১। সূচনা অথবা একদিন
মিলি দু হাতে টেনেও ছাতাটা ধরে রাখতে পারছে না। যত না বৃষ্টি, তার থেকেও বেশী দমকা বাতাস।
কোথাও ঠাস করে বাড়ি খেয়ে ঝনাৎ ঝনাৎ শব্দে জানালার কাঁচ ভেঙ্গে পড়ল। স্কুল গেটের পাশে কেউ দেয়াল ঘেঁষে পেশাব করছে। তেরচা বাতাসে সেই পেশাব ছিটকে ছিটকে ফোয়ারার মত আশপাশের মানুষের গায়ে পড়ছে। হাল্কা হলুদ মুত্রজলের যত্রতত্র আনুভুমিক প্রক্ষেপণ এড়াতে মানুষ ত্রস্ত হয়ে দিক্বিদিক ছুটছে।
সরু সুঁইয়ের মত বৃষ্টির মিন মিনে ধারা সহসাই বর্তুল আকার নিয়ে আকাশ উপচে টপ টপ করে পড়ছে। মিলির হাতে এম্বস করা হাল্কা বাদামী চামড়ার ব্যাগ। ভেতরে আড়ং-এর ছোট নকশীকাঁথার পার্টস। সেই পার্টস ভেদ করে সশব্দ ভেসে আসছে ‘হি হি হা হা হা’’। বেটোভেনের ফিফ্থ্ সিম্ফনি পাল্টে বিকট হাসির রিং টোন দেয়া। বাবার উপর আচ্ছা রাগ হচ্ছে। মিলির বিষণ্ণতা কমাতে গিয়ে এই সব মকারি করে উনি বরং বিরক্তিই বাড়িয়ে দেন। ‘আফার ব্যাগে খেক্কস ডাহে’। মিলি ভ্রু কুঁচকে পেছনে তাকালো। চায়ের দোকানের ছেলেটা দাঁত কেলিয়ে হাসছে।
বৃষ্টির বেগ ক্রমশ বাড়ছে, জলের ঝাপট ছাতায় কুলুচ্ছে না। মিলি ব্যাগ থেকে পাতলা ফিনফিনে নীল রেইন কোটটা বের করে গায়ে জড়িয়ে নিলো। মাথার ভেতরে একটা গান ঘুরছে,‘দাও আকুলিয়া ঘন কালো কেশ/পর দেহ ঘেরি মেঘ নীল বেশ’। এই ‘মেঘ নীল বেশ’ যে একটা রেইন কোট হবে তা নিশ্চয় রবিবাবু কস্মিনকালেও ভাবেননি! মিলির ম্লান মুখে একটা হাল্কা হাসির রেখা ফুটে উঠলো।
আশেপাশে রিক্সার নাম গন্ধ নেই। মলমবাজি কিম্বা তার চেয়েও হীন উদ্দেশ্য ছাড়া এই মুহূর্তে কোন ট্যাক্সি থামবে না। মিলিদের বাসার দিকে ডাইরেক্ট বাস যায় না। ফার্মগেটে চেইঞ্জ। তারপর মিরপুর দশ নাম্বার গোল চত্বর থেকে পনেরো মিনিটের হাঁটা পথ। বাস স্ট্যান্ড রাস্তার ওপারে । সেখানে গাদাগুচ্ছের ভিড়। সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে ভিজছে। দশ বছর আগে এ দৃশ্য কল্পনাই করা যেত না।
রাস্তা পার হবার জন্য মিলি ট্রাফিক সিগণ্যালের সামনে এসে দাঁড়ালো। সিগন্যাল সবুজ বাতি তখনো লাল হয়নি,রাস্তার ওপার থেকে একজন আগেই হাঁটা ধরেছেন। মধ্য বয়সী, বাঁ কাঁধে ল্যাপটপ ব্যাগ, ডান হাতে পলিথিনে মোড়ানো মিষ্টির প্যাকেট জাতীয় একটা কিছু। বাঁ দিক থেকে একটা পিক আপ ভ্যান হঠাৎ খুব কাছে চলে এসেছে। তারপর ব্রেক চাপার শব্দ। গাড়িটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে স্লাইড কেটে ট্রাফিক বাতি পার হয়ে গ্যালো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা ভার এসে পড়ল মিলির উপর।
যে লোকটা রাস্তা পার হচ্ছিল তার নীচে মিলির দু’পা চাপা পড়েছে। লোকটাকে পাশে সরিয়ে মিলি কোন মতে উঠে দাঁড়ালো। নীল রেইন কোট এখন টকটকে লাল। মুহূর্তেই মিলিকে ঘিরে ছোটখাটো একটা জটলা বেঁধে গ্যাছে। অনেকেই গায়ে স্পর্শ করে জানতে চাইছে ও ঠিক আছে কিনা। মিলির মনে হলো এরা অযাচিত সুযোগ নিচ্ছে। ওর চেয়ে অনেক বেশী মনোযোগ দাবী করে আহত লোকটি। মিলি ত্রস্ত হয়ে ছুটে গ্যলো পড়ে থাকা লোকটার কাছে। ভদ্রলোকের ঠোঁট কাঁপছে,বোধ হয় একটা কিছু বলতে চাইছে। মাথা গড়িয়ে রক্তের ধারা রাস্তার ঢাল বেঁয়ে নেমে যাচ্ছে।
মিলির ব্যাগ ফুটপাথে পড়ে আছে। ব্যাগটা উঠিয়ে মিলি ভেতর থেকে মোবাইল ফোন বের করল। তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে জহিরকে ফোন করল,
’ভাইয়া একটা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা কর। প্লিজ এখুনি। আমি এলিফ্যান্ট রোডে বাটার মোড়ের কাছে। অ্যাক্সিডেন্ট। পরে এক্সপ্লেইন করছি’
মিলি ওর সুতির ওড়না ভাঁজ করে আহত লোকটার মাথায় চেপে ধরেছে। ওড়না ভিজে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। এভাবে রক্তক্ষরণ চললে একে বাঁচানোই মুশকিল হয়ে পড়বে। মিলির মনে পড়ল ছোট খালার কথা। ব্লিডিং হতে হতে ভদ্রমহিলা অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যান। অথচ ছোট খালা ছিলেন বোনদের মাঝে সবচেয়ে স্বাস্থ্যবতী । এসব ভাবতে ভাবতেই রিং বেজে উঠলো ‘হি হি হা হা হা’। জহিরের ফোন। মজা দেখার আগ্রহ এবং অংশগ্রহণের অনীহা নিয়ে যারা আশেপাশে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের একজন রাগত স্বরে বল্ল ‘মানুষ মরতেছে আর ম্যাডামে ইয়ার্কি মারেন’। মিলি লোকটাকে চিনতে পারল,একটু আগ দেয়ালে পেশাব করছিল। ব্যাপারটা উপেক্ষা করে ফোন ধরতেই জহির জানালো ও রওনা হয়েছে।
বৃষ্টিতে রাস্তা ফাঁকা বলেই হয়তো মিরপুর থেকে আধ ঘণ্টার ভেতর অ্যাম্বুলেন্স চলে এলো। জহির নেমে এসেছে। চোখে মুখে উৎকণ্ঠা। ‘আপু তোমার কি হয়েছে?’বলতে বলতেই মিলির দৃষ্টি অনুসরণ করে সটান হয়ে পড়ে থাকা লোকটাকে দেখতে পেলো। আর সময় নষ্ট না করে দ্রুত ভদ্রলোককে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানো হলো। অ্যাম্বুলেন্সে উঠে মিলি একবার জানালা দিয়ে পেছনে তাকালো। পিক আপ ভ্যানটা অ্যাক্সিডেন্টের সঙ্গে সঙ্গেই ঘটনাস্থল থেকে টেনে চলে গ্যাছে। কিন্তু ভিড় কমেনি। অভ্যাসের কারনে কিম্বা কিছু করার তাগিদে জনগণ ঘোর বৃষ্টিতেও একটা প্রাইভেট কার থামিয়ে ভাংচুর করেছে। পেছনের সিটে মধ্যবসী এক মহিলা বাচ্চাকে জড়িয়ে মাথা নীচু করে কাঁপছে। মিলির মুখ থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
জহির থমথমে মুখ করে পেশেন্টকে লক্ষ্য করছে। মিরপুরে পৌঁছুতে পৌঁছুতে এ রোগীর অবস্থা অনেক অবনত হবে। মাইলখানেকের ভেতরেই একটা প্রাইভেট ক্লিনিক। জহিরের সিদ্ধান্তে অ্যাম্বুলেন্স সেখানে এস থামল। ক্লিনিকের মানুষজন করিৎকর্মা। গাড়ি থামতেই পেশেন্টকে স্ট্রেচারে উঠিয়ে জরুরী বিভাগে নেয়া হলো। ডিউটি ডাক্তার পেশেন্টকে দেখলেন,হিস্ট্রি নিলেন। তারপর ইমারজেন্সী রুমে রাখা ফোন থেকে কারো সাথে কথা বল্লেন। ফিরে এসে জহিরকে বল্লেন, ‘সরি ভাইয়া, একে ভর্তি করে আমরা ঝুঁকি নিতে পারব না। এনার সারভাইভালের চান্স কম। রোগী এক্সপায়ার করার সাথ সাথেই ক্লিনিক ভাঙচুর আরম্ভ হবে। আমাদের অভিজ্ঞতা আছে। দুঃখিত’। মিলি ডিউটি ডাক্তারকে লক্ষ্য করছে। আটাশ/উনত্রিশ বছর বয়সী মহিলা। মুখের আদলে এখনো অনভিজ্ঞতার ছোঁয়া। ‘মানব সেবা পরম ধর্ম’ জাতীয় আদ্র ভাব সারা অবয়বে মাখানো। বোঝাই যাচ্ছে কথাগুলো তার নিজের না, মানেজমেন্টের সিদ্ধান্ত। মেয়েটার চোখে মুখে সত্যিই একটা দুঃখিত ভাব ফুটে উঠেছে।
অ্যাম্বুলেন্স আবার স্টার্ট নিয়েছে। এরকম ক্রিটিকাল রোগীকে এখন কেউ অ্যাডমিশন দেবে না। মিরপুরে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। একটা পলিথিনের ব্যাগের ভেতর রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জিনিসগলো জড়ো করা হয়েছে। মিলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। একটা ওয়ালেট, মোবাইল ফোন, বারো ইঞ্চি ল্যাপটপ, বনফুলের মিষ্টির প্যাকেট। একজন মৃত্যু পথযাত্রীর ব্যক্তিগত ব্যবহার্য ঘাঁটতে খারাপ লাগছে। কিন্তু কিছুই করার নেই, যত দ্রুত সম্ভব কাছের কারো ঠিকানা জানতে হবে, দুঃসংবাদটা দিতে হবে।
কে আছেন এই ভদ্রলোকের? বাবা, মা, স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে? মিলি লোকটাকে আবার ভালো করে খেয়াল করল। চল্লিশ-বেয়াল্লিশ বছর বয়স। মাথার চুল সামনের দিকে সামান্য পাতলা। শ্যামলা রঙ, একহাড়া গড়ন। লাল-শাদা চেক শার্টে ইস্তিরির ভাঁজের দাগ। ফর্মাল প্যান্ট, সেটিও সদ্য ইস্তিরি করা। বাঁ হাতে অ্যানালগ ঘড়ি। ছেলেরা নিজ থেকে সচরাচর এত যত্নবান হয় না। অনামিকায় সোনার রিং। নিঃসন্দেহে বিবাহিত। ফোনে দু তিন বার নিশ্চয় বাসায় কথা হয়।
মিলি ভদ্রলোকের ফোনে রিসেন্ট কল ঘাঁটতে লাগলো। কল লিস্টে বেশ ক’টা নাম। এর ভেতর অমৃতা নামের কাউকে আজ তিনবার ফোন করা হয়েছে। গতকালও। মিলি অমৃতার নাম্বারে ডায়াল করল। ওপার থেকে একটা অল্প বয়সী মেয়ের কন্ঠ,
‘আব্বু, আসছ না কেন? আজ কিন্তু দেরী করা যাবে না’
‘তুমি অমৃতা?’
‘আপনি কে বলছেন?’
‘অমৃতা,আমার নাম মিলি। এটা কি তোমার বাবার নাম্বার?’
‘জী, বাবা কোথায়, ফোন অফিসে ফেলে গ্যাছেন, তাই না?’
‘তোমার বাবা একটা দুর্ঘটনায় পড়েছেন। আমরা ওনাকে ক্লিনিকে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি কি তোমার মা’কে নিয়ে এখুনি রওনা হতে পারবে? আমি ঠিকানা দিচ্ছি’
ও পাশ থেকে হুহু কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো। মিলি বুঝতে পারছেন না কিভাবে এমন নাজুক মুহূর্ত সামাল দেবে।
‘আব্বুর কি হয়েছে?’
‘তোমার মা কোথায়? আমি ওনাকে বলছি’
‘মা নেই’
‘তোমার ঠিকানা দাও। আমি ক্লিনিকে পৌঁছে গাড়ি পাঠাবো।’
মিলি অমৃতার ঠিকানা লিখতে লিখতে গাড়ি ক্লিনিকে পৌঁছে গ্যালো। দশ নম্বর গোল চত্বরের মোড়ে ‘জনসেবা সদন’। অত্যাধুনিক ক্লিনিক। জহিরদের বাবা চিকিৎসক ছিলেন। ষাটের দশকে এই ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেন। ধনীদের চিকিৎসা বাবদ আয়ের বেশীর ভাগই খরচ হয় যায় গরীবদের বিনামূল্যের সেবা দানে। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর ধাতটা জহিরও পেয়েছে।
পেশেন্টকে হাসপাতালে এনেই রক্ত পরীক্ষা এবং এম আর আই করা হলো। ব্রেইন হেমারেজ। জটিলতা আরও বাড়িয়েছে কোমরে হেয়ার লাইন ফ্র্যাকচার।
মিলি জহিরের গাড়ি নিয়ে শ্যামলীর উদ্দেশে রওনা হয়েছে। শ্যামলী কাঁচা বাজার পেরিয়ে পাঁচ নাম্বার রোডের ঠিক মাঝে অমৃতাদের বাসা। অমৃতা দরজার বাইরে অপেক্ষা করছিল। গাড়ি থামা মাত্রই উঠে এলো। পনেরো-ষোল বছরের মেয়ে। ঘন চুল খোঁপা করে পেছনে বাঁধা,স্বচ্ছ চোখ,পাতলা ঠোঁট। নীল জিন্সের উপর হাল্কা নীল কামিজ। মেয়েটি হয়তো স্বভাবজাতভাবেই পরিচ্ছন্ন ও গোছালো। বোঝাই যাচ্ছে ওর মা সংসারটাকে ঝকঝকে তকতকে করে রেখেছেন।
অমৃতা জানালার দিকে মুখ করে আছে। গাড়ির ভেতর নীরবতা ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছে। কিছু একটা বলতে হবে তাই মিলি বললো,
‘তোমার মা কখন বাড়ি ফিরবেন? জানিয়েছ ওনাকে?’
‘আমার মা নেই’
মেয়েটির মা নেই, বাবাও থাকবে না। মানুষের জীবনের এই গতিগুলো কে নিয়ন্ত্রণ করে? কে সেই অমোঘ ট্রাফিক কন্ট্রোলার? মিলির মন ভারী হয়ে গ্যালো। অমৃতার কথা তখনো শেষ হয়নি,
‘মা আমাদের সাথে থাকেন না। আবার বিয়ে করেছেন।’
‘ও’মিলি কি বলবে বুঝতে পারছে না।
আজ অমৃতার পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। গোল্ডেন এ। কথা ছিল বাবা মেয়ে মিলে ভালো কোন রেস্টুরেন্টে খাবে। অমৃতা লক্ষ্য করেছে ওর সব সৌভাগ্যের সাথে দুর্ভাগ্য গাঁটছড়া বেঁধে থাকে।
হাসপাতালে পৌছুতে বিকেল হয়ে গ্যালো। রোগীর জরুরী অস্ত্রপ্রচার চলছে। জহিরের স্ত্রীর দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই উঠতি ব্রেইন সার্জন। তাকে ফোন করে আনানো হয়েছে। এ পজিটিভ রক্তের প্রয়োজন ছিল। বাংলাদেশে অনুভুতিময় মানুষের সংখ্যা এখনো অগণ্য, ফেইস বুকে পোস্ট দিতেই অনেকে তরুণ-তরুণী চলে এসেছে। অপেক্ষা আর প্রার্থনা ছাড়া এই মুহূর্তে আর কিছুই করার নেই।
অপারেশনের পর এক মাস হয়ে গ্যাছে। অমৃতার বাবাকে রিকভারির জন্য বঙ্গবন্ধু হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। মিলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অমৃতার কাছ থেকে ওর বাবা সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছে। আরিফ হাসান। একটা কন্সট্রাকশন কন্সালটেন্সীতে কাজ করেন। স্ট্রাকচারাল এঞ্জিনিয়ার। কত ব্রীজই না ডিজাইন করেছেনঃ ট্রাস ব্রিজ, বিম ব্রীজ, সাসপেন্সন ব্রিজ,আর্চ ব্রিজ।
দাম্পত্যের ব্রিজটা যে কে কখন স্যাবোটেজ করে উড়িয়ে দিলো, অনিলা চলে যাওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত টেরও পান নি। অমৃতার বয়স তখন আঁট বছর চার মাস। অ্যাপেনডিসাইটিস অপারেশন করে এক রাতে ওকে বাসায় আনা হয়েছে। অমৃতা যখন ওর বাবার কাঁধে ভোর করে ঘরে ঢুকছে, অনিলা তখন বড় একটা স্যামসনাইট ব্যাগ হাতে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে। আরিফ অবাক হয়ে জানতে চেয়েছেন,
‘ কি ব্যাপার কোথায় যাচ্ছ?’
‘ আর থাকছি না‘
‘ থাকছ না মানে?’
‘ শিহাবের কাছে চলে যাচ্ছি’
তারপর আঙ্গুলের ইশারায় দূরে অপেক্ষমান শিহাবকে দেখালো। অনিলার প্রথন জীবনের প্রণয়। কিন্তু সে তো প্রায় পনের বছর আগের কথা। সম্পর্কের একটা চোরা স্রোত ভেতরে ভেতরে বইছিল কি? আরিফ বললো,
‘ অমৃতার কী হবে, আমার কী হবে?’
‘তোমার মত পারফেক্ট মানুষের পক্ষে আমার চেয়ে অনেক নিখুঁতভাবে মেয়েকে দেখা সম্ভব, নিজেকেও। ’
যেন কিছুই হয়নি ভঙ্গীতে অনিলা ধীরে ধীরে হেঁটে বেরিয়ে গ্যালো। রাস্তার ওপারে মাইক্রোবাস নিয়ে শিহাব দাঁড়িয়ে। আরিফের সাথে চোখাচোখি হতেই হেসে হাত নাড়ালো। পুরো ব্যাপারটার ঠাণ্ডা নিষ্ঠুরতা আরিফকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। এরপর আরিফ সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। আত্মীয়স্বজন বন্ধু বান্ধবের সাথে কোন যোগাযোগ নেই। বাসা থেকে কাজ, কাজ থেকে বাসা,মেয়ের স্কুল, ব্যাস।
অসুস্থ লোকটার জন্য মিলি সেদিন মনের ভেতর একটা কান্না মেশানো হাহাকার বোধ করেছিল। হয়তো ওর নিজের সঙ্গে মিল আছে বলেই। সেদিন থেকে স্ব-আরোপিত দায়িত্বের মত সপ্তাহে অন্তত দু’বার আরিফকে হাসপাতালে দেখতে যেত। সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে ডায়রি নিয়ে বসত।
২। মিলির ডায়রি
১৫/০৩/১৪২০
আজ আরিফ সাহেবকে হাসপাতালে দেখতে গেলাম। সঙ্কট কেটে যাবার পর এই প্রথম। ওনাকে বারডেমে আনা হয়েছে। ভালই হলো,আমার অফিসের কাছে।
উনি একটা বই পড়ছিলেন। আমাকে দেখে বই নামিয়ে এমন করে তাকালেন…
আমি সাহিত্যের ছাত্রী। উদ্ধৃতির লোভ সামলাতে পারি না। টি এস এলিওট বলতেন, সত্যিকারের কবিতা বোঝার আগেই মনে গেঁথে যায়। আরিফ সাহেব কি মূর্তিমান কবিতা? তা না হলে কিভাবে প্রথম পরিচয়েই আমার হৃদয়ে হাত রাখলেন?
কথোপকথন হলো সম্পর্ক স্থাপনের সেতু। আমাদের ক্ষেত্রে তার প্রয়োজন খুব বেশী হলো না। চিরকালের একটা সম্পর্ক যেন দুজনের দেখা হবার প্রহর গুনছিল।
২৫।০৩।১৪২০
আরিফের স্ত্রীর চোখে আরিফ একজন পরিপূর্ণ মানুষ। মেশিনের মত পারফেক্ট মানুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপন নাকি কঠিন ব্যাপার। অভাব, অভিযোগ, চাহিদা কোন কিছুই থাকে না। এই টানাপড়েনহীন একঘেয়ে জীবন অনিলার পছন্দ না।
আমার কিন্তু আরিফকে মোটেও একঘেয়ে মনে হয়নি। আমার মনে হয়েছে আরিফের একটা অভিমানী বহিরাবরণ আছে। সেটা ভেদ করে ভেতরে গেলে অনেক মনি-মুক্তো কুড়োনো সম্ভব। অনিলা হয়তো সেই গভীরতায় যেতে পারেনি অথবা চায়নি। জলের কল্লোলে ভেসে প্রমোদ ভ্রমণ অনেকেই করে, কিন্তু ডুবুরী ক’জন (সত্যি কথাই বলছি, নিজের গুণ গাইছি না)?
১৫।০৪।১৪২০
আজ আরিফের কাছে মনের ঝাঁপি মেলে ধরলাম। আমি তখন ষোল। না-কিশোরী না-যুবতি মেয়েরা যে ভুল করে তাই করলাম। মোহের ঘোরে যার হাত ধরে পথে নামলাম সে কিন্তু তার মুল্য রাখেনি। বাবা-মা প্রগতিশীল মানুষ ছিলেন। যখন ফিরে আসি আন্তরিকভাবেই গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু আত্মীয় স্বজন বন্ধু-বান্ধবী তো আর বাবা-মা না। আড়ালে আড়ালে সব সময়ই কানাঘুষা চলত। মানসিকভাবে ভীষণ একঘরে হয়ে পড়েছিলাম। আরিফের মতই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম। অনেক বছর আন্টি-ডিপ্রেসেন্ট নিয়েছি।
সব শুনে আরিফ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। ইতিহাস বয়ে বেড়ানো মানবীকে গ্রহণ করার মানবিক উদারতা এবং ক্ষমতা সবার থাকে না। আমার ভয় করছিল।
সব সংশয় মিথ্যে করে দিয়ে আরিফ আমার হাতের উপর আলতো করে হাত রাখলো। জানালার দিকে তাকিয়ে কিছুটা উদাস স্বরে আবৃতি করল ‘যে মণি দুলিল যে ব্যথা বিঁধিল বুকে,ছায়া হয়ে যাহা মিলায় দিগন্তরে,জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা,ধুলায় তাদের যত হোক অবহেলা’।
ওর হাত থেকে এক ঝাঁক মুক্ত ইলেকট্রন যেন নেচে নেচে আমার হাতে উঠে এলো। আমি সে বিদ্যুৎ স্পর্শে কেঁপে উঠলাম। ফেরার সময় ও বলল দুঃখের প্রদীপ জ্বালিয়ে আমি নাকি সেদিন ওকে আলোকিত করেছি।
২০।০৪।১৪২০
গতকাল থেকে অমৃতা আমাকে ‘তুমি’সম্বোধন করছে। আমার কিন্তু একটুও কানে বাঁধেনি। এটাই যেন সম্পর্কের স্বাভাবিক উত্তরণ। উত্তরণ? কোন উচ্চতায়? কার মনের কাঞ্চনজঙ্ঘায়?
আজ ফেরার সময় অমৃতা কানের কাছ ঘেঁষে বললো ‘তুমি মা হলে মন্দ হতো না। বাবাও কিন্তু খুশী হবে। তুমি?’
একটা কিছু উত্তর দেয়া শোভন ছিল কিন্তু চুপ হয়ে রইলাম। আমার দু গাল লাল হয়ে ভাপ বেরোচ্ছিল। লজ্জায় নাকি আনন্দে? উফ,কী ভাবলো অমৃতা?
২৭।০৪।১৪২০
মাঝে অনেকদিন লেখা হলো না। কী করেই বা লিখব? জাদুর মাদুরে (ম্যাজিক কার্পেটের বাংলা করলাম) ভাসছি। মনে ভেতরে মাতাল হাওয়ার ঘূর্ণি। মনকে উস্কে দিচ্ছে, উড়িয়ে নিচ্ছে, গুড়িয়ে দিচ্ছে।
কাল আটাশে শ্রাবণ। আরিফ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবে।
আরিফ বলেছে ও কী একটা বলবে। যা বলবে তা ওর চোখের চাওয়া থেকে সেদিনই আঁচ করে নিয়েছি। ওর মন যদি হয় দীঘির গহীন গোপন তলদেশ, ওর চোখ তার স্বচ্ছ জল। ভাগ্যিস আরিফ নিজে সেটা জানে না। জানলে সব সময় সানগ্লাস পড়ে থাকবে :)
অমৃতা বলেছে ওর বাবাকে এমন হাসিখুশী আর সহজ আগে কখনোই দেখেনি। সেটা ব্রেন সার্জারির জন্য নাকি আমার কারনে? আমি মনে করি শেষেরটা।
৩। সমাপ্তি কিংবা অসমাপ্তি
আজ আটাশে শ্রাবণ। মিলি ত্বরা করে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। ছাতা,রেইনকোট,কিছুই সাথে নেই। বের হবার পাঁচ মিনিটের ভেতরেই রোদ ঝকঝকে আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গ্যাছে। তারপর প্রবল বৃষ্টি। নীল-শাদা পোল্কা ডটের শাড়ি ভিজিয়ে, কলা পাতার মত পাতলা দেহ ভেদ করে জলের ধারা এখন মিলির মনের ভেতরে বইছে। ওর সব গ্লানি, সব ম্লানিমা বৃষ্টির নরম জলে গলে গলে ঝরে ঝরে পড়ছে।
শাহবাগের মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যাল। ট্রাফিক বাতি লাল হবার আগেই মিলি রাস্তা পার হতে শুরু করেছে। মিলির হাতে একটা শন পাপড়ির প্যাকেট, আরিফের পছন্দ। দখিণা বাতাসের তুমুল দাপটে বর্ষার অজস্র জলধারা ঝাউ পাতার মত তির তির করে কাঁপছে।
মিলি এখন রাস্তার ঠিক মাঝখানে। তির্যক জলের উন্মাদনা ভেদ করে একটা সাদা পিক আপ ভ্যান এদিকেই ধেয়ে আসছে।