তখন আমার কতইবা বয়স- বড়জোর, বার কি বা তের। সবেমাত্র ষষ্ঠশ্রেণিতে ভর্তি হয়েছি। ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসাবে সহপাঠি যাদের পেলাম তাদের মধ্যে আমার মামার শালক ‘শান্ত’ অন্যতম। আমি মা-হারা। আমার জন্মদানপর জননী যখন পরলোক গমন করেন, তখন থেকে আমি মামার বাড়িতেই মানুষ। মামার শ্বশুরবাড়ির দূরত্বটা একটু বেশি, ওই দুর্গম এলাকায় ভাল কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না-থাকায় শান্ত বোনের শ্বশুরবাড়িতেই বিদ্যার্জন করতে আসে; সেই সুবাধে শান্তকে আমি বন্ধুহিসেবে পাই। বয়সে সে আমার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় হতে পারে, কিন্তু তার দেহের যা গঠন, এ বয়সে সে পুরাদস্তুর নওজোয়ান। তার সামনে যেন আমি এক মশক। যদিওবা আমাদের সম্পর্কটা- মামা-ভাগিনার, সেটা বোধহয় সম্বোধনাধি সমাপ্ত। দুনিয়াতে সে যমকেও ভয় করবে না, কিন্তু মামার নাম শুনলে এক শ চার ডিগ্রি জ্বরে তার হাত-পা কাঁপুনি শুরু করে দেয়। ওঁর সামনে দাঁড়ালে মনে হয়, ফেরেস্তা যেন এরূপ। তার ছলের ঢং দেখে আমি মনে মনে হাসি আর বলি- হালার হুত, শয়তানের রূপ দেখলে তুরে দেখতে অয় আর অন হাচ্ছচ্ ফিরিস্তা। মাথা কিল্ল্যায় নিচু কইরা আছচ্, অন তুর বাপ্রে কচ্চ্যা, মাইয়্যাহুলা দেখলে তুর মন কেইচ্চ্যা কেইচ্চ্যা করে। দোষ অয় ত চাওস্ হগলডি আঁর ঘাড়ে- ঐ রঞ্জু বেটাই ত কইচ্চ্যে সব। হিয়ালের ছা, অন কইতান্নি তুই মুচ্চ্যার মাইয়্যার লয় হেম করচ্।
এমনই বহুত প্রমাণ দেওয়া যায়- তার দুষ্টবুদ্ধিতে শয়তানের নানিকেও হার মানায়। মিথ্যাকে এমনভাবে উপস্থাপন করে, যেন সৃষ্টিকর্তাপ্রদত্ত বয়ান। আজকাল অন্যদিকে মন তার একেবারে নাই বললেই চলে- একমাত্র লক্ষ্য... ...
: ভাগ্নে, তুই আঁর বাপ্... ...
: কিতারে মামু, আজ্জ্যে তুঁর মুয়ে অত মধু ঝরে কিল্ল্যায়!
: আঁর মাথায় ত আর কাম কইচ্চ্যে না, আঁরে কিচ্ছু বুদ্ধি দেচনারে বাপ্।
: হায় হায় ইয়া কিয়া কও মাউ, তুঁরে আঁই বুদ্ধি দিমু! হারা জনম কইচ, আঁর বুদ্ধি যে লবু হেতার মাথায় কাওয়া হাগে- আর অন কও বুদ্ধি দিতাম!
: অরে হারামজাদা, আঁই তুরে কই ভালা কথা তুই আঁর লয় করচ্ হাইজলামি।
: মামু, তুঁরে আঁই কতবার কইচি- তুঁই আঁর বারে গাইল দিবা না।
: দেহি তুর হাছা ঘুরা-
: কিল্ল্যায়? আঁর হাছায় ত বৌত লাত্থি মাইচ্চ, অন এগুলি হেলান্না ক্যান্-অনও সময় আছে ভদ্রতায় হিঁখো, ভদ্রতায় হিঁখতে হঁইসা খরচ নাই।
: অরে জারওয়া, তুই আঁরে ভদ্রতায় হিঁখাছ্! ...তুর বারে হাই কই, হালা গরুচোর জিয়েনে জিয়েনে যায় হিয়েনে হিয়েনে এড্ডা এড্ডা বিয়ে করে; আর তুঁয়র হইচে অন বাপের দরদ... ...হুঁ...
: আঁর বাপে বিয়ে করে ত তুঁর বাপের কিয়া যায়। আর তুঁর মতন ত কনো মুচ্চ্যার মাইয়্যার হিছে হিছে ঘুরঘুর করে না। রাজাবাদশার লান বিয়ে করে।
: আহা রে, হুনচনি! হুলায় কয় কিয়া- হুন্দে নাই তেনা মিয়ে দি ভাতখানা। হুঁ, বাপ আবার রাজাবাদশা... ...
এভাবে কথায় কথায় প্রায়ই আমাদের ঝগড়াঝাটি হত। দুয়েকদিন উভয়ের মুখ দেখাদেখি বা আলাপাদি বন্ধ হলেও এর বেশি স্থায়ী হওয়া যেত না। দুজনেরই মনে তখন পৃথিবীটা বিষাদ লাগত। বেশিরভাগ সময় শান্ত এসে আমার হাত চেপে ধরত; বলত- ভাগ্নে, তুই বড্ড জঘন্য হুলা- আঁর লহে নমাতি তুই ক্যান্নে যে থাইকতে হারচ্! আঁই হাসিমশকরা নকল্ল্যে যে বাঁচি নে- আড্ডাটা যেন্ আঁর রক্তেমাংসে মিশ্সা গেছে। তুই নমাইত্লে দুন্নেয়ান আঁর অসাড় লাহে।
: হাঁছা কইলা নি?
: তো মিছা কিয়া কইলাম?
: হ, এর লাইগা বুঝি আঁর হুন্দে বাঁশ দও।
: আর দিমুনারে মাউ, অন চল্ এড্ডু হরিণ্যাদিহিত যাই।
: হিয়েনে তুঁর কাম কি?
: নিরলে বসি এড্ডু মাউ-ভাগ্নে কথা কমু।
: ভাগ্নে, বাদামতলায় আজ্জ্যে কেউ নাই দেহি! চল্ হিয়েনে বই।
: কাল্ল্যে এওশে হেবরুয়ারির দিন, শহিদমিনারে যাইতে অইবো। এড্ডা বছর পর শোহের এ দিনডা বড্ড ভালা লাহে আঁর।
: হেতার লাইগা ত আঁই তুরে এয়েনে ডাইকা আঁনছি। ... ... ...
: আর কইতে অইবো না, বুজ্জ্যা গেচি- তুঁয় কেইচ্চ্যা হেমিক; এড্ডা বছর গত অইল অনও হেতির নামডা হজ্জন্ত জানতে হারোনি! হুধু জানচ রানির হাডে হেতির বার এড্ডা মুচির দোহান আছে। এইডা জাইন্যা লাব কি।
: আরে না ভাগ্নে, আজ্জ্যা হগলডি জাইন্যা হেলাইচি- হেতির নাম ‘স্বস্তি’।
: কিয়া?
: স-হ-স-তি।
: স-স-তি হোগ্গা হ-স-তি নামে তুঁয়ার কাম কিয়া, তুঁয়ার দরকার বংশহরিচয়; কারন তুঁই চধুরিবংশের হুলা। আর চধুরিবংশের হঙ্গে কি মুচ্চ্যার জাত মানায়?
: আঁই ইয়েল্যায় তুরে গাইল দি- হালার হুত, জাত ধুইয়া তুই হানি খাবি নি? বল্? দেখা তুর জাতের রং? হেতির লান অহূর্বসুন্দরি এড্ডা মাইয়্যা তুই দশ গেরামে খুঁজ্জ্যা হাবিনি। আঁই হেম করি ত তুর জ্বলন হয়!
: ওমা, ইয়ে কিয়ে কও! আঁই জ্বইলতাম কন্ দুক্কে। তুঁই এড্ডা না, দুইডা না, দশডা হেম করোগা- আঁর বাপের কিয়া যায়।
: আচ্ছা মাউ, রাক্ কইরা লাব নাই, অন ক আঁই কিয়া কত্ত্যাম?
: কিয়া কত্ত্যাম মানে?
: আঁই ত হেতিরে ছাড়া বাঁইচ্তেন্ন্ন।
: তুঁই হেতিরে ছাড়া বাঁইচ্তে ন- ঠিক আছে, হেতি তুঁয়ারে ছাড়া বাঁইচবোনি? ... ...
: ইয়ে কিয়ে কচ্?
: ঠিকই ত কই। গত একুশে হেবরুয়ারিতে হেতির লগে তুঁয়ার দেহা। বছরডা ঘুইরা আবার আইচে। এড্ডা বছরেও তুঁই হেতিরে মনের কথাডা কইতে হারোনি!
: কেন্ন্যে কই, বল্, কেন্ন্যে কই? তুই হারামজাদারে কত কইচি- হাতপাঁও কত মাইচ্চি- তুই আঁর এড্ডা চিডি দিছচ্ কনও? মাইয়্যাহুলার ডরে হগল সময় ইঁদরের গাঁত তোয়াচ্- হালার হুত, আবার কচ্... ...
: আঁই ইঁদরের গাঁত তোকাই ত- ঠিক আছে; তই তুঁই কিল্ল্যায় দিতে হারনা? তুঁয়ার ত বুকের হাডা আকাশের লান।
: অরে গোমুখ, বন্ধুবান্ধব আর কোন্ দিনের লায়- বন্ধুবান্ধবের সায্যহযোগিতা চাড়া কেও হেমে হফল হইতে হাচ্চ্যেনি- বল্?
: তাইলে আঁর এড্ডা বুদ্ধি লইবানি?
: অরে ভাগ্নে, কচ্ কিয়া! তুর হাড্ডা দেয়- না না তুর মুয়ে এড্ডা চুঁয়া দি... ...আহ্হা...কিয়ারে ভাগ্নে, তুর মুয়ে এত গন্ধ ক্যান্? জীয়নে ত বোধয় গোছলগাছল কচ্ছ্যচ্ না! মুও আর কি ধুবি-
: আচ্ছা, আঁই জীয়নে গোছলগাছল করি নো- ভালা কথা, তুঁই কন্ আঁতরের ডিহিতুন্ নায় আইচ? তুঁইয় ত হেই জনমের হুঁছা।
: অরে আঁধার হুত, আঁই যে হতিদিন সাবন দিয়া মাথা ধুই তুর চুহে দেহে না বুঝি?
: কইলা ধুইয়া আর কিয়া অইবো... ...
: আঁর মাথা কইলা? হালার হুত দাঁড়া- বলেই শান্ত কঞ্চি কিবা ডালপালা খুঁজতে গেলে আমি মালকোঁচা মেরে দিই দৌড়- ঘরে এসে দেখি মামির মা বেড়াইতে এসেছে। আমাকে দেখে বলল- কিতারে নাতি, ভালা আছচ্নি?
আমি নানির পায়ে সেলাম করে বললাম, হ নানি-
খুব ভোরে ওঠে শহিদমিনারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। শান্ত আমার হাতে একটা কাগজের টুকরো গুঁজিয়ে দিয়ে বলল- এড্ডু হড়ে দেখ ত রঞ্জু কেইচ্চ্যা হইচে।
আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি : অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কোনেক নিরপরাধী যেন ক্ষমা প্রার্থনা চাচ্ছে- মনে হচ্ছে, ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত আসামী। তার এমন অশান্ত রূপ খুব কমই দেখেছি আমি। মিনতিঢঙে- শান্তকণ্ঠে আবার বলছে, এড্ডু হড়ে দেহেচ্চ্যা মাউ।
আমি হাসতে হাসতে বললাম- আরে, এইডা কেইচ্চ্যা চিডি! না আছে ভাষার মান, না আছে লিয়ার শ্রী; এইডা এড্ডা চিডি অইল! আমার উদ্দেশ্য- তাকে নাস্তানাবুদ করা। মনে মনে এও বলি, বেটা তুর হেমের বুত আঁই যদি চাড়াইতাম না হারি তাইলে আঁর নাম রঞ্জু পোদ্দার না।
: কিতা করি ভাগ্নে, বহৌত লেখচি আর হাটচি; এরতুন্ বেশি শ্রী ত আঁই আর লেখতে হারিরনা। আঁর মাথায় ত মানের ভাষা কিয়া হেইডা আর আইয়েরনা।
: তো একখান কাম করো-না।
: কিয়া কত্ত্যাম? কচ্-না।
: আঁই ত হেদিনও এ বুদ্ধি তুঁয়ারে দিতে আছিলাম- তুঁই হুনতে চাইচনি।
: অন হুনাচ্চা।
: চিডি যেগুন হাটচ হেগুন কোঁয়ায় হেলচ?
: হেলাইতাম কই- অনও চকির নিচে আছে।
: হেলান লাইগত নো।
: তো?
: হানির গামলা চিনো নি? ঐ যে লাল-নীল- হেলাস্টিকের?
: আরে বেডা কচ্-না, চিনতেম না কিল্ল্যায়।
: হাডা চিডির টুকরাগুন লইয়ে কুচিকুচি কইরে হে গামলায় এড্ডু হানি দিয়া নাইরা ঢকঢক কইরা খাইয়ে হেলবে; দেখবে তুঁয়ার মাথায় ভাষার কিলা জওয়ার বইচে।
: হাঁচা কইলিনি!
: দেহো-না একবার-
শান্ত শয়তানের কলকাঠি নাড়াতে পারে ঠিকই, কিন্তু বুদ্ধিসুদ্ধি তেমন একটা খাটিয়েখুটিয়ে চলতে পারে না; কখনো কখনো এমনই কাণ্ড করে বসে যে, বোকাকেও হার মানায়! আমার আদেশানুযায়ী রুমে ডুকে দরজায় খিল লাগিয়ে দিল। চিঠির ছুড়ে ফেলা অংশসব খুঁজিয়ে নিল এবং জামের মতো ভর্তা বানিয়ে আমাকে বলল-ভাগ্নে, কিলা বিষের লান দেহা যায়! তুই এড্ডু খাইয়া দেহচ্-না।
: কও কিয়া! আঁই খাইলে ত বুদ্ধি হগল আঁর মাথায় ডুইকবো। তুঁয়ার কিয়া লাব অইবো-খাইতাম নি? হেসময় হেতির হেম আঁর দিকে ছুইট্টা আইবো। তহন আঁই ত হেতির লয় হেম করন্ লাইগবো।
: তুর আর হেম করন্ লাইকতুনো, আঁই-ই খাই- বলে, এক হাতে নাকটা চেপে ধরে ঢকঢক করে খেয়ে অপর হাতের পাত্রটা একেবারে নিঃশেষ করে ফেলল!
: ভাগ্নে, এইচ্চ্যা ক্যান্ লাহে?
: কেইচ্চ্যা লাহে?
: নুন্তা নুন্তা- এড্ডু টক টক।
: হ, এড্ডু লাইগবেই ত। ভালা জিয়িসের গুন এইচ্চ্যা হয়।
আমি মনে মনে হাসতে হাসতে প্রাণশেষ- বলি, হালার হুত, তুর চদ্দগোষ্ঠীয়ে `হেমের নাম লইবে নি আর।।
: এরে, অ হালার হুত, তুই আঁরে কিয়া ভাইবচচ্! আঁই হাগল নি? কপালে করাঘাত করে : অরে আল্লা, আঁর মুও ত অন দুন্ন্যের মাজন হকলডি দিয়া মাইজলেও হরিস্কার অইতনো; আঁই অন কিয়া কত্ত্যেম! আঁই শহিদমিনারে কেন্ন্যে যাইতেম।
: মাউ, চিন্তে নাই; আঁই জামগাছের টেইলা একখান ভাইঙ্গা আনচি হিয়েন দি মাইজলে এড্ডু হরিস্কার অইবো।
: হিয়েন তুর বার হুন্দে দে। ঐ কুত্তার ছা, অন হাসচ্ কিল্ল্যায়? তুই-না আঁর বুদ্ধি বাড়াচ্।
: আচ্ছা তুঁই টেনশন নিয়ো না, আঁই হেতিরে কইয়ুম নি, তুঁই জামগুলা খাইচ। `তুঁয়ার এইচ্চ্যা টেনশন কিল্ল্যায় মাউ? চিডি আঁই দিইয়ুম....... ...
: তুর দাওনের গোষ্ঠী কিলাই, আঁর চিডি দে- হিয়ালের হুত। বলে চিঠিটা আমার হাত থেকে একটানে কেড়ে নেয়।
আমি ঈষৎ হেসে বললাম-আচ্ছা মাউ, রাক কইরা লাব নাই-ভুল অইয়া গেচে... ...এ দেহ-না কান ধইরচি। অন চল যায়... ...হগলে চইলে যাচ্চে... ...ঐ দেহ হেবরুয়ারির গান শুরু হইয়া গেচে।
: তুর রাস্তা তুই মাপ। আঁই যাইতেন্ন্য।
: আচ্ছা মাউ, রাক্ কইরা লাব নাই- ভুল অই গেচে... ...এ দেহ আঁই কান ধইরচি। অন চল যায়... ...হগলে চইলে যাচ্চে... ...ঐ দেহ হেবরুয়ারির গান শুরু হইয়া গেচে।
: তুর রাস্তা তুই মাপ। আঁই যাইতেন্ন্য।
: তই আঁর লয় যাইতননি?
: আঁই তুর লগে যাইয়ুম, হিয়েন তুর ইশ্বাস অয়নি?
: অন যাইবা কি না হিয়েন ক?
: হুঁ, হুলায় কয় কিয়া? হেতা আঁরে ছিয়াই খাওয়াইবো আঁই হেতার লগে যামু! হাগল হাইচচ্নি- বোকার হুত।
আমি মনে মনে হাসি আর বলি, তুই নিজে বোকা আর আঁরে কচ্ বোকার হুত!
স্কুলমাঠে এসে দেখি, জনমেলা জমে উঠেছে। শোকগাঁথা- দেশাত্মবোধক গান চলছে। ফুলে ফুলে শহিদমিনার ভরে গেছে। আমি দিলাম একগুচ্ছ রক্তগোলাপ। অপলকে চেয়ে আছি- আমার মানসজুড়ে ভেসে ওঠছে অসংখ্য শহিদের মুখ।
শান্ত এসে দেখি, জবাফুলের মালা দিচ্ছে। তার ঠোঁট দুটো জামের মতো কালো হয়ে আছে। ফর্সা সুডৌল মুখে কালো ওষ্ঠাধর ভালই লাগছে। আমার দিকে ভুলেও তাকাচ্ছে না। তার চোখজোড়া বারবার স্বস্তিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। বটের তলায় একঝাঁক ছাত্রছাত্রীদের আড্ডা চলছে। স্বস্তিকে আনন্দ করতে সেখানে দেখা যাচ্ছে। আমি একটু তফাতে বসে আছি। স্বস্তি বারবার আমাকে দেখছে। নয়নেঙ্গিতে কি যেন বলতে চাচ্ছে। শান্তকে দেখে পিক করে হাসছে। স্বস্তির সঙ্গে আমাদের অনেক কথাবার্তা হয়েছে, তবে শান্তের মনের কথা কখনো বলা হয় নি। স্বস্তিও বোধহয় একাধটু টের পেয়েছে- শান্ত তাকে চায়- ভালবাসে। শান্তকে দেখলে যে, কেউ ভালবাসবে না এমন বোকা মেয়ে বোধহয় পৃথিবীতে পাওয়া যাবে না। আমরা সহপাঠিরা যেখানেই যায় আমাদের মধ্যে শান্তকেই একমাত্র অন্যতম বলা যায়। যেখানে সে দাঁড়াবে দশজনকে বাদ দিয়ে সে-ই নজর কাড়বে। এ প্রথম চিঠি নিয়ে এসেছে স্বস্তিকে দিবে। আমি মনে মনে বলি, দেহা-না এবার বুহের হাডা। বড়ই সাওসীহুরুষ বনতেচিলি- আঁর চিডি আঁই দিমু। অন দে।
ওমা, সেকি! একটুপর দেখি, স্বস্তিকে নির্জনে ডেকে নিল! আমাকে হিট দিয়ে তার হাত ধরে ফেলল! চিঠিখানাও দিল! আমি রীতিমতো অবাক। স্বস্তি হাতের ইশারায় বারবার আমাকে ডাকছে নিকটে ডাকছে। আমি হাত নেড়ে বলি, যাব না- তোমরা ঠিক আছ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে, দুজনের কথার শেষ নেই! মনে হয়, পৃথিবীর সমস্ত প্রেমের কাহিনীবর্ণনা শেষ করে তবেই যাত্রা সমাপ্ত হবে আজ। প্রেমের রূপ কি এ রকম হয়? আমি জ্বলেপুড়ে চলে এলাম।
ঘরে ডুকতেই নানি বলছে, নাতি, তুর মাউ শান্ত কোঁয়ায়?
আমি হেসে বললাম, আইবো।
: কওন আইবো?
বুড়ির উপর্যুপরি প্রশ্নে আমি বিদ্ধ হয়ে সবকিছু খোলাখুলি বলে ফেললাম। দেখি, বুড়ি পার্সি নাচন নাচছে, একেবারে মরাকান্না জুড়ে বসেছে! মামিকে লক্ষ্য করে বারবার ডাকছে, সানু, অরে সানু, কোঁয়ায় গেলি? কোঁয়ায় গেলি? জলদি আ, জলদি আ।
মামির নাম ‘সাহানা’ সবাই তাকে ‘সানু’ বলে ডাকে। দুই বোন এক ভাইয়ের মধ্যে ‘শান্ত’ মাধ্যম। ছোট বোনের নাম ‘নাহিনা’ আদর করে ডাকে সবাই ‘নেনু’। মামি এসে সবকিছু জেনে মাকে ধমক দিয়ে বলল, এর লাহি এইচ্চ্যা হাঁদন লাহেনি!
: অরে, কিয়া কচ্ রে সানু, তুর বায় হুনলে আঁরে গরে ডুইকতে দিবোনি?
: আচ্চা তুঁই শান্ত হ। আঁই দেহুম নি।
বুড়িকে শান্ত কে করায়- হইচই করে বাড়িসুদ্ধ একখানে করলে এমন সময় শান্ত এসে হাজির। ছেলেকে দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে ‘অই অই হারামজাদা’ বলে মারতে উদ্যত হলে মামির ধমক খেয়ে বুড়ি থামে- কাঁদে আর ছেলেকে গালাগালি করে। মামি মামার ভয় দেখিয়ে রাগের দন্ততলে চর্বণ করে ভাইয়ের প্রেমের ভূত ছাড়াতে গেলে সে আমাকে মিথ্যুক বানাতে বৃথা চেষ্টা করে; কাঁদে আর বলে, অই রঞ্জু শয়তানের হগল হড়যন্ত্র। এরমধ্যে কথায় কথায় অনেক কিছু উত্থাপন হয়েছে, তবে স্বস্তির বংশের কথা তারা বোধহয় ভুলে গেছে। আমাকে যখন মিথ্যুক বানাতে বেটা অপপ্রচার চালাচ্ছে, তখন আমিও জ্বলন্ত আগুনে একটু একটু ঘিয়ের ছিটা দিতে আমারও জানি কেমন স্বস্তি বোধ হচ্ছে। স্বস্তির বাপের কর্মকাণ্ডের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে বুড়ি ফিঙ করে লাফ দিয়ে বলে, অরে মুর আল্লা, হেতা বলে মুচ্চ্যা। অরে সানু, আঁর নেনুরে অন এড্ডা ভালা বংশে কেন্ন্যে দি বিয়া। আঁই কিল্ল্যায় আগে মল্লেমনো। তুর বা ত আঁরে রাইখতনো। আঁই এ অয়সে কোঁয়ায় যাই।
বুড়ির যত আহাজারি- থামায় কে, মামি চোখ রাঙিয়ে ধমকটমক দিয়ে একটু থামাল। আমি আরেকটু উস্কি দিয়ে বললাম- নানি, আঁই মাউরে কত বুয়াইচি : তুঁই চধুরিবংশের হুলা, তুঁয়ার লয় মুচ্চ্যার মাইয়্যা কি মানায়? হেতা আঁর কথা হুনেনি।
বুড়ি আবার শুরু : অরে নাতি, জাওরারে হিঁখা- তুর মুত খাওয়া। হেতার হদ্দগোষ্ঠীর হেমের মুয়ে ঝাঁটা মায়ি আঁই। আল্লা গো, এইচ্চ্যা হুত নি তুঁই আঁরে দিলা। অরে সানু, এ এওশে হেবরুয়ারিই যত নষ্টের গোয়া। হারামজাদা তুই আর হেবরুয়ারির মাটে যাইচ্। এ হেবরুয়ারিয়ে তুরে নষ্ট কচ্চ্যে।
গল্প এখানে শেষ নয়। আরও পর্ব আছে। তবে আজ পঁচিশ তারিখ শেষ- তাই এটুকুতেই জমা দিতে হল। নোয়াখালি অঞ্চলের ভাষার প্রতি আমার শ্রদ্ধা এবং টান... ... হয়তো ভুলত্রুটিও হয়েছে অনেক- তবে ক্ষমাপ্রার্থী.....