আমি একজন ল্যাব টেকনিশিয়ান। ঢাকায় একটি মধ্যম মানের সরকারী বিশবিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগের গবেষণাগারে আমার জীবনের একটা বিরাট সময় কেটে যায়।
ল্যাব টেকনিশিয়ান হবার কোন অভিপ্রায় আমার ছিল না। আমি বিজ্ঞানী হতে চেয়েছিলাম। আন্তর্জাতিক ভাবে খ্যাতিসম্পন্ন না হলেও অন্তত দেশের ভেতর গুরুত্বপূর্ণ। ছোটবেলায় স্কুলের পাঠ্য বইয়ে পড়েছিলাম কুদরত ই খুদা তাঁর অসাধারণ উদ্ভাবনী ক্ষমতা খাটিয়ে পারটেক্স আবিষ্কার করেছিলেন। ব্যাপারটা আমাকে পুলকিত করেছিল। ভেবেছিলাম, জগদীশ চন্দ্র কিম্বা সত্যেন বসুর মত বাঘা বিজ্ঞানী না হই, অন্তত কুদরতই খুদা মানের উদ্ভাবক হলেও যৎকিঞ্চিত আত্মশ্লাঘায় এ জীবন বেশ বর্তে যাবে।
এই দিবাস্বপ্নের পাশাপাশি আমার একটা শখও ছিল। আমি যখন ক্লাস ফোরে পড়ি তখন বাংলাদেশের কে একজন সাফ শুটিঙ্গে সোনা জেতে। বাবার কী হলো জানি না, উনি মহা উৎসাহে উঠে পড়ে লাগলেন আমাকে শুটার বানাবেন। আমাদের নিম্নমধ্যবিত্ত বাবা এর ওর থেকে ধারকর্য করে চকবাজার থেকে একটা লম্বা এয়ারগান কিনে এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। বাবার অর্থ বিনিয়োগ বিফলে যায়নি। ধীরে ধীরে সবাই আবিষ্কার করল, দূর পাল্লার নিশানায় আমার হাতের টিপ অব্যর্থ। যখন শীতকালে গ্রামের বাড়ী বেড়াতে যেতাম, মাঠের এপার থেকে গুলি করে ওপাড়ে খেজুর গাছে ঝোলানো রসের হাড়ি ফুটো করে দিতাম। সবাই আমার নাম দিয়েছিল ‘স্নাইপার সুহৃদ’।
ইউনিভার্সিটির প্রথম বছর ঢাকার একটা শুটিং ক্লাবে ঢুকেছিলাম। একটা দুটো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের পর সম্ভাবনাময় শুটারের তালিকায় আমার নামও উঠে এসেছিল। তারপর হঠাৎই সব বদলে যায়। যেই বাবা আমাদেরকে রেখে ঘরের বাইরে বেরোতে চাইতেন না,আমার একমাত্র বোন নীলাকে ঢ্যাঙ্গা বয়সেও বুকে আগলে রাখতেন, সেই বাবাই ঘুমের ভেতর অজানা অন্ধকারে পাড়ি জমালেন। ডাক্তার চাচা পরে জানিয়েছিলেন, নীরব হৃদরোগে বাবার হৃদপিন্ডের অর্ধেক ক্ষমতা আগেই লুপ্ত হয়েছিল, পরীক্ষা না করায় ধরা পড়েনি।
অনেক বলে বিগত প্রিয়জনেরা রাতের আকাশে লাল নীল নক্ষত্রের দীপালী জ্বালিয়ে ভালোবাসা ব্যক্ত করেন। কিন্তু আমার ধারণা বাবা একটা সূক্ষ্ম উপগ্রহ হয়ে অস্থিরভাবে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করছেন আর মহাকাশ ব্যপ্ত মায়ার বলয় থেকে আমাদের আনন্দ বেদনা প্রত্যক্ষ করছেন।
বাবার মৃত্যুতে আমাদের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে অমাবস্যার অন্ধকার নেমে আসে। নীলা এইচ এস সি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে, মা আজীবন গৃহবধূ আর আমি ভার্সিটিতে, মাত্র দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছি। নিম্নমধ্যবিত্তের চক্ষুলজ্জা ঝেরে ফেলে আমি মরিয়ার মত চাকুরীর সন্ধানে মানুষের দরজায় ধর্না দেয়া আরম্ভ করলাম। প্রায় ছ মাস পর অনেক অপমান আর প্রত্যাখান শেষে ঘন মেঘের সীমারেখা জুড়ে দেখা দিলো লুকনো সূর্যের ক্ষীণ রূপালী আভা। বাবার এক প্রাক্তন ছাত্র দয়াপরবশত আমাকে ল্যাব টেকনিশিয়ানের চাকুরীটা জুটিয়ে দিলেন। বেগারস ক্যানট বে চুজারস। আমি চোখ বন্ধ করে চাকুরীর খড়কুটো আঁকড়ে ধরলাম। অনিশ্চয়তার চোরাবালি থেকে রক্ষা পেলাম বটে কিন্তু আমার ছাত্রজীবনের অকাল মৃত্যু ঘটল।
কেন যেন আমার মনের ভেতর গেঁথে গিয়েছিল সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাব থাকবে কোন পুরনো ভবনের নীচতলার স্যাঁতস্যাঁতে ক্লান্তিকর কামরায়। সেখানে দিনের আলো কষ্টেসৃষ্টে পৌঁছায়, ভেতরের আসবাবপত্র বহু ব্যবহার আর অবহেলায় অবসন্ন। কিন্তু কাজে যোগ দেয়ার প্রথম দিনেই মনটা ভালো হয়ে গেলো। অবাক হয়ে অনুধাবন করলাম এটা একটা ডিজিটাল ফ্যাব্রিকেশন এবং থ্রি ডি প্রিন্টিং ল্যাব। তার চেয়ে বড় কথা, এই ল্যাবটি আমাদের ভবনের সবচেয়ে উপরের তলায়। ল্যাবের উত্তর দিকে বড় একটা জানালা দিয়ে প্রচুর দিনের আলো ভেতরে আসে, বাইরে চোখ রেখে সবুজ আরে নীলের নানা বর্ণচ্ছটা উপভোগ করা যায়। আর ভেতরের সব যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র এত ঝকঝকে তকতকে যেন এখুনি কিনে এনে বসানো হয়েছে।
আইনের শিক্ষক আবেদ খান আমাকে সব ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন। আমার বিস্ময় লক্ষ্য করে বলেছিলেনঃ এই যে চাকচিক্য দেখছেন, এর কিছুটা ক্রেডিট কিন্তু রাধাবিনোদ পালের। আমি অবাক হয়ে জিগেস করেছিলাম, উনি কী বোর্ড অফ ডিরেক্টরসের কেউ কিম্বা গভর্নিং বডির কেউ? উনি হেসে জবাব দিয়েছিলেন, না না। উনি কুষ্টিয়ার লোক, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর টোকিও ট্রাইবুনালে তিনি ডিসেন্টিং জাজমেন্ট দিয়েছিলেন মানে বাকী দশজন বিচারকের সাথে দ্বিমত করে বলেছিলেন যে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো জাপানীরা নির্দোষ। জাপানীরা নাকি এই বাঙ্গালী বিচারকের ব্যর্থ প্রয়াস ভোলেনি, বাঙ্গালীদের প্রতি একটা কৃতজ্ঞতাবোধ আজও জিইয়ে রেখেছে। এই যে নিজেদের গাঁটের পয়সা খরচ করে স্টেইট অফ দা আর্ট থ্রি-ডি প্রিন্টিং ল্যাব বানিয়ে দিয়েছে, এটা তাদের নানা ক্ষুদ্র প্রয়াসের একটা অংশ, বুঝেছেন? আমি বিস্ময়ে মাথা নেড়েছিলাম।
চাকুরীতে যোগ দেয়ার দু সপ্তাহ পরই জাপানী সাপ্লাইয়াররা আমাকে নিবিড় প্রশিক্ষন দিয়েছে। কীভাবে সফটয়ার চালাতে হবে, কীভাবে প্রিন্টারগুলোর কলকব্জা সাড়াতে হবে, রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন কোথায় ও কেন, এই সব জ্ঞান খুব দ্রুত আমার নখাগ্রে চলে এলো।
ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট হলেও আমার ভূমিকা একের ভেতর তিন। ল্যাবের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার, যন্ত্রপাতির রক্ষণাবেক্ষণ আমাকেই করতে হবে, আবার ছাত্রছাত্রীদের ত্রিমাত্রিক প্রিন্টের ঝামেলাও আমারই ঘাড়ে। প্রিন্টিঙের ব্যাপারটা অবশ্য স্বয়ংক্রিয় এবং সংক্ষিপ্ত। ওরা ফাইল পাঠিয়ে দেয়, আমি থার্মোপ্লাস্টিক কিম্বা পলিল্যাক্টিক আসিডের ফিলামেন্ট দিয়ে থ্রি-ডি প্রিন্ট বের করে আনি। আমাদের একটা অত্যাধুনিক ওভেন আছে যেখানে থার্মোপ্লাস্টিক রিসাইকেল করা হয়, মানে আবার গলিয়ে ফিলামেন্ট বানিয়ে নূতন করে প্রিন্টের কাজে লাগানো যায়।
আমার একমাত্র বোন নীলা এর মাঝে কলেজ পাশ করে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভুগোল বিভাগে ভর্তি হলো। আমার ভ্রমণ-পিপাসু বোনটি নাকি খোঁজ নিয়ে জেনেছে ভূগোলে স্টাডি ট্রিপ বেশী। ওর কথার সত্যতা মিলতে খুব বেশী দেরী হলো না। দ্বিতীয় সেমিস্টারেই ওরা ভারত আর নেপাল ভ্রমণে বেরিয়ে গেলো। ভারতের বোধি গয়া থেকে নীলা আমার জন্য একটা বুদ্ধের মূর্তি নিয়ে এসেছিল। ওর ধারণা আমি গৌতম বুদ্ধের মত সহনশীল, ধৈর্যবান, আর সহমর্মী। আমি মূর্তিটা হাতে নিয়ে বলেছিলাম ‘আর বুদ্ধের মত সংসারত্যাগী, সেও হব নাকি?’। নীলা খুব অভিমান করেছিল।
আমি বুদ্ধের মূর্তিটা আমাদের ল্যাবের একটা টেবিলে স্থাপন করেছিলাম। অফিস পলিটিক্স কিম্বা অন্য কোন কারনে মন কখনো অশান্ত হলে আমি মূর্তিটার দিকে তাকাতাম আর মনে মনে আবৃত্তি করতাম,
‘এ ধরার মাঝে তুলিয়া নিনাদ
চাহি নে করিতে বাদ প্রতিবাদ,
যে ক' দিন আছি মানসের সাধ
মিটাব আপন-মনে---
যার যাহা আছে তার থাক্ তাই,
কারো অধিকারে যেতে নাহি চাই
শান্তিতে যদি থাকিবারে পাই
একটি নিভৃত কোণে।‘
কিন্তু খুব বেশীদিন শান্তিতে থাকা আমার হলো না। এক বিকেলে নীলাদের ডিপার্টমেন্টের শেষবর্ষের বিদায় সম্বর্ধনা ছিল। নীলা উপস্থাপনা করবে, তাই আগেই জানিয়েছিল বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা পেরোবে। কিন্তু সন্ধ্যা পেরিয়ে অনেক রাত হল, তারপরও নীলা ফিরছিল না। একসময় চাপ নিতে না পারে নীলাকে ফোন করলাম। নীলার মোবাইল বন্ধ পেয়ে ওর বন্ধুদের চেষ্টা করলাম। ওরা জানালো নীলা অনুষ্ঠান শেষ হতেই বেরিয়ে গেছে, সন্ধ্যা সাতটার দিকে।
আমি পাগলের মত সারারাত বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ করেও কোন কিনারা করতে পারলাম না। সেই রাতে নীলা আর ফিরল না।
নীলাকে পেলাম পরদিন। কুয়াশামাখা ভোরে ভার্সিটির পাশের বড় খোলা ড্রেনে নীলার দেহটা উপুর হয়ে পড়েছিল। ক্ষতবিক্ষত, আবরণ আর আভরণহীন।
প্রথম প্রথম পত্রিকায় এই নিয়ে অনেক লেখালেখি চলল। ফেইবুক আর ব্লগে প্রতিবাদের তুফান ছুটে গেলো। চাপের মুখে সরকার প্রতিশ্রুতি দিলো ছ মাসের ভেতর দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে। পুলিশ বড় কর্মকর্তা আর স্থানীয় এম পি এসে আমার বাসাও ঘুরে গেলেন।
তারপর ধীরে ধীরে বিস্মরণের মখমল আবরণে, দেশে ঘটে যাওয়া আরও অনেক কুৎসিত কদর্য ঘটনার অন্তরালে নীলা নামের মেয়েটির সব চিহ্ন ম্লান হয়ে গেলো। কষ্ট চেপে চেপে আমার বৃদ্ধা মাও ছ’ মাসের মাঝে বিগত হলেন।
বেঁচে থাকার জন্য হৃদয়-দুয়ার রুদ্ধ করে আমি একটা অনুভুতিশুন্য রোবটে পরিনত হলাম। অফিসে যেতাম, অফিস থেকে ফিরতাম, আবার অফিসে যেতাম। জীবিকার প্রয়োজন ছাড়া মানুষের সান্নিধ্য ভালো লাগতো না।
এভাবেই নীলা আর মা’র মৃত্যুর দু দুটো বছর পেরিয়ে গেলো। তারপর হঠাৎ এক ভোরে ল্যাবে এসে দেখলাম দরজার নীচ দিয়ে কেউ একটা চিঠি ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। ইমেইল আর মেসেঞ্জারের যুগে এমন চিঠি পেয়ে অবাক লাগলো। সঙ্গে সঙ্গেই খাম খুলে পড়লাম।
‘সুহৃদ ভাই, আপনি আমাকে চিনবেন না কিন্তু আমি আপনাকে জানি। নীলার ঘটনার পর থেকে আমি মর্মযাতনায় ভুগছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমিও ব্যবহৃত হয়েছি, এখনো হচ্ছি, শুধু নীলার মত বাঁধা দিইনি বলে আজও টিকে আছি। নিজের অধোগতির জালে এতটাই জড়িয়ে গেছি যে এখন ফিরে আসা খুব দুরূহ। নীলার ক্ষতি যে করেছে সে’ই আমার রক্ষক (নিজেকে রক্ষিতা না বলে বিপরীত জনকে রক্ষক বলাই শোভন, কী বলেন?)।নীলাই প্রথম না। ক্যাম্পাসে এরকম ঘটনা ওরা অনেক ঘটিয়েছে। মেয়েগুলো লোকলজ্জায় চেপে গেছে। হয়তো ভেবেছে একটা দুর্ঘটনার কারনে বাকি জীবন বিষাক্ত করে কী লাভ? বেশীর ভাগ ঘটনাই আমি ঘটে যাওয়ার পর জেনেছি। আমার রক্ষক আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের জান্তব উল্লাস দেখে ভয়ে আঁতকে উঠেছি। সাহস করে কখনো কাউকে বলতে পারিনি। যার নিজের নৈতিক অবস্থান দুর্বল আর মানসিক অবস্থা ভঙ্গুর, তার কথা কে বিশ্বাস করবে বলুন? কিন্তু এই প্রথম একটা আগাম কিছুর আভাস পাচ্ছি। ওরা তিনজন আমার বাসায় বসে নূতন পরিকল্পনা আটছে। একটা খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে আপনার ক্যাম্পাসে। খুব বেশী সময় নেই। পুলিশ ডেকে লাভ হবে না, কেন সেটা আর ব্যাখ্যা করব না। আপনি হয়তো চাইলে থামাতে পারবেন। প্লিজ এর পরের চিঠির অপেক্ষায় থাকুন।’
এর পর মেয়েটি আরও দুটো চিঠি এসেছে। আমি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জেনেছি কী ঘটতে যাচ্ছে, কোথায় ঘটতে যাচ্ছে। হৃদয়ের জ্বালামুখে জোর করে চেপে রাখা আদিম রিরংসার রিপুটা উদগীরণের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছিল। ক্ষোভে আরে উত্তেজনায় বার বার আওড়াচ্ছিলাম, অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে…
শুক্রবারের ছুটিরে দিনে ল্যাবে এসে নীলার দেয়া গৌতম বুদ্ধের থার্মোপ্লাস্টিকের মূর্তিটা হাতে নিলাম। তারপর উত্তপ্ত অভেনে ছেড়ে দিলাম। ওভেনের একপাশ থেকে গলিত প্লাস্টিক ফিতার মত বেরিয়ে আসলো। প্লাস্টিকের এই ফিতা ত্রিমাত্রিক প্রিন্টারের কালি। কি প্রিন্ট করতে হবে তা আগেই ঠিক করা। প্রিন্টারে এই ফিতা-কালি ভরে কম্পিউটারে প্রিন্ট কম্যান্ড দিলাম।
ঘন্টাখানেকের ভেতরে কতগুলো প্লাস্টিকের পাইপ আর যন্ত্রাংশ বেরিয়ে এলো। আরও ঘণ্টাখানেক সময় নিয়ে প্লাস্টিকের টুকরোগুলো জোড়া দিলাম। একটা পুরোদস্তুর মডিফাইড ব্লেইসার আর নাইন্টি থ্রী হান্টিং রাইফেল। শুটিং রেঞ্জের প্রশিক্ষণের সুবাদে আগে থেকেই কিছু বুলেট জোগাড়যন্ত্র করা ছিল।
অচেনা মেয়েটির পূর্বাভাস বিশ্বাস করে শনিবার সন্ধ্যায় আমাদের ভবনের ছাদে উঠলাম। মেঘের ফাঁক দিয়ে আকাশে তখন রূপালী চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। সূক্ষ্ম জলবিন্দুর প্রভাবে চাঁদটা যেন চন্দন কাঠের মৃদু আভা ছড়াচ্ছে। সেই অস্থির আলোয় ছাদের মেঝেটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এখানে সেখানে মদের বোতল, সিগারেটের ভাঙ্গা টুকরো আর জন্মনিয়ন্ত্রণের ছেঁড়া প্যাকেট বাদামের খোসার মত নির্বিকারে ছড়ানো ছিটানো। আমার গলা উগড়ে বমি চলে এলো।
আমাদের ছাদটা ইংরেজি এল অক্ষরের মতন। আমি এক কোনা দিয়ে ঢুকেছি।সামান্য হাঁটতেই উল্টো দিকের কোনা থেকে ধ্বস্তাধস্তির আওয়াজ ভেসে এলো। আমি সেই শব্দ লক্ষ্য করে সাবধানে এগোলাম। ছাদের মাঝামাঝি গাজী কোম্পানির একটা বড় প্ল্যাস্টিকের পানির ট্যাংক। পেছনে গিয়ে দাঁড়াতেই ওদের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম,
কে একজন শীতলভাবে হেসে বলছে,
‘অনেক তো গরম দেখালি শালী, এখন একটু ঠান্ডা করে দেই, নাকি?’
কন্ঠটা খুব পরিচিত। এখানকার ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি, সংগ্রামী নেতা মন্টু ভাই। সারা বছর মাইক ফাটিয়ে গলাবাজি করে, যে কোন ছুতো ধরে আশেপাশের দোকান থেকে সপ্তাহান্তে চাঁদা তোলে।
আকাশ থেকে মোটা মোটা বৃষ্টির ফোটা ছাদে এসে পড়ল। একটু পরই প্রবল বর্ষণ আরম্ভ হবে। বৃষ্টি এলেই চারিদিকের দৃশ্যমানতা অর্ধেকে নেমে আসবে।
পানির ট্যাংকের আড়াল থেকে দেখলাম, দুটো ছেলে একটা মেয়েকে জাপটে মাটিতে শুইয়ে রেখেছে। মেয়েটার মুখে দলা করে ওড়না গোঁজা। মেয়েটার সামনে দাঁড়িয়ে মন্টু প্যান্টের বেল্ট খুলে ব্যান্ডের মত করে মাথায় পড়ল। কে একজন বলল,
‘এভাবে চার ছক্কা পেটালে তো মন্টু ভাইয়েরও সেঞ্চুরী হতে দেরী নাই। জাহাঙ্গীরনগরের বাবু ভাইরে টেক্কা দিবেন মনে হচ্ছে?’
আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেলো। থ্রিডি প্রিন্ট করা রাইফেলটা উঁচু করে করে মন্টুর দিকে তাক করলাম। মন্টু এখন মাটিতে উপগত হয়ে মেয়েটার পাজামা ধরে টানছে। মেয়েটা পা ছুঁড়ে বাঁধা দেবার চেষ্টা করছে। কিছু বোঝার আগেই আমার বন্দুক থেকে পর পর দুটি গুলি কিছু ভর, কিছু বেগ আর কিছু ঘৃণা নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে ছুটে গ্যালো মন্টুর দিকে। রিফ্লেক্স অ্যাকশন। শুটিং প্রাক্টিসের মাসল মেমরিটা এখন হারিয়ে যায়নি।
ঠিক সেই সময়ই সজোরে বিদ্যুৎ চমকালো আর আকাশ ভেঙ্গে প্রবল বৃষ্টি নামলো।
মন্টু মাটিতে গড়িয়ে পড়েছে। সাগরেদ দুটো হতভম্ব হয়ে এদিকে ওদিক তাকিয়ে কোন রকম প্রতিরোধ ছাড়াই সিঁড়িঘরের দিকে দৌড় লাগিয়েছে। দুজনেই আমার নিশানার ভেতর। ওদের শুইয়ে দিতে দু মিনিটের বেশী লাগলো না। আমি ধীর পায়ে মন্টুর দিকে এগোলাম। মন্টু মরেনি, মাটিতে শুয়ে তীব্র ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। মেয়েটার মুখ থেকে দলা করা কাপড় বের করে আমি মন্টুর মুখে গুঁজে দিলাম। মন্টুর হাঁটুর উপর থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। মরুক আস্তে ধীরে।
মেয়েটাকে চেহারায় চিনতে পারলাম। আমার ল্যাবে প্র্যাকটিকাল করতে এসেছে দু’ একবার। তার চেয়ে বড় কথা, ও একটা প্রগতিশীল দলের সক্রিয় কর্মী। কিছুদিন আগে সুন্দরবনের কী একটা ইস্যু নিয়ে জাতীয় সংসদের সামনে মানববন্ধন করে ওরা কর্তৃপক্ষকে ভীষণ চটিয়ে দিয়েছিল। মেয়েটাকে হাত ধরে টেনে তুলতেই ও আমার বুকে মাথা রেখে ভেউ ভেউ করে কেঁদে দিলো।
পরদিন ভোরে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকার প্রথম পাতার হেডিং ছিলঃ সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের তিন ছাত্র নেতার রহস্যজনক মৃত্যু-অন্তঃকলহ নাকি প্রতিপক্ষের প্রতিশোধ?
খবরের সারমর্ম এই যে, কিছুদিন আগে মগবাজারের কোন ফেন্সিডিলের আখড়ার দখলবাজি নিয়ে প্রতিপক্ষের একজন মন্টু গং-এর হাতে ঘায়েল হয়েছিল। গতকালের পৈশাচিক তিন খুন সম্ভবত তারই পাল্টা প্রতিঘাত।
একদম শেষ লাইনে খুব সাবধানী ভাবে লেখা, মন্টুর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে মেয়েদের উত্যক্ত করার নানা অভিযোগ উঠেছে। বুঝলাম সাংবাদিকরা ক্ষমতাশীনদের পে রোলে আছে কিম্বা হয়তো তথ্য প্রযুক্তি আইনের ভয়ে গুটিয়ে গেছে।‘ধর্ষণ’ শব্দটা পুরোপুরি উহ্য রেখেছে।
এর ভেতর রাস্তায় মিছিল নেমে গেছে, মুহুর্মুহু শ্লোগান ধ্বনিত হচ্ছে,
‘মন্টু ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না।’
‘এক মন্টুরে লোকান্তরে, লক্ষ মন্টু ঘরে ঘরে’
এর পাশপাশি আরেক করিৎকর্মার দল গাড়ি ভাঙচুর আরম্ভ করে দিয়েছে।
সরকারী দল বলে কথা। পুলিশের গাড়িতে ক্যাম্পাস গিজগিজ করছে। ওরা যত্রতত্র তল্লাশি চালাচ্ছে, একে ওকে পথ আটকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
একটু আগে আমি রাইফেলটা ওভেনে ঢুকিয়ে দিয়েছি। রাইফেলের থার্মোপ্লাস্টিক এখন ২৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় দ্রবীভূত হচ্ছে। জাপানীদের দেয়া অত্যাধুনিক মেশিনে গলিত প্লাস্টিক থেকে লোহা আলাদা হয়ে যাচ্ছে, ধাতুর যায়গায় ধাতু জমা হচ্ছে, অধাতুর যায়গায় অধাতু। অধাতুর কন্টেইনার থেকে অদ্ভুত কৌশলে থার্মোপ্লাস্টিকের ফিলামেন্ট তৈরি হয়ে চলে যাচ্ছে থ্রিডি প্রিন্টারে।
আমি প্রিন্টিং কম্যান্ডে চাপ দিলাম। বুদ্ধের মূর্তিটা আগে থেকেই কম্পিউটারে সেট করা ছিল। ধীরে ধীর প্রিন্ট আরম্ভ হতে না হতেই ল্যাবের দরজায় টোকা পড়ল।
দরজা খুলতেই দু’জন ইউনিফর্ম পরা পুলিশ ভেতরে প্রবেশ করল। পকেটের উপরের প্লাস্টিকের ব্যাজে চোখ বুলিয়ে বুঝলাম এরা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। একজন কাঠির মত চিকুন, অন্যজন কাঁঠালের মত গোলগাল। নিজেদের পরিচয় না দিয়ে সূক্ষ্ম পুলিশটা বললো,
‘বুঝতেই পারছেন কী জন্য এসেছি?’
‘জ্বি,এরকম একটা বিশ্রী কান্ড ঘটে গেলো, কাজে মন লাগাতে পারছি না’
‘ভিকটিমরা সরকারী দলের, বুঝেন তো। এদিকে বৃষ্টিতে সব আলামত ধুয়ে গেছে। ভীষণ চাপে আছি ভাই। আপনার ল্যাব তো ছাদের একদম কাছে। কোন তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে পারলে অনেক উপকার হয়’
‘আমি ছাড়া এই ল্যাব দেখার তো কেউ নেই, সকাল সন্ধ্যা এখানেই পড়ে থাকি। কীভাবে উপকার করব বুঝতে পারছি না’
‘গতকাল ক’টা পর্যন্ত ছিলেন?’
‘প্রতিদিনই ন’টায় আসি আর সন্ধ্যা সাতটার দিকে বেরোই। স্টুডেন্টরা এসে ঘূর্ণিঝড়ের মত ল্যাব তছনছ করে রেখে যায়। সব গোছগাছ করতে করতে সন্ধ্যা নেমে আসে, এটা একটা রুটিনের মত হয়ে গেছে’
‘কোন অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েছে, কাল সন্ধ্যায়?’
‘ল্যাবের ভেতরের জানালা তো দেখতেই পারছেন বাগানের দিকে মুখ করা, বিল্ডিঙের অন্য কোথাও কিছু হলে কীভাবে জানব? কোন হৈচৈ কিম্বা ঝগড়া ফ্যাসাদের শব্দও কানে আসেনি। তবে...’
‘তবে কী?’, স্থূল পুলিশটা উৎকর্ণ হলো।
আমি একটু আমতা আমতা করলাম। চিকুন পুলিশটা বিরক্ত হয়ে বললো,
‘বলে ফেলুন, ভয়ের কী আছে?’
‘প্লিজ, আমার নাম জানাবেন না’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে বলুন’, চিকুন পুলিশের কণ্ঠে তাড়া।
‘আমাদের ক্যাফেটেরিয়ার খাবারে খুব একটা বৈচিত্র্য নাই’
‘তো?’, মোটা পুলিশটা বোধ হয় বিরক্ত হলো।
‘আমি প্রায়ই রাস্তার ওপারের একটা রেস্টুরেন্টে খেতে যাই’
‘কী নাম’
‘কাবাব সমগ্র’
‘এটা কী কবিতার বই, এ রকম নাম কেন? যা হোক, কোথায় কী খেতে গেলেন সেটা শোনাচ্ছেন কেন?’
‘আমি গতকাল খাবার অর্ডার করে কাবাব সমগ্রের টয়লেটে ঢুকেছি। তখনই দেখলাম…’
‘কী দেখলেন?’
‘আসলে অত গুরুত্বপূর্ণ না, নিজেদের মধ্যে অমন হয়ই। ঠিকই বলেছেন আপনাদের জেনে কাজ নেই’
‘কীসের কথা বলছেন? কাদের মধ্যে কী হয়? খোলাসা করুন’
‘না, দেখলাম আর কী…মন্টু ভাইকে তিনজন মিলে’
‘কী করছে?’
‘একজন কলার চেপে ধরেছে, অন্যজন চড় থাপ্পড় দিচ্ছে’
‘কী বলছেন?’, সূক্ষ্ম পুলিশটা চমকে উঠলো।
‘আর তিন নম্বর লোকটা? সে কী করছে’, মোটা পুলিশ জানতে চাইলো।
‘দরজা আগলে আমার দিকে কটমট করে তাকিয়েছিল, মনে হচ্ছিল আমাকেও একটা থাবড়া মেরে দেবে’
‘আপনি কী করলেন?’
‘আমি হাত না ধুয়েই মাথা নীচু করে বেরিয়ে এসেছিলাম। সোজা ল্যাবে’
‘চিনতে পেরেছেন ওদেরকে?’
‘তখন চিনিনি, আজ চিনলাম, দুজনকে’
‘আজ চিনলেন, কীভাবে?’
‘কাগজে ছবি দেখে’
‘আপনি বলছেন তৃতীয় আরেকজন ছিল?’
‘জ্বি, মাথা ন্যাড়া করা’
ওরা দুজন চোখ চাওয়াচাওয়ি করল, মোটা পুলিশ চিকুন পুলিশকে বলল,
‘ইন্টারনাল কনফ্লিক্ট, সামনে ইলেকশন, নমিনেশন নিয়ে লেগেছে বোধ হয়’
‘হুম, ন্যাড়া লোকটার কথা ভাবছি, দ্যাট এক্সপ্লেইন্স নিজেরা মারামারি করে মরলে অস্ত্র কোথায় গেলো’
‘আমি অবশ্য একটু কনফিউজড’, আমি ফোঁড়ন দিলাম।
‘কী নিয়ে?’
‘ন্যাড়া নাকি টাক মাথা, টাক মাথা নাকি ন্যাড়া, মানে তাড়াহুড়োর ভেতর…’
মোটা লোকটা আমার দিকে পৃষ্ঠপোষকতার দৃষ্টি দিয়ে বললো, ‘ঠিক আছে আপনি আপনার কাজ করুন, অত নার্ভাস হবেন না, ন্যাড়া নাকি টাক মাথা সেটা আমরা বুঝব। আরও কোন ইনফরমেশন লাগলে আমরাই যোগাযোগ করব।’
থ্রি-ডি প্রিন্টার থেকে ততক্ষণে রাইফেল গলানো বুদ্ধের মূর্তিটা বেরিয়ে এসেছে। আমি মূর্তিটা মোটা পুলিশের হাতে দিয়ে বললাম, ‘স্যার, আমদের ল্যাব থেকে কোন অতিথি খালি হাতে ফেরে না। এই নিন একটা বুদ্ধের মূর্তি, থ্রিডি প্রিন্ট।’
মোটা পুলিশ উচ্ছসিত হয়ে বললেন, ‘থ্রি ডি প্রিন্ট? বাহ দারুণ তো। বুদ্ধই তো বলেছিলেন, অহিংসা পরম ধর্ম। এই স্কাল্পচারটা আমাদের অফিসের রিসেপশনে রেখে দেব। দেশ জুড়ে এত হিংসা, হানাহানি, খুন, ধর্ষণ, মামলা মোকদ্দমা। এটা একটা শান্তির মেসেজ দেবে, কী বলেন?’
আমি বিড়বিড় করে বললাম ’নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিছে নিঃশ্বাস, শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস’
‘কী হাঁস বললেন? কাবাব সমগ্রে হাঁসের মাংস পাওয়া যায়?’
‘হাঁস না, একটা কবিতা আওড়াচ্ছিলাম’
‘কবিতা? আচ্ছা, আচ্ছা, আপনি ভাই নরম মনের মানুষ, আপনি আপনার মত থাকুন, আমরা বাকিটা দেখছি’
চিকুন পুলিশ সায় দিয়ে মাথা নাড়ল।
জোকার দুটোকে বিদেয় করে দেয়ালে ঝোলান আয়নার দিকে তাকালাম।
হঠাৎ মনে হলো আমার বাবা গভীর স্নেহভরে আমাকে দেখছেন।