতে ধরিয়ে দেয় মিথিলা । এরপর আর কিছু বলতে হয়না। অভ্র ব্রাশ করে পড়তে বসে । পাশে মিথিলাও কোনদিন একটা বই বা কোনদিন পরীক্ষার খাতা নিয়ে বসে পড়ে । ওদিকে হালকা সুরে বেজে চলে গুরুসঙ্গীত । এ সময়টাতে জীবন টাকে বড় সুন্দর মনে হয় ।

মিথিলা বেসরকারী একটা কলেজের লেকচারার । কলেজ থেকে বেশ দূরেই তার বাসা। রিক্সায় যেতে মিনিট পনের লাগে। তাই প্রতিদিন ক্লাস টাইমের প্রায় আধা ঘন্টা আগে বাসা থেকে বের হতে হয়। তারপরও রিক্সার জন্য কোন কোন দিন সময়ে টান পড়ে যায় ।

আজও সে আধাঘন্টা আগেই বাসা থেকে বের হয়ে হাঁটা শুরু করলো। চৈত্রের দিন,এখনই সূর্যের যে তেজ! শরীর যেন পুড়ে যেতে চাইছে।
প্রায় অর্ধেক রাস্তায় এসে রিক্সা পেল মিথিলা। রিক্সাওয়ালার পুরো শরীর ঘামে জবজবে ভেজা। তাকে দেখে নিজের গরমের কষ্টটা ভুলে যায়। মনে মনে ভাবে কি অমানবিক দুনিয়া ? এখন সে রিক্সায় উপরে আরামে বসে থাকবে আর একজন ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে প্যাডেলে চাপ দিয়ে তাকে বয়ে নিয়ে যাবে গন্তব্যে । বিনিময়ে পাবে হয়েতো দশটি টাকা। যে টাকায় আজকাল পঞ্চাশ গ্রাম কাঁচামরিচও পাওয়া যায় না।


কলেজ সেরে বাসায় ফেরার জন্য মিথিলা আবার যখন রিক্সায় চড়ে বসে তখন বেলা প্রায় তিনটা। বাসার প্রায় কাছাকাছি এসে হঠাৎ মিথিলার চোখ একখানে আটকে যায়। মনে মনে ভাবে কে ওটা ? অপূর্ব না ? হ্যাঁ তাইতো ।গায়ে টকটকে লাল রঙের স্যান্ডো গেঞ্জি পরনে একই রঙের থ্রি কোয়াটার প্যান্ট ।
এই অপু , এদিকে আয় । রিক্সায় ওঠ।

অপু ফিরে তাকায় একটু হেসে বলে ফুপু তুমি যাও আমি হেঁটে যাব ।
ফাইজলামি করিস না, উঠে আয় । না হলে থাপ্পড় খাবি।
অপু আর কোন কথা না বলে রিক্সায় উঠে বসে । বলে,তুমি কেমন আছ ফুপু?

তার আগে বল তুই কখন আসলি ? আর এই জোকারের ড্রেস পরে রাস্তায় টো টো করছিস কেন ?
তুমি বের হওয়ার একটু পরেই আসছি, হেঁটে হেঁটে তোমাদের শহর দেখছি।
অপু মিথিলার বড় ভাই জাফরের বড় ছেলে। তার আচরণ কিছুটা অদ্ভুত। অনেকেই সেটা ভাল চোখে দেখে না। কিন্তু মিথিলা এই ছেলেটাকে অসম্ভব ভালবাসে । সে যখন কেবল এইচ.এস.সি পড়ে তখন তার জন্ম । ঢাকায় ভাইয়ের বাসায় থেকে লেখাপড়া করেছে মিথিলা, অপুকে কোলে পিঠে করে সেই বড় করেছে।
অপুর বয়স যখন দেড় বছর তখন মিথিলার বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু লেখাপড়া শেষ না হওয়াতে স্বামীর কর্মস্থলে আর যাওয়া হয়নি । অপুদের সাথেই থেকে যায় আরও দুই বছর । মিথিলা পড়ালেখা শেষ করে একটা কলেজে প্রভাষক হিসাবে যোগ দেয়। সেই কলেজে এখনো আছে সে । স্বামী সরকারী চাকুরে । দেশের নানা জেলায় বদলীর চাকরী করে এখন ঢাকায় এসে থিতু হয়েছে ।

মানুষের আশা ডালপালা ছাড়ে কখনো নিজেকে নিয়ে তবে বেশীরভাগ সময় সন্তানকে ঘিরে। মিথিলার ভাই জাফর সাহেবের স্বপ্নও তার ছেলেকে ঘিরে ডালপালা ছড়াতে থাকে। অপুর বাবা নিজে ইঞ্জিনিয়ার বিশাল কনসাল্টিং ফার্ম রয়েছে । ফ্ল্যাট, প্লটের ব্যবসা । কোটি টাকার লেনদেন প্রতিদিন। ছেলে বড় হবে , ইঞ্জিনিয়ার হবে। তার ব্যবসার হাল ধরবে। এটাই চেয়েছিল জাফর সাহেব। কিন্তু ছেলে যত বড় হতে থাকে তার স্বপ্নের ডালগুলো ঝড়ে যেন ভাঙতে থাকে । কারণ ছেলের লেখাপড়ায় কোন মন নেই বাসায় টিচার এসে যতটুকু সময় পড়ায় ঠিক ততটুকুই বাকী সময়টা বই এর সাথে তার কোন সম্পর্ক থাকে না। সেই ক্লাস এইটে থাকতেই বাইরে গিয়ে টো টো করে ঘুরে বেড়ানো
মাঝে মাঝে যখন মিথিলা ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে যায়। ভাবী নালিশ করে ছেলের নামে। বলে , অপু আমার কোন কথা শোনেনা। পড়ালেখা করে না। তোমার ভাই আমাকে দোষ দেয় ।
মিথিলা মিটি মিটি হাসে। ভাবী , ভাইয়ের কথা বলে লাভ নাই। তোমাকে দোষ দিয়ে সে নিজে দোষ এড়াতে চায়।
মিথিলা অপুকে নানা ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে ।
কিন্তু কার কথা কে শোনে? অপু ফুপুকে জড়িয়ে ধরে বলে , ফুপুমা , আচ্ছা তুমি বল, সবাই কি সব কাজ পারে ? আমার দ্বারা পড়ালেখা সম্ভব না। এটা তোমার ভাইকে বোঝাও।
দেখতে দেখতে অপুর এস.এস.সি পরীক্ষা সামনে চলে আসে । শাহানা চিন্তিত হয়ে পড়ে কারণ পরীক্ষায় খারাপ করলে পুরো দায়ভার পড়বে তার উপর । আমাদের সমাজে এখনো সন্তানের কৃতিত্ব সব বাবার আর সন্তান দোষ করলে সে অপরাধ যেন মায়ের। অনেক চিন্তা ভাবনা করে সে ঠিক করে যে ছেলেকে তারা ছোট চাচার বাসায় পাঠিয়ে দেবে। চাচাকে অপু খুব ভয় পায়। ওখানে গিয়ে তিনমাস লেখা পড়া করলে হয়তো পরীক্ষায় ভাল করবে।
অবশেষে অপুকে তার ছোট চাচার বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। চাচার তত্ত্বাবধানে অপু এস.এস.সি তে ভালভাবেই পাশ করে। এস.এস.সি পাশ করার পর তাকে আর পায় কে? মিথিলার সাথে দেখা হলে বলে , তোমরা না বলেছিলে আমি পাশ করব না ? দেখ সবার মুখে ঝ্যাঁটা মেরে পাশ করেছি।
মিথিলা হাসি চেপে বলে ফাজিল ! তোর লজ্জা লাগে না? চারদিকে গোল্ডেন এ+ এর ছড়াছড়ি আর তুই এ- পেযে অহংকার করিস ? বেশরম !

জাফর সাহেব অপুর রেজাল্টে মোটেই খুশী নয়। তার বন্ধুদের ছেলেমেয়েরা এ+ নিয়ে পাশ করেছে তাদের কাছে ছেলের রেজাল্ট বলতে লজ্জা পায়। আস্তে আস্তে ছেলের সাথে তার দূরত্ব বাড়তে থাকে।
এদিকে অপু দিনের বেশির ভাগ সময় সে ঘরের বাইরে থাকে। বাবার পকেট থেকে প্রচুর টাকা বের করে নিয়ে যায়। তার বাবার টাকার হিসাব নেই দেখে তিনি বুঝতে পারেন না। মিথিলা সহ সবাই অনেকবার জিজ্ঞাসা করেছে সে বাইরে কি করে ? এত টাকা কিসে খরচ করে ? অপু হেসে উড়িয়ে দেয়। বলে জাফর সাহেবের অনেক টাকা । এর ছিটেফোঁটা আমি নিয়ে ভাল কাজেই লাগাই চিন্তা করোনা ।
জাফর সাহেব সাংঘাতিক রগচটা মানুষ ছেলের এসব কান্ড শুনলে তুলকালাম করে ফেলবে। তাই কেউ আর তার কানে কিছু দেয় না। তাছাড়া অপুর মধ্যে খারাপ কোন অভ্যাস আছে বলেও মনে হয় না।

অপু তার নিজের মতই চলতে থাকে। দেখতে দেখতে এইচ,এস,সি পরীক্ষা কাছে চলে আসে । কিন্তু সে তার সব বই এর নামও ঠিকমত জানে না। শাহানার মনে আবার দুশ্চিন্তা দানা বাধতে থাকে। এস.এস.সি তে তো চাচার বাসায় থেকে পাশ হলো। এইচ,এস,সি কি হবে? সেটাতো আরো কঠিন।
এবার শাহানা মিথিলার কাছে পাঠিয়ে দেবে অপুকে । সে যদি কিছু করতে পারে। জাফর সাহেব শুনে মুখ বিকৃত করে বলেন ঐ ছেলের কথা আমার সামনে বলবে না । তোমার যা খুশী কর ।


শাহানা মিথিলাকে ফোনে জানালে মিথিলা বলেছিল ঠিক আছে পাঠিয়ে দাও । কিন্তু সেত আরও পরে । আজ তো তার আসার কথা ছিলনা ।

বাসায় এসে দেখে অপু তার সব বইপত্র নিয়ে একবারে চলে এসেছে। অপু , তুই যে না বলে চলে আসলি, প্রাইভেট সবগুলো শেষ হয়েছে ? মিথিলা জানতে চায়।

না ফুপু এখানে প্রাইভেট পড়ব। তাছাড়া এখানে আমাকে অভিযোজিত হতে হবে না ? বুঝ না মাছ এখন পানি ছেড়ে ডাঙায় এসেছে ?
মানে ?

মানে হলো, তুমিতো দারোগা। তোমার শাসনে অভ্যস্ত হতে হবেনা ?

আমি দারোগা ? আমি বুঝি বেশী শাসন করি ?
সে আর বলতে ? আমার হিসাবে তোমার ছেলেদের দুর্ভাগ্য যে তারা একজন জল্ল্যাদ টাইপের নারীর পেটে জন্মেছে ।
শোন মাকে কখনো জল্লাদ হতে হয়, কখনো মায়াবতী , এটা কি তুই জানিস ?
জানি, এজন্যই তো তোমাকে ফুপুমা ডাকি।
হাহাহা .... ।

আচ্ছা যা , গোসল করে ফ্রেস হয়ে নে। আর শোন, আমার কাছে থাকতে হলে তোর এই ফুটপাত থেকে কেনা উদ্ভট কাপড়গুলো আমার সামনে বের করবি না।

প্লিজ ফুপু , তোমার এই কথাটা আমি রাখতে পারবো না। তোমার বড়লোক ভাইয়ের দামী কাপড় পরলে আমার গায়ে ফোস্কা পড়ে , আমি ফুটপাতেই ঠিক আছি।
মিথিলা আর কথা বাড়ায় না । কারণ জানে এই পাগলের সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।

মিথিলা কলেজের শিক্ষক । তার সাবজেক্ট অপুর না থাকলেও ইন্টারমিডিয়েটের সিলেবাস সম্পর্কে তার পরিষ্কার ধারণা রয়েছে। অপু কমার্সের ছাত্র। মিথিলা বিকালেই অপুর বই আর সিলেবাস নিয়ে বসে মিলাতে থাকে কোন বইয়ের কতটুকু পড়া হয়েছে। মিলাতে গিয়ে সে যা দেখলো মাথায় বাজ পড়ার মতো অবস্থা । একমাত্র একাউন্টিং ছাড়া কোন বিষয়ে দশ ভাগের এক ভাগও তার পড়া নেই। শুধু তাই নয়। বাংলা, গদ্য, কম্পিউটার শিক্ষা, সাচিবিক বিদ্যা এসমস্ত বিষয়ে তার কোন ধারণাই নেই কারণ এগুলো বই সে এখন কেনেনি। মিথিলা হতবাক হয়ে যায়। এই তিনমাসে এত পড়া সে কিভাবে করবে ? আর একটা বিষয় সে বুঝতে পারে না অপু টেষ্টে পাশ করলো কিভাবে ?
অপু তুমি টেষ্টে কিভাবে পাশ করেছ? অপু বুঝতে পারে ফুপুর সাথে এখন কোন ঠাট্টা করা চলবে না। কারণ তার দারোগা মেজাজ শুরু হয়ে গেছে। খুব রেগে গেলে ফুপু তাকে তুমি করে।

অপু কিছু না বলে চুপ করে থাকে। অপু বল তোমাকে কিভাবে কলেজ সেন্টআপ করলো ?

ফুপু ,এখন তোমার মেজাজ খারাপ পরে বলব।
আসলে সে যে বেসরকারী কলেজে পড়ে সেখানে টেষ্ট পরীক্ষা না দিলেও যে ফরম পূরণ করতে কোন সমস্যা হয় না এটা সে আর মিথিলাকে বলতে চায় না।
মিথিলা প্রথম দিনেই অপুর জন্য একটা পড়ার রুটিন করে ফেলল। কিন্তু রুটিন করলে কি হবে ? অপুকে কি সহজে পড়ান যায় ? এক নাগাড়ে দশ মিনিট বসে না । এতবড় ছেলেকে মিথিলা মার পর্যন্ত দেয়। কখনো বাবা বলে কখনো বকা দিয়ে পড়াতে বসে। তাও তার আব্দার সে পড়বে না। মিথিলা পড়বে সে শুধু শুনবে। শেষ পর্যন্ত মিথিলা সেটাও করে।

একটা জিনিস খেয়াল করে মিথিলা অসম্ভব মেধাবী অপু । মিথিলা একটা প্রশ্ন পড়ে ওকে শোনায় ও ঠিক নিজের মত করে পরে গড় গড় করে বলে যায়। এই ছেলে যদি ঠিকমত লেখাপড়া করতো তাহলে সে বাবার আপসোস না হয়ে গর্ব হয়ে দাড়াত। আমাদের সমাজে এখনো মানুষ মেধাবী বলতে ভাল রেজাল্ট করা ছেলেমেয়েদেরকেই মনে করে আর তাদেরকে সবাই সমাজের গর্ব হিসাবে দেখে। তার বাইরের কিছু গর্ব করার মত যে থাকতে পারে সেটা মনে করে না।
অন্য আর একটা বিষয় খেয়াল করে মিথিলা । অপু জানে তার বাবা তাকে প্রচন্ড ঘৃনা করে। কিন্তু তার কথা হল , পৃথিবীর সকল সন্তান তার মা বাবার মনের মত নাও হতে পারে। সবাই লেখাপড়ায় ভাল থাকে না । তার কারণে বাবা মা তাকে নিয়ে গর্ব না করুক ঘৃনা তো করতে পারে না ! সে ভাল কাজ করতে না পারুক খারাপ কাজ তো করছে না ? মদ খায় না, গাঁজা খায় না, ছিনতাই করে না, চুরি করে না এমনকি সিগারেট পর্যন্ত খায় না। কোন খারাপ সঙ্গে মিশে না। তার একটাই দোষ সে লেখাপড়া ঠিকমত করতে পারে না। তাই বলে বাবা তাকে ঘৃনা করবে কেন? কেন তাকে কীটের মত প্রাণী মনে করবে ?

অপুর ভিতরের অভিমান দেখে মিথিলা স্তব্ধ হয়ে যায় । হেরে যায় অপুর যুক্তির কাছে। ঠিকই তো সেতো কোন খারাপ কাজ আজ পর্যন্ত করে নাই। সবাইতো লেখাপড়ায় ভাল হয়না তাই বলে কেন তাকে ঘৃনা করতে হবে ? মিথিলা ঠিক করে এবার ঢাকায় গিয়ে ভাইকে সে ভালভাবে বুঝাবে। না হলে অপু তার বাবাকে কখনো ভালবাসতে পারবে না। একজন বাবার জন্য এর চেয়ে দুঃখের আর কি হতে পারে ?

দেখতে দেখতে সময়গুলো পার হয়ে যায়। অপুর পরীক্ষার পাঁচ দিন আগে সে ঢাকায় চলে যায় । পরীক্ষার দিনগুলোতে প্রতিদিনের পরীক্ষার খবর জানতে মিথিলা উদগ্রীব হয়ে থাকতো।
অপুর খুব মজা করে ফোনে বলে, ফুপু, তোমার বাংলা সাজেশন একশ ভাগ কমন। সবগুলোর উত্তর দিয়েছি। পঁয়তাল্লিশ তো অবশ্যই পাব।
মিথিলা বকা দিতে গিয়ে হেসে বলে, বলিস কি ? একশভাগ কমন তারপরেও পঁয়তাল্লিশ ? হাহাহা !

এরমধ্যে মিথিলা কয়েকবার ঢাকা গিয়েছে । দেখেছে অপুর প্রতি তার বাবার ঘৃনা আরো বেড়েছে , বেড়েছে মায়ের দুশ্চিন্তা । কারণ অপু এখন প্রায় সারাদিন বাইরে থাকে। বাইরে খায়, একটা মটর সাইকেল কিনেছে বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে। বাবার পকেট থেকে প্রচুর টাকা নেয়।
মিথিলা অপুর কাছে আবারো জানতে চেয়েছে সে বাইরে কি করে? অপু বলেছে ফুপু কি করি এটা জানার দরকার নেই । তবে এটুকু শুধু জেনে রাখ আমি খারাপ কাজ করিনা। খারাপের মধ্যে শুধু একটু ফাস্ট ফুড খাই । হাহাহা !

অপুর কথায় কোথায় যেন নির্ভরযোগ্যতার একটা সূর । মিথিলা আর কিছু বলে না। যেদিন পরীক্ষার রেজাল্ট হওয়ার কথা সেদিন মিথিলার মনে ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। অপু কি রেজাল্ট করে সেই টেনশনে। মিথিলার কলেজে রেজাল্ট চলে এসেছে। অথচ অপু এখনো ফোন করছে না। মিথিলা নিজেও ভয়ে ফোন করে না।
অবশেষে অপু ফোন করে গম্ভীর গলায় বলে ফুপু মন খারাপ করো না। মিথিলার নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসে । ভয়ে ভয়ে বলে কি হয়েছে ?

ফুপু তুমি ইন্টারে কোন ডিভিশন পেয়েছিলে ?
ফাস্ট ডিভিশন কেন ? আমার রেজাল্ট দিয়ে কি হবে? তোর রেজাল্ট বল। আমিও ফাস্ট ডিভিশন ?

এ- ? যাহ ! হারামজাদা । আমাকে ভয় পাইয়ের দিয়েছিলি, সত্যি?

হ্যাঁ ফুপুমা। তবে তুমি না হলে নিশ্চয় আমি পাশ করতে পারতাম না । বলে অপু ফোনের লাইন কেটে দেয়।
আনন্দে মিথিলার চোখে পানি চলে আসে। এরপর মাঝে মাঝে অপুর সাথে কথা হয়। একটা বেসরকারী ইউনিভার্সিটিতে ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হয়েছে অপু । কিন্তু এখনও একই অবস্থা। ভার্সিটিতে ঠিকমত যায় না। বাসায় একটুও পড়ালেখা করে না। সারাদিন বাইরে কোথায় ঘুরে বেড়ায় কেউ জানে না । লম্বা চুল রেখেছে আর ছোট্ট দাড়ি।


অনেকদিন থেকে মিথিলার যোগযোগ নেই অপুদের সাথে । ছেলের পরীক্ষা, নিজের চাকরী ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত । মাঝে মাঝে ভাবীর সাথে কথা হয় ।
হঠাৎ করে একদিন ভাবীর ফোন আসে ভাবী চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছে মিথিলা , এখনি ঢাকায় আস, আমার অপু বুঝি আর বাঁচবে না।

মিথিলার ব্রেন কিছু সময়ের জন্য শূন্য হয়ে পড়ে। কি হয়েছে বুঝতে পারে না । বার বার বলে ভাবী কি হয়েছে? কিন্তু ভাবীর এককথা তুমি এখনই চলে আস।

মিথিলা তার স্বামী ইফতেখারের কাছে ঢাকায় ফোন করে ।
সে বলে তেমন কিছু না ছোট একটা একসিডেন্ট । আমি ইচ্ছা করে তোমাকে জানাইনি। তবে তুমি চলে এস।

মিথিলা সাথে সাথে দুই ছেলেকে নিয়ে ঢাকার পথে রওনা দেয় ।

মানুষের জীবনে ছোট ছোট অনেক ঘটনা থাকে যেগুলো মনে মিষ্টি একটা অনুভূতি তৈরি করে । বাসে বসে নিজের অজান্তেই সে ফিরে যায় জীবনের সেই সুন্দর সময়টাতে যে সময়টুকু তার কেটেছিল ছোট্ট শিশু অপুর সাথে। জন্মের পরে একটা শিশুকে কিভাবে পরিচর্যা করে বড় করে তুলতে হয় সেটা সে সেই সময়ে শিখেছিল। অপুর জন্মের পর থেকে কয়েকবছর কেটেছে তার ফুপুর সাথে। মিথিলা একটা পুতুলের সাথে যেভাবে মেয়েরা আদর যত্ন করে খেলা করে ঐ ভাবেই অপুর সাথেও খেলা করত কথা বলত। তার বিয়ের আগে হওয়ার আগেই সন্তানের স্নেহ দিয়েছিল এই বাচ্চাটিকে। এখন বড় হয়ে অনেকেই যখন তার কাজ নিয়ে সমালোচনা করে মিথিলার ভিতরটা তখন মায়ের মতই কষ্ট পায়।


একটা ঘটনা মনে পড়লে তার প্রায়ই হাসি পায়। অপুর বয়স যখন সাত আট মাস তখন একদিন তার মায়ের সাথে ঘুমাচ্ছিল। মিথিলা অন্য ঘরে। হঠাৎ করে অপুর কান্নার শব্দে ছুটে যায় মিথিলা । গিয়ে দেখে সে এক ভয়াবহ অবস্থা। অপু কখন ঘুম থেকে জেগে গিয়ে পায়খানা করেছে, করে সেটা সে কিছু নিজের মুখে মেখেছে আর কিছুটা পরম যত্নে তার মায়ের চুলে আর মুখে মাখিয়েছে। মিথিলার ভাবী গন্ধ পেয়ে জেগে উঠে ছেলেকে পিটাচ্ছে আর বমি করছে । ঘটনা দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে মিথিলা ।
ভাবী খেপে ওঠেন, আমি মরি আমার জ্বালায় তুমি হাস ? ওকে সরাও এখান থেকে।
মিথিলা অপুকে বার্থরুমে নিয়ে সাবান দিয়ে গোসল করায় আর বলে , এটা তুমি কি করলে বাবাসোনা ? হাগু তোমার এতো প্রিয় হোল কবে থেকে ? জবাবে অপু খিলখিল করে হেসে ওঠে।
এরকম ছোট ছোট অনেক ঘটনা রয়েছে অপুর সাথে তার। মিথিলা চুলে সবসময় দুই বেনী করে রাখত। অপুর অভ্যাস ছিল মিথিলার কোলে চড়ে ঘাড়ে মাথা রেখে ঘুমানো। মিথিলা অপুকে কোলে নিয়ে হাঁটত আর গুনগুন করে গান গাইত। অপু মিথিলার চুলের দুইটা বেনীর একটা সে একহাতে ধরে রাখতো অন্যটা আর এক হাতে ধরে মুখে নিয়ে চুষত। মিথিলা অনেক চেষ্টা করেও তার এই অভ্যাসটা বদলাতে পারেনি। চুলের বেনী চুষতে চুষতে সে একসময় ঘুমিয়ে পড়ত।
কিন্তু আজ অপুর হটাত করে এমন কি হোল যে কেও তাকে ঠিকমত বলছেনা । খুব খারাপ কিছু নয়ত ? মিথিলার দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে অবিরত !

মিথিলারা যখন ঢাকায় পৌঁছায় তখন রাত সাড়ে এগারটা।

মিথিলার স্বামী ইফতিখার বাসস্ট্যান্ডে গাড়ী নিয়ে অপেক্ষা করছিল। তাকে দেখেই মিথিলা কান্নায় ভেঙে পড়ে। ইফতিখার সান্তনা দেয়। কাঁদছ কেন ? কান্নার মত তেমন কিছুই হয়নি। খুব সামান্য একটা এ্যাকসিডেন্ট।
সামান্য হোক , কি হয়েছে ? সেটা আগে বল।

চল গাড়ীতে উঠ পরে বলছি ।
গাড়ীতে বসে মিথিলা যেটা শুনলো সেটা শোনার জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না। গতকাল রাতে অপু বাইরে থেকে রাত দশটার দিকে বাসায় ফিরছিল। তখন বাসার কাছে আসলে পিছন থেকে কে বা কারা তার মাথায় রড দিয়ে আঘাত করেছে। অনেক রক্ত পড়েছে। এখন একটা বেসরকারী হাসপাতালের আই.সি.ইউ.তে আছে।
এতবড় ঘটনা অথচ তুমি বলছ কিছুই হয়নি ?

এই মিজান আগে হাসপাতালে চল । ড্রাইভারকে নির্দেশ দেয় মিথিলা,
এখনই কেন ? বাসায় গিয়ে ফ্রেস হয়ে তারপরে হাসপাতালে যাও। ইফতেখার বলার চেষ্টা করে ।

না , আমি এখনই যাব।

ইফতেখার আর কিছু বলে না। মিথিলার জিদকে সে হাড়ে হাড়ে চেনে ।

হাসপাতালের সামনে গাড়ীতে বাচ্চাদের রেখে হাসপাতালের আই.সি.ইউ এর সামনে যায় মিথিলা আর ইফতিখার। ভেতরে ঢোকার অনুমতি নেই। বাইরের গ্লাসের বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে। অপুর মাথা জুড়ে ব্যান্ডেজ। চোখ বন্ধ। ঠোট দুটো লাল টকটক করছে। ফরসা মুখে ছোট ছোট দাড়ি। অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে। দুই হাতে মুখ ঢেকে মিথিলা সেখানেই বসে পড়ে।
ইফতিখার দুরেই দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে কিছু বলে না । মানুষকে সব সময় সান্তনা দেবার ভাষা থাকে না। এটা সেরকম একটা সময়।

একসময় মিথিলা নিজে নিজেই শান্ত হয়ে বাইরে রাখা চেয়ারে এসে বসে । পাশে ইফতেখার । কিন্তু কারো মুখে কোন কথা নেই।
কিছুক্ষণ পরে মিথিলার বড় ভাই আসে। সাথে অপুর মামা সাব্বির ।এখানেই ছিল সম্ভবত, ঔষধ আনতে বাইরে গিয়েছিল।
বড় ভাই মিথিলাকে দেখে বলে ওঠে , আমার কোন কথা তো তোমরা পাত্তা দাও না । এখন দেখলে তো ? আমি তোমাদেরকে সবসময় বলেছি এতো আদর করে মাথায় তুলোনা । মানুষ আদরে বাঁদর হয় । আমার এতদিনের সুনাম সব ধূলায় মিশে গেল । এর জন্য ওর মা দায়ী ।
মিথিলা আর চুপ থাকতে পারেনা বলে , ভাইয়া এই সময় এই কথাগুলো না বললে হয় না ? দেখছ তো ছেলেটার অবস্থা ।
ওর এই অবস্থার জন্য তো আর আমি দায়ী না । সে নিজেই দায়ী আর তোমরা । কোন সন্ত্রাসী দের সাথে মিশে আল্লাহ জানেন । এখন থানা পুলিশ না করা না লাগে !
অপুর মামাকে অপুর কাছে রেখে মিথিলারা সবাই বাসায় চলে আসে । মিথিলাকে দেখে শাহানা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে । মিথিলা বলে কেদনা ভাবী সব ঠিক হয়ে যাবে ।
বড় ভাই যতই বলুক মিথিলা কিছুতেই বিশ্বাস করেনা যে অপু কোন খারাপ সংগে পড়তে পারে । মিথিলাএটা নিয়ে ইফতেখারের সাথে কথা বলে । ইফতেখার সরকারের মোটামুটি পদস্থ একজন কর্মকর্তা । সে জানাল যে এ বিষয়ে সে পুলিশের সাথে আলাপ করেছে । তারা খোঁজ নিচ্ছে আগামি কাল সব কিছু জানা যাবে ।
মিথিলারা হাসপাতাল থেকে ফিরেছে এক ঘণ্টাও হয়নি । এসময় হটাত করে জাফর সাহেব হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢোকেন , ইফতেখার তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চল , অপুর অবস্থা খারাপ । সাব্বির ফোন করেছিল । মিথিলা তুই তোর ভাবীর সাথে বাসায় থাক , তোর ভাবী খুব কান্নাকাটি করছে ।
না আমিও তোমাদের সাথে যাব ।
আচ্ছা চল । জাফর সাহেব জানে ওকে আটকানো যাবেনা ।
বাসা থেকে হাসপাতাল খুব বেশি দূরে নয় । গভীর রাত , রাস্তা সুনসান । গাড়ীতে তারা দশ মিনিটেই পৌঁছে যায় । কিন্তু এই দশ মিনিটকেই দশ দিনের মত মনে হতে লাগলো ।
আই.সি.ইউ তে ডক্টর নার্সের ভিড় দেখে মিথিলা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে । কিছুক্ষণ পর একজন ডক্টর বের হয়ে আসেন । জাফর সাহেবকে ডেকে নিয়ে বললেন , চিন্তা করবেন না । মাথার আঘাতটা তো অনেক বড় । একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল এখন ভাল । আপনারা বাসায় যেতে পারেন ।
কিন্তু কেও বাসায় যায়না সারারাত তারা বাইরে বসে কাটিয়ে দেয় ।আবছা আলোতে হাসপাতালের করিডোর গুলোকে কেমন ভৌতিক লাগছে । বারান্দায় মিথিলাদের মত আরও কয়েকজন রোগীদের আত্মীয় । কারো মুখে হাসি নেই , কথা নেই। আই.সি.ইউ এর ভিতরে পরমাত্মীয়কে রেখে বাইরে স্বজনদের এই যে অসহায় অবস্থান , এটা এদেশের পরিচিত একটি বিষণ্ণ দৃশ্য ।
রাত যত কালো আর গভীর হোক না কেন সব রাতের শেষেই সকাল হয় । আজো রাত শেষে ভোর হোল ।কিন্তু কেমন যেন অন্য দিনের মত নয় । ভোরের আলোটা আজ কেমন নিস্প্রভ । নিয়ন বাতির মত ।
সকাল দশটায় ডাক্তার আসলে মিথিলা অনুমতি নিয়ে অপুকে দেখতে গেল । ধীর পায়ে অপুর কাছে গিয়ে আস্তে করে ডাকে , অপু ..
এক ডাকেই যেন অনেক কষ্টে চোখ খুলে তাকায় অপু । প্রথমে মনে হোল চিনতে পারছে না । ভাল করে দেখার চেষ্টা করছে , তারপর মুখে মিষ্টি হাসি , ক্লান্ত চোখের তারায় একটু খুশির ঝিলিক দেখা দেয় । মিথিলা বুঝতে পারে অপু তাকে চিনতে পেরেছে । ইশারায় যেন জানতে চাইছে কেমন আছ ফুপুমা ?
মিথিলার চোখ বেয়ে দর দর করে পানি পড়তে থাকে । সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা । দ্রুত বের হয়ে আসে । যে ছেলে দশ মিনিটই একখানে স্থির থাকতে পারেনা তাকে এই অবস্থা কে করল ? তার মত ছেলের তো কোন শত্রু থাকতে পারেনা
দুপুর বারোটার দিকে ইফতেখার আসলো হাসপাতালে সাথে দুইজন পুলিশ । এক জনকে দেখে মনে হল অফিসার হবে । বাংলাদেশে পুলিশ দেখে খুশী হয় এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম । মিথিলার বুকের মধ্যে কেঁপে ওঠে । খারাপ কোন খবর নয় তো ? ইফতেখার জাফর সাহেবের সাথে পুলিশ অফিসারের পরিচয় করিয়ে দেয় ।
জাফর ভাই, উনি আজমল সাহেব রমনা থানার অছি । উনার কাছে শুনেন আপনার ছেলের কাহিনী ।
জাফর সাহেব হাত মিলাতে অছি সাহেবের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন । কিন্ত অছি সাহেব হাত না ধরে জাফর সাহেব কে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন ।
আবেগ নিয়ে বলে উঠলেন , ভাই আপনি একজন অত্যন্ত ভাগ্যবান বাবা । আপনার ছেলের মত ছেলে যেন প্রতি ঘরে ঘরে হয় ।
জাফর সাহেব কিছু না বুঝে অছি সাহেবের দিকে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন ।
এরপর অছি সাহেব যেটা বললেন সেটা একটা গল্পের মত মনে হল । তার ভাষায় বিষয় টা এরকম ,
‘‘ প্রায় বছরখানেক ধরে আমরা মাঝে মাঝেই বিভিন্ন নম্বর থেকে ফোন পেতাম । এসমস্ত ফোনে আমাদেরকে কোন একজন নানা সন্ত্রাসি কর্মকাণ্ডের আগাম সংবাদ জানাতো । আমরা গত একবছরে যত সন্ত্রাসী ধরেছি তার বেশির ভাগই ঐ ফোনের মাধ্যমে খবর পাওয়ার ভিত্তিতে । এমনকি গত মাসে জে এম বির যে বড় গ্যাং ধরা পড়েছে সেটার খবরও ঐ একই মাধ্যমে পাওয়া । কে আমাদেরকে এভাবে সহায়তা করছে সেটা জানতে আমরা অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি । গতকাল যখন ইফতেখার স্যার আপনার ছেলের উপর হামলার বিষয়ে খোঁজ নিতে থানায় যান তখন আমরা হামলাকারীদের ধরার জন্য তৎপর হয়ে উঠি । গতকাল হামলাকারীদের একজন ধরা পড়েছে । তার কাছে যেটা শুনলাম তাতে তো মনে হয় আপনার ছেলে এ যুগের মহানায়ক !
মানুষের সন্ত্রাসী গ্যাং থাকে অপুর একটা দল রয়েছে কিন্তু সেটা কোন সন্ত্রাসিদের দল নয় । সে দলে রয়েছে একদল দেশপ্রেমিক যুবক । যাদের কেও ভার্সিটির ছাত্র , কেও চাকরী করে , কেও রিকশা চালায় আবার কেও সব্জি বিক্রেতা করে । এই দলের কাজ হল সমাজ থেকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড উৎখাত করা আপনার ছেলে এদেরকে তৈরি করেছে । এরা একেকজন একেক এলাকার সন্ত্রাসীদের খবর এনে অপুর কাছে দেয় অপু সেটা যথাযথ জায়গায় পৌঁছে দিত । এরা গোয়েন্দার মত কাজ করে খবর সংগ্রহ করে খুব সাবধানে যাতে সন্ত্রাসীরা বুঝতে না পারে । তবে কখনও নিজেরা হাতে আইন তুলে নেয়নি । ওর আর এক বন্ধু শাফিও ওর সাথে কাজ করে । সেও হামলাকারীদের টার্গেট ছিল । আমরা এসব কিছু তার কাছ থেকেই জানতে পেরেছি । দুঃখের বিষয় আমাদের পুলিশের মধ্যে কিছু অসৎ পুলিশ আছে যাদের সাথে সন্ত্রাসীদের সখ্যতা আছে । সন্ত্রাসীরা তাদের সহায়তায় অপুকে খুঁজে বের করে । এরা অপুকে চিরতরে রাস্তা থেকে সরিয়ে ফেলতে চেয়েছিল । কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে ? আপনার ছেলে নিঃসন্দেহে একজন বড় দেশপ্রেমিক ?‘‘
এ পর্যন্ত বলে অছি সাহেব থামলেন । মিথিলা খেয়াল করে দেখল তার ভাইয়ের চোখ টলটল করছে কিন্তু সমস্ত মুখ গর্বের আলোয় উদ্ভাসিত ।

অছি সাহেবকে নিয়ে ইফতেখার অপুকে দেখতে ভিতরে গেল । তবে এখন অপুকে কিছুই জানানো হবেনা । অছি সাহেব সবাইকে বিষয়টাকে গোপন রাখার জন্য অনুরোধ করলেন ।

বিকাল নাগাদ অপুকে কেবিনে শিফট করা হল । শরীর খুব ভাল না হলেও এখন কথা বলতে পারছে । মিথিলা ভাইকে নিয়ে কেবিনে ঢুকল । জাফর সাহেব ছেলের পাশে বসে দুইটা হাত দিয়ে ছেলের হাতটা শক্ত করে ধরে বসে আছেন ।তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে । সে পানি বাবাছেলের হাত গুলোকে ভিজিয়ে পরিশুদ্ধ করছে । ছেলের চোখেও পানি । একজন দেশপ্রেমিক সন্তানের প্রতি গর্বিত বাবার ভালবাসার বহিঃপ্রকাশের জন্য এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কি হতে পারে ?
ফুপুমা আমার মাথায় যে বাড়ি দিয়েছিল তাকে পেলে একবার আমার কাছে নিয়ে আসবে ? চোখে জল নিয়ে অপু বলে ওঠে ।
কেন ?
তাকে আমি মিষ্টি খাওয়াবো । সে না হলে আমি আমার বাবাকে এমনভাবে কোনোদিনই পেতাম না ।
অপু জানেনা তার প্রতি বাবার এই ভালবাসা তার নিজের অর্জন করা । কারো দান নয় । কিন্তু সে কথা মিথিলা আর বলেনা ।
মিথিলাদের জন্য আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল । সন্ধ্যার কিছু আগে অপুর বন্ধু শাফি আসে । তার কাছে সব কিছু বিস্তারিত শুনে মিথিলা হতবাক হয়ে যায় । সে এত কিছু করে অথচ পরিবারের কেউ জানে না ।
শাফি বলে , ফুপু , কাল দশটার সময় রেডি থাকবেন আপনাকে একখানে নিয়ে যাব ।
পরদিন শাফি শান্তিনগরের কাছে একটা বস্তিতে নিয়ে যায় । ঘিঞ্জি বস্তির মাঝখানে একটা ঘরে ঢোকে তারা । বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই যে ভিতরে এত বড় জায়গা । আয়তকার ঘরের মাটির মেঝেতে খেজুরের পাটি বিছানো । চারদিকে চাটায়ের বেড়া তার গায়ে একপাশে একটা ব্ল্যাকবোর্ড । অন্য পাশে নানা ধরণের নীতিবাক্য লেখা পোষ্টার । বিভিন্ন নামকরা মনিষীদের ছবি ঝোলানো । মিথিলা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে শাফির দিকে তাকায় ।
শাফি ফুপুর প্রশ্ন বুঝতে পারে বলে , ফুফু তোমরা তো মনে কর অপু একজন অপদার্থ ছেলে । কিন্তু ওর মত আরও কিছু ছেলে যদি এদেশে জন্মাত তাহলে এদেশকে নিয়ে আমরা সত্যিকার ভাবে গর্ব করতে পারতাম । ও একদিকে যেমন সন্ত্রাস মুক্ত সমাজ গড়তে চায় তেমনি মানুষকে মানবিক করে গড়ে তুলতে চায় । এই ঘরটা ও ভাড়া নিয়েছে । এখানে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে দেরকে পড়ালেখা শেখানোর পাশাপাশি সততা , মূল্যবোধ , দেশপ্রেম ইত্যাদি শিক্ষা দেয় ।এরা সবাই দরিদ্রের সন্তান যাদেরকে বাবামা ভাল পরিবেশ দিতে পারেনা । এসব বাচ্চারা কতটুকু মানবিক হয়ে উঠছে সেটা দেখার জন্য মাঝে মাঝে তাদের পরীক্ষা নেওয়া হয় । সে অনেক কথা আর একদিন বলব । অপু বলে ,‘আমরা সবাইকে তো শিক্ষা দিতে পারবনা । তবে যতজনকে পারি মানুষের মত মানুষ করে তুলতে দোষ কোথায় ? ‘ ওর এসব কাজে আমরা কয়জন বন্ধু সাহায্য করি । ওর বাবার পকেট থেকে আনা টাকা অপু এদের পিছনে খরচ করে ।
মিথিলা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতে থাকে তার ভাইয়ের ছেলের বিজয়গাঁথা ।
সে বাসায় এসে সব কথা ভাইকে খুলে বলে ।
জাফর সাহেব ভেঙ্গে যাওয়া কন্থে বলে , মিথিলা আমার এই ছেলেটাকে আমি কত অপমান করেছি মনে হলেই নিজেকে আর মানুষ বলে মনে হয়না ।
এসব কথা থাক ভাইয়া ! এখন তো জেনেছ যে শুধু ভাল ছাত্র হলেই সে বাবামায়ের বা দেশের গর্ব হয়না । তোমার ছেলের মত সমাজের জন্য এমন কিছু যারা করতে পারে তারাই বাবামায়ের গর্ব দেশের গর্ব ।
অছি সাহেব ফোন করেছিল অপুকে তারা একটা সম্বর্ধনা দিতে চায় । যেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রধান অতিথি থাকবেন । কিন্তু জাফর সাহেব নিষেধ করে দেন । বলেন , আমার ছেলে সবসময় গোপনে কাজ করেছে সেটাকে গোপনই থাকতে দেন । আপনি তার জন্য দোয়া করেন যেন আপনাদের কাজে সে সবসময় সাহায্য করতে পারে ।
অবশ্যই তাই হবে । তবে আপনিও চিন্তা করবেন না । আমরা ওর নিরাপত্তার বিষয়টা দেখব ,। বলে অছি সাহেব ফোন রেখে দেন ।

আরও পাঁচদিন পর অপুকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে দেয় । অপুকে বাসায় রেখে মিথিলা তার নিজের ঘরের রাস্তার পথ ধরে । পিছনে রেখে যায় একরাশ ভালবাসা সাথে নিয়ে যায় বুকভরা গর্ব ।
অপুর এক্সিডেন্টের খবর শুনে যখন মিথিলা ঢাকার রাস্তার পথ ধরেছিল তখন তার চোখে ছিল কষ্টের অশ্রু আর বুকে ছিল অপুর ছোট্ট বেলার সব মিষ্টি স্মৃতি । আজ সুস্থ অপুকে ঘরে রেখে যখন সে নিজের ঘরে ফিরে যাচ্ছে তখনো তার চোখে অশ্রু তবে সেটা কষ্টের নয় আনন্দের । বুকে আজ তার একটাই স্বপ্ন , যে স্বপ্ন তার নিজের সন্তারদেরকে নিয়ে । ডাক্তার , ইঞ্জিনিয়ার , ব্যারিস্টার কিছুই নয় তার সন্তানরা যেন অপুর মতই হয় । তবেই তারা হতে পারবে তার গর্ব, দেশের গর্ব ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আসাদুজ্জামান অপু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটা কথা বলে ছিলেন অনেকটা এরকম , যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধ করার জন্য সৈনিক অনেক পাবে কিন্তু তাদেরকে অনুপ্রাণিত করার জন্য গান লেখক,কবিতা লেখক অনেক কম পাবে। আমাদের যুগটাতে মানুষ গুলো সব দ্বিতীয় শ্রেণীতে চলে গেছে।এখন সবাই শুধু দেশপ্রেমের কথা বলে ফেসবুক,ব্লগ সাইট গুলুতে কিন্তু বাস্তব জগতে কেউ রাস্তায় একটা অনৈতিক কাজ হতে দেখলেও তার প্রতিবাদ করে না।এদের সবার থেকে অপুকে ভিন্নরকম দেখে অনেক ভাল লাগল। একই সাথে একটু কষ্টও লাগল,শুধু অপুর নাম টাই পেলাম ওর মত মুক্তচিন্তা পেলাম না। :(
দীপক সাহা আমার চোখে জল এসে গেল। আবেগময় একটা লেখা। বড় গল্প, তবে পড়ার পর মনে হচ্ছে আর একটু বড় হলেও মন্দ হতো না। তবে আমার একটা আপত্তি আছে। "ডাক্তার , ইঞ্জিনিয়ার , ব্যারিস্টার কিছুই নয় তার সন্তানরা যেন অপুর মতই হয় । তবেই তারা হতে পারবে তার গর্ব, দেশের গর্ব ।" এখানে 'তবেই' তারা.... বাক্যে 'তবে'র সাথে 'ই' প্রত্যয় যোগ করার ফলে অর্থটা এমন দাড়াল যে - অপুর মতো হলেই কেবল তারা আপনার বা দেশের গর্ব হতে পারবে - অন্য কারো মত হলে নয়। বিষয়টা কি ভেবে দেখবেন ? গল্পের অসারণত্ব কিন্তু প্রশ্নাতীত।
ম্যারিনা নাসরিন সীমা হায় হায় ! নিরো তুমি এটা কি ডিক্লেয়ার দিলে ? আমি তো লজ্জা পাচ্ছি । তবে তোমার কথার সাথে আমি একমত । সন্তানদের মতের প্রতি ,ইচ্ছার প্রতি বাবা মায়ের শ্রদ্ধা বোধ থাকা দরকার । আমি চেষ্টা করেছি সমাজের কাছে একটা মেসেজ দিতে । এটাতে যদি সামান্যতম কাজ ও হয় মনে করব আমার লেখা সার্থক । তোমার মন্তব্য আমাকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করল । অসংখ্য ধন্যবাদ ।
নাজমুল হাসান নিরো এবার প্লট নিয়ে বলি দিদি। এটার নির্মম শিকার আমি নিজে। হাইস্কুলে থাকতেই স্বপ্ন দেখতাম বড় হয়ে দার্শনিক অথবা সায়েন্টিষ্ট হব। কিন্তু বাবা জোর করে ইঞ্জিনিয়ার বানিয়ে দিলেন। কারন ওতে নাকি ভাত নাই। বাস্তবতার নির্মম ছোঁয়ায় অহরহ ঝরে যায় অপুর মত মৌলিক চেতনা নিয়ে জন্ম নেয়া সন্তানগুলো। আমি বলব এটি গল্প না, এটি সমাজ বদলের ডাক। দৃষ্টিভঙ্গী বদলের ডাক। যে চেতনার অভাবেই আমরা এত পিছিয়ে। গল্পটি পড়ে তা আমার দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে এতটা মিলে যাবে ভাবি নি। শেষ একটাই কথা, যার মনযোগ যেদিকে বেশি সে সেখানে গেইন করে, তাকে সেখানেই বাড়তে দাও। এ মাসের সেরা লেখা ডিক্লেয়ার দিলাম দিদি।
নাজমুল হাসান নিরো একে একে শুরু করি। প্রথমে বলব গল্প হিসেবে, গল্পকবিতায় আমরা প্রায় সবাই নতুন হওয়ার কারণে বেশিরভাগ গল্পেই প্রকাশভঙ্গীর একটা রুক্ষতা থেকে যায়। ছলছলে হয় না। কিন্তু গল্পটাতে আমি সত্যিকার একটা গল্প পাঠের স্বাদ পেলাম। আর একটা মেসেজ প্রদানের উদ্দেশ্যে লেখা গল্প শৈল্পিক করে তোলাটা সত্যিই কুশলতার পরিচয় দিল।
ম্যারিনা নাসরিন সীমা @আনোয়ারুল ইকবাল, দিগন্ত রেখা ,কনিকা কনা M.A.হালিম , অনেক অনেক ধন্যবাদ , অনেক সময় নিয়ে গল্প পড়েও ক্লান্তি আসেনি সেটা আমার জন্য বড় পাওয়া । চেষ্টা করি ভাই ,লেখা গুলোতে কিছু মেসেজ দেওয়ার জন্য । শুভকামনা সবার জন্য ।
ম্যারিনা নাসরিন সীমা Khondaker Nahid Hossain তোমার মন্তব্য সবসময় গঠনমূলক । তোমার কথা আমার মনে থাকবে । গল্প পড়ার জন্য এবং ভাল লাগার জন্য ধন্যবাদ ।
ম্যারিনা নাসরিন সীমা @minarmasud ,ধন্যবাদ আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য । নাটকীয়তার কথা আমার মনে থাকবে ।
দিগন্ত রেখা উপস্থাপনাটাও ভীষণ সুন্দর !. অনেক ভালো হয়েছে......আপনার জন্য শুভকামনা.

০৩ মার্চ - ২০১১ গল্প/কবিতা: ২০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪