আশ্রয়

গ্রাম-বাংলা (নভেম্বর ২০১১)

আনিসুর রহমান মানিক
  • ৩৯
  • 0
চাচার হঠাৎ আগমনে সবাই একটু অবাকই হয়।যদিও ফোন করেই এসেছেন তবুও সবাই ভাবেন কেনইবা চাচা গ্রামে এসেছেন!
বাবা বলেন,হয়তোবা জমিজমার ভাগ নিতে কিংবা অন্য কোন উদ্দেশ্যও থাকতে পারে।
মা বলেন,ওনার বাবার বাড়ি উনিতো আসবেনই।
-কিন্তু এতদিনতো আসেননি ?
-সেজন্য যে আর আসবেননা তাতো নয়।
হ্যা মার কথায় যুক্তি আছে। বিশাল ভাবে।
কিন্তু যে চাচা গ্রামকে পছন্দ করেননা সেই চাচা কোন কারন ছাড়াই গ্রামে আসছেন এটা বিশ্বাস করা কষ্টকর।ঢাকার অভিজাত এলাকার বিশাল বাড়ি ছেড়ে গ্রামে এসে থাকবেন এটা কল্পনাতেই মানায়।
চাচা ঢাকায় বড় চাকরী করেন।গুলশানে বিশাল বাড়ি।চাচা পাঁচ বছর আগে শেষ এসেছিলেন যখন দাদু মারা যান।এরপর পাঁচ বছর আর এমুখো হননি। তবে বিশাল কিংবা তাদের সাথে যোগাযোগ হত না তা নয়।এমনকি তাদের যে অবহেলা করতেন সেটাও নয়।বিশাল যখন এসএসসি পাশ করল ভাল ফল করে তখন কাদের চাচা তাকে ঢাকায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সেখানে ভাল কলেজে ভর্তি করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। নিজের কাছে রেখে পড়াতে চেয়েছিলেন।কিন্তু বাবা রাজি হননি।বিশালেরও যেতে ইচ্ছে করেনি।তার প্রিয় গ্রাম ছেড়ে,বন্ধুদের ছেড়ে শহরে যেতে মন চায়নি।
বাবার প্রচন্ড আপত্তি ছিল।এমনকি দাদুরও।দাদু বলেছিলেন ও গ্রামের ছেলে,গ্রামে থেকেই মানুষ হবে।গ্রামেই চাকরী করবে। না হয় জমি চাষ করবে।শহরে যাবার দরকার নাই।
দাদুর একটা দুঃখবোধ ছিল।আর সেই দুঃখবোধ থেকেই ক্ষোভের সাথে কথাগুলো বলেছিলেন।বাবাকে বলেছিলেন সাবের তুই বিশালরে শহরে যাইতে দিস না।
দাদুর এই ক্ষোভের কারন সবাই বুঝতে পেরেছিল।তাই বিষয়টা সেখানেই থেমে গিয়েছিলো।বিশালকে আর শহরে যেতে হয়নি।গ্রামে থেকেই পড়াশুনা শেষ করে বেসরকারী কলেজে শিক্ষকতা করছে।বিয়েও করেছে গ্রামের এক মেয়েকে।চার বছরের কন্যা সন্তান নিয়ে তাদের সুখের সংসার।
চাচা এখনো বলেননি কেন এসেছেন। দুদিন হয়ে এলো। এ দু"দিন গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছেন।গ্রামের মানুষগুলোর সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলেছেন।চাচা আর তার দশ বছরের নাতি পাভেলকে নিয়ে গ্রাম ঘুরে বেড়িয়েছে বিশাল।
আড়ালে আবডালে কানাঘুষা চলতে থাকে চাচা নির্বাচনে দাঁড়াবেন নাতো!
মানুষের ধারনাকে অমূলক বলা ঠিক হবেনা। আসলেইতো মানুষের টাকা হলে মানুষ সম্মান কিনতে চায়।চাচার চাকরী আর এক দেড় বছর রয়েছে।হয়তো সে কারনেই গ্রামে আসা।চাকরী শেষে নির্বাচনে দাঁড়াবেন।
এর আগে চাচাকে কখনো গ্রামে এভাবে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়নি।তাই সবার উৎসুক্য বেশী ছিল।আর থাকবেইনা বা কেন!
যে মানুষটি ভার্সিটিতে পড়তে গিয়ে ভুলে গেল তার গ্রামকে।ভুলে গেল তার ভালবাসার মানুষটিকে যাকে সে স্বপ্ন দেখিয়েছিল তাকে নিয়ে ঘর বাঁধার।সেই মানুষটিই আজ এতদিন পর গ্রামে এসে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে,সবাইকে আপন করে নেয়ার চেষ্টা করছে।
-বিশাল , গ্রামটা অনেক বদলে গেছে।
চমকে জবাব দিয়ে উঠে বিশাল-জ্বী ,তাই।
-আমাদের সেই গ্রামটা এখন আর নেই।বেশ আফসোসের সুরেই কথাটা বলেন চাচা।
কোন জবাব দেয়না বিশাল।তার ইচ্ছে করেনা এ বিষয় নিয়ে চাচার সাথে কথা বলতে।যেদিন সে জেনেছিল চাচা শহরে পড়তে গিয়ে তার প্রেমিকা সুমিকে ভুলে গিয়ে ভার্সিটির একটা মেয়েকে ভালবেসে ,বড়লোকের সেই মেয়েটিকে বিয়ে করে ঢাকায় থেকে গিয়েছিলেন ,সেদিন থেকেই চাচার প্রতি কেমন যেন একটা ঘৃণার জন্ম হয়েছিল।চাচী শহরের মেয়ে বলে যে খারাপ তা কিন্তু্তু নয়।অনেক ভাল।
বাবার,দাদুর তখন থেকেই একটা দুঃখবোধ,ক্ষোভ রয়ে গেল চাচার প্রতি ।তাই গ্রাম নিয়ে চাচার এই অতিউৎসাহ, আলোচনায় তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ জন্মেনা।
সে নিজেই প্রশ্ন করে চাচা হঠাৎ এতদিন পর গ্রাম নিয়ে এত কথা বলছেন ?
-বলতে পারিস নষ্টালজিয়ায় পড়ে গেছি।এখন বয়স হয়েছে-----
-চলেন চা দোকানটায় গিয়ে বসি।
-চল।

-আমার চাচা।
-স্লামালাইকুম। দোকানদার চাচাকে সালাম দেয়।
-ভাবতে ভালোই লাগছে,চায়ের দোকানে এখন স্যাটেলাইট চলে এসেছে। সেই চিরচেনা গাঁ এখন আর নেই।চাচা দোকানের সামনে রাখা বেঞ্চিতে বসতে বসতে বলেন।
-হ ঠিকই বলেছেন। দোকানদার গল্প জুড়ে দেয় চাচার সাথে।

রাতে চাচা তার ঘরে ডাকেন বিশালকে।ঘরে বাবা বসে আছেন।
চাচা বলতে থাকেন,বাবা শোন,আমাদের নিজস্ব কোন কবরস্থান নেই। বাবার কবরটা অযত্নে পড়ে আছে। গোরস্থানটার বেড়া ভেঙ্গে আছে। আমি চাইছি আমাদের জন্য ক"টা কবর কিনে রাখতে। মানুষকেতো মরতে হয়। আমাদেরও মরতে হবে।তাই কবরস্থানের কয়েকটা কবর আমরা কিনে রাখি। যত টাকা লাগে দেয়া হবে। তুই কবরস্থানের কমিটির সাথে কালকে আমার যোগাযোগ করিয়ে দিস।
এবার বুঝতে পারে বিশাল চাচা কেন এসেছেন গ্রামে।কখনো চাচার মুখের উপর কোন কথা বলেনি।আজও বলতে পারল না। শুধু আস্তে করে বলল,চাচা এখানে তো কবর বিক্রি হয় না।
-আমিতো কবরের জায়গা কিনতে চাই।বিক্রি হয়না ,এখন হবে। যাতে আমাদের ভবিষ্যত বংশধররা মাঝে মাঝে এসে আমাদের কবর জিয়ারত করে যেতে পারে।তাতে ওদের, আমাদের কবর খুঁজে পেতে সহজ হবে।তারপর একটু থেমে চাচা বলেন,তোরা না থাকলেতো বাবার কবরটা খুঁজে পেতাম না। মার কবর যে কোনটা ছিল সেটাও সহজে চেনা যায়না। কত কবর পড়েছে মার কবরের উপর----
বাবা মুখ খুললেন,কেন কাদের,শহরে কবরের জায়গা বিক্রি হয়না?
-হ্যা হয়।সবাই কিনে রাখে। সেজন্যইতো শহরে পাওয়া কষ্টকর।আর যদিও পাওয়া যায় দাম অনেক বেশী।আর এমনি কবর দেয়ার জায়গাইতো সহজে পাওয়া যায়না।যে যেখানে পাচ্ছে কিনে রাখছে।
এ বিষয়ে আর কথা বলতে মন চায়না বিশালের।সে সেখান থেকে উঠতে নেয়।
চলে যাচ্ছিস যে-----
ঘুমুতে যাবো ঘুম ধরেছে।
তারপর একটু থেমে বলে,কাল আপনাকে কমিটির সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিব।

আশ্চর্যজনকভাবে চাচার প্রস্তাবে কমিটির সদস্যরা দু"ভাগে ভাগ হয়ে গেল।
একপক্ষ চাইল কবরস্থানের জায়গা বিক্রি করতে।অন্য পক্ষের মত হল কবরের জায়গা কোন ব্যক্তি বা পরিবারের কাছে বিক্রি করা যাবেনা।
বিক্রির পক্ষে যারা তারা বলতে চাইলেন উনি যেহেতু টাকা দিতে চাচ্ছেন সেই টাকা দিয়ে মসজিদ সংস্কার করা যাবে,মসজিদের উন্নয়ন হবে।কবরস্থানের পাকা বাউন্ডারী দেয়া যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
অন্য পক্ষের বক্তব্য না এ কবরস্থানের কবরের জায়গা কারো নামে বরাদ্দ দিয়ে জায়গা কমানো যাবেনা।এখানে ধনী গরীব সবার সমান সুযোগ থাকবে।
সর্বসম্মত কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারেনা কমিটি।বেশ হতাশ হয়ে পড়েন চাচা।আদরের নাতিকে নিয়ে দু"জনের যে উদ্দ্যেশ্যে গ্রামে আসা তা বাস্তবায়ন করতে না পারায় অনেকটাই মনোকষ্ট পান তিনি।


চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন চাচা। বাবা বলেন,কাদের তোর শহরে জায়গা না হলে তুই জানবি তোর গ্রামে তখনো আশ্রয় হবে।

চাচা যাওয়ার সময় কমিটির সদস্যসহ গ্রামের অনেকেই আসে চাচাকে বিদায় জানাতে।চাচা এগিয়ে যান কমিটির সদস্যদের কাছে।
চাচা বলতে থাকেন,আপনাদের কি সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত করেছেন সেটা আমি আর জানতে চাইনা।আমি আসলেই ভুল করেছি। আমায় ক্ষমা করবেন। আমি যান্ত্রিক শহরে থেকে সবকিছুই অর্থ দিয়ে কিনতে চেয়েছিলাম।
আমি বুঝতে পেরেছি ভালবাসা অর্থ দিয়ে কেনা যায়না।গ্রামের মানুষের ভালবাসা কখনো ফুরোয় না। আমি মসজিদ ও কবর স্থানের উন্নয়নের জন্য ভাইজানের কাছে কিছু টাকা দিয়ে গেলাম।ওগুলো দিয়ে সেসবের উন্নয়ন করবেন।
কমিটির সভাপতি বলেন,আপনি এ গ্রামের ছেলে। যে কোন অবস্থায় আপনার আশ্রয় না হলে ছুটে আসবেন এ গাঁয়ে।এ গ্রামে আপনার কখনো আশ্রয়ের অভাব হবেনা।গ্রামের মানুষগুলো এখনো অতিথিপরায়ন। আপনি চাইলে আপনার মৃতু্যর পর এই কবরস্থানে আপনাকে আশ্রয় দেয়া হবে,না না সেজন্য আপনার কবর কিনে রাখবার প্রয়োজন নেই।
চাচা বললেন আমার মৃতু্যর পর আমাকে এই গ্রামেই শেষ আশ্রয় দিয়েন শুধু এটুকুই অনুরোধ রইল।
আশ্রয়ের প্রতিশ্রূতি পেয়ে চাচা ছুটে চললেন শহরের উদ্দেশ্যে। চোখদুটো তার জলে ভিজে উঠছে।একটুক্ষনের জন্য হলেও তার মনে অপরাধবোধ জেগে উঠল।গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়ে সত্যিই তিনি ভুল করেছিলেন।তার সেই সহজ সরল গাঁয়ের মানুষের ভালবাসা পেয়েও ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন।আপনমনেই তিনি বলে ওঠেন,আমি আসছি অতি শীঘ্রই চিরকালের আশ্রয় নিতে,আশ্রয় পেতে তোমাদের মাঝে,আমার শৈশব কৈশোরের প্রিয় গাঁয়ের মাঝে।

গ্রামের রাস্তার ধুলো উড়ছে। গাড়ীর জানালার কাঁচ নামিয়ে দেন তিনি।
গ্রামের ধুলো শরীরে মাখতে দেন।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আনিসুর রহমান মানিক যারা কষ্ট করে লেখাটি পড়েছেন ,মন্তব্য করেছেন তাদের সবার প্রতি রইলো আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ / আসুন আমরা গ্রামকে ভালবাসি ,দেশকে ভালবাসি /
আনিসুর রহমান মানিক ইফতেখারুল ইসলাম ,আপনাদের ভালবাসায় আমি অভিভূত /এর বেশি কিছু বলতে পারলামনা / ধন্যবাদ কষ্ট করে লেখাটি পরবার জন্য /
ভূঁইয়া মোহাম্মদ ইফতেখার সূর্য ভাই যেটা বললেন আমিও সে ব্যাপারে একমত- আপনার লেখাটি এবারের বিষয়ের আলোকে শ্রেষ্ঠ লেখা। গল্পটিতে অতিরঞ্জিত কিছু নেই, সমসাময়িক গ্রাম-বাংলার বাস্তবসম্মত রূপায়ণ। লেখায় ভোটিং বন্ধ বলে খুবই খারাপ লাগছে। তবে কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ থাকবে সংকলনে আপনার লেখাটি যেন স্থান পায়।
আনিসুর রহমান মানিক ধন্যবাদ বন্ধু তোমাদের ,কষ্ট করে লেখা পরেছ ,মন্তব্য করেছ /
সালেহ মাহমুদ UNION ALL SELECT NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL# ভাই আনিসুর রহমান মানিক, অনেক সুন্দর গল্প | বর্ণনায় অতিরঞ্জিত কিছু নেই | মেদহীন এমন গল্পই তো চাই | ধন্যবাদ আপনাকে |
বিষণ্ন সুমন আসলে শেকড়ের টান যে কেও অস্বিকার করতে পারেনা গল্পটিতে তার'ই শিক্ষা পেলাম । অনেক ভালো লাগলো গল্পটি ।
খোরশেদুল আলম অনেক আবেগ আর শরীরে গ্রামের ধুলা মাখানো সুন্দর একটি গল্প, খুব ভালো হয়েছে।
প্রজাপতি মন অনেক ভালো লাগলো, অন্তত মৃত্যুর জন্য হলেও তিনি গ্রামে ফিরতে চেয়েছেন।।
নিলাঞ্জনা নীল মানুষ আজকাল আবেগ অনুভুতিগুলো অর্থ দিয়ে কিনতে চায়........... কিন্তু শেকড় কে ছেড়ে থাকা যায় না ফিরে আসতেই হয়......... ভালো লাগলো..
ডাঃ সুরাইয়া হেলেন ভালো লাগা রেখে গেলাম ।ভোট বন্ধ রেখেছেন,তাই প্রাপ্যটা দিতে পারলাম না ।শুভকামনা লেখক ।

২০ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৪০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“মে ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ মে, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী