চাষার ছেলে

গর্ব (অক্টোবর ২০১১)

আনিসুর রহমান মানিক
  • ৪৯
  • 0
নিঝুম রাতের জ্যোৎস্না ছড়ানো রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে লাশবাহী গাড়ি।সাথে পুলিশের একটা ভ্যান। সূর্য ওঠার পরপরই হয়তো পৌছে যাবে গন্তব্যে গাড়িটি। মফস্বল শহরের অজ পাড়াগাঁয়ের এক চাষার বাড়িতে লাশটি পৌছে দেয়া হবে।সেই গায়ের গর্ব অপু এর লাশ তার বাবামার কাছে হস্তান্তর করা হবে। তাদের গর্বের দাফন হবে। আকাশে চাঁদ উঁকি দিচ্ছে।ঘুম আসছে না। ঘুম আসার কথাও নয়। লাশের সাথে থাকলে কারই বা ঘুম আসে।আমারও আসছে না।কোন এক অপরাধবোধ আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। জানিনা কি সে অপরাধ। সেটা কি আমি সাংবাদিক বলে!নাকি অপুর সাথে পূর্বে পরিচয় হয়েছিল বলে।

এরকমই দুবছর আগে অপুর সহযাত্রী হয়েছিলাম। ট্রেনে বসে পরিচিত হয়েছিলাম সদ্য কৈশোর পেরোনো উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা অপুর সাথে।তখনও তার শরীর থেকে গ্রামের মেঠো গন্ধ দুর হয়নি।শ্যামলা রঙের মায়াবী চেহারার ছেলে।দেখলে যে কারোরই মায়া জন্মাবে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি শেষে তার গ্রামের বাড়ি ফিরছিল।আমি অন্য একটা এ্যাসাইনমেন্টে সৈয়দপুর যাচ্ছিলাম।
নিজে থেকেই প্রশ্নটা ছুড়লাম-তুমি কি পড়?
-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গিয়েছিলাম।
মনে মনে ভাবলাম, উত্তরটা কেমন হলোনা ? সেতো বলতে পারতো অনার্স প্রথম বর্ষে,তা না বলে কোথায় ভর্তি হল পুরোটাই জানিয়ে দিল। বলবেই না বা কেন?প্রাচ্যের অক্সোসফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,সবাই তো আর চান্স পায়না!এরকম একটা গর্বের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পেরে সে নিশ্চয়ই গর্ব করতে পারে।
-তোমার নাম?
-অপু।
-তোমার বাবা ? পাশের লোকটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বললাম।
-না,উনি আমার স্যার।
-স্লামালুইকুম।
ভদ্রলোকটির পোশাক আশাক অনেকটা সেকেলের শিক্ষকের মত।
-উনি আমাকে ভর্তি করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন।
আমি আমার পরিচয় দেই।শফিকুল ইসলাম,সংবাদকর্মী।
-তোমার বাবা?
-আমি চাষার ছেলে।
কথাটি কি অহংকার নিয়ে বলল,নাকি বিনয়ের সাথে বলল অপু ঠিক বিশ্লেষণ করতে পারলাম না।
আমি শুধু বললাম,তাই! কোন বিষয়ে ভর্তি হলে?
-বায়োকেমিস্ট্রি।
আমি অবাক হয়ে গেলাম,অজ পাড়াগাঁয়ের একটা ছেলে এত ভাল বিষয়ে পড়বে কি করে!তার মেধা নিয়ে প্রশ্ন না হলেও সন্দেহ রয়ে গেল।এত কঠিন বিষয় সেকি ভাল করতে পারবে।
তার শিক্ষক গল্প জুড়ে দিলেন। তার কাছ থেকেই জানা গেল,সে গ্রামের স্কুল থেকে জিপিএ ৫ পেয়ে এসএসসি পাশ করেছে।গ্রামের কলেজ থেকেই একা জিপিএ ৫ পেয়েছে।স্যার বলেন,তাকে নিয়ে আমরা গর্ব করি। ও যে আমাদের স্কুলের,কলেজের সর্বব্যাপী গায়ের গর্ব।বড় বড় শহরের নামকরা স্কুল কলেজ মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভর্তি করিয়ে তাদের ভাল ফলাফলে গর্ব করে।আমাদের শ্রম সার্থক,ভাল ছাত্র তৈরি করতে পারে গ্রামের এসব প্রতিষ্ঠান। অপু আমাদের গর্ব।আনন্দে চোখে জল চলে আসে অপুর শিক্ষকের।




-সাধারণত দেখা যায় ভাল ফলাফল করলে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়,আর তুমি কিনা------জবাবের অপেক্ষায় চেয়ে থাকি অপুর দিকে।
মিষ্টি হেসে অপু জবাব দেয়,হ্যাঁ চায়,কিন্তু আমার কাছে এই সাবজেক্টটাকে ভালো মনে হয়েছে।এ বিষয় নিয়ে পড়ে গবেষণা করতে চাই।দেশের কাজে লাগাতে চাই।
আমি অবাক হয়ে ভাবি অজপাড়াগায় থেকে এ স্বপ্ন দেখাও কি সম্ভব ? কে এই স্বপ্ন দেখিয়েছেন?
অপু বলে আমার স্যার,তিনি শুধু আমার স্কুল শিক্ষকই নন ,তিনিই আমার পথপ্রদর্শক।স্যার আমাদের সময় নিয়ে স্কুল ছুটির পরও পড়াতেন। না কোচিং নয়,আমরা যাতে ভাল ফল করতে পারি সেজন্য বিনা খরচে আমাদের সময় দিতেন।
শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে আসে।শহরে যেখানে অধিকাংশ শিক্ষক কোচিং, টিউশনি পড়িয়ে টাকার পাহাড় গড়ছেন, শিক্ষাকে ব্যবসার পণ্য হিসেবে বিবেচনা করছেন সেখানে এসব শিক্ষক আছেন বলেই এখনো অপু এর মত ছেলেরা লেখাপড়া শিখতে পারছে মানুষ হতে পারছে।

গাল গড়িয়ে চোখের জল পড়তে থাকে আমার।পকেট হতে রুমাল বের করে রুমাল দিয়ে চোখের পানি মুছি।কিভাবে গিয়ে দাঁড়াবো শ্রদ্ধেয় সেই শিক্ষকের সামনে। অপুর প্রিয় শিক্ষকের কাছে অপুর লাশ নিয়ে দাঁড়াবো।যে শিক্ষক একদিন যাকে দেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন তাকে কি করে সেই প্রিয় ছাত্রের লাশ ফিরিয়ে দেব।
অপু কোন রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের সাথে জড়িয়ে গিয়েছিল কিনা জানা যায়নি। কিংবা জড়িয়ে গেলেও তার সাথে যতটুকু মিশেছিলাম তাতে এটা নিশ্চিত করে বলা যায় সে বাধ্য হয়েছিল জড়িয়ে পড়তে। নোংরা অসুস্থ রাজনীতির কারণে এসব মেধাবী শিক্ষার্থীরা পদে পদে বিপথে যাচ্ছে।বিপথগামী করা হচ্ছে।হল দখল,সিট দখল কর্তৃপক্ষের সামনেই চলছে।যেন চর দখলের প্রতিযোগিতা।দলীয় ক্যাডারের সমর্থনপুষ্ট না হলে হলে সিট মেলে না।আরও কত কি!
সে হলে সিট পেয়েছিল কিনা ঠিক জানা হয়নি।এরপর আর অপুর সাথে যোগাযোগ করা হয়নি। অপু সন্ত্রাসী কিনা সেটাও জানিনা।গ্রামের হত দরিদ্র এক চাষার ছেলে ভাল ফলাফল করে সন্ত্রাসী হওয়ার জন্য নিশ্চয়ই শহরে আসবে না।

অপুর বাসায় গিয়েছিলাম। ওর বাবার সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। তার বাবার সাথে অনেক কথা হয়েছিল। তার বাবার স্বপ্নের কথা জেনে অবাক হয়েছিলাম।অশিক্ষিত চাষি হয়ে তার ছেলেকে নিয়ে কতইনা তার স্বপ্ন। ছেলে অনেক বড় হবে,দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে।ইচ্ছে ছিল অপু আর বাবাকে নিয়ে একটা ষ্টোরী লিখব।
অপু তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,আমার বাবা আমার গর্ব।বাবা কষ্ট করে আমায় মানুষ করে তুলেছেন।কি কষ্টই না করছেন।বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলে অপু।
বাবা তার ছেলের চোখ মুছে দিয়ে বলেন,হ্যাঁ বাবা একদিন তোকে নিয়ে যেন সবাই গর্ব করতে পারে সেদিন আমার পরিশ্রম সার্থক হবে।আমার ভার লাঘব হবে।
চোখ মুছে নেই আবার।ঘড়িতে সময় দেখি রাত চারটা। কফিনের দিকে তাকাই। কাঠের তৈরি কফিন। ভারতো হবেই। কিন্তু বাবার কাঁধে সন্তানের লাশের ভার কোন কিছুর চাইতেই কম নয়।যতদিন বেঁচে থাকবেন অপুর বাবা তার সে ভার কখনোই আর লাঘব হবেনা।
একটু একটু করে আলো হতে শুরু করেছে। নিউজ কভার করতে সাথে পাঁচজনের সাংবাদিকের একটা দল।আমি অপুর স্কুল দেখেছি,স্যারকে দেখেছি তার গায়ের মানুষগুলোকে দেখেছি । অনুভব করতে পারি কতইনা কষ্ট বুকে নিয়ে তারা অপেক্ষা করছে। ওদের প্রিয়,এ গায়ের গর্ব অপুর জন্য। না ঠিক হলো না, অপুর লাশের জন্য।

কোন অনাকাঙ্ক্ষিত, বিশৃঙ্খলা হবে নাতো!সে ভয় তো আমাদের নয়। তার জন্য রয়েছে পুলিশ।সাথেই তো আছে এক ভ্যান পুলিশ।না কোন ভিআইপির লাশ যাচ্ছে বলে নয়। যাতে কোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয় সেজন্য পুলিশি পাহারা। কেননা তার মৃত্যু যে স্বাভাবিক নয়। তার মৃত্যুতে কি রাষ্ট্রের কোন ভূমিকা নেই?
গ্রামের কাছাকাছি চলে এসেছি। দূর থেকে স্কুল মাঠে ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ওখানেই লাশ নামানো হবে।
সূর্য ওঠে গেছে। গ্রামে সব ঘরে ক্যাবল সংযোগ আছে কিনা জানিনা। তবে অপুর বাড়িতে টিভি ছিল না। আজকের পত্রিকা গ্রামে এসে পৌছুবার আগেই অপুর লাশ চলে আসে।শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে পুরো গ্রাম। পরিবেশ ভারী হয়ে উঠে। প্রস্তুতি চলে গাঁয়ে,গর্বের লাশ দাফনের।


পরিশিষ্ট: আজকের পত্রিকার অন্য অনেক খবরের সাথে গুরুত্বসহ ছাপা হয় খবরগুলো-

# ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠনের দু"দল গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে এক ছাত্র নিহত,আহত ত্রিশ।

# র‍্যাবের কথিত ক্রসফায়ারে একজনের মৃত্যু।

# ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনিতে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যু।

এই তিনটি ঘটনার যে কোন একটির শিকার এই গল্পের অপু। অকালে ঝড়ে যাওয়া কিংবা ঝড়ে ফেলা আমাদের দেশের সম্পদ যাকে নিয়ে গর্ব করতে পারত এ দেশ সেই অপু। আমরা শুধু এটুকুই বলতে পারি, অপু আমাদের ক্ষমা করো। আমরা তোমায় বাঁচাতে পারিনি। আর যেন কোন অপুকে এভাবে অকালে,অস্বাভাবিকভাবে মরে যেতে না হয়।যাদের নিয়ে এদেশ গর্ব করতে পারে তাদের আমরা আর কিছু দিতে না পারি শুধু বাঁচতে দেই। বাঁচার অধিকারটুকু দেই।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আনিসুর রহমান মানিক অনেক ধন্যবাদ বন্ধু তোমাদের -মৌসুমী ,Khondaker Nahid Hossain ,dr.suraiya helen .
ডাঃ সুরাইয়া হেলেন বাস্তব একটি কষ্টকর চিত্র তুলে এনেছেন লেখায় ।কোথাও থামতে হয়নি,সচল গতিসম্পন্ন ঝরঝরে লেখা ।আপনার লেখার হাত শুধু ভলো নয়,খুব ভালো!চর্চাটা আশা করি রাখবেন।ভবিষ্যতের এক মেধাবী গল্পকারকে পাবো আমরা।শুভকামনা ।
খন্দকার নাহিদ হোসেন অনেক সুন্দর একটা গল্প। বিষয়টার জন্য লেখক কে সাধুবাদ জানাই। লেখার হাতও ভালো। শুধু "অপুর বাসায় গিয়েছিলাম" লাইনটিতে বাড়ি শব্দটা দিলেই হয়তো ভালো হতো কারণ জায়গাটা অজ পাড়াগাঁ। যাইহোক বেশ লাগলো গল্পটি।
রোদের ছায়া দেশের বর্তমান পরিপেক্ষিতে সুন্দর গল্প.
আনিসুর রহমান মানিক আশা ,শেখ এ কে এম জাকারিয়া,Monir Khalzee ধন্যবাদ আপনাদের /আপনাদের বিশ্লেষনধর্মী মন্তব্য আমাকে ভালো লিখতে অনুপ্রেরণা যোগাবে /
মনির খলজি অপুর মত মেধাবী ছেলের অকাল মৃত্যু খুবই স্পর্শকাতর ও মর্মস্পর্শী দিক....রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে কতধরনের বিরম্বনা চলে ..... অপরদিক এদেশ এখন সম্পূর্ণ গোলামী মুক্ত হতে পারেনি ...পরাধীনতার জিনজির থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি .......সুন্দর উপস্থাপনায় একটা পরিনত লিখা ...ভালো লাগলো ....Biochemistry আমারও প্রিয় বিষয় ...শুভকামনা রইল !
আশা আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ যেন এখনো পরাধীনতার কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করতে পারেনি। আপনার অতন্ত সুন্দর উপস্থাপনায় আর দক্ষতায় ফুটিয়ে তোলা গল্পটিতে যেন তারই প্রমাণ মিলে। তা না হলে- জীবনকে গড়ার নেশায় মত্ত এক মেধাবী মুখ শিক্ষার উদ্দেশ্যে গিয়ে প্রাণ হারাবে কেন?
আনিসুর রহমান মানিক @খন্দকার আযহা সুলতান ,খোরশেদুল আলম ,মিজানুর রহমান রানা ,সেলিনা ইসলাম -ধন্যবাদ আপনাদের কষ্ট করে গল্পটি পড়েছেন বলে /
সেলিনা ইসলাম যাদের নিয়ে এদেশ গর্ব করতে পারে তাদের আমরা আর কিছু দিতে না পারি শুধু বাঁচতে দেই। বাঁচার অধিকারটুকু দেই। ---আমারও এটাই কামনা । সুন্দর সাবলিল গল্প । শুভকামনা !

২০ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৪০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী