আমার পতাকা

স্বাধীনতা (মার্চ ২০১১)

মো: আরাফাত ইসলাম
  • 0
  • ১৩২
সেইদিন সন্ধ্যে হতে না হতেই মায়ের কাছে গুঁটিসুটি মেরে মুখ গুঁজে বিছানার এককোণে দুটি প্রাণী জড়সড় হয়ে বসেছিলাম। আমার কাছে কেন যেন সেই দিন তার চেয়ে নিরাপদ কোন আশ্রয় পৃথিবীতে আছে বলে মনে হয়নি, মা যে কিছু ভাবছিলেন তা তার মুখের দিকে না তাকিয়েও স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলাম। আমার ধারনা হয়তো সকালের ইদরিস মোল্লার কথাই ভাবছে, লোকটা হাড়ে-হাড়ে বজ্জাত সেটা ছোটদের মহলেও সকলে অবগত ছিল, এই তো সেইদিন মামুন এর বাবা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল বলে ধরে নিয়ে তাদের সেই কি অত্যাচার! লোকটার আজকের কথা শুনে তো তাকে ফেরেস্তা মনে হচ্ছিল কিন্তু কথা আর চোখের কোণায় যে অশুভ কোন ইঙ্গিত ছিল তা আমার চোখে যেহেতু ফাঁকি দেয়নি সেহেতু আম্মার চোখে দিয়েছিলো বলেও মনে হয় না । ইদরিস মোল্লা বাড়ির ফটকে একেবারে চাঁদ-তারা এঁকে নিজের বাড়ির লোকদের রক্ষা করছে, সেই জন্যে আমাদের প্রস্তাব দিতে এসেছিল তার বাড়িতে যেতে তাহলে সে তার বিবিদের মতোই হেফাজতে রাখবে। আমি তখন ছোট হলেও হলফ করে বলতে পারি যদি আর মাত্র কয়েকমাস আগে এই কথা বলত যখন বাবা আমাদের সঙ্গে ছিলেন, তিনি ঠিকই ওর পান খাওয়া খয়েরি দাঁতগুলো মাড়ি থেকে আলাদা করে দাড়ির সাথে বেধে দিতেন, অথচ বাবা না থাকায় আমরা যে কতটা অসহায় তা আজকে সকালেই মায়ের মুখ দেখে জেনেছিলাম।

সবার মা-ই সবার কাছে সবচেয়ে সুন্দর তবুও তুলনা করলে আমার মা ছিলেন লাখে একটা। সবাই আমাকে বলতো ছেলেটি মায়ের মতো সুন্দর হয়নি, আমার রাগ উঠত না কেননা আমি আলবত জানতাম আমার বয়সী ছেলেগুলো আমার মতো সুন্দর না। তা-হলে কি মা আমার চেয়ে ও সুন্দর ছিলেন! উত্তর জানি না, তবে আমার মা কাজল, কামাল বা বাবলুদের মায়ের মতো জল্লাদ বা দীর্ঘদেহী ছিলেন না।ও হ্যা,মন্তব্যগুলো আমার নয় বরং ওরাই বাড়ি হতে মা-এর মার-গুতো খেয়ে এসে পরে বলত। আমার এখনও ঠিক মনে আছে ঐ দিন আমি মায়ের আচঁলে মাথা গুঁজে মায়ের শরীরের চিরচেনা গঁন্ধটা পাচ্ছিলাম আর মায়ের নিস্পাপ চোখজোড়ায় দুশ্চিতার ছাপ যে ছিল তাও আমি টের পেয়েছিলাম। আমার ঠিক মনে আছে, সেদিন মা আমাকে শরীরের সাথে শক্ত করে চেপে রেখেছিলেন আর সে যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল তাও আমি টের পাচ্ছিলাম। বাবা যাবার পর হতেই মা কেমন যেন পাল্টে গিয়েছিলেন, একেবারে চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলো কিন্তু আমার মনে হলো আজকে তার অন্য চেহারা। খুব সম্ভব সকালের ঘটনার সব কথা আমি স্পষ্ট শুনতে পাইনি, এতে মনে হলো শেষ পর্যন্ত ইদরিস মোল্লা আম্মাকে একরকম শাসিয়ে তার বিরুদ্ধাচরণ এর পরিণতির ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তাই আজ একটা আতঙ্কের ছাঁপ ও স্পষ্ট ছিলো।আম্মার গায়ের মিষ্টি ঘ্রাণে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তা মনে করতে পারি না।

মাঝরাতে দরজায় বুটের লাথিতে ঘুম ভাঙ্গল অথচ চোখ খুলে দেখি মা ঠিক আগের মতোই চেয়ে চেয়ে কি যেন ভাবছে, আমি তো অবাক তাহলে কি মা সারা রাত জেগে ছিলেন? আমি তাড়াতাড়ি মা-কে নাড়া দিলাম তাতে মা-এর ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় লাগল অথচ বাইরে বুটের লাথিতে মনে হয় দরজাটা এখনই ভেঙ্গে যাবে। মা আমাকে টেনে নিয়ে চালের মটকাটার মধ্যে রেখে ঢেকে দিলেন আর আমি নিশ্চিত রইলাম এইজন্যে যে দরজার পাল্লার মধ্যে যে সান দেয়া দা-টা রয়েছে হয়তো আম্মা হাতে নিবে, হঠাৎ ধুম করে দরজার পাল্লা ভাঙ্গার শব্দটা কানে এল, তারপর... সাথে সাথে কতগুলো বুটের শব্দ। তাদের সবাই উদর্ুতে কথা বলছিল, যা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম না তবে "শ্যালীকো লেকে চালো" এ জাতীয় কিছু শোনা যাচ্ছিল, আমার প্রচন্ড রাগ হচ্ছিল যে মা কেন চিৎকার-চেচাঁমেচি করলো না। তবে চিৎকার করলে যে কি লাভ হতো তা এখনো বুঝে আসে না, মাঝে মাঝে নিজেকে প্রচন্ড ধিক্কার দেবার ইচ্ছে হয়েছিল আবার পরক্ষণেই ভাবলাম কি-ই বা করতে পারি আমার মতে বাচ্চা ছেলে। তৎকালীন পরিস্থিতিতে পাশে এসে দাড়াতে পারে এমন পরিচিতদের মধ্যে একমাত্র ইদরিস মোল্লাকে শুভাকাক্ষ্নী মনে না হলেও কেন যেন মনে হয়েছিল তার কাছে গেলে কাজ হবে তাই ঐ রাতেই ইদরিস মোল্লার বাড়ি ছুটেছিলাম, যাবার পথে 'নুরা পাগলা' -র মাজার চোখে পরেছিল একটা গাঢ় সবুজ কাপড় দিয়ে সেটা ঢাকা ছিলো সেটাকে টপকে "মোল্লা বাড়িতে" হাক-ডাক করেও শেষে বাড়ির দিকে ফিরতে হয়েছিল কিন্তু একবারও মনে হয়নি বাড়িতে গিয়ে তো মা কে দেখতে পাবো না। মনে মনে এই কথাও আসতে লাগল যে, মা তো ঠিকই জানে যে আমি ঘরে একা একা আছি ভয় পাবো, এজন্যে মা নিশ্চয়ই বুদ্বিকরে ঠিক চলে আসবে বাড়িতে। বাড়ি পৌঁছে শেষ আশাটা যখন দেখলাম ফললো না তখন মনে করলাম হয়তো আসতে দেরি হবে কিন্তু ঠিক এসে যাবে তাই দরজা বন্ধ না করে কেবল ভিজিয়েই অপেক্ষা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তার খেয়ালই নেই।

অনেক রাত্রে বিরাট ধকল যাওয়ার ঘুম থেকে উঠতে বেশ দেরিই হয়েছিলো যখন ঘুম থেকে উঠলাম তখন নিজের শূন্যতা হঠাৎ উপলব্ধি করতে পারলাম। অত:পর পূর্ব ঘটনা স্মরণ করে ইদরিস মোল্লার বাড়ি দিকে দ্রুত চলছিলাম ঠিক তখনই দেখলাম বাচ্চাদের একটা দল কাকে যেন তাড়া করছে, কেউ কেউ পাথর ও ফিঁকছে। সেইদিনই প্রথম আমি তাদের সাথে যোগ না দিয়ে কতগুলো ইট মেরে তাদের ভাগিয়ে দিলাম অথচ কেন করলাম তা জানা নেই, কৌতূহলবশত বাচ্চাগুলো ভেগে গেলে মনে হলো দূরে কেউ যেন নিজেকে গাছের আড়ালে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে, আমি আস্তে আস্তে কাছে যেতেই যেন ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গাছের গুড়ির সাথে মিশে যাচ্ছিল। অনেকক্ষণ পরে বুঝতে পেরে যেন আমার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। এ কি করে সম্ভম! সে আর কেউ নয়, আমার গর্ভধারিণী মা!! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, যেই মহিলাটি আমার পাশে বসে আছে তিনিই কি আমার মা ? ভাল করে নিরীক্ষণ করলাম, মনে হলো একরাত্রে বয়স বিশবছর বেড়ে গেছে আর চুলগুলোও উস্কোখুস্কো, চোখ কোটরাগত, সারা শরীরে মাটি-বালি দিয়ে ভরা, শরীরের বেশির ভাগই অনাবৃত আর একটা আধ-ময়লা চিটচিটে সবুজ একটা কাপড় দিয়ে নিজেকে নামমাত্র আবৃত করে রেখেছে। আমার হঠাৎ মনে হল এই আধ-ময়লা কাপড়টাকে কোথায় যেন দেখেছি, সত্যিই তো সেটা 'নুরা পাগলা'-র ! ওহ!! আমার যেন কান্নায় নিজের বুকটা ফেটে যাচ্ছিল আর আমার আপন মা আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে ছিল যেন আমাকে অনেক চেনার চেষ্টা করছেন কিন্তু পারছেন না। ইট-পাটকেল এর আঘাত লেগে যে দরদর করে রক্ত গড়াচ্ছিল কিন্তু তার কোন হুশ-ই ছিল না।

নিজেই ধরে ধরে মাকে ঘরে নিয়ে এসেছিলাম আর টিন থেকে মুড়ি গুড় দিতে না দিতে এগিয়ে এসে কোন কথা না বলেই সে খেয়ে নিল, মা কে খেতে দেখে কেন যেন উত্তর পাঁড়ার রমিজ গাজীর ছোট ছেলে 'সুজা পাগলা'-র কথা মনে পড়লো, তাকেও একদিন ঠিক একইভাবে খেতে দেখেছিলাম, তাহলে কি মা-ও ? নিজেকে আর সামলে রাখতে পারছিলাম না কারণ এ পর্যন্ত আমি বড়দের ন্যায়ই ভূমিকা পালন করেছিলাম আর পারলাম না, শেষ পর্যন্ত মায়ের সামনে ভেঁউ ভেঁউ করে কাঁদতে লাগলাম। মা আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে ছিল যে, সেখানে আর ঐ কৌতূহলী দৃষ্টি ছিল না, ছিল নিস্পাপ এক ভঙ্গি যেন সে নিজেকে অনেকটা অসহায় মনে করেছিলো যেমনটি হয়তো আর পৃথিবীতে হয় না।

আমি আর তাকিয়ে থাকতে পারলাম না দৌড় দিয়ে ঘর হতে বের হয়ে গেলাম। যাবার সময় একবার বাইরে থেকে লাগিয়ে যাব ভাবলাম কিন্তু কিভাবে? সে তো আমার-ই মা! সেখান হতে সোজা গিয়ে রাজনদের পুকুরঘাটে গিয়ে একা একা কাঁদতে থাকলাম আর অনতিদুরে গাছের আড়াল হতে বড় সড়কটা একটু আধটু যা দেখা যেত, সেটার দিকে তাকিয়ে বাস-গাড়ি দেখে আর নদীর জলের মাঝে কত কি যে ভাবলাম তার ইয়ত্তা নেই। এভাবে কতক্ষণ বসে ছিলাম তা ঠিক বলতে পারবো না এমনই সময় আচম্কা বড় রাস্তায় চোখ পড়তেই সেখানে গাড়িগুলোর ভিড় দেখে মনে কেন যেন কিছুটা খটকা লাগল, সাধারনত এখানে এঙ্েিডন্ট হলেই লোকজন গাড়ি ভাঙ্গচুর করে। এঙ্েিডন্টের কথা মনে হতেই কে যেন আমার পাঁজরটাকে সাড়াশি দিয়ে চেপে ধরলো, সত্যিই তো আমি হতভাগী মা-টাকে বাইরে থেকে আটকে আসিনি।অমনি পাগলের ন্যায় দৌড় দিয়ে বড় সড়কে গিয়ে দেখি লোকজনের বিশাল ভিড়, কাছে যেতেই পরিচিত কয়েকজন আমাকে দেখে ভিড় থেকে কিছুটা সরে দাড়াল আবার দু-একজন মুরব্বী আমার কাঁধে পিঠে হাত রাখলো এতে আমার যথেষ্ট অস্বস্তি লাগছিল। একটু আগাতেই যা দেখলাম তা আর মুখে বলা সম্ভব নয়।
ওহ ! কি বিভৎস !!
এর চেয়ে বেশি ব্যক্ত করা সম্ভব নয় তবে রাস্তায় রক্তের যে বন্যা বয়ে গিয়েছিলো তাতে মাংসপিন্ডের উপর একটা রক্তে চুপসে যাওয়া কালচে চিটচিটে কাপড় দেখা যাচ্ছিল, আমি নির্বাক হয়ে সেই দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। আমি জানতাম, কাপড়টি কালো ছিল না........................................
তারপর..
অনেকবছর........

ভোরের আকাশে পত-পত করে উড়তে থাকা সেই লাল আর সবুজের কাপড়টা দেখলে এখনও বুকের ভিতরটা ছ্যাৎ করে উঠে। মায়ের শরীরের সেই পরিচিত গন্ধটা যেন ঐ কাপড় থেকে ভোরের বাতাসের ন্যায় আমার নাকে এসে লাগে । এরপরই চিরাচরিত নিয়মে চোখের পাতা দুটো ভারি হয়ে আসে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
বিন আরফান. আমার দেখা ভালো গল্পের মধ্যে একটি. আলহামদুলিল্লাহ অপূর্ব লিখেছেন.আমি অভিভূত. দুয়া রইল. আরো ভালো লিখুন. আমার লেখা বঙ্গলিপি পড়ার আমন্ত্রণ রইল. http://www.golpokobita.com/golpokobita/article/736/372
বিষণ্ন সুমন মা কে নিয়া লিখা পরার পর আসলে কোনো মন্তব্য করার সাহস হয়না.... ভালো হয়েছে
জাবেদ ভূঁইয়া খুব সুন্দর লিখেছ ভাইয়া ।ছোটভাইয়ের পড়ার জন্য আবদার রইল ।
মহিম মাহফুজ রপরই চিরাচরিত নিয়মে চোখের পাতা দুটো ভারি হয়ে আসে। খুব ভাল..............

২৬ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী