(একটি সত্য ঘটনা....... তাই এখানে কোন আবেগের স্থান নেই...... নেই কোন বিশেষণ)
গভীর রাতে যখন জানতে পারলাম একজন পেসেন্ট মারা গেছে তখন আমরা নিশ্চিত জালাল আর নেই। যুদ্ধের ময়দানে যোদ্ধারা গুলিবিদ্ধ হবে, মারা যাবে এটাই তো স্বাভাবিক! কিন্তু মন মানতে চাইছিল না। তাই আমরা সবাই মিলে জালালকে দেখতে গেলাম। যদিও রাতে মেয়েদের ক্যম্পে কোন কাজ করার অনুমতি নেই। কিন্তু আমাদেরই এক ভাই শহীদ হয়েছে। তাকে দেখতে যাবো না!
আজ সন্ধ্যায় মুক্তিযোদ্ধারা জালাল আর হারুনকে চিকিৎসা ক্যাম্পে দিয়ে গেছে। হারুনের স্বাস্থ্য বেশ ভাল। তার কাঁেধর পেছন দিয়ে গুলি ঢুকে সামনে দিয়ে বের হয়ে গেছে। অন্যদিকে জালালের ফুসফুস ফুটো হয়ে গুলি আটকে গেছে পাজরে। জালালের এতটাই রক্তক্ষরণ হয়েছে যে, এক পর্যায়ে শিরায় বাতাস ঢুকে গেল। আর জালাল সেটা নিয়ে মজা করছিল। তার হাতে পায়ে যেখানেই চাপ দেয়া হোক না কেন পঁচ পঁচ করে ভেঁপু বাজছে। এমতাবস্থায় যখন ডাক্তার এলেন তখন জালাল বলল, স্যার আমার এলএমজি টা কৈ? ঐটা ঠিকমতো রাইখেন! মুক্তিযোদ্ধাগো অস্ত্রের অভাব। ডাক্তার বললেন, এখন কথা বলো না। আগে দেখতে দাও। সাথে সাথে জালাল বলে, স্যার আমি ঠিক আছি, আমারে পরে দেখলেও চলবো। আগে হারুনরে দেখেন। ওরটা ইমার্জেন্সি। ডাক্তার বোস তখন ওটি (অপারেশন থিয়েটার) রেডি করতে বললেন। ওটি বলতে ছনের ঘর নীল পলিথিন দিয়ে ঘেরা। সেখানেই গরম পানি আর ছুরি কাচি নিয়ে ডাক্তার প্রস্তুত হলেন। আমাদের অবাক করে দিয়ে ডাক্তার হারুনকে আগে ওটিতে নিলেন। সাথে সাথে আমরা প্রতিবাদ জানিয়ে কারণ জানতে চাইলে, ডাক্তার বললেন, জালালের কিছু হবে না। ওর আত্মবিশ্বাসই ওকে বাঁচিয়ে রাখবে।
হারুনের যখন অপারেশন চলছে আমরা তখন জালালের কাছে গেলাম। জালাল হাসিমুখে বলে, আপা বাঁশি শুনবেন? আমার সারা শরীর বাঁশি হয়ে গেছে দেখেন, বলেই জালাল তার হাতে চাপ দিয়ে বাঁশি বাজাতে লাগলো। জালালের হাসি দেখে অন্যদের চোখে পানি খেলা করছে। কিছুক্ষণ পর জালালের ডাক আসলো। আমরা সবাই মিলে তাকে ওটিতে নিয়ে গেলাম। যে গামছাটা দিয়ে জালালের বুক বাধা ছিল, সেটা খোলার সাথে সাথে এক গামলা রক্ত মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল। ইতিমধ্যে আমরা লাইন বেধে ব্লাডগ্রুপ পরীক্ষা করে মাত্র একজনকে পেলাম যার সাথে জালালের রক্তগ্রুপ মিলে। তিনি ডা. ইকবাল। তো ডা. ইকবাল উচুঁ একটা মাচায় শুয়ে কোন ব্যগ বা বোতলে রক্ত না দিয়ে সরাসরি পাইপের মাধ্যমে জালালের শরীরে রক্ত দেয়া শুরু করলেন। এই প্রথম আমি সরাসরি এক শরীর থেকে অন্য শরীরে রক্ত দেয়া দেখলাম।
ডাক্তার বোস অনেকক্ষণ জালালের ক্ষতের দিকে চেয়ে রইলেন। ইতিমধ্যে তিনি কেচি আর ফোরসেফ দিয়ে গুলি বের করার ব্যর্থ চেষ্টা করে অবশেষে আঙ্গুল দিয়ে খোঁচানো শুরু করলেন। আমাদের শরীরে কাটা দিয়ে উঠলেও জালাল হাসিমুখেই বলতে লাগলো, আপা... চোখ বন্ধ কইরা থাকেন। এক সময় গুলি বের হলো। জালালকে ড্রেসিং দিয়ে তাবুতে নিয়ে আসা হলো। জালালের হাসিমাখা মুখ, তার ঠাট্টা-মশকরা আর ভয়াবহ ক্ষত আমাদের সবাইকে কেমন যেনো তার প্রতি আবেগী করে তুলল। হারুন তখন কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। আর ঠিক তখন জালাল অপারেশনের ধকল আর রক্ত শূন্যতায় দূর্বল হয়ে হয় জ্ঞান হারিয়েছে না হয় ঘুমোচ্ছে। তাই আমরা মেয়েরাও ফিরে এলাম ক্যম্পে।
মাঝ রাতে যখন খবর এলো একজন প্যসেন্ট মারা গেছে তখন আমরা সবাই বুঝতে পারলাম জালাল আর নেই। এক প্রকার কাঁদতে কাঁদতে আমরা সবাই তাবুতে ঢুকলাম। একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। এমন সময় কেউ একজন বলল, জালালের হাত নড়ছে... জালাল তো মরেনি...। আমরা সবাই তাকিয়ে দেখি সত্যিই তাই! আমরা চিৎকার করে ডা. বোসকে ডাকতে লাগলাম। ডা. বোস ছুটে এলেন। জানতে চাইলেন কি হয়েছে! আমরা বললাম, জালাল তো মরেনি! ডা. বোস আরো অবাক হয়ে জবাব দিলেন, তা তো আমিও জানি। মারা গিয়েছে হারুন।... আমরা কেমন যেনো অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। আরে তাই তো, আমরা তো এতক্ষণ হারুনের কথা মনেই করিনি।
এরপর জালাল সুস্থ্য হয়ে আবার যুদ্ধে যায়। যেদিন যুদ্ধে ফিরে যায় সেদিন আমরা সবাই অনেক কেঁদেছিলাম। জালাল তার স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বলে, আপা যেদিন আবার শরীরে বাঁশি বাজবো.... ছুইটা আপনাদের কাছে চইলা আসমু। তারপর জালাল হাটা ধরে। আমরা চোখের সর্বশেষ সীমা পর্যন্ত জালালকে দেখি।
গল্পটা এখানে শেষ হলেই ভাল হতো। কিন্তু স্বাধীনতার পর গল্পটা কয়েক পাতা বাড়িয়ে দিল। ততদিনে আমি বিয়ে করে সংসারী। আমার স্বামীও একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনিও সেই ক্যম্পে কাজ করতেন। তো একদিন হঠাৎ করেই বাসায় এক অচেনা আগুন্তককে দেখে আমরা দুজনই অবাক। কিন্তু পরিচয় জানতেই... কি জানি কি হলো.... আমরা তিনজনই তিনজনকে ধরে কেঁদে ফেললাম। কান্নাকাটির পর্ব শেষ হতেই জালালের কাছে জানতে চাইলাম খবরাখবর। তখন সে বলল, আপা একবার মরার হাত থেইকা তো বাঁচাইলেন যুদ্ধের সময়। কিন্তু এখন তো আমি আবার মরতে বসছি। অবাক হয়ে জানতে চাইলাম কেন? কি হয়েছে? বলে, আপা আমি তো সেনাবাহিনীতে সৈনিক ছিলাম। কিন্তু ঐ যে গুলি ঢুইকা গেল.... এখন আমারে আনফিট কইয়া তো বাইর কইরা দিছে। পুলাপাইন নিয়া তো রাস্তায় নামছি। আমারে তখন বাঁচাইলেন ক্যান? আমি আর আমার স্বামী দুজনই দুজনের মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। পরে বললাম, পরশু আসো একবার কালকে আমরা মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে কথা বলে দেখি।
কাউন্সিল থেকে জানানো হলো বিমান বাহিনীতে গ্রাউন্সে কাজ করার জন্য লোক নেয়া হবে, কাজেই সেখানে যোগাযোগ করতে। সেখানে যাবার পর অফিসার চিৎকার করে বের করে দিলেন। বললেন, আমরা কি আপনাদের চাকরী দেবার জন্য অফিস খুলে বসে আছি। আপনারা মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন তো কি হয়েছে? একপ্রকার গোলমেলে মাথা নিয়ে আবার মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে ফিরে এলাম। এসেই দেখি আমাদের সর্বাঅধিনায়ক বসে আছেন। তিনি আবার আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তাকে সব বলতেই তিনি বললেন, তুমি জালালের চাকরীর ব্যবস্থা না করেই ফিরে আসলে? তোমাকে ফিরে আসতে কে বলছে? কালকে আবার যাবা। গিয়ে কানের নীচে দুটো থাপ্পর দিয়ে বলবা, যাদের জন্য এই চেয়ারে বসে আছোস... তাদের নিয়া ফাইজলামী! চাকরী না থাকলে পোষ্ট বানিয়ে তারপর নিয়োগ দিতে হবে। পরদিন কিন্তু তা-ই করলাম, শুধু থাপ্পর বাদে। সকালে সরাসরি চেম্বারে ঢুকে উচু গলায় কথা বলে, হাতে করে চাকরীর চিঠি নিয়ে তারপর বাসায় ফিরলাম। জালালের চাকরী হলো।
গল্পটা কিন্তু এখানেও শেষ হতে পারতো। কিন্তু আরো একটা ঘটনা গল্পের আকার বাড়িয়ে দিল। বেশ ক'বছর পর একদিন খবর এলো জালাল সরোওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি। দেখতে গেলাম। মেঝেতে পড়ে আছে। বউ পাশে বসে মুখে বাতাস করছে। জিজ্ঞেস করলাম, বেড পাও নি? মাথা নাড়লো। জালালকে শান্তনা দিয়ে বললাম, তুমি ভাল হয়ে যাবা... আমরা আছি না! জালাল অনেক কষ্টে একটু হাসি ফুটিয়ে বলল, আপা এইবার মনে হয় বাঁচবো না। আমার আর আমার স্বামীর চোখে তখন পুরানো দৃশ্যটাই ভাসতে লাগলো, ক্যম্পে এই জালালই বারবার বলছিল, আমার স্টেনগানটা কোথায়? সেইটা ভালমতো রাইখেন। আমি আবার যুদ্ধে যামু।........ আমরা কর্তৃপক্ষকে বললাম, আপনারা জানেন যাকে মাটিতে রেখেছেন তিনি কত বড় মাপের লোক! জানেন তিনি একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা? তারা চোখের দিকে না তাকিয়েই জবাব দিল, হাসপাতালে সবাই সমান। পরে একজন দালালের হাতে টাকা দিয়ে জালালের জন্য একটা বেডের ব্যবস্থা করলাম আমরা। আমাদের জীবনের একমাত্র অন্যায় এটা। তুমি হয়ত বিশ্বাস করবে না রুবেল আমরা দুজন মানুষ জীবনে এই একটাই অপরাধ করেছি। জালালের বেডের জন্য ঘুষ দিয়েছি।
এবার আমি খুব ভাল করে তাকালাম সামনের মানুষ দুজনের দিকে। দুজনের চোখেই জল। কিছু বোধহয় বলা বাকি আছে। আন্দাজ করেই জিজ্ঞেস করলাম, তারপর জালালের কি হলো? জবাব পেলাম, দুদিন পর মারা গেল সেই হাসপাতালেই। জানো রুবেল, এই দেশের জন্য যারা রক্ত দিয়েছে, অঙ্গ দিয়েছে তারা কিন্তু এমন দেশ চায়নি। আমাদের একটাই কষ্ট... যার জন্য এত লক্ষ লক্ষ লোকের আত্মত্যাগ.... সেই দেশটা ভাল মানুষের হাতে থাকলো না। আমরা তো কিছুই করিনি। বর্ডার এলাকায় হাসপাতালে ছিলাম। কিন্তু যারা সরাসরি যুদ্ধ করেছে... তাদের যখন এই পরিণতি দেখি তখন কেমন লাগে বলো? জানো গত তিনটা বছর আবেদন করেও আমাদের নাম সরকারী গেজেটে উঠেনি। আমাদের ছেলে-মেয়েরা তাদের বাবা-মার নাম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেখতে চায়, তাই ওসমানী সাহেবের দেয়া সার্টিফিকেট নিয়ে গিয়েছিলাম। মন্ত্রনালয় বলে, এতদিন পর এটা দিয়ে কি করবেন? ভাতা নেয়ার জন্যই এতদিন পর নাম তুলতে চান? রুবেল, এই দেশটা বাজে কতগুলো রাজনৈতিক ব্যক্তির হাতের পুতুল হয়ে গেছে। তোমরা যারা নতুন প্রজন্ম তোমরা কি পারো না তাদের হাত থেকে দেশটাকে বাঁচাতে? তোমরা কি দেশপ্রেমের দীক্ষা নিয়ে আবার একটা নতুন সংগ্রাম শুরু করতে পারো না এইসব দেশবিরোধী মানুষের হাত থেকে দেশটাকে বাঁচাতে?
আমি খুব ঠান্ডা চোখে জানালাম, এ কে আর বাঁচানো যাবে না। আমার ক্ষমতা থাকলে আমি মূহুতের্্বর মধ্যেই এ কে ধ্বংস করে দিতাম।
২১ জানুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
২৩ টি
সমন্বিত স্কোর
৬.৪৫
বিচারক স্কোরঃ ৪.২৯ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ২.১৬ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪