অঘোষিত বীরাঙ্গনার অকাল প্রয়াণ

মুক্তিযুদ্ধ (ডিসেম্বর ২০২৫)

খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি
  • 0
  • 0
পুব দিগন্তে ভোরের আকাশটা ফরসা হতে না হতেই জেগে উঠে পুটির মা। রাতের দীর্ঘ আয়েশ কাটিয়ে গোটা দুই হাই তুলে চোখ কচলাতে কচলাতে উঠোনে এসে দাড়ায়। ঝাপসা চোখে চেয়ে থাকে বাড়ির দক্ষিণ কোণা বরাবর উন্মুক্ত পাথারের দিকে।
না আজও ধান কাটার কনোও আলামত চোখে পড়ছে না। কাঠ কয়লা মুখে পুরে চিবিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে উদাসীন হয়ে ভাবতে থাকে।

আর কদিন বাদে ঈদ। ছেলে মেয়েদের জন্য নতুন কাপড় কিনে দেবার কনোও সাধ্য নেই তার। আছে শুধু এক রাশ স্মৃতিময় অতীত। কিছুটা আনমনা হয় পুটির মা। ভাবতে থাকে তারও একদিন স্বামী ছিল, ঘর ছিল, গোলা ভরা ধান ছিল, সংসারে সুখ ছিল। কিন্ত ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ অন্যের জমির ধান কুড়াতে তীর্থের কাকের মতো দিন গুনতে হচ্ছে তাকে। বাম হাতের সবকটি আঙ্গুল ভাজ করে গালে ঠেস দিয়ে দাওয়ায় বসে আবারও স্মৃতির সাগরে ভেসে যায় সে। কেন জানি আজ পুরানো দিনের কথা পুটির মার খুব বেশী করে মনে পড়ছে।

মুক্তি যুদ্ধ চলাকালীন সেই সময়ের কথা। স্বামী তজুমুদ্দিন মেম্বার মুক্তি বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। গভীর রাতে প্রায়ই মুক্তি যোদ্ধারা আসত মেম্বার বাড়িতে। নিজের হাতে ভালমন্দ রান্না করে রাত বিরেতে ওদের খেতে দিতো পুঁটির মা। পেটের সন্তানের মত করে ওদের যত্ন আত্তি করতো। অস্ত্রসস্ত্র গোলা বারুদ সব গুছিয়ে রাখতো। সময় মত সেগুলো আবার ঠিকঠাক তুলে দিতো মুক্তি যোদ্ধাদের হাতে হাতে। তারপর দু’হাত তুলে ওদের বিজয় সাফল্যের জন্য দোয়া করত।
তরুণ মুক্তি যোদ্ধারা তাকে শ্রদ্ধা ভরে ‘মা’ সন্মধন করে ডাকতো। ওরা দশ মায়ের দশ সন্তান হলেও আসলে পুঁটির মা ছিল একজন জাতীয় বিবেকের মা।

সেদিন টিপটিপুনি বৃষ্টি ঝরা কৃষ্ণপক্ষ রাত ছিল। গোটা গ্রামের মানুষ তখন গভীর ঘুমে অচেতন। রাতের মধ্য প্রহরে হঠাৎ কুকুরের ঘেউ ঘেউ প্রতিবাদী কন্ঠ কানে ভেসে আসতেই আচমকা ঘুম ভেঙ্গে যায় পুঁটির মার। নীরব রাতের অলস আঁধার ভেদ করে হঠাৎ কলিম রাজাকারের কন্ঠ ভেসে আসে কানে।
.ঃ মেম্বর সাব বাড়িতে আছেন নাকি..? মেম্বর সাব..ও মেম্বর সাব....?
আজানা আশঙ্কায় অন্তরটা কেঁপে ওঠে ওর। স্বামীকে ফিসফিস করে গায়ে ধাক্কা দিয়ে ডাকতে থাকে। তজুমুদ্দিন মেম্বার ঘুমের ঘোরে হকচকিয়ে চোখ মেলে তাকায়। সহসা কিছু বুঝে উঠতে না পেরে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকে। বাইরে কারা জেনো তাকে ডাকছে বিষয়টা সাংকেতিক ভাষায় স্বামীকে বুঝিয়ে বলে পুঁটির মা।

ঘটনা আঁচ করতে পেড়ে চমকে ওঠেন তজুমুদ্দিন শেখ!! মনে মনে ভাবেন আজ তার বাড়িতে মুক্তি বাহিনীর কোন কর্মসূচী নেই! তা ছাড়া খবর না দিয়ে মুক্তি বাহিনীর কনো গ্রুপের এভাবে আসার কথাও নয়। এরা তবে কারা....? সাথে সাথে থার্ড আম্পায়ারকে ডিসিশন নিতে বলেন। থার্ড আম্পায়ার অর্থাৎ তৃতীয় নয়ন নার্ভাস সিসটেমে শত্রুর গন্ধ ছড়িয়ে মস্তিস্কে ঘোর বিপদের সংকেত পাঠায়।

আবার কলিম রাজাকারের কন্ঠ ভেসে আসে। আৎকে ওঠেন তজুমুদ্দিন শেখ!! আর দেরি নয় এখনই সেভ এক্সিট নিতে হবে তাকে। বাড়ির পেছন দিকে বড়াল নদী। বিপদ আপদের জন্য ঘাটে সব সময় নৌকা বাধা থাকে। অন্ধকারে চুপি চুপি এগিয়ে যান তিনি সেই দিকে। নদীর ঘাটে পৌছে নৌকাতে উঠতে যাবেন ঠিক এমন সময় পেছন থেকে ভরাট কন্ঠে কে একজন বলে ওঠে...
ঃ হ্যান্ডস আপ। আর যায় কোথায়....চারিদিক থেকে পাক সেনারা ঘিরে ধরে তাঁকে। উপায়ান্তর না দেখে বাধ্য হয়ে সেদিন আত্ম সমর্পন করতে হয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার তজুমুদ্দিন মেম্বারকে। কলিম রাজাকারের সহযোগীতায় মিলিটারীরা ক্যাম্পে নিয়ে যায় তাকে। সেই যাওয়াই যাওয়া আর কখনো তিনি ফিরে আসেন নাই।

মুক্তি যোদ্ধার কমান্ডার ছিলেন বলে আক্রশটাও ছিল খুব বেশি। জমি জিরাত ঘর বাড়ি ভিটা মাটি সব গ্রাস করে তবেই খান্ত হয়েছিল ওরা। স্বাধীনতার পর সময়ের চাকায় অনেক দিন গড়িয়ে যায়।
কিছু দিন পর দেশটা আবার চলে যায় অনিশ্চয়তার দিকে। স্বামীর অবর্তমানে অনেক কষ্ট করে ছেলে মেয়ে দুটোকে পুটির মা অনেক প্রতিকুলতার মধ্য দিয়ে মুক্তি যুদ্ধের চেতনায় বড় করে তোলে। মুখে জয়বাংলা আর বুকে সাহস নিয়ে বেচে থাকার মত দেশ প্রেম দিয়ে ওদের মানুস করে তুলেছে সে।

প্রতি বছর গ্রামে বিজয় দিবসের মেলা বসে। বিজয় মেলায় পতাকা কিক্রি করে ছোট ছেলে জয়নাল। আর সেই জন্যই কিছু পুঁজি চাই, তাই আগে থেকে প্রস্তুতি নেয়া। মাঠে ধান কুড়িয়ে পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে কিছু টাকা আয় করা যায়।
এ ছাড়া ফি-বছর আনাজ পাতি হাস পুরগীর ডিম বিক্রি করে পুটিরমা অনেক কষ্টে সংসার চালিয়ে মেলার উদ্দেশ্যে বাড়তি কিছু টাকা গুছিয়ে রাখে। এমনি কিছু টাকা কাপড়ের পুটলিতে পেচিয়ে মাটির দেয়ালের ফোকলে রেখে দিয়েছিল পুটির মা। কিন্তু সেদিন ফোকলে হাত ঢুকিয়ে টাকার পুটুলিটাকে আর খুঁজে পায় না সে। আসঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠে তার। উচ্চস্বরে বড় মেয়ে পুটিকে ডাকতে থাকে।

ধান কুড়াতে ডালি কোদাল গোছগাছ করছিল বড় মেয়ে পুঁটি। মায়ের ডাকে দৌড়ে এসে ঘরে ঢোকে। দেয়ালের ফোকলে হাত ঢুকিয়ে জিনিসটা খুঁজতে থাকে। কিন্তু কিছুতেই তা খুঁজে পায়না, বাধ্য হয়ে কোদাল দিয়ে দেয়ালটা কোপাতে থাকে। অবশেষে পুটলিটা এক সময় বেড় করতে সক্ষম হয় পুটি। অথচ আশার বালু চরে আবারও হতাশা। পুটলি খুলে মা মেয়ে উভয়ের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। ১০০ টাকার তিন তিনটে গোটা নোট কুটি কুটি করে কেটে রেখেছে ইঁদুরের দল। কপালে হাত দিয়ে দাওয়ায় বসে ডুকড়ে কেঁদে উঠে পুঁটির মা।

কান্না শুনে ছোট ছেলে জয়নাল দৌড়ে আসে। ঘটনা দেখে শুনে মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলে সে। টাকার ছিন্ন ভিন্ন অংশ গুলো আঠা দিয়ে জোড়া লাগাবার ব্যার্থ চেস্টা চালায় কিন্তু সম্ভব হয়ে উঠেনা। ইঁদুরের উপর ভীষণ রেগে গিয়ে প্রতিহিংসায় মনটা বিদ্রোহী হয়ে উঠে জয়নালের। কাল বিলম্ব না করে বড় বোন পুটির হাত টেনে ডালি কোদাল নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ে মধ্য পাথারের দিকে।

পুটি কামলাদের পিছু পিছু পড়ে থাকা ধানের শীষ কুড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ওদিকে জয়নাল কোপাতে শুরু করে ইঁদুরের গর্ত সনাক্ত করে। কিছুক্ষণের মধ্যে ইদুরের গর্তে থেকে থরে থরে সাজানো ধানের শীষ গুলো তুলে আনতে থাকে অতি সন্তর্পণে।
পান্তা বেলায় পুটির মা পাথারে এসে ধান সংগ্রহের অগ্রগতি দেখে অনেকটা উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। তারপর ছেলে মেয়েদের পান্তা খেতে দেয়। ছেলে মেয়ে দুটো পান্তা খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

ইতোমধ্যে বড় একটা ইদুরের গর্ত বেছে নিয়ে খুরতে থাকে পুটির মা। খুরতে খুরতে এক সময় দেখতে পায় অনেক গুলো ধানের শীষ গর্তে জমানো রয়েছে। খুশীতে মনটা নেচে ওঠে তার। উৎফুল্ল পুটির মা এবার অভাবী হাতটা বাড়িয়ে দেয় ইদুরের গর্তে। আর তখনই ইদুরের গর্তে লুকিয়ে থাকা গোখরো সাপটা ফোঁস ফোঁসিয়ে ছোবল মারে পুটির মার কব্জিতে। তৎক্ষণাৎ ও মাগো বলে পুটির মা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
ছেলে মেয়ে দুটো পান্তা খাওয়া ছেড়ে দৌড়ে মায়ের কাছে আসে। মায়ের নিথর দেহ দেখে ডুকরে কেদে উঠে ওরা। সহসা কান্নার রোল পড়ে যায় মধ্য পাথারে।

জয়বাংলা ধ্বণী শক্তির উৎস আর চেতনার মুলমন্ত্র। বিপদে কখনো শক্তি হারাতে নেই। মায়ের শেখানো কথা গুলো জয়নালের মনে পড়ে যায়। মায়ের লাশকে সামনে রেখে কন্ঠ চড়িয়ে এবার জয়নাল জয় বাংলা বলে অবিরাম ধ্বণী দিতে থাকে। সাথে সাথে সেই জয় বাংলা ধ্বণী আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করে প্রতিধ্বণীত হতে থাকে। অতঃপর পাথারের চার পাশ থেকে হাজার হাজার পতাকাবাহী কল্পিত চেতনার লাশ দৌড়ে আসতে থাকে পুটির মার লাশের পাশে একজন অঘোষিত বীরাঙ্গনার অকাল প্রয়াণে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

পুব দিগন্তে ভোরের আকাশটা ফরসা হতে না হতেই জেগে উঠে পুটির মা।

১৯ আগষ্ট - ২০২৫ গল্প/কবিতা: ৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“ ” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ , থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী