ঝালমুড়ির ব্যাবসাটা আজ তিন দিন ধরে বন্ধ। কুদরত বন্ধ করেনি বরং চালানোর জন্য যে মূলধন দরকার সেটাই অবশিষ্ট নেই।থাকবেই বা কেমন করে,ভাষা ভাষা বলে চেঁচিয়েই সবার গলায় রক্ত ওঠার জোগাড়।ঝালমুড়ি খাবার সময় আছে কার?বেঁচা-বিক্রি গত এক মাস আগেই লাটে উঠেছে।কাছে যে কয়টা জমানো টাকা ছিল সব শেষ।শেষ তিন দিনের পেটের আগুন নেভানোর দায়টা নিজের দোকানের মুড়ির উপরই পড়েছে।দোকানদারী শেষ হলে কি হবে অভ্যাসটা শেষ হয়নি।তাই সকালের ঘুম ভাঙার পর কুদরতের গন্তব্য সেই চিরচেনা রাস্তার পাশের ভাঙাচোড়া ঝালমুড়ি বিক্রির টেবিল্।গত এক সপ্তাহ ধরে রাস্তার পরিবেশ থমথমে।কিছু সময় পরপর পুলিশের গাড়ির টহল চলছে।পুলিশের গাড়িকে অগ্রাহ্য করেই ডান-বাম হতে ছোট ছোট মিছিল আসছে “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই” স্লোগান নিয়ে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, গোলগাল চেহারার একটি ছেলে এসে দাঁড়ালো ভাঙাচোড়া টেবিলের সামনে।। -কুদরত ভাই,ঝালমুড়ি বিক্রি কি বন্ধ করে দিলেন? -নারে ভাই, ঝালমুড়ি খাওনের লোক না্ই। -লোক পাবেন কোথায়?সামনে ঘোর বিপদ।ওরা আমাদের “মা” ডাক বন্ধ করতে চায়।আপনি চিন্তা করতে পারেন, ঝালমুড়িকে আর কোনদিন ঝালমুড়ি বলতে পারবেন না।“মা” শব্দটা চিরতরে হারিয়ে যাবে আপনার সামনে হতে। -এই রকম ঘইটবার আগে মইরা যাওন ভালো। -ঠিক বলেছেন।আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আগামী কাল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বাংলা ভাষার জন্য মিছিল দেব। আগামী কাল উচ্চস্বরে “মা” বলে ডাকার জন্য আপনাকে দাওয়াত।
সন্ধ্য হতেই কুদরতের মনটা টালমাটাল।তার মত একজন জালমুড়ি বিক্রেতার কি আন্দোলন করা সাজে।গত মাসে বড়িতে কোন টাকা পাঠানো হয়নি। বৃদ্ধা মা কেমন করে চলছে আল্লাহই ভালো জানেন।মাকে দেখতে যাওয়া দরকার। মায়ের কথা মনে পড়তেই কুদরতের সকালের সেই নাম না জানা ছেরেটির মুখচ্ছবি ভেসে উঠলো চোখের সামনে।ছেলেটির কথাগুলো কানে বাজতে লাগলো।কিছু সময় আগেও খাবারের জন্য হাহাকার করছিল পেট। জটিল বিষয়গুলো সামনে এসে দঁড়াতেই খাবারের ইচ্ছাটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল।অবশ্য খাবার হিসাবে পরিচয় দেবার মত কিছুই ঘরে অবশিষ্ট নেই।এসব চিন্তা মাথায় নিয়ে শুয়ে পড়ল কুদরত।কিছু সময়ের ভেতর ঘুমে তলিয়ে গেল সে।একটা সুন্দর স্বপ্নে প্রবেশ করল। পড়ন্ত বিকেলে নদীর ধার ধরে হাটছে কুদরত, বাড়ির উদ্দেশ্যে।তার হাতে মায়ের জন্য কেনা সাদা থান কাপড়ের শাড়ি। হঠাৎ পশ্চিমের আকাশে কালো মেঘ জমতে শুরু করল।কুদরত শাড়ির ভাজ খুলল,মনের ভয় দূর করতে।আঁচলে বা ভিতরে কোন কাঁটা-ছেড়া নেইতো।আগেও তিনবার পরখ করেছে সে।কিন্তু মনের মধ্যে কেমন খচখচ করছে। জন্মের পর হতে তার মায়ের গায়ে একটা ভালো শাড়ি দেখেনি সে কোনদিন।ছোটবেলা থেকে মায়ের শত ছেড়া শাড়ীতে চোখের জল মুছতে দেখে মনে একটা স্বপ্ন লালন করেছে,যদি কোনদিন টাকার মুখ দেহি তাইলে পরথম টেকা দিয়া মায়েরে একখান লাল পাইড়ের শাড়ি কিনা দিমু্।লাল পাইড়ের শাড়ি সে কিনেছিল গত বছর।শাড়ি হাতে যখন সে বাড়ির উঠানে পৌছালো তখন বাড়ি ভরা মানুষের কান্নার মাতন চলছে।বাবার লাশ নিয়ে নির্বিকার হয়ে বসে আছে মা।কুদরতের হাতে লাল পাইড়ের শাড়ি দেখে চিৎকার করে উঠলেন তিনি।–বাজান গো তর বাপের কত শখ আছিল আমারে লাল পাইড়ের শাড়ি কিনা দিব।আমারে কইতো, দেইখো কুদরতের মা আমার উপর গোসা কইরো না। আমি অভাবের লাইগা পারলাম না তাতে কি আমার বেটা বড় হইয়া তোমারে ঠিকই লাল শাড়ি কিনা দিব।হেই লাল শাড়ি আনলি একটু আগআনলি না কেন? লোকটা দেইখা যাইতে পারলনা। কুদরত কি বলবে উত্তরে? কেমন করে বোঝাবে ছাপোষা আয় দিয়ে কোন কিছু তাড়াতাড়ি করা সম্ভব না। এসব সাত-পাঁচ চিন্তা করতে করতে শাড়ি আবার ভাঁজ করে দৌড় শুরু করল বাড়ির পথে।বাড়ির আঙিণায় একটা কাফনে মোড়ানো লাশ নিয়ে বসে আছে সকালের সেই অপরিচিত ছেলেটি। লাশের মুখ দেখতেই “মা” বলে চিৎকার করে উঠলো কুদরত। কিন্তু সাথে সাথেই তার মুখ চেপে ধরেছ ছেলেটি । আর চিৎকার করে বলছে “মা” বলার কোন অধিকার নেই তোমার।শক্ত হাতের চাপে দম বন্ধ হয়ে আসছে কুদরতের। হাপাতে হাপাতে ঘুম ভেঙে গেল তার।
সকাল হয়েছে অনেক্ষ্ন হল।রোদটা আস্তে আস্তে চড়তে শুরূ করেছে। চারপাশে মাইকিং হচ্ছে।“১৪৪ ধারা জারি হয়েছে।সকল প্রকার মিছিল মিটিং নিষিদ্ধ। কোথাও কোন মিছিল দেখা গেলে গুলি চালানো হবে।” কোথাও কোন মিছিল দেখা যাচেছনা।ছেলেগুলো কি দমেই গেলো শেষ পর্যন্ত। কিন্তু কুদরত যে শপথ করে এসেছে আজ মন ভরে মা ডাকবে।রাগে কটমট করতে লাগলো কুদরত।ঝালমুড়ির টেবিলে লাথি মারলো কুদরত।ভাঙাচোড়া টেবিলের কালো বীভর্ষ পা নড়ে গেছে।দীর্ঘ দিন ধরে বোঝা টেনে টেনে অভ্যস্ত ফ্যাকাসে বণে´র ইটটি হঠাৎ করেই সরিয়ে নিয়েছে নিজেকে।হয়ত এটাই তার বোবা প্রতিবাদ।স্বাধীনচেতা ইটটিকে উৎসাহ দিতেই কুদরত ওটাকে ছুড়ে মারলো তীব্র বেগে সামনের দিকে। পিছনের দিকে মৃদু গুণ্জন শুনে ঘুরে তাকলো কুদরত।এগিয়ে আসছে বাংলা ভাষার জনসমুদ্র।বেশ কিছুটা দূরে পুলিশের বিশাল বেড়িগেট।কোনকিছু দিয়ে কি এই জনস্রোতকে আটকানো যাবে।ভাষার জন্য ভালোবাসা জেগে উঠলো কুদরতের অন্তরের গহীনে। কুদরত মিশে গেল ভাষার সমুদ্রে। চিৎকার করে ডাকলো “মা”।হাজারো “মা” শব্দের ধ্বনী-প্রতিধ্বনীতে কেঁপে উঠল আকাশ-বাতাস।হঠাৎ গুলির গর্জণে প্রকম্পিত হল রাজপথ।টুপটাপ বৃষ্টির শব্দে মত পীচ ঢালা রাস্তায় ঢলে পড়ল কিছু তাজা প্রাণ। গতকালের সেই নাম-না জানা ছেলেটি পড়ে আছে কুদরতের সামনে। কুদরত উপুড় হয়ে পড়ে থাকা ছেলেটিকে সোজা করতেই দেখতে পেল বুকের নিচে পড়ে থাকা ফ্যকাশে বর্ণের ইটটি রক্তজবার মত লাল বর্ণ ধারণ করেছে।কুদরত তার মাথা কোলের উপর নিল।ছেলেটি কাঁপা হাতে র্ক্তজবা ইটের উপর লিখলো “মা”।কুদরত অপলক তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে। সারা রাস্তায় ভেসে যাওয়া রক্ত বণ্যায় বর্ণমালার ফুল ফুটতে শুরু করেছে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।