একটি কিশোরের চোখে মুক্তিযুদ্ধ

মুক্তিযুদ্ধ (ডিসেম্বর ২০২৫)

Prince howlader
  • 0
  • ২৮
১৯৭১ সালের বসন্ত। মফস্বল শহর নাসিরনগরের শান্ত, ছায়াঘেরা গ্রামটি হঠাৎ করেই যেন বদলে যেতে শুরু করল। ষোলো বছরের কিশোর আলীম দেখছিল, তাদের নিস্তরঙ্গ জীবনে কেমন যেন চাপা উত্তেজনা আর ভয় খেলা করছে। শহরের মিছিলে স্লোগান দেওয়া মানুষগুলো এখন ঘরে ফিরে ফিসফিস করে কথা বলে। ২৫শে মার্চের কালরাতে ঢাকায় যা ঘটেছিল, তার খবর এখানেও পৌঁছেছে।

আলীমের বাবা, মওলানা সাহেব, গ্রামের মক্তবে পড়াতেন। তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে রেডিওতে কান পেতে থাকতেন।

"বাবা, এটা কি সত্যিই যুদ্ধ?" একদিন রাতে আলীম জিজ্ঞেস করল।

বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "ব্যাটারে, এটা শুধু যুদ্ধ নয়। এটা আমাদের বাঙালির অস্তিত্বের লড়াই। ওরা আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল, এখন কেড়ে নিতে চায় আমাদের দেশ।"


এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে গ্রামে পাক-হানাদার বাহিনীর আগমন ঘটল। তাদের বুটের শব্দে যেন মাটি কেঁপে উঠত। তাদের আগমন মানেই অত্যাচার, লুটপাট আর আতঙ্ক।

একদিন দুপুরে, যখন আলীম বন্ধুদের সাথে বটতলায় খেলছিল, তখন দেখল একটি জিপ গ্রামের দিকে আসছে। জিপ থেকে নামল কয়েকজন সৈন্য। তারা প্রথমেই মক্তবে গিয়ে মওলানা সাহেবকে টেনে বের করল।

"এই এলাকার সব বিদ্রোহী কোথায়?" একজন সেনা চিৎকার করল।

মওলানা সাহেব শান্ত গলায় বললেন, "এখানে কোনো বিদ্রোহী নেই। সবাই সাধারণ মানুষ।"

সেনারা বাবার কথা শুনল না। তারা বাবাকে মারতে শুরু করল। আলীম বুকফাটা আর্তনাদ করে ছুটে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু তার বন্ধু রতন তাকে শক্ত করে ধরে রাখল। অসহায়ের মতো দেখতে হলো, কীভাবে তাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে অকথ্য নির্যাতন করা হচ্ছে। একসময় জ্ঞান হারানো মওলানা সাহেবকে তারা উঠিয়ে নিয়ে গেল।

সেই দিনটি আলীমের মনে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার সাথে তীব্র প্রতিশোধের আগুন জ্বেলে দিল।


বাবা অপহৃত হওয়ার পর আলীম স্থির করল, সে আর চুপ করে বসে থাকবে না। মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিল—নিঃশব্দ বিদায়, কারণ বেশি কথা বললে মা তাকে যেতে দিতেন না। রাতের অন্ধকারে সে গ্রাম ছাড়ল, উদ্দেশ্য—মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করা।

কয়েক দিন হেঁটে, ফসলের মাঠ পার হয়ে সে অবশেষে সীমান্তের কাছে একটি গোপন শিবিরে পৌঁছাল। তার দুর্বল শরীর, চোখে-মুখে ভয় আর ক্লান্তি। কিন্তু তার ভেতরের প্রতিজ্ঞা ছিল ইস্পাতের মতো শক্ত।

সেখানে তার দেখা হলো রণাঙ্গনের এক অসম সাহসী যোদ্ধার সাথে, যার নাম 'ক্যাপ্টেন' জামান। জামান ভাই তার দুর্বলতা দেখে প্রথমে তাকে ফেরাতে চাইলেন।

"তোমার বয়স কম, আলীম। তুমি বাড়ি ফিরে যাও," জামান ভাই বললেন।

আলীম মাথা নত করে বলল, "আমার বাবা কোথায়, আমি জানি না। কিন্তু আমি আমার দেশের জন্য লড়তে চাই। আমাকে যুদ্ধ শেখান।"

আলীমের চোখে সেই আগুন দেখে জামান ভাই রাজি হলেন। শুরু হলো প্রশিক্ষণ। লাঠি-হাতে কৃষকের ছেলেটি শিখতে লাগল কীভাবে স্টেনগান ধরতে হয়, গ্রেনেড ছুঁড়তে হয়, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—কীভাবে গেরিলা কায়দায় লুকিয়ে থাকতে হয়।


সময়টা তখন অক্টোবর। আলীম এখন একটি ছোট গেরিলা দলের সদস্য। তাদের কাজ ছিল নাসিরনগরের আশেপাশে শত্রুদের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করা।

একদিন রাতে তারা একটি রেল সেতুতে হামলা চালাল। তুমুল গোলাগুলির মাঝে আলীম দেখল, তার পাশে রতন—তার ছোটবেলার বন্ধু, যাকে সে বটতলায় রেখে এসেছিল—সেও আজ মুক্তিযোদ্ধা।

"তুই!" বিস্মিত আলীম ফিসফিস করে উঠল।

রতন হেসে বলল, "দেশের টানে আমিও এসেছি। তোর বাবা আমাদের সবার বাবা ছিল রে।"

সেই রাতে তারা সফল হলো। সেতুটি ধ্বংস হয়ে গেল, শত্রুদের রসদ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেল। ফিরে আসার সময় আলীম তার বন্ধুকে বলল, "জামান ভাই বলেছেন, এই ব্রিজ ভাঙা মানে স্বাধীনতার পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া।"


ডিসেম্বর মাস। চারদিকে বিজয়ের বার্তা। মুক্তিবাহিনী আর মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণে শত্রুরা পিছু হটতে শুরু করেছে।

১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১। চারদিকে উল্লাস। ঢাকা মুক্ত হয়েছে। নাসিরনগরেও মুক্তির নিশান উড়ল। আলীম, রতন আর তাদের দল গ্রামে ফিরল।

গ্রামের মানুষ তাদের বুকে জড়িয়ে ধরল। কিন্তু আলীমের চোখে ছিল বিষাদের ছায়া। তার বাবা ফেরেননি।

জামানের ভাই তাকে সান্ত্বনা দিলেন, "আলীম, তোমার বাবা একজন শহীদ। তিনি আমাদের হৃদয়ে বেঁচে আছেন। তোমার আর রতনের মতো হাজারো ছেলের আত্মত্যাগেই এই পতাকা উড়েছে। এটাই তোমার বাবার সবচেয়ে বড় শান্তি।"

আলীম তখন গ্রামের বটতলার দিকে তাকাল। সেখানে মওলানা সাহেবের স্মৃতিতে সদ্য তোলা একটি বাঁশের খুঁটিতে নতুন পতাকাটি পতপত করে উড়ছিল—সবুজ জমিনে টকটকে লাল বৃত্ত। সেই পতাকায় লেখা ছিল মুক্তিযোদ্ধা আলীম ও শহীদ মওলানা সাহেবের মতো অসংখ্য বাঙালির আত্মদানের গল্প।

তার চোখে জল এসেছিল, কিন্তু সে চোখের জল ছিল দুঃখের নয়, ছিল এক নতুন দিনের, স্বাধীনতার আনন্দাশ্রু।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

আমার লেখা গল্পটি, যার শিরোনাম "একটি কিশোরের চোখে মুক্তিযুদ্ধ", সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১) এই বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ১. মূল চরিত্র ও প্রেক্ষাপট গল্পের প্রধান চরিত্র আলীম, একজন সাধারণ গ্রাম্য কিশোর। তার চোখে মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা, প্রতিরোধ এবং অবশেষে বিজয়—এই তিনটি পর্যায় তুলে ধরা হয়েছে। গল্পের সময়কাল শুরু হয়েছে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালরাতের পর, যা মুক্তিযুদ্ধের সূচনা মুহূর্ত। স্থানের উল্লেখ হিসেবে নাসিরনগর নামক মফস্বল এলাকার ব্যবহার দেখায় যে যুদ্ধ শুধু ঢাকা বা বড় শহরে সীমাবদ্ধ ছিল না, তা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছিল। ২. ঘটনারাজি ও থিম গল্পের মূল ঘটনাগুলো সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে: হানাদার বাহিনীর অত্যাচার: মওলানা সাহেবকে (আলীমের বাবা) ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি পাক-হানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতন ও বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রতীক। গেরিলা যুদ্ধ: আলীম ও রতনের মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়া এবং রেল সেতু ধ্বংস করার অভিযানটি ছিল গেরিলা যুদ্ধের একটি চিত্র, যা মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের অন্যতম প্রধান কৌশল ছিল। স্বাধীনতা ও আত্মত্যাগ: মওলানা সাহেবের মতো অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, গল্পটি শেষে সেই সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ৩. উপসংহার গল্পটি আবেগের মাধ্যমে দেখিয়েছে কীভাবে সাধারণ মানুষের জীবনে যুদ্ধের প্রভাব পড়েছিল এবং কীভাবে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের দেশের পতাকা উড়িয়েছিল। এটি শুধুমাত্র একটি যুদ্ধের গল্প নয়, এটি স্বাধীনতার জন্য বাঙালির সর্বাত্মক সংগ্রাম ও বিজয়ের গল্প, যা এটিকে বিষয়ের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত করে।

১৭ নভেম্বর - ২০২৫ গল্প/কবিতা: ২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“ ” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ , থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী