সখী, ভালবাসা কারে কয়

বৈরিতা (জুন ২০১৫)

এশরার লতিফ
মোট ভোট ২৯ প্রাপ্ত পয়েন্ট ৫.১
  • ২৩
  • ৯৪
আমার অফিসের ফ্রেঞ্চ পলিশ করা মেহগনি ডেস্কের উপর তিনটে জিনিস আছে। একটা কমলা রঙের টেলিফোন, একটা কাঁচের পেপার ওয়েট, রেবেকা আর আমার একটা বাঁধানো ছবি। বিয়ের এক সপ্তাহ পর কক্সেস বাজার থেকে চাঁদের গাড়ি নিয়ে ইনানী সৈকত গিয়েছিলাম মধুচন্দ্রিমায়। সান্দ্র অধীর জলবায়ুর দিন ছিল তখন। সমুদ্র থেকে ভেসে আসা লোনা হাওয়ায় রেবেকার শিফন শাড়ির পাতলা আঁচল পানসী নৌকার পালের মত উড়ছিল। ওর দীঘল ঘন উড়ুক্কু চুল কালো আগুন হয়ে দুরন্ত বাতাসে রায়ট লাগিয়ে দিয়েছিল। আনন্দের আতিশয্যে রেবেকার চোখ দুটো নূতন কেনা মার্বেলের মত ঝলমল করছিল। ছবিটা সেই সময় তোলা। মিলন ভাইয়ের ক্যামেরায়। অ্যাপারচার ফোর, শাটার স্পীড টু ফিফটি।

রেবেকার বাঁ পাশে আমি দাঁড়িয়েছিলাম, জুবুথুবু, আলটপকা। আমার দৈর্ঘ্যপ্রস্থ, চেহারাসুরত, ভাবভঙ্গী, কোন কিছুই রেবেকার রাজহংসীময়তার সাথে খাপ খাচ্ছিল না। খুব বড়জোর আমাকে লাগছিল জেল-পলাতক সিঁধেল চোরের মত। রেবেকার তখন কাঁচা আবেগের রূপালী রিবন জড়ানো যৌবন। ওর আনকোরা তারুণ্যের বিপুল ভারে আমাদের অসঙ্গতিগুলো পাতলা কাগজের মত চ্যাপ্টা হয়ে গিয়েছিল।

প্রতিদিন পুবের জানালা দিয়ে ত্রসরেণুমাখা সোনালী আলো এসে পড়ে আমাদের ছবির উপর। অমিত সূর্যের শতসহস্র ফোটন কণার প্রগল্ভতা আমাদের জীবনপাত্র নূতন করে উপচে ফেলতে চায়। সাত বছর ধরে এভাবে আলো পড়ে পড়ে ছবিটা নিষ্প্রভ হয়ে গ্যাছে। এই সাত বছরে তারও চেয়েও বেশী চটে গেছে আমাদের দাম্পত্য জীবনের রঙ।

রেবেকা প্রথম যেদিন বললো ও চলে যাবে, আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম। বার বার জানতে চাইছিলাম ও কেন যাবে। শেষমেষ বলেছিল, ’বরং জিগেস কর তোমার মত লোককে বিয়েটা কেন করেছিলাম’। আমি আঘাত হজম করে বলেছিলাম,‘কেন?’। ও বলেছিল, ‘আসলে বিয়েটা আমি করিনি, তুমি আটাশ বছরের ম্যান্দামারা লোক হয়ে সতেরো বছরের ইম্যাচুরড মেয়েকে ইমোশনালী এক্সপ্লয়েট করেছ, কিছু বোঝার আগেই তার অপরিপক্ক কমিটমেন্টের সুযোগ নিয়েছ’। আমি বলেছিলাম, ’তুমি তাই ভাব?’। ও বলেছিল, ‘টু বি মোর প্রিসাইস, ইউ অয়্যার আ বর্ডারলাইন পিডোফাইল’।

বছর তিনেক আগে রেবেকা আক্কাস ভাইয়ের এনজিওতে যোগ দেয়। ওদের কাজ নারীর ক্ষমতায়ন। তারপর থেকে রেবেকার বাণীর বহর অনেক বেড়ে গ্যাছে। কোনটা ওর বাণী আর কোনটা আক্কাস ভাইয়ের, কোনটা ক্ষমতায়ন আর কোনটা পণ্যায়ন, আমি ঠিক ঠাহর করতে পারি না। আক্কাস ভাই ডিভোর্সি, আমার চেয়ে বছর দুয়েকের বড়। রেবেকা মাঝে মধ্যেই রাত করে বাড়ি ফেরে। আক্কাস ভাইয়ের অনেক কাজের চাপ, আক্কাস ভাইকে হেল্প করতে হয়। বাড়ি ফিরেই রেবেকা বিছানায় পড়ে গভীর নিদ্রায় তলিয়ে যায়। আমার শত স্পর্শেও সাড়া দ্যায় না। বাতাসে অনেক কানাঘুষো। আমার কানেও কথা ভেসে আসে।

আজ তেরোই জানুয়ারী। আমাদের সপ্তম বিয়ে বার্ষিকী। রেবেকার মনে ছিল না। আমি ফোন করে মনে করিয়ে দিতেই রেবেকা বলল, ‘ও…, বাসায় কাঁচা মরিচ নাই, ফেরার সময় কাঁচা মরিচ আনতে হবে’।

সেদিন নিউমার্কেট হয়ে বাড়ি পৌঁছুতে সন্ধ্যা হয়ে গ্যালো। ঘরের সামনে এসে তিনবার কলিংবেল দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। রেবেকা দরজা খুলে কিছু না বলেই রান্নাঘরে চলে গ্যালো। আমাদের একটা পুডলি কুকুর আছে। নাম শ্রীমতী ভেলভেট। আমাদের ছেলেপুলে নেই বলে আক্কাস ভাই রেবেকাকে গিফট দিয়েছিল। শ্রীমতী ভেলভেট আমাকে দেখে লাফ দিয়ে কোলে উঠে আদর খেতে লাগলো। শ্রীমতী ভেলভেটকে টিভির সামনে বসিয়ে টয়লেটে গিয়ে হাতমুখ ধুলাম। তারপর বেডরুমে এসে অফিসের ব্যাগ থেকে বের করলাম হীরে আর পান্না বসানো একজোড়া প্লাটিনামের ঝুমকো। ক্ষয়খর্চা কমিয়ে, ওভারটাইম করে অনেকদিন ধরে টাকা জমিয়েছিলাম। নিউমার্কেটের মিনা জুয়েলার্‌স্‌কে তিন কিস্তিতে শোধ করেছি। আজ আমাদের বিয়ে বার্ষিকীতে রেবেকাকে অবাক করে দেব। আমি জানি আমার প্রয়াস দেখে রেবেকা সামান্য হলেও আর্দ্র হবে। আমার জন্য ফের ওর মনে যৎকিঞ্চিত হলেও মায়া জন্মাবে। এভাবেই ধীরে ধীরে আমাদের আধ-মরা সম্পর্ক প্রাণ ফিরে পাবে।

রান্না ঘরে এসে দেখি রেবেকা একটা লোহার পাতিলে পিয়াজ ভুনায় আদা রসূনের পেস্ট ঢালছে। গত মাস থেকে ও এলুমিনিয়ামের পাতিল অনির্দিষ্ট কালের জন্য ত্যাজ্য করেছে। আক্কাস ভাইয়ের কোন কাজিন নাকি বলেছে এলুমিনিয়াম থেকে এন্ড্রক্রাইন ডিস্‌রাপ্‌টার নিঃসরণ হয়। নার্ভে বেরাছেরা লাগে। নার্ভের ক্ষতি যা হবার তা অবশ্য হয়েই গ্যাছে। রেবেকার, আমা্‌র, দুজনেরই। তবে এলুমিনিয়ামের পাতিলের কারনে না, আক্কাস ভাইয়ের কারনে। আমি পেছন থেকে বিড়ালের মত সন্তর্পণে এসে রেবেকার গলা জড়িয়ে ধরলাম। ও প্রথমে একটু চমকে উঠলো, তারপর পাথরের মত শক্ত হয়ে গ্যালো। আমি কণ্ঠে ভুমধ্যসাগরের চেয়েও গভীর আবেগ ধারণ করে বললাম, ‘সুরঞ্জনা ওই পথে যেয়ো নাকো তুমি, বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে’। রেবেকা আমার হাত দুটো ওর কাঁধ থেকে শীতলভাবে সরিয়ে দিলো। তারপর দ্বিগুণ শীতল কণ্ঠে বলল, ‘মুরোদ থাকলে সুরঞ্জনাকে থামাও, সেই মুরোদ তো তোমার নাই’। ওর কথায় আহত হয়ে আমি বললাম, ‘সুরঞ্জনা, তোমার হৃদয় আজ ঘাস’। ও পাতিলে মরিচের গুঁড়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, ‘কাল কুরবানী, আমার হৃদয়ের ঘাস তুমি না খেয়ে বরং ছাগলে খাক, সেও ভালো’।

দারুচিনি-এলাচি ভাঙার জন্য মশলা বাঁটার পুতোটা কীচেন টপে তোলা ছিল। আমার কি হলো জানি না, পুতোটা উঠিয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে রেবেকার মাথায় মারলাম। রেবেকা একদিকে কাঁত হয়ে চুলোর দিকে ঢলে পড়ল। ওর চোখে নিশ্চয় এখন তীব্র ঘৃণা আর অবিশ্বাস। আমার মত ম্যান্দামারা লোকের পক্ষে কি এমন কাজ সম্ভব? ওর মুখটা উপুর হয়ে পড়ল ঝোলের পাতিলে। তাৎক্ষণিকের উত্তেজনায় নাকি আগুনের আঁচ থেকে রেবেকার নরম কোমল মুখখানি বাঁচানোর জন্য, ওর ঘন কালো চুলের মুঠো ধরে হেঁচকা টান দিলাম। এক গোছা চুল খুলির ভাঙ্গা টুকরো সমেত হাতে উঠে আসতেই আমি ভারসাম্য হারিয়ে মেঝেতে পড়ে গেলাম।

রেবেকার অনেকগুলো দীঘল চুল ততক্ষণে পাতিল থেকে গড়িয়ে গ্যাসের আগুনে ঢুকে গ্যাছে। চুল পোড়ার উৎকট গন্ধে বাতাস ভারী হয় যাচ্ছে। আমি কোনরকমে উঠে রেবেকার গলা ধরে টেনে ওকে মাটিতে শুইয়ে দিলাম। এতক্ষণ উলম্ব থাকায় বোঝা যায়নি,এখন আভুমিলম্বিত অবস্থায় ওর মাথার ভাঙ্গা অংশ দিয়ে প্যাঁচ কাঁটা কলের মত রক্তের নহর নেমেছে। একবার এক আলগা পণ্ডিত আমাকে বলেছিল মানুষের শরীরে নাকি পাঁচ লিটারের মত রক্ত থাকে। ওই আঁতেলের কথা সত্য হলে পাঁচ লিটার রক্তে তো রেবেকার রান্না ঘর ভেসে যাবে! আমি তাড়াতাড়ি রেবেকার মাথা একটা ময়লা ফেলার পলিথিনের প্যাকেটে ভরে প্যাকেটের মুখ গিঁট দিয়ে দিলাম। কিচেনে একটা পাঁচশ বাহাত্তর লিটারের ডিপ ফ্রিজ আছে। রেবেকাকে দুহাতে উঠিয়ে ফ্রিজের কাছে নিয়ে এলাম। বাচ্চারা মায়ের পেটে যেভাবে ফিটাল পজিশনে থাকে, রেবেকাকে ঠিক সেই রকম হাঁটু ভাঁজ আর জোড়হস্ত করে ডিপ ফ্রিজে শুইয়ে দিলাম।

রেবেকার জন্য খুব কষ্ট হলো। কত স্বপ্নই না ছিল মেয়েটার। আক্কাস ভাইয়ের হাত ধরে হাঁটবে, আক্কাস ভাইয়ের সাথে ইউরোপ ট্যুর করবে,আক্কাস ভাইয়ের সাথে প্রতিদিন এক বিছানায় শুবে। ক্ষয়ে যাওয়া প্রেম আর গোপনে বোনা স্বপ্ন-বীজের অঙ্কুরোদ্গম, এই সব টানাপড়েন নিশ্চয় এই ক’টা দিন ওকে অস্থির করে রেখেছিল। পুতোর এক বাড়িতে সব নিকেশ হয়ে গ্যালো। আহা, ঘুমোক মেয়েটা এবার শান্তি করে। সালামের দোকান থেকে কেনা ফ্রোজেন রুই মাছের সাথে, নক্ষত্রের রূপালী আগুনভরা রাতে।

সেই রাতটা আমার দারুন অশান্তিতে কাটলো। কোন শব্দ কানে এলেই মনে হচ্ছিল এই বুঝি রেবেকা ফ্রিজ খুলে উঠে এলো। অন্তহীন অনিদ্রার শেষে ভোরের সাক্ষাৎ মিললো। সাথে এলো কুরবানী ঈদ। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে তখন হাসি, আনন্দ আর অবলা জীব-উৎসর্গ। ঈদ উপলক্ষ্যে এবারও রেবেকা দেড় লাখ টাকা দিয়ে একটা মহিষ কিনেছিল। কম করে হলেও সেই মহিষ থেকে পাঁচশ’কেজি মাংস হলো।

আজ অনেক কাজের ধাক্কা। শ্বশুর সাহেবের বাসায় ভাগ নিতে হবে, আক্কাস ভাইয়ের বাসায় ভাগ নিতে হবে, সামনের মুটকি মেয়ের বাসায় ভাগ নিতে হবে, ফকিরমিসকিনরা তো পাবেই। সবার জন্য মাংস বাটলাম। আক্কাস ভাইয়ের পয়তাল্লিশ কেজির ভাগে প্রায় পুরোটাই রেবেকার মাংস মিশিয়ে দিলাম। রেবেকার পঞ্চাশ কেজি ওজনের হাল্কা পাতলা শরীর নিয়ে তাই আলাদা করে ভাবতে হলো না। হাতের আঙ্গুল, পায়ের আঙ্গুল, এইগুলো অবশ্য কিমা না করে উপায় ছিল না। কিমাটা রেবেকার কষানো ঝোল দিয়ে রান্না করে একটা এলুমিনিয়ামের টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে নিয়েছি, আক্কাস ভাইয়ের জন্য। রেবেকার মাথাটা ভালো করে ধুয়ে মুছে কানে পড়িয়ে দিয়েছি ওর জন্য আনা হীরে আর পান্না বসানো প্লাটিনামের ঝুমকো। ওকে এখন রৌপ্য মুদ্রার রানীর মত লাগছে, যাদের শুধু মাথাই থাকে। একটা আলতো চুমু বসিয়ে যত্ন করে মাথাটা আবার ডিপ ফ্রিজে রেখে দিলাম।

শ্বশুর সাহেব জানতে চাইলেন রেবেকা আসেনি কেন । আমি মন খারাপ করে বলেছি, ‘ও ব্যস্ত বাবা,ও ভীষণ ব্যস্ত। কাল সিঙ্গাপুর কিসের একটা কনফারেন্স। ও আর আক্কাস ভাই যাবে, কথা বলারও সময় নাই’। শ্বশুর সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন। বোধ হয় আমার জন্য দুঃখ কিম্বা করুণা বোধ করছিলেন। শ্বশুর বাড়ি থেকে ফিরে দুইটা বড় ব্যাগে পয়তাল্লিশ কেজি মাংস নিয়ে আক্কাস ভাইয়ের বাসায় গেলাম। আক্কাস ভাই ফ্রিজে মাংস রেখে আসতেই ওনার হাতে টিফিন ক্যারিয়ার গছিয়ে দিলাম। বললাম, ‘রেবেকা আপনার জন্য পরোটা আর কিমা রেঁধে পাঠিয়েছে। আমার সামনেই খেয়ে নিতে বলেছে,না হলে ও কিন্ত ভীষণ আপসেট হবে’। আক্কাস ভাই তৃপ্তি কর পরোটা আর কিমা খেলেন। বেশ কয়েকবার ঢেঁকুর তুললেন। রেবেকার মোবাইল ফোনটা আক্কাস ভাইয়ের সোফার নীচে গোপনে গুঁজে দিয়ে বললাম,‘রান্না কেমন হয়েছে আক্কাস ভাই?’। আমার দিকে অর্থপূর্ণ হাসি দিয়ে আক্কাস ভাই বললেন, ‘রেবেকার মাংস সব সময়ই সুস্বাদু’। যাওয়ার সময় বললাম, ’আক্কাস ভাই, রেবেকা তো কাল আপনার সাথে কনফারেন্সে যাবে, ওকে একটু দেখে রাখবেন প্লিজ’। আক্কাস ভাই আমার পিঠ চাপরে বললেন, ‘তুমি কোন চিন্তা কর না বেলাল, আমি আছি না?’। আমি আক্কাস ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দুর্বল মানুষের বোকাটে হাসি দিলাম। মনে মনে বললাম, ’শালা লম্পট শুয়ার, আরও খা রেবেকার মাংস, পেট ভরে খা’।

ঈদের পর দিন দুপুরে আক্কাস ভাইয়ের ফোন এলো, ‘রেবেকা তো এখনো এয়ারপোর্ট আসেনি। ওকে মোবাইলেও পাচ্ছি না’। আমি অবাক হয়ে বললাম, ’তাই আক্কাস ভাই? ও তো সেই ভোরেই বেরিয়ে গ্যালো’। আক্কাস ভাই বললেন, ’দেখি তোমাকে জানাচ্ছি’। এই সময় হঠাৎ ঘরের কলিং বেল বেজে উঠলো। আমি দরজা খুলে দেখি পাশের বাসার মুটকি মেয়েটা দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখে মিষ্টি হেসে বলল, ‘কেমন আছেন বেলাল ভাই? চাচি কোথায়?’ আমি বললাম, ‘রেবেকা তো কনফারেন্সে গ্যাছে, কি ব্যাপার, আমাকে বলা যায় না?’ মুটকি মেয়ে মিষ্টি হেসে বলল, ‘আমাদের কতগুলো মাছের প্যাকেট চাচির ডিপ ফ্রিজে ছিল। রুই, চাপিলা, কাচকি, মলা। অনেকগুলো ছোট বড় পুটলি, আপনি হয়তো খুঁজে পাবেন না, আমি বের করে নেব?’। আমার মনে পড়ল রেবেকার মাথা এখনো ডিপ ফ্রিজে। বললাম, ‘একটু ড্রইং রুমে বস, আমি দেখি আগে, না পেলে তোমাকে ডাকব’। মুটকি মেয়েকে ড্রইং রুমে বসিয়ে হাতে রিমোট দিয়ে আমি দ্রুত কিচেনে গেলাম। ফ্রিজ থেকে রেবেকার মাথা বের করে কিচেনের দরজা দিয়ে সামনের বাগানে বেরিয়ে আসলাম। আমাদের সামনের বাগানটা বড্ড সুন্দর। রেবেকা মালি রেখে কাজ করিয়েছে। বাগানের ঠিক মাঝখানে জলকানন কোম্পানির বানানো উল্টো ছাতার মত একটা নক্সাদার ফোয়ারা। ভাবলাম ফোয়ারার পানির নীচে ইট বেঁধে রেবেকার মাথাটা ডুবিয়ে রাখি। ফোয়ারার কাছে এসে হঠাৎ খেয়াল হলো পেছনেই একটা পরিত্যাক্ত ম্যানহোল আছে। ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে রেবেকার মাথা ভরে ঢাকনাটা বন্ধ করে রাখলাম। ড্রইং রুমে ফিরে মুটকি মেয়েকে বললাম, ‘পাচ্ছি না, তুমিই দ্যাখো’। মাছের পুটলিগুলি নিয়ে যাওয়ার সময় মুটকি মেয়েটা একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে চোখ টিপ দিলো। ভাবলাম কত্ত বড় বেয়াদব এই মেয়ে, আমাকে বলে ভাই আর রেবেকাকে বলে চাচি।

পরের দিন সন্ধ্যায় পল্লবী থানায় গেলাম। হন্তদন্ত হয়ে ওসির রুমে ঢুকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। ওসি আমার দিকে টিস্যু পেপার এগিয়ে দিলেন। টিস্যু পেপার দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললাম, ‘আমার স্ত্রীকে…’।ওসি সাহেব বললেন, ‘কেউ রেপ করেছে? যৌনসন্ত্রাসী?’। আমি আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। মাটিতে গড়িয়ে হাত পা ছোড়া আরম্ভ করলাম। আমার অবস্থা দেখে ইন্সপেক্টরের চোখের কোনায় কয়েক বিন্দু জল চিক চিক করে উঠলো, হয়তো নিজের কোন স্মৃতি মনে পড়ল। ইন্সপেক্টর ফ্লোরে বসে আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ‘ভাইসাহেব, আপনে শান্ত হন। ভাবীর এই সর্বনাশ যে করেছে, উই উইল ব্রিং হিম টু জাস্টিস’। তারপর দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মুখলেস, অয় মুখলেস, ভাইসাহেবের জন্য মিরিন্ডা নিয়ে আয়’। আমি মিরিন্ডা খেয়ে ঠাণ্ডা হয়ে পুরো ঘটনা খুলে বললাম। ইন্সপেক্টর জানতে চাইলেন আক্কাস লোকটা কেমন, আমি মাথা নীচু করে ইতস্তত করে বললাম,’ওনার অনেক কানেকশন’। হঠাৎ ইন্সপেক্টরের ভেতরে ভিসুভিয়াসের মত সুপ্ত বাংলা সিনেমার হিরোটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। খপ করে আমার হাত ধরে বললেন, ‘শুনুন, ভয় করবেন না, আপনি যা জানেন সব খোলাসা করে বলুন’। আমি বললাম, ‘নোট নেবেন না প্লিজ, শুধ আপনাকেই বলছি। ইদানিং আক্কাস ভাই আমার ওয়াইফকে…’। ইন্সপেক্টর আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘ডিস্টার্ব করতেন, যখন তখন ফোন দিতেন?’। আমি মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললাম, ‘রেবেকা ট্যুরে যেতে চায়নি, কিন্তু আক্কাস ভাই বললেন ওনার সাথে ট্যুরে না গেলে…’। ‘না গেলে কী?’, ইন্সপেক্টর এবার ভীষণ উত্তেজিত। আমি বললাম, ’না গেলে রেবেকার নাম কথা ছড়াবে, নোংরা নোংরা কুৎসিত কথা, রেবেকা খুব আপসেট ছিল’। একটু থেমে ইন্সপেক্টরকে কথাগুলি গিলতে দিলাম, তারপর উদাস কণ্ঠে বললাম, ‘তবে কি জানেন, এসবই আক্কাস ভাইয়ের রাগের কথা, রাগের কাজ। রেবেকার প্রতি হয়তো ওনার একটা উইকনেস গ্রো করেছিল। কিন্তু আমি বলব, উনি মানুষ খারাপ না…’। ইন্সপেক্টর টেবিলে জোরে চাপর দিয়ে বললেন, ‘কি বলছেন উনি মানুষ খারাপ না? আই উইল গেট দ্যাট বাস্টার্ড, আমি জিডি তৈরি করে দিচ্ছি, আপনি শুধু সাইন করুন’।

ঘটনা প্রবাহের পিছলা ঢাল বেঁয়ে এভাবে দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছিল পাথরের মত ভারী সময়।

ঈদের ঠিক সাত দিন পর ভোরবেলা চিৎকার-চ্যাচামেচি শুনে ঘুম ভেঙ্গে গ্যালো। কোন রকমে লুঙ্গি আর গেঞ্জি গায়ে চাপিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলাম গেটের সামনে ব্যাপক সোরগোল। পাড়ার ময়মুরুব্বিরা ছোটাছুটি করছে। পাশের বাড়ির মুটকি মেয়েটা একপাশে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে। আমি যেতেই উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘গতরাতে বেশ ক’টা বাড়িতে চুরি হয়ে গ্যাছে, স্ট্রিট লাইট, ম্যানহোলের ঢাকনা কিছুই বাদ যায়নি’। তাপর হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে জিগেস করল, ‘চাচি ফিরেছে বেলাল ভাই?’। আমি না শোনার ভান করে ঘরে চলে এলাম।

ঘরে ফিরে এক কাপ দার্জিলিং চা নিয়ে শান্তি করে বসতে না বসতেই পাশের ঘরে ফোন বেজে উঠলো। পল্লবী থানার ইন্সপেক্টর। বারোটার দিকে বাসায় আসতে চান। অনিচ্ছা সত্যেও বললাম, ‘প্লিজ আসুন না, আপনাকে দেখলে মনটা কেমন শান্ত হয়ে যায়’। মেজাজটা ভেতরে ভেতরে খিচড়ে গ্যালো। গত পরশু মধ্যরাতে কথা নাই বার্তা নাই গাদাগুচ্ছের পুলিশ নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। বললেন ওনার কাছে সার্চ ওয়ারেন্ট আছে। আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘ভয়ের কিছু নাই, রুটিন চেক’। তারপর দলবলসহ পুরো বাড়ি তন্ন তন্ন করে উলটে ফেলেছিলেন। আমি খুব ঘাবড়ে মনে মনে সুরা ইউনুস পড়ছিলাম। প্রার্থনায় বোধ হয় কাজ হয়েছিল। ঘরের কাজ সেরে এরা বাইরে খোঁচাখুঁচি করেছে ঠিকই কিন্তু ফোয়ারার পেছনে ম্রিয়মাণ হয় পড়ে থাকা ম্যানহোল ওদের চোখেই পড়ে নাই। সেইদিন ইন্সপেক্টর অসময়ে আসার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বিদেয় হয়েছিলেন। আজ আবার কি সন্দেহ কে জানে। আক্কাসের পেছনে না লেগে খামোখাই আমার পেছনে লেগেছে।

কথামত ঠিক বারোটায় ইন্সপেক্টর এসে হাজির হলেন। আজ আর দলবল আনেন নাই। বললেন, ‘বেলাল ভাই, আমার মনে হয় আমরা ভাবীর কেইসটার কিনারা করেছি’। আমি বললাম, ’তাই? আমার রেবেকা? পেয়েছেন ওকে? কোথায় পেয়েছেন? ওয়াজ সি অ্যাবডাক্টেড? । ইন্সপেক্টর আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, ‘আপনি প্লিজ মনটা শক্ত করুন। উই হ্যাভ রিজন্স টু বিলিভ দ্যাট ইওর ওয়াইফ ইজ নো মোর’। আমি ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললাম। কয়েকবার দেয়ালে কপাল ঠুকলাম। তারপর নাক দিয়ে ফোঁচ ফোঁচ করে সর্দি টেন টেনে বললাম, ’আপনি শিওর?’। ইন্সপেক্টর বললেন, ‘আমরা ধারণা করছি আক্কাস মার্ডারড ইওর ওয়াইফ’। আমি ইন্সপেক্টরের দিকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে বললাম, ‘আমি বিশ্বাস করি না, কোথাও একটা ভুল আছে’। ইন্সপেক্টর বললেন, ’আক্কাসের সোফার নীচে রেবেকার মোবাইল ফোন পাওয়া গ্যাছে। তার চেয়ে বড় কথা আক্কাসের ফ্রিজে…’। আমি চিৎকার করে বললাম ‘ফ্রিজে? ফ্রিজে কি?’। ইন্সপেক্টর অপরাধীর মত মুখ করে বললেন, ‘আই ক্যান্ট গো টু দ্যাট ডিটেইলস, আক্কাসের ফ্রিজে হিউম্যান ফ্লেশ ছিল, আমরা ফরেনসিকে পাঠিয়েছি’। আমি হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, ‘ইয়া আল্লাহ,ইয়া মাবুদ, আমারে তুমি উঠায়ে নাও’। আমি শান্ত হবার পর ইন্সপেক্টর বললেন, ’আক্কাস এখনো সিঙ্গাপুরে, আমরা ইন্টারপোলে খবর পাঠিয়েছি’। আমি অনেকক্ষণ সোফার কুশনে হেলান দিয়ে ধাতস্থ হবার ভান করলাম। তারপর বিষণ্ণ-অবসন্ন দেহটাকে যেন কোনরকমে টেনেহিঁচড়ে রান্নাঘরে নিয়ে ইন্সপেক্টরের জন্য চা করলাম। সাথে নাবিস্কো বিস্কিট। ইন্সপেক্টর চুক চুক করে চা গিল্লেন, চায়ে ভিজিয়ে নাবিস্কো বিস্কিট খেলেন। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। একটা বিস্কিট স্লিপ কেটে চায়ে পড়ে গ্যালো, আমি চামচ এনে দিলাম। মাঝে আরও একবার ডুক্‌রে কেঁদে উঠলাম।

চলে যাওয়ার সময় ইন্সপেক্টরকে বাইরের গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিচ্ছিলাম। এমন দুঃখের দিনেও আমার পরম বিনয় আর আতিথেয়তা পল্লবী থানার ইন্সপেক্টরকে অভিভূত করে ফেলেছে। একজন দুঃখী ভদ্রলোককে বিব্রত করে বেচারা নিজেই আত্মদহনে পড়েছেন। গেটের কাছে এসে ইন্সপেক্টর মুখ নীচু করে লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন, ‘সেদিন মাঝরাতে আপনার বাসা আমরা এভাবে সার্চ করলাম, আশা করি আপনি কিছু মনে করেননি’। আমি তখন বেদনায় নিমজ্জমান ভালো মানুষটি, উদাস স্বরে উত্তর দিলাম, ‘মনে করার কি আছে? আপনি আপনার কর্তব্য পালন করেছেন। সবাই যদি আপনার মত নিজের কাজটা …’।

আমার কথা ফুরনোর আগেই ইন্সপেক্টর মুখ হাঁ করে ঘোলাটে চোখে বাঁ পাশের ফোয়ারার দিকে তাকালেন। মাথা ঘুরিয়ে দেখি ফোয়ারার ঝিরি ঝিরি জলের কোলাহলের তল দিয়ে আমার অতি আদরের পুডলি কুকুর শ্রীমতী ভেলভেট মিহি লেজটা নাড়াতে নাড়াতে এ দিকেই ছুটে আসছে। শ্রীমতী ভেলভেট দাঁতে কামড়ে আছে একটা থলথলে রাবারের মুখোশ। কাছে আসতেই বুঝলাম মুখোশ না, ওর দাঁতে ঝুলছে রেবেকার আধ-খাওয়া মুখ। উপরের ঠোঁট, অর্ধেক নাক আর একটা পরিপূর্ণ কান মুখের চামড়ার সাথে কোন মতে লেগে আছে। রেবেকার ফাঙ্গাস ধরা ধবধবে সাদা কানে এখনো ঝুলছে হীরে আর পান্না বসানো প্লাটিনামের ঝুমকো। বুঝলাম আমার ম্যানহোলের ঢাকনাও চুরি গ্যাছে।

ঠিক এই সময়ই পাশের বাড়ির মুটকি মেয়ের রুম থেকে ভেসে এলো আমার বড় প্রিয় গানের কলি, সখী, ভালোবাসা কারে কয়, সে কি কেবলি যাতনাময়।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
রাজু অভিনন্দন । শুভেচ্ছা রইলো ।
মোজাম্মেল কবির অভিনন্দন এশরার লতিফ ভাই।
Fahmida Bari Bipu অনেক অনেক অভিনন্দন। আপনি আসলেন, লিখলেন এবং আবার জয় করলেন।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে .
তাপস চট্টোপাধ্যায় খুব ভালো লাগলো. আমার পাতায় আমন্ত্রণ.
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে .
কবিরুল ইসলাম কঙ্ক ভালো লাগলো পড়ে । ভোট রইলো । রইলো শুভেচ্ছাও ।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি অদ্ভুত কাহনী আর গল্প লেখার মুন্সিয়ানা তো রয়েছেই ......অসাধারণ সমাপ্তি......মূল্যায়নের সাথে অভিনন্দন ও শুভকামনা আপনার জন্য ...
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে .
সেলিনা ইসলাম কখন যে গল্প শেষ হল বুঝতেই পারলাম না...এক সময় দেখি স্ক্রল করে মন্তব্য শুরু... আফসোস! নিষ্ঠুর গল্পের প্লট, ভীষণ ভয়ঙ্কর! অসাধারণ লাগলো। অভিনন্দন ও শুভকামনা।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে

০১ মার্চ - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৫২ টি

সমন্বিত স্কোর

৫.১

বিচারক স্কোরঃ ২.৯২ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ২.১৮ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪