যুদ্ধের শিশু

স্বাধীনতা (মার্চ ২০২৫)

পল্লব শাহরিয়ার
  • 0
  • 0
১.
রাতটা ছিল নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেওয়ার মতো। চারদিকে ঘন অন্ধকার, কিন্তু সেই অন্ধকারের ভেতরেই ছড়িয়ে পড়ছিল ভয়, আগুনের শিখা, ধ্বংসের শব্দ। ঢাকা শহর কখনো এত ভয়াবহ রাত দেখেনি।
রেহানা ছুটছিলেন।
তার গায়ে একটা ময়লা শাড়ি, পায়ের নখ পর্যন্ত কাঁপছে ভয়ে। কিন্তু থামার উপায় নেই। পেছনে, শহরের গলিতে, একের পর এক গুলি চলেছে—একেকটি শব্দ মানেই হয়তো কারও প্রাণ নিভে যাওয়া। তার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে রফিক, তার স্বামী। তারা জানে, এই শহর আর নিরাপদ নয়। পেছনে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। গন্ধটা চেনা হয়ে গেছে—পোড়া মাংস আর বারুদের গন্ধ।
"আর একটু, রেহানা! আর একটু সামনে গেলে আমরা নিরাপদ!" রফিক ফিসফিস করে বলেন, যেন তার কণ্ঠস্বরও মৃত্যু টেনে আনতে পারে।
কিন্তু রেহানা জানে, এই শহরে এখন আর কোনো 'নিরাপদ' জায়গা নেই। তার পেটে ব্যথা শুরু হয়েছে কিছুক্ষণ ধরে। শিশুটির জন্ম হবার কথা ছিল আরও দুই সপ্তাহ পর, কিন্তু আজকের রাতেই যদি সব কিছু শেষ হয়ে যায়? তার শরীরের ভেতর এখন দুটো যুদ্ধ চলছে—একটা বাইরের, একটা তার নিজের ভেতরে। একটা গলি পার হতে না হতেই গুলির শব্দ।
রফিক থমকে দাঁড়ান, আর পরের মুহূর্তেই ধপ করে পড়ে যান রাস্তায়। রেহানা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে দেখতে পায়, রফিকের বুকের মাঝখানে একটা গুলি লেগেছে। তার মুখ হাঁ হয়ে আছে, চোখ বিস্ময়ে স্থির হয়ে গেছে।
"না!" সে ঝাঁপিয়ে পড়ে, কিন্তু রফিক তখনো ফিসফিস করে বলেন, "পালাও, রেহানা… ছেলেটাকে নিয়ে… পালাও…" তারপর তার চোখ নিভে যায়।
রেহানা চিৎকার করতে পারে না। ওপাশে সৈন্যরা এগিয়ে আসছে। পেটের ভেতর তীব্র ব্যথা নিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। সে জানে, এখন কান্নার সময় নয়। সে শুধু ছুটতে থাকে, অন্ধকারের দিকে, এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে
০২.
রেহানা ছুটছিলেন। চারদিকে শুধু আগুনের ছায়া, ধোঁয়া, আর ভয়ার্ত মানুষের ছুটোছুটি। রাস্তাগুলো ছিল শূন্য, কিন্তু বাতাসে ভেসে আসছিল চাপা কান্না আর গুলির শব্দ। তিনি জানতেন, এই শহরে আর কোথাও আশ্রয় নেই।
হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন একটা ভাঙাচোরা বাড়ি—দেওয়ালের রঙ চটে গেছে, জানালাগুলো ভাঙা, এবং আশেপাশে কেউ নেই। তার শরীরের ভেতর ধকধক করছে ব্যথা, যেন প্রতিটি পা ফেলার সাথে সাথে এক অদৃশ্য ছুরি তার শরীরের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। তিনি দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন। অন্ধকার। মেঝেতে ধুলোর আস্তরণ জমেছে, কোথাও একটা ইঁদুর ছুটে গেল। কোনো শব্দ নেই। শহরটা যেন হঠাৎ এক শ্মশানে পরিণত হয়েছে।
তার পেটে আবার ব্যথা উঠল। তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে মেঝেতে বসে পড়লেন। তার গায়ে এখনো রফিকের রক্ত লেগে আছে। তবে চোখের পানি ফেলার সময় নেই। শরীরের প্রতিটি স্নায়ু যেন চিৎকার করে উঠছে, সে বুঝতে পারছে, শিশুটি আসতে চাইছে। কিন্তু চারপাশে কেউ নেই, কেউ সাহায্য করতে পারবে না। তার নিশ্বাস দ্রুত হয়ে আসছে। "হে আল্লাহ… হে আমার বাংলাদেশ… এই যন্ত্রণা তুমি আমাকে কেন দিচ্ছ?" আকাশে তখনো আগুনের লাল আভা। তারপর, সেই ভয়াবহ নীরবতার মধ্যে, শিশুটি জন্ম নিলো।
কিন্তু শিশুটি কাঁদল না। শুধু দুটো ছোট ছোট চোখ মেলে তাকিয়ে রইল। বাইরে তখনো গুলি চলছে, শহর জ্বলছে, আর ধোঁয়ার গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। মা অবাক হয়ে দেখলেন, তার সন্তান কাঁদছে না কেন? শিশুটি কি ভয় পেয়ে গেছে? নাকি এই পৃথিবীতে আসার মুহূর্তেই বুঝে গেছে, তার প্রথম কান্নার শব্দই হয়তো মৃত্যুর ডাক হয়ে যাবে?
০৩.
রেহানা হাঁপাচ্ছেন। শরীরটা নিস্তেজ হয়ে এসেছে, চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। তিনি হাত বাড়িয়ে শিশুটিকে কোলে নিলেন।
শিশুটি এখনো কাঁদেনি।
বাইরে তখনো গোলাগুলির শব্দ হচ্ছে, মাঝে মাঝে কারও চিৎকার ভেসে আসছে, কিন্তু এই ঘরটার ভেতর সবকিছু থমকে গেছে। যেন এই পরিত্যক্ত বাড়ির দেয়াল জানে, এখানে এক নতুন প্রাণ এসেছে—একটি শিশু, যে যুদ্ধের মাঝে জন্ম নিয়েছে, যে তার প্রথম শ্বাসটাও নিয়েছে ধোঁয়ার গন্ধ মিশ্রিত বাতাসে।
রেহানা কপালে ঘাম মুছলেন। শিশুটির ছোট ছোট হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আছে, তার চোখ দুটো বড় বড়, গভীর—একজন সদ্যজাত শিশুর চোখ এত শান্ত কেন? তিনি শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। এই শিশুটির বাবা আর নেই। এই দেশটাও আর আগের মতো নেই। কিন্তু এখনো সূর্য ওঠেনি, এখনো রাত শেষ হয়নি। হঠাৎ তিনি বুঝতে পারলেন, তাকে এখান থেকে বের হতে হবে।
এই ঘর তাকে লুকিয়ে রেখেছিল কিছুক্ষণের জন্য, কিন্তু সৈন্যরা এলে এই ছোট্ট আশ্রয় আর থাকবে না। তিনি উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু তার শরীরের শক্তি নিঃশেষ হয়ে এসেছে। তবুও তাকে যেতে হবে। শিশুটিকে আঁচলের ভাঁজে জড়িয়ে নিয়ে তিনি দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন। শহর স্তব্ধ হয়ে আছে। রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মৃতদেহগুলোও যেন তাকিয়ে আছে তার দিকে, ফিসফিস করে বলছে—"পালাও। পালাও।"
রেহানা আস্তে আস্তে দরজা খুললেন। তারপর, এক হাতে দেয়াল ধরে, অন্য হাতে শিশুটিকে বুকে চেপে, তিনি আবারও ছুটতে শুরু করলেন। এইবার শুধু নিজের জন্য নয়, তার সন্তানের জন্যও।
০৪.
রেহানা ছুটছেন, কিন্তু শরীর আর দিচ্ছে না। পা দুটো যেন পাথরের মতো ভারী হয়ে গেছে, দৃষ্টিটাও ধোঁয়াটে হয়ে আসছে। শিশুটি নীরব, ঠিক যেন রাতের মতো।
ঢাকার এই গলিগুলো তার চেনা। একসময় বিকেলে হাঁটতে বের হলে, এই পথ দিয়ে হেঁটে রফিকের সঙ্গে ফিরতেন। রাস্তায় চা-দোকানের সামনে লোকজন জড়ো হয়ে কথা বলত, দেশ নিয়ে, মুক্তি নিয়ে। এখন সেই দোকান নেই, শুধু পোড়া কাঠ আর ছাই পড়ে আছে। সামনে অন্ধকার গলি। তারপর, একটা শব্দ। পায়ের আওয়াজ।
রেহানা দ্রুত দেয়ালের গায়ে চেপে দাঁড়ান, নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফেলেন। সেনাদের দল শহরের ভেতর ছড়িয়ে পড়ছে, যারা এখনো বেঁচে আছে তাদের শেষ করতে।
কোথায় যাবেন? তিনি জানেন না। শুধু জানেন, তাকে যেতেই হবে। তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে যান, দেয়ালের ছায়ার ভেতর দিয়ে। হাতে শক্ত করে ধরে আছেন শিশুটিকে, যেন তার শরীরের উষ্ণতায় তাকে ঢেকে রাখতে পারেন। হঠাৎ দূর থেকে ভেসে আসে এক নারীর চিৎকার— "আমার ছেলেকে ছেড়ে দাও! আল্লাহর দোহাই, ও ছোট একটা বাচ্চা!"
তারপর এক প্রচণ্ড শব্দ। চিৎকার থেমে যায়। রেহানার সমস্ত শরীর শিউরে ওঠে। তার বুকের ভেতর একটা বরফের স্রোত নেমে আসে। এই শহরে কেউ আর শিশুদের কান্নার শব্দ শুনতে চায় না। সে আরও দ্রুত এগোতে থাকে। একসময় একটা পুরোনো মসজিদের কাছে এসে থামেন তিনি। জায়গাটা অন্ধকার, চারদিকে ভাঙা ইট পড়ে আছে। তিনি বুঝতে পারেন, এই জায়গাটা এখনো সৈন্যদের নজরে আসেনি। তিনি ধীরে ধীরে বসে পড়েন, দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে। তার শ্বাস দ্রুত হচ্ছে, শরীর অবশ হয়ে আসছে। তবে শিশুটিকে দেখেই যেন তিনি আবার শক্তি ফিরে পান।
সে এখনো কাঁদেনি।
তার চোখের দিকে তাকিয়ে রেহানা ফিসফিস করে বলেন, "তুই বুঝতে পারিস না মা? কান্না কর, একটু কাঁদিস। তোকে আমি এই ভয়াবহ পৃথিবীতে আনতে চাইনি, কিন্তু তুই এসেছিস। এখন তুই অন্তত একটু জানিয়ে দে, তুই বেঁচে আছিস।"
শিশুটি তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখ যেন প্রশ্ন করে—"তুমি কি পারবে আমাকে নিয়ে বাঁচতে?" রেহানা জানেন না। শুধু জানেন, ভোর আসতে এখনো অনেক দেরি। আর রাতটা এখনো শেষ হয়নি।
০৫.
রেহানা দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছেন, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। পুরো শরীর ক্লান্ত, মাথার ভেতর যেন শূন্যতা। কিন্তু তার কোলে যে ছোট্ট প্রাণ, তাকে নিয়েই তাকে এগোতে হবে। শিশুটি নীরব, একেবারেই শব্দহীন। যেন এই শহরের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে জন্ম নিয়েই বুঝে গেছে, এই পৃথিবীতে কাঁদা মানেই বিপদ ডেকে আনা।
রেহানা জানেন না কতক্ষণ এভাবে বসে ছিলেন। তারপর দূর থেকে শোনা যায় বুটের আওয়াজ। সেনারা কাছাকাছি। তার আর বসে থাকার উপায় নেই। তিনি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ান, কোমর সোজা করতে গেলে ব্যথায় মুখ বিকৃত হয়ে যায়। কিন্তু এখন ব্যথার কথা ভাবলে চলবে না।
শিশুটিকে শক্ত করে আঁচলের ভাঁজে জড়িয়ে তিনি মসজিদের পাশের গলিপথ ধরে এগিয়ে যান। গলিটা সরু, দুই পাশের বাড়িগুলো ধ্বংসস্তূপের মতো পড়ে আছে। হয়তো এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই কোথাও তিনি নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারবেন। চারপাশে নীরবতা।
শুধু মাঝে মাঝে আগুনের টুকটাক শব্দ, দূরে কারও গোঙানির আওয়াজ। তিনি হঠাৎ থমকে দাঁড়ান। সামনে পড়ে আছে একটা মৃতদেহ। বয়স বিশ-বাইশ হবে, মুক্তিযোদ্ধা বলেই মনে হয়। তার হাতে এখনো একটা রক্তমাখা দা ধরা, গায়ে বুলেটের ছিদ্র, রক্ত মাটির সঙ্গে মিশে কালচে হয়ে গেছে। রেহানা চোখ সরিয়ে নেন। তারপর আবার হাঁটতে থাকেন।
গলির এক কোণায় একটা বাড়ির দরজা হালকা খোলা। এতক্ষণে তার শরীরের সব শক্তি শেষ হয়ে আসছে। এখানে যদি একটু লুকাতে পারেন! তিনি আস্তে আস্তে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকেন। ঘরটা অন্ধকার, কিন্তু যেন কোনোভাবে এখনো টিকে আছে।
"কে?"
হঠাৎ এক ফিসফিসে কণ্ঠস্বর শোনা যায়। রেহানার দম বন্ধ হয়ে আসে। তিনি পেছনে ফিরে যেতে চান, কিন্তু ততক্ষণে একজন ছায়ার মতো মানুষ বেরিয়ে আসেন। একজন বৃদ্ধ, হাতে একটা লাঠি, চোখে গভীর দুশ্চিন্তা। তিনি ধীরে ধীরে বলেন, "তুমি ভয় পেয়ো না মা। আমি তোমাকে আঘাত করব না।" রেহানার চোখ ছলছল করে ওঠে। "আমি… আমি শুধু একটু আশ্রয় চাই। আমার বাচ্চাটা…"
বৃদ্ধ এক মুহূর্ত চুপ থাকেন, তারপর আস্তে করে বলেন, "ভেতরে এসো, মা।"
রেহানা জানেন না এই মানুষটি কে, তবে এখন তার আর কোনো বিকল্প নেই। তিনি ধীরে ধীরে ভেতরে যান। বাইরে তখনও বুটের আওয়াজ, আগুনের গন্ধ। এই শহর ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এই ছোট্ট ঘরটার ভেতর তিনি হয়তো একটুখানি সময় পাবেন, একটু বিশ্রাম, একটু আশ্রয়। কিন্তু এই আশ্রয় কি সত্যিই নিরাপদ? তিনি জানেন না। শুধু জানেন, রাতটা এখনো শেষ হয়নি।
০৬.
রেহানা ঘরে ঢোকেন, কিন্তু ভেতরের অন্ধকার যেন আরও বড়। তিনি এক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন, যেন চোখ সয়ে যাক, যেন তার কানে পৌঁছায় এই ঘরের গাঢ় নীরবতা।
বৃদ্ধ তাকে ইশারা দিয়ে আস্তে আস্তে সোজা করে বসতে বললেন। রেহানা জানেন, এতটুকু সময় পেলে হয়তো কিছুটা শান্তি পাবে। পায়ের নিচে ছোট্ট একটা কুশন ফেলা, গা ঘেঁষে সেঁটে বসে সে শিশুটিকে বুকের সাথে আরো শক্ত করে চেপে ধরে।
বৃদ্ধ খুব আস্তে হাঁটলেন এবং আলো জ্বালালেন। সেদিকে একটু মলিন উজ্জ্বলতা। আর কিছুক্ষণের মধ্যে, ঘরটায় এক হালকা আলো ছড়িয়ে পড়ল। "নাম কী তোমার, মা?" বৃদ্ধটির কণ্ঠে এক ধরনের গাঢ় মায়া ছিল, যে মায়া রেহানার কাছে জীবনের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। "রেহানা।" তিনি খুব সাবধানে উত্তর দিলেন। "তোমার ছোটটা? নাম কী?"
"আজকের আগে তো তাকে নামই দেওয়া হয়নি।" রেহানার চোখে অশ্রু জমে উঠে। "এখনও জানি না, এই শহরের মধ্যে কতজন মা সন্তানের জন্য নাম রাখতে পারবে?" বৃদ্ধ নিঃশব্দে মাথা নেড়ে হালকা কাঁপছেন। "তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো। এখানে যতদিন ইচ্ছা থাকতে পারো। তবে সাবধান, বাহিরে যেও না। তারা এই এলাকা ছাড়বে না।"
রেহানা জানেন, কিন্তু কিছু বললেন না। তার কিছু করার ক্ষমতা নেই। শহর ভেঙে পড়েছে, যুদ্ধ চলছে, মনের মধ্যে এক বিরাট শূন্যতা, যা এই পৃথিবীর যেকোনো কিছুর থেকে বড়। কিছু সময় কাটানোর পর, বৃদ্ধ তাকে আরো কিছু খাবার দিলেন। ধীরে ধীরে রেহানা অল্প একটু খাবার খেতে শুরু করলেন, আর শিশুটির জন্য একটু গরম দুধ।
তিনি নিজের চোখে চেয়েছিলেন জীবনের ছোট্ট সুন্দর মুহূর্তগুলো, যেমন দুধের গরম গন্ধ, শিশুর গাঢ় নিঃশ্বাস। কিন্তু এক অদৃশ্য ভয় তার মনে বাসা বেঁধেছে, যেন প্রতিটি শ্বাসে মৃত্যুর গন্ধ।
"এখন তুমি কোথায় যাবে?" বৃদ্ধের প্রশ্ন। রেহানা মাথা তুলে তার দিকে তাকালেন। "আমি জানি না," সে বলল, "আমার পেটের ভেতর একটা ভয় আছে, আর এই ভয় আমার পিছু ছাড়বে না। আমি কোথাও যাব না।" বৃদ্ধ তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, "এই শহরের মাঝে তুমি যদি কিছু হারাতে চাও, তবে আর কিছু না, তোমার নিজের হারানোটা বেশি বড় হবে। সাবধান থেকো, মা। এই শহরটা কাউকে বাঁচতে দেবে না।"
কথাগুলো মনে করিয়ে দেয়, যে শহরটা, যার কোলাহল একসময় তার প্রাণে চিরকালীন আনন্দ এনে দিয়েছিল, এখন সেই শহর তাকে প্রাণ হারানোর মুখে দাঁড় করিয়েছে। হঠাৎ, কিছু আওয়াজ শোনা গেল—একটা গুরুতর শব্দ। তখন রেহানা দৃষ্টি ফেরালেন, একটি বিকট আওয়াজ বাইরে শোনা গেল।
"এটা কী ছিল?" রেহানার গলা দিয়ে স্বর বের হলো না। বৃদ্ধ কিছু বললেন না, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। কিছু সময় পর, বাইরে যে আওয়াজ ছিল তা আরও কাছাকাছি এল। কোনও রকমের ভয়াবহ কিছু আসছে। হয়তো সেনারা কিছু খুঁজছে। রেহানা এক নিমেষে শিশুটিকে কোলে তুলে নিলেন। বৃদ্ধ তাকে কিছু বললেন না, কিন্তু তার চোখের ভাষা বলেছিল— "এটা তোমার যুদ্ধ, রেহানা।" কোথায় যাবে? আর কী করতে হবে? এটি কেবল তারই সিদ্ধান্ত।
০৭.
রেহানা চুপচাপ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন, শিশুটিকে কোলে শক্ত করে চেপে ধরে। বাইরে থেকে গুলির শব্দ আসছে, একে একে এগিয়ে আসছে সেনাদের দল। তারা জানে না এই ঘরটি কোনো আশ্রয়স্থল, তারা জানে না, এখানে একজন মা আর তার সন্তান অবাঞ্ছিতভাবে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু রেহানা জানে, যদি কিছু করতে না পারে, তবে এই শান্ত ঘরটা তাদের শেষ আশ্রয় হয়ে যাবে।
বৃদ্ধের কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না, সে যেন মনের মধ্যে কোনো গভীর চিন্তা ভাবনায় ডুবে আছেন। তার চোখে গভীর চিন্তা ছিল—সে হয়তো জানে, রেহানা আর শিশুটিকে এক মুহূর্তের জন্যও নিরাপদ থাকতে দেবে না এই শহর। "তোমাদের চলে যেতে হবে, মা।" বৃদ্ধ এক সময় আস্তে করে বললেন। রেহানা তার দিকে তাকালেন, তার চোখের মধ্যে প্রশ্ন—"কীভাবে?"
বৃদ্ধ এক মুহূর্ত চুপ থেকে আবার বলতে লাগলেন। "তারা এই আশ্রয় জানে না, কিন্তু জানো, এখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না। সেনারা কিছু একটা জানলে, এখানকার সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। তুমি বের হয়ে যাও, কোনও রাস্তা খুঁজে বের করো।" রেহানা কোনো কথা না বলে মাথা নেড়ে তাকে বুঝিয়ে দিলেন। তিনি জানতেন, সময় শেষ হয়ে এসেছে।
রেহানা আর শিশুটি কাঁপছে, কিন্তু এখন আর কোনও ভয় নেই। ভেতরের দরজাটি চুপিসারে খুলে দিয়ে, রেহানা আবারও গলিপথে নামলেন। গলির প্রান্তে ছায়া মিশে গিয়েছে, যেন পৃথিবী তাদের চোখে অদৃশ্য হয়ে গেছে। শহরের এই বেঁচে থাকার যুদ্ধ, এই পালানোর যুদ্ধ, সবই এখন অবধি তাদের জন্য এক দীর্ঘ যন্ত্রণা। কিন্তু এখন আর পিছনে ফেরা যাবে না। গলি ধীরে ধীরে আরও গভীর হয়ে উঠছে, ছায়াগুলি তাদের আশ্রয় হিসেবে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ, সামনে কিছু আলো দেখা গেল, যেন সেখানে কেউ দাঁড়িয়ে। রেহানা তার দিকে তাকালেন, কিন্তু সে ব্যক্তিটি চেনা ছিল না।
সে ব্যক্তি হাঁটতে শুরু করলেন, রেহানার কাছাকাছি আসতে লাগলেন। "আমার নাম আলি। আমি মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। এই শহরে অনেক কিছুই ঘটে, তুমি যদি নিরাপদ থাকতে চাও, তবে তোমার উচিত আমার সঙ্গে চলা।" রেহানা একটু অবাক হলেন।
এই কথায় যেন একটা আলোর ঝলক রেহানার মনে প্রবাহিত হলো। শিশুটির জন্য, তার নিজের জন্য, নতুন জীবন, নতুন আশ্রয়। রেহানা বুঝতে পারলেন, এখন তাকে আলির সঙ্গে যেতে হবে।
০৮.
রেহানা আলির পেছনে পা রেখে চলছিলেন, তার শরীর থেমে থেমে বাঁচানোর লড়াই করছে। শিশুটি এখনো তার কোলেই, শান্ত, যেন কিছুই জানে না। আলি সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, গলির অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার মতো চুপচাপ।
বাড়ির ভেতরে ঢুকে, রেহানা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। ঘরের ভেতর কিছু মানুষ ছিলেন, বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। এককথায় বলা যায়, তারা মুক্তিযুদ্ধের শেষ বাকি সৈনিকদের মতো, যারা এখনো শহরের অন্ধকার কোণায় বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। তারা জানতেন, স্বাধীনতা হারানোর পথ অনেক দীর্ঘ, কিন্তু হাল ছাড়েননি।
"এটা তোমাদের আশ্রয়," আলি বললেন, রেহানাকে ঘরের এক কোণে বসিয়ে। "এখানে তোমরা সুরক্ষিত থাকবে, তবে যুদ্ধ এখনো থেমে যায়নি।"
রেহানা তাকিয়ে দেখলো। এই জায়গাটা এক অদ্ভুত শান্তি দিয়েছে, কিন্তু তার মন স্থির হয়নি। ঘরের মধ্যেও কেমন যেন কিছু একটা নাই। তার সামনে যে এই পৃথিবী খুলে যাচ্ছে, সেখানে কেবল মৃত্যুর মুখ, ধ্বংসের ভয়ে তাকে পথ চলতে হবে—এটা তার মনে রয়ে গেল।
"এখানে কতদিন থাকতে হবে?" রেহানা জিজ্ঞেস করলেন।
আলি চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপর বললেন, "এটা তোমাদের নিজেদের হাতে। তুমি এখানে সুরক্ষিত থাকতে পারো, কিন্তু একদিন তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—তুমি কী চাইবে, স্বাধীনতা, নাকি শুধু বেঁচে থাকা?"
রেহানা মাথা নিচু করে ভাবতে লাগলেন। স্বাধীনতার সেই আকাঙ্ক্ষা, সেই দিনের যুদ্ধে তার পিতামাতার শত্রু হয়ে ওঠা, সেই সব স্মৃতি তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। কিন্তু তাকে ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল, এই শহরের মধ্যে এখন নতুন এক যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।
এক সপ্তাহ পার হলো, রেহানা এবং শিশুটি আলির এই গোপন আশ্রয়ে থাকতে শুরু করলেন। এখানে তারা সুরক্ষিত ছিল, কিন্তু শান্তির অস্থিরতা রেহানাকে কখনো ছেড়ে যায়নি। তিনি জানতেন, এখন তার সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় চলে এসেছে। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত কী হবে? একদিন আলি তাকে ডেকে বললেন, "আজকে রাতে কিছু একটা ঘটতে চলেছে। সেনারা আমাদের কাছে আসছে। তাদের ঠেকাতে আমাদের কিছু করতে হবে।" রেহানা শ্বাস টেনে বললেন, "তাহলে, আমাদের কি যুদ্ধ শুরু করতে হবে?" আলি তাকে এক দৃষ্টিতে দেখলেন। "না। আমাদের যুদ্ধ ততটা সহজ না। তবে যদি তোমরা চাও।
রেহানা জানতেন, সে এখন মুক্তিযোদ্ধাদের পথে হাঁটবেন। তাকে নিজের সন্তানকে নিরাপদ রাখতে হবে, কিন্তু সেই সঙ্গে তাকে দেশের জন্য কিছু করতে হবে।
০৯.
একদিন গভীর রাতে, আলি রেহানাকে নিয়ে এক গোপন স্থানে পৌঁছালেন। এটি ছিল এক পুরনো মাটির ঘর, যেখানে আরও কয়েকজন বিদ্রোহী ছিলেন। তাদের চোখে ছিল এক ধরনের দৃষ্টি—একসঙ্গে লড়াইয়ের প্রস্তুতি, আর এই যুদ্ধ থেকে মুক্তির এক স্বপ্ন।
"তোমরা এখানে নিরাপদ থাকবে," আলি বললেন, "কিন্তু এটা মনে রেখো, সেনারা তোমাদের খুঁজতে আসবে। এর জন্য আমাদের নিজেদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।"
রেহানার মনে ভয়, কিন্তু আশাও ছিল। এখানে আসার পর, সে বুঝতে পেরেছিল, শুধু তার সন্তানই নয়, এ শহরের প্রতিটি মানুষই এই লড়াইয়ের অংশ। এটা শুধু জীবনের জন্য নয়, এটি দেশ ও স্বাধীনতার জন্য। যতদিন যাচ্ছে, রেহানা বুঝতে পারছে, এই যুদ্ধ একেবারে অন্য রকম—এখানে শুধুই বাঁচার যুদ্ধ নয়, এটি নিজের পরিচয়, নিজের অস্তিত্বের যুদ্ধ।
রেহানা, আলি, এবং তার সহযোদ্ধারা একসঙ্গে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাদের অস্ত্র ছিল না, তবে ছিল এক ধরনের অদম্য ইচ্ছা—এক অঙ্গীকার যে তারা তাদের দেশের জন্য যেকোনো মূল্য দিতে প্রস্তুত। "আমরা আমাদের শহরকে মুক্ত করব," আলি একদিন রেহানার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন। "আমরা জানি, আমাদের কাছে সামরিক শক্তি নেই, কিন্তু আমাদের কাছে একটা জিনিস আছে—এটা হল মনোবল।"
রেহানার চোখে অদ্ভুত এক দৃঢ়তা ছিল। "তুমি ঠিক বলছ। আমরা যদি একে অপরকে সাহায্য না করি, তবে এই শহর কখনোই মুক্ত হবে না।"
শহরের রাস্তাগুলো আজ এক ভিন্ন দৃশ্য। সেনাদের বিপুল সংখ্যক সৈন্য শহরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে, কিন্তু রেহানার বিশ্বাস ছিল, বিদ্রোহীরা অন্তত তাদের মুক্তির জন্য একযোগভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে। আলি ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা তাকে নির্দেশ দিলেন, "আজ রাতেই আমাদের শেষ সুযোগ, রেহানা। এই যুদ্ধ শুধু শহরের জন্য নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বের জন্য।"
১০.
রেহানা, আলি এবং তাদের সহযোদ্ধারা একত্রিত হয়ে সেনাদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আক্রমণ শুরু করল। রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ, গুলি, বিস্ফোরণ—যুদ্ধের দৃশ্য ছিল ভয়ঙ্কর, তবে তাদের আশা একেবারে মুছে যায়নি। বিদ্রোহীরা একসাথে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে শুরু করে। রেহানা জানত, যদি তারা এই মুহূর্তে পরাস্ত হয়, তবে শহর হারাবে, তবে এই যুদ্ধে তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল একতাবদ্ধতা।
যুদ্ধের শেষে, শহরের একটি বিশাল অংশ মুক্ত হয়ে যায়। রেহানা এবং তার সহযোদ্ধারা তাদের সংগ্রামের ফলাফল দেখেন—সেনারা শহর ছেড়ে চলে যায়, আর মানুষের মুখে আসে স্বাধীনতার সুর। তবে, এই বিজয়ের মধ্যে একটি ব্যথাও ছিল—যুদ্ধে অনেকেই প্রাণ হারিয়েছিল, অনেকেই তাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছিল।
রেহানা শিশুটিকে কোলে তুলে, শহরের রাস্তায় হাঁটতে থাকে। তার হৃদয়ে এক মিশ্র অনুভূতি—দুঃখ, তৃপ্তি, আশা, ভয়। আজ তাদের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনা গেছে, কিন্তু এই যুদ্ধের জন্য অনেক কিছুই ত্যাগ করতে হয়েছে।
শেষে, রেহানা শহরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, নতুন সূর্যোদয়ের দিকে তাকালেন। তার শিশুটি কোলের মধ্যে শান্ত, যেন জানে—আজ থেকে তার পৃথিবী নতুন হয়ে উঠেছে। রেহানা জানত, এই শহর এবং দেশের মুক্তি একদিন পৃথিবীজুড়ে আলো ছড়াবে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

রাতটা ছিল নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেওয়ার মতো।

২০ জানুয়ারী - ২০২৫ গল্প/কবিতা: ১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“ ” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ , থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী