কখনো ভেবেছো কি, এই শহরের মধ্যে
যানবাহন শুধু চলতে থাকে, কিন্তু চলার জায়গা কোথাও নেই?
একটি রাস্তা, হাজার হাজার গন্তব্য—
এদের কোনো শেষ নেই, না কোনো শ্বাস ফেলার সময়।
আকাশের দিকে তাকালে
একটি সূর্য উঠবে, কিন্তু ধূলির স্রোত
যতই বাড়বে, ততই অদৃশ্য হবে।
রাস্তা নয়, যেন এক স্রোত—
যানজটের অসীম ভিড়ে
যেমন নদীর জল থেমে যায়,
এভাবেই থেমে যায় স্বপ্ন, প্রতিটি চলন্ত দৃশ্য।
কতদিন ধরে এই পথে হাঁটছি,
কতদিন ধরে এই রাস্তা গুনছি!
গাড়ির হর্ন, মানুষের শোরগোল,
এগুলোই যেন আমার জীবনের সঙ্গী,
কিন্তু কখনও কি ভেবেছি,
এই গুনগুন, এই রাস্তায়,
আমাদের জীবন আসলেই কোথায় যাচ্ছে?
প্রতিটি গাড়ি মনে হয়,
একটি একক অস্তিত্ব,
একটি অন্ধকার গন্তব্যের দিকে চলতে চলতে,
অথবা রোদে পোড়া শহরের গায়ে
একটা ছোট ক্ষত চিহ্ন ফেলে যাচ্ছে।
এই নগরের ভেতর যে ক্ষীণ আলোটা,
সে আলো কি সত্যিই বাঁচাতে পারবে?
নাকি, একে একে সব গাড়ি মিলিয়ে যাবে
যানজটের এক অতৃপ্ত মগ্নতায়?
শুরুটা ছিল ঠিক যেমন,
যেমন আজও প্রতিদিন,
অফিস, বাজার, স্কুল, অথবা আড্ডা—
সব জায়গায় পৌঁছাতে,
সময়ের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
গাড়ি চলছিল একটানা,
খোলা জানালা থেকে ভেতরে আসছিল গরম হাওয়া,
সবাই দ্রুত পৌঁছানোর চেষ্টায়,
কিন্তু সেই পথের মাঝখানে
থেমে ছিল—একটি সারি গাড়ি,
একটি ক্লান্ত অস্থিরতার মাঝখানে,
যাতে থেমে যেতে হচ্ছিল, প্রতিটি যাত্রীকে।
যানজটের মাঝে কেমন এক নিরবতা—
শব্দের ক্লান্তি আর কোলাহল মিলেমিশে।
মনটা ক্রমশ বিষণ্ণ হয়ে উঠছিল,
কিন্তু বাইরে সেই একই ঘূর্ণি চলছিল।
সেই সিগনাল, সেই গাড়ির হর্ন,
সবই যেন নতুন এক দুঃস্বপ্নে পরিণত হচ্ছিল।
এই শহরের রাস্তাগুলোর মধ্যে,
আমরা যেন হারিয়ে যাচ্ছিলাম,
প্রত্যেকটি মুহূর্তে আরও দূরে,
আর একটি সিগনাল, আর এক সেকেন্ড।
মনের মধ্যে তখন চিন্তা আসছিল—
এই কি আমার লক্ষ্য?
এই পথটাই কি আমার ঠিকানা?
কত মানুষ, কত গাড়ি,
প্রতিটি মানুষের মধ্যেই
একটা গল্প, এক অবিরাম সঞ্চার—
কিন্তু এই শহরের ভিড়ে
কেউ কাউকে খুঁজে পায় না।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে,
মনটা স্থির হয়ে যায়,
যানজটের মাঝে আর কিছু মনে হয় না—
এক অন্ধকার সময়ের মধ্যে
অথবা এক নিঃশব্দ যুদ্ধের মাঝখানে
মানুষ কেন ছুটছে,
কী চাইছে তারা,
আমাদের সকলের কি আদৌ কোনও দিক আছে?
দূর থেকে আসছে বড় একটা ট্রাক,
তার পিছনে গাঢ় ধোঁয়া,
আকাশে গন্ধ আর অস্থিরতা।
রাস্তার ঠিক মাঝখানে,
যানজটের মাঝে,
সবাই যেন একে অপরকে ঠেলে চলে যাচ্ছে,
তবুও কোনো গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়।
একটু সামনে তাকিয়ে দেখি,
একটি মেয়ে রিকশায় বসে আছে—
তার মুখে এক তীব্র ক্লান্তি,
চোখে অদৃশ্য দুঃখ,
সেই রিকশাটা যেন থেমে গেছে,
আলগে আলগে, শান্ত, স্থির।
আমরা দ্রুত চলার জন্য সবকিছু ভুলে যাই,
কিন্তু আমাদের জীবন কোথাও থেমে থাকে—
রাস্তার অক্ষরে, যাত্রার প্রতিটা ভ্রমণে,
আমাদের আত্মা কোথাও আটকায়।
যানজটের মাঝে, এক টুকরো স্থিরতা—
যেখানে কেউ আর কারো দিকে তাকায় না,
সেখানে কিছুই শোনা যায় না।
আর শহরের পুরো ভিড়ে,
একটি ছোট শ্বাস ফেলার সময়ও
না থাকা,
মনে হয়,
আমাদের সবার জন্য এক অভিশাপ।
জানালা দিয়ে যখন আকাশ দেখা যায়,
তখন মনে হয়, আকাশটা কি আমাদেরই?
এটা কি এমন জায়গা যেখানে
কিছুটা শান্তি পাওয়া যায়,
না কি এই শহরের মধ্যে,
এই যানজটের মাঝে,
আমরা কখনোই পৌঁছাতে পারব না?
এভাবে, প্রতিদিন জীবনের পথে,
যানজটের মধ্যে,
আমরা সবকিছু ভেবে দেখি,
কিন্তু থেমে থাকা সময়ের মধ্যেই
আমরা হারিয়ে যাই।
বিধাতা আমাদের পথের মাঝখানে,
একটি সিগনাল তুলে ধরেন,
কিন্তু সেই সিগনাল কখনোই সবুজ হয় না।
অথবা আমাদের প্রত্যেকের জীবনের দিকে
যানজট যেন এক বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
একটি রাস্তা, হাজার প্রশ্ন—
কিন্তু কোন উত্তর নেই।
আমরা সবার জন্য, এই শহরের নাগরিক,
যারা প্রতিদিন এই একই পথ চলি।
সবাই দ্রুত পৌঁছাতে চায়,
কিন্তু কোথাও কিছুই পৌঁছাচ্ছে না,
হয়তো এখন, হয়তো কখনোই।
যানজটের এই নীরব অস্থিরতা
যতদিন আমরা এই শহরে থাকি,
এটা আমাদেরই অংশ হয়ে থাকবে।
একটি বাস্তবতা,
যা কখনো বদলাতে চায় না,
যেমন আমাদের নিজেদের অন্তর্গত যন্ত্রণা।
তবুও, গাড়ির হর্ন,
মানুষের হাঁটা,
রাস্তার কাঁপা,
এগুলোর মধ্যেই,
আমরা একে অপরকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করি—
আর থেমে যাওয়ার মুহূর্তে
একটি শান্তি,
একটি দাঁড়ানো,
যানজটের মাঝে,
যতটা হতে পারে।
এটা যেন শেষ হয় না,
কিন্তু আমরা একদিন—
একদিন, বুঝতে পারব,
যানজটের মধ্যে,
থামতে থামতে,
একবার শ্বাস ফেলা
প্রকৃত শান্তির মতো
একটি বিশাল অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে।