“আমি তৃষ্ণায় আকুল তোমার মুখের,
তোমার কণ্ঠস্বরের,
তোমার চুলের জন্য।
নিঃশব্দ ও ক্ষুধার্ত আমি ঘুরে বেড়াই পথে পথে।
শুধু খাদ্য আমাকে বাচিয়ে রাখতে পারে না,
প্রভাত আমাকে বিচলিত করে,
সারাদিন আমি খুঁজে বেড়াই তোমার পায়ের চিহ্ন ,
কতটুকু জলে তুমি পা ভিজিয়েছো ।
আমি তোমার মসৃণ হাসির জন্য ক্ষুধার্ত,
তোমার হাত যেন এক বুনো ফসলের রঙে রাঙানো,
তোমার নখের ফিকে পাথরের জন্য ক্ষুধার্ত,
আমি চাই তোমার ত্বক পুরো বাদামের মতো খেয়ে ফেলতে।
আমি চাই তোমার সুন্দর শরীরে জ্বলে ওঠা সূর্যরশ্মি আস্বাদন করতে ,
খেয়ে ফেলতে চাই তোমার অহংকারী মুখের সার্বভৌম নাক,
আমি চাই তোমার চোখের পলকের ক্ষণস্থায়ী ছায়া গ্রাস করতে,
আর আমি ঘুরে বেড়াই ক্ষুধার্ত হয়ে,
গোধূলির গন্ধ শুঁকে,
তোমাকে খুঁজি,
তোমার উষ্ণ হৃদয়ের জন্য,
যেন কুইত্রাতুর শূন্যতায় এক বাঘের মতো।”
― পাবলো নেরুদা
তমার সাথে রায়হানের দীর্ঘ ছয় বছরের রিলেশন এখন ঠিকানাবিহীন , গন্তব্যহীন । তমা ক্যান্সারে মারা গেছে অনেকবছর হয়েছে , কিন্তু সুর থেমে যায়নি , থামেনি ঝড় ও ,শুধু সময় বয়ে গেছে।
এখন নিস্তব্দ রাত , zero hour পার হয়েছে বেশ আগে , নিশাচর পাখিদের মতো স্মৃতিরা সব জেগে উঠেছে , নিউরনে বাসা বাধা অভিমান,অপমান আর হাওয়ায় মিঠের মতো ভালোবাসায় মোড়ানো অনুভূতিগুলো ফিরে এসেছে ছায়ার শরীর নিয়ে । কাল অফিস আছে , সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে ওকে বেরিয়ে পড়তে হবে, তাই রায়হান জোর করে হলে ও ঘুমানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু রায়হানের চোখে ঘুমের বরফ জমে উঠতে পারে না , কিছু স্মৃতির সাথে সাথে কবিতার উষ্ণ আগমনের স্পর্শে । কিছু কবিতার স্তবক মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে , এগুলোকে কবিতা বলা যায় কিনা রায়হান নিজে ও তা আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারেনি , কোন ছন্দ নাই তাল নাই , লয় নাই আছে শুধু শব্দের কিছু সস্তা অলংকার । অনেকে এটাকে গদ্য কবিতা বলে । অবশ্য গদ্য কবিতার ও ন্যূনতম একটা ব্যাকরণ থাকে , ওর তা ও নেই । তাই ও নিজের লেখাগুলোকে কবিতা না বলে কথামালা বলে । রায়হান এর লেখালেখির ঝোক চেপেছে অদ্ভূত ভাবে , আগে তমা কে ছোট ছোট চিরকুট লিখতো গদ্য কবিতার মতো , তমা বেশ পছন্দ করতো , ওকে কবিতা লেখার জন্য বলতো , রায়হান বলতো আমার তো কবিতা আসে না । তবে আমি তোমাকে গিটার বাজিয়ে শোনাতে পারি, তমা চোখে চোখ রেখে মুগ্ধ হয়ে শুনতো । তমা মারা যাওয়ার মাস খানিক আগে এক গোধূলি গোলাপি বেলায় হাত টা ধরে বললো তোমার সাথে আমার য়াবার দেখা হবে অন্য কোথাও অন্য কোন টাইম ফ্রেমে , মাঝে মাঝে ওর কথাগুলো খুব অদ্ভুত শোনাতো । কথা বলতো খুব গুছিয়ে । তমার প্রয়ানের পর রায়হান যখন ভেঙ্গে দুমড়ে মুচড়ে গেছিলো , তখন ওর সিজোফ্রোনিয়ার মতো হতো ।
হঠাত একদিন রাতে , তমা আসলো , বললো এ কি অবস্থা করেছো তোমার ? তুমি আমার কাছে কবিতা লিখবে , কিন্তু সেই চিরকুটের মতো ছোট ছোট নয় অনেক বড় , ছায়াপথ আমার কাছে পৌছে দেবে ।
এরপর অনেকদিন পর আরেকদিন ঘোরের মধ্যে , নিজের ই প্রতিচ্ছবি ই যেন নিজের সাথে ফিসফিস করলো -
তোমার মধ্যে যে গভীর যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে,
তাকে পুনরুজ্জীবিত করো এবং এমন একটি জায়গা দাও-
যেটা তোমার শরীরের মধ্যে নয়।
তাকে শিল্পে বাস করতে দাও।,
তাকে লেখায় বাস করতে দাও,
তাকে সুরের মাঝে প্রবাহিত হতে দাও,
তাকে আরও উজ্জ্বল সম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে,
মুছে ফেলতে দাও জল থেকে সিক্ততা তুলে নেয়ার মতো ।
তোমার শরীর কোনো কফিন নয় ,
যেখানে কষ্টগুলোকে কবর দেওয়া হবে,
তাকে অন্য কোথাও স্থানান্তরিত করো ।
ভালোবাসা মিশে থাক ভালোবাসার হাত ধরে ,
কষ্ট গুলো উড়ে যাক নীলাভ বাষ্প হয়ে ।
সেই থেকে রায়হানের কবিতা লেখার কিছুটা প্রয়াস ।
পাশের ঘরে রায়হানের মামা জহির সাহেব খুক খুক করে কাশতেছে , এ সংসারে মামা আর ভাগ্নে ছাড়া আর কেউ নেই ।ও বিছানা ছেড়ে পাশের ঘরে রাস্তার ল্যাম্পপোষ্টের আযোচিত আধো আলো আধো ছায়ায় উঁকি দিয়ে দেখলো মামা ঘুমের মধ্যেই কাশছে । বারান্দায় দাঁড়িয়ে রায়হান একটা সিগারেট জ্বালালো , নিকোটিন রক্তে মিশে যেতে যেতে রায়হান ওর কথামালা প্রসবের তাড়নায় ব্যাকুল হয়ে উঠলো , তাড়াতাড়ি ফুসফুস করে সিগারেট টেনে শেষ করে ঘরে এসে ল্যাপটপ টা অন করে গুগল ড্রাইভে ঢুকে পড়লো এটাই ওর কবিতার খাতা । ভাবনার মতো এলোমেলো আঙ্গুল গুলো কিবোর্ডে টাইপ করতে থাকলো ,
–জন্মান্তরের গান–
“একদিন এক বৃষ্টি ভেজা বিকেলে
গিটারের স্ট্রিং এ
সুর বুনেছিলো ,
নিকোটিনে হলদে
আঙুল সোনালিমা ।
ল্যাম্পপোস্ট বাতি গুলো,
ফুল হয়ে ঝুলে ছিলো,
মহাপথ ধরে ,
সন্ধ্যার ভীড়ে ।
বিষ্ময় ভরা চোখে,
ডুব দিয়েছিলো,
নিরাসক্ত সময় ,
আচেনা অনুভূতি
উৎসারিত হয়েছিলো,
নীলাভ অন্তর্লোকে ।
অজস্র স্বপ্নের মাঝে ,
হাতে হাত রেখেছিলে ,
যেন -গত জন্মের,
সেই ,নিবিড় পথিক তুমি।
আমরা হারিয়ে যায়নি,
জোনাকির মতো ছেড়ে যায়নি ,
নিওন আলোর শহর ।
বুকে আটকা পড়ে আছে,
ডানা ভাঙ্গা পাখি ।
আমাদের সমান্তরাল মহাবিশ্বে ,
আজ ও আছি আমরা,সেই,
দ্বিধার কোয়াশায়
মুখোমুখি বসে
অনেককাল ধরে ,
অনেক পথ দূরে ।
চেনা বৃত্তের আবর্তে
আবারো দেখা হবে ,
এই জন্মের
দীর্ঘ ঘুমের শেষে ,
সবটুকু অভিমান মুছে।
পথের গায়ে পড়ে থাকা
পুরণো পায়ের ছাপ
আবারো হেটে যাবে
বহু বহুকাল ধরে ।”
আজ রাতে আর ঘুম হলো না , স্মৃতির স্টোরেজ থেকে এক এক টা দৃশ্য আর এক একটা কথা পপ আপ করতে থাকলো , চিন্তা গুলো bubles এর মতো ভাবনার আকাশে উড়তে থাকলো ।
সকালে ক্লান্ত শ্রান্ত শরীর আর মন নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো , শাওয়ারের বৃষ্টিতে ওর শরীর মনের ক্লান্তি ধুয়ে যেতো থাকলো , সব নীল ধুয়ে যাওয়া পর্যন্ত ও বৃষ্টিতে ভিজলো । তারপর ধোপাদুরস্ত কাপড় পড়ে রাস্তায় বের হয়ে পড়লো । মোড়ে চায়ের দোকানে চা খেয়ে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে হলুদ রোদ্দুরে ছুটে চলা পথের সাথে পা মিলিয়ে মেইন রাস্তার দিকে হাটতে থাকলো বাস ধরার জন্য । অফিস সাভারে , আর বাসা যাত্রাবাড়ী , একটা দীর্ঘ যাত্রার জন্য ও বাসে চেপে উঠলো , বাসের এই যাত্রাটুকু প্রতিদিনই ও ঝিমোতে ঝিমোতে যায় আসে । আজ আর তা হলো না , পাশের সিটে একজন তরুণী উঠে বসেছে । পাশে মহিলা বসলে ও বেশ এটোসেটো হয়ে বসে , কখন আবার গায়ে স্পর্শ লেগে যাবে , আর কিনা ভাববে সেই ভয়ে ও বেশ জড়োসড়ো হয়ে থাকে , আজ আর রিল্যাক্স করতে করতে ঝিমোতে ঝিমোতে যেতে পারলো না ।
অফিসে ঢুকে কম্পিউটার অন করার কিছুক্ষণ পর পিয়ন চা দিয়ে গেলো প্রতিদিনের মতো , চা শেষ করে ছাদের সিড়িঘরে দাঁড়িয়ে সিগারেট শেষ করে এসে রায়হান কাজে ডুবে গেলো , তারপর লাঞ্চ তারপর আবার কাজ । অফিস থেকে বের হতে হতে সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেলো , বাইরে বের হয়ে দেখে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে , অনেক্ষণ ধরেই নাকি ঝুম বৃষ্টি হয়েছে, রাস্তা ঘাটে বেশ পানি জমে গেছে । অনেক কষ্টে হুড়োহুড়ি করে একটা বাসে উঠতে পারলো , কিন্তু কোন সিট নেই , বাসের কন্ডাক্টার ঠেলে ঠুলে সব যাত্রীকে পিছে পাঠিয়ে দিচ্ছে , রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম , বৃষ্টি হলেই এ শহরে তীব্র জ্যাম লেগে । কিছুটা আসার পর বাস আর এগুচ্ছে না , স্থিরচিত্রের মতো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে যেন অনন্তকাল , বাস না এগোলে ও কন্ডাক্টার এর অত্যচারে এগোতে এগোতে একেবারে শেষ সারির সিটের সামনে এসে দাড়িয়ে আছে রায়হান, কন্ডাক্টার চাইলে ও তাকে এর চেয়ে বেশি পিছনে পাঠাতে পারবে না । একটু একটু করে বাস চলতে শুরু করেছে । কিছুক্ষণ পর পিছনের সারির জানালার পাশের সিট টা ফাঁকা হলে রায়হান ওই সিটটাতে বসলো , তারপর প্রতিদিনের মতো ঝিমোতে শুরু করলো , একসময় ঘুমিয়ে গেলো এক গাড় স্বপ্নের ভীড়ে -
ও একটা বনের মাঝ দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে সব গাছ আর লতা গুল্মগুলো অভিবাদন জানাচ্ছে । হঠাত একটা বড় কালো পাখি মুরগীর মতো কিছুটা , কি যেন নাম, পাখিটা খাওয়া যায় , সেই পাখি্টাকে হাতের নাগালে পেয়ে সে ধরে ফেললো, তারপর ওর মনের মধ্যে একটা চিন্তার উদয় হলো, এই শীত শীত আবাহাওয়ায় পাখিটিকে খুব ঝাল দিয়ে রান্না করে ঝোল করে চালের রুটি দিয়ে খেতে পারলে মন্দ হতো না ! ও যখন ভাবছে যে, পাখিটাকে কীভাবে খাবে?
ঠিক এমন সময় পাখিটি বলে ওঠে— ‘কবি তুমি তোমার এই জীবনে এতো গোশত খেয়েছো; অথচ তোমার এই আমিষের আকুতি শেষ হয়না। তুমি যদি আমাকে মুক্ত করে দাও; আমি তোমাকে তিনটি পরামর্শ দেবো; যা তোমার জীবনকে সন্তোষ আর শান্তিতে ভরে দেবে। তাছাড়া তুমি একজন কবি , তুমি এতো নিষ্ঠুর হবে কিভাবে ? ’
ও কিছুটা বিচলিত হয়ে বললো— “আমার হাতে বসেই প্রথম পরামর্শটা দাও; যদি পছন্দ না হয়; তাহলে তোমাকে ছাড়বো না।”
পাখিটি রাজি হয়ে বলল— ‘তুমি সব সময় তোমার বন্ধু, আত্নীয় , পরিবার আর সমাজের অন্যান্য মানুষের কথায় বিচলিত হয়ে পড়ো। এর চেয়ে তাদেরকে তাদের মতো থাকতে দাও। তাতে তোমার জীবন শ্রেয়তর হবে।’
ও কিছুটা চিন্তা করে নিয়ে ভাবতে থাকে; পাখিটার কথায় যুক্তি আছে ,বোধ আছে। সুতরাং দ্বিতীয় পরামর্শর কথা বললো ও।
পাখি বলে— ‘তুমি আমায় ছেড়ে দিলে ওই গাছের ডালে বসে দ্বিতীয় পরামর্শটা দেবো।’
ও তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পাখিটিকে ছেড়ে দিলো; আর পাখি গিয়ে কাছেই একটি গাছের ডালে বসে।
পাখিটা এবার তার দ্বিতীয় পরামর্শের কথা বলে— ‘ অতীতকে কখনো পালটানো যায় না। সুতরাং বর্তমান মুহূর্তটিকে উপভোগ করো। আর ভবিষ্যতের জন্য বাঁচো। যা হোক বড় বোকামি করেছো তুমি। আমার পেটের মধ্যে তিন কেজি হীরা আছে। তুমি এটা পেলে তোমার তিনপুরুষ বসে খেতে পারতে।’
সাংঘাতিক ঘাবড়ে গিয়ে ও পাখিটির পেছনে রেগে ছুটতে থাকলো; তাকে আবার ধরতে। পাখি তখন জোরে জোরে বলে— ‘তুমি দেখছি আমার পরামর্শ একেবারেই শুনলে না। আমার নিজেরই ওজন যেখানে দুই কেজির বেশি নয়; আমার পেটে কী করে তিন কেজি হীরা থাকবে! তুমি দেখছি এখনো উদ্ভট আর বোধহীন কথায় প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছো! দ্বিতীয়ত আমি এরিমাঝে তোমাকে ছেড়ে গেছি; তোমার জীবনে এখন আমি অতীতের বিষয়।’
পুরোপুরি স্তম্ভিত হয়ে ও তখন তৃতীয় পরামর্শের জন্য অনুরোধ করলো।
পাখিটি বলে— ‘শোনো; সবাইকে উপদেশ দিতে যেওনা। শুধু তাদের উপদেশ দাও; যারা সেটা শুনবে-মনে রাখবে। মনে রেখো কিছু কাপড় এতো জীর্ণ হয়ে যায়; যা আর কখনো সেলাই করা যায় না।’
বাইরে বৃষ্টি বেড়েছে , ভাংগা কাঁচের জানালা দিয়ে আসা বৃষ্টির পানিতে রায়হান এর শরীর ভিজে যখন শীত শীত লাগতে শুরু করেছে , তখন ওর ঘুম ভেঙ্গেছে কিন্তু স্বপ্নের ঘোর ভাংগেনি । ও কি এখন ও জঙ্গলে নাকি জ্যামে আটকা বাসের মধ্যে তা বুঝে উঠতে সময় লাগলো । এখন ও শাহাবাগের জ্যামে আটকা , ঘড়িতে এখন রাত পৌনে এগারো বাজে ।
রায়হান বাস থেকে নেমে পড়লো শাহাবাগে , বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাটা শুরু করলো ইউনিভার্সিটির ভিতর দিয়ে ,সারি সারি ল্যাম্পপোষ্টে সোডিয়ামের আলো কমলা রঙের ফুলের মতো ঝুলে আছে , স্বপ্নের পাখি তখনো মাথার মধ্যে যেন কথা বলছিল , তখন ওর মনে পড়লো পাখিটি জালাল উদ্দিন রুমির গল্পের সেই তিতির পাখি । অনেক অনেক দিন আগে তমা গল্পটা বলেছিল । তমার বই পড়ার নেশা ছিল , রুমি ওর প্রিয় কবি ।আজ স্বপ্ন হয়ে সেই স্মৃতি ফিরে এসেছে , কি অদ্ভূত সুন্দর উপদেশ গুলো ।
এই ক্যাম্পাস রায়হানের , এই ক্যাম্পাস তমার ও ,এ পথে কত কত দিন পায়ে পা মিলিয়ে হেটেছে হাতে হাত রেখে , কত বোহেমিয়ান বিকেলে চোখে চোখ রেখেছে , কত আবেগ তাড়িত বৃষ্টিতে ভিজেছে দুজনের শরীর , আজ ও ভেজে রায়হান পাশে নেই তমা ,চোখের জল বৃষ্টির জলের সাথে এক হয়ে ভিজে যায় এক হয়ে মিশে যায় ,এক নিঃসংগ শেরপার মতো রাতের বুক চিরে আজ ও পথ হাটে রায়হান , হাটতে হাটতে একাকীত্বের বিষণ্ণতার দেয়ালে হোচট খায় , তবুও হেটে চলে হাটতে হয় …
"সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এটাই , হাঁটার ইচ্ছা কখনো হারিও না। প্রতিদিন, আমি হাঁটতে হাঁটতে ভালো থাকার রাজ্যে পৌঁছাই এবং প্রতিটি অসুস্থতা থেকে দূরে সরে যাই। হাঁটতে হাঁটতে আমার জীবনের সেরা ভাবনাগুলো পেয়েছি, এবং এমন কোনো চিন্তা আমার জানা নেই যা থেকে হাঁটতে হাঁটতে মুক্তি পাওয়া যায় না। কিন্তু স্থির হয়ে বসে থাকলে? - যত বেশি বসে থাকা হয়, ততই অসুস্থ বোধ করার সম্ভাবনা বাড়ে। তাই, যদি কেউ শুধু হাঁটা চালিয়ে যায়, তবে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।"
~সোরেন কিয়ারকেগার্ড (অস্তিত্ববাদী দার্শনিক)
তমা আমার জন্য একটা চিঠি রেখে গেছিলো , শর্ত ছিল যখন ও থাকবে না তখন চিঠিটা পড়বো । ওর চলে যাওয়ার পর রায়হান চিঠিটা খুলেছিলো -
"যখন আমি চলে যাব
যখন আমি চলে যাব, আমি চাই না তোমরা খুব বেশি দুঃখিত হও। চুপ করে থেকো, কথাগুলো জমিয়ে রাখো এবং সেই আনন্দময় মুহূর্তগুলো মনে রেখো, যা আত্মাকে উষ্ণ করে। যখন আমি ঘুমিয়ে পড়ব, আমায় বিশ্রাম নিতে দিও। আমি চলে গেছি কারণ আছে। যদি আমার জন্য মন কাঁদে, কিছু বলো না। নীরবতায় খুঁজে নিও আমার উপস্থিতি— আমার প্রিয় জায়গায়, আমার বইয়ে, আমার চিঠিতে, আমার ছবিতে এবং সেই তাড়াহুড়োর কাগজগুলোতে যা আমি লিখেছিলাম।
সেই চকলেট আর প্রিয় হেমন্ত উপভোগ করো, যা আমি রেখে গেছি। সেই গান শুনো যা আমি খুব ভালোবাসতাম, আমার সুগন্ধি ব্যবহার করো এবং আমার গাছগুলোর যত্ন নিও।
যদি আমার শরীর সমাধিস্থ করা হয়, ভয় পেও না। মুক্ত হয়ে দৌড়াও এবং তোমার অশ্রুগুলো ঝরতে দাও। বাতাস যেন তোমার মুখ স্পর্শ করে। কবিতা, সঙ্গীত, এবং গান অনুভব করো। পৃথিবীকে চুমু দাও, জল পান করো এবং পাখিদের ভাষা শিখো। যদি গভীরভাবে আমার জন্য মন কাঁদে, চেষ্টা করো লুকিয়ে রাখতে এবং খুঁজে নিও আমাকে শিশুদের মধ্যে, কফির মধ্যে, রেডিওতে, এবং সেই জায়গাগুলোতে যেখানে আমি লুকোতাম। ‘মৃত্যু’ শব্দটি কখনোই বলো না। কখনো কখনো ভুলে যাওয়া অনেক বেশি দুঃখজনক, যতবার মৃত্যু ঘটলেও মনে রাখা যায়।
যখন আমি ঘুমিয়ে পড়ব, আমার কবরের পাশে ফুল এনে দিও এবং সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলো জীবন চলতে থাকে। শুধু আমি না থাকায় জীবনের শিখা নিভে যায় না। যারা ‘বেঁচে থাকে’ তারা কখনো সম্পূর্ণ মরে না; তারা শুধু সাময়িকভাবে ঘুমিয়ে পড়ে। চিরন্তন ঘুমানো কেবল এক অজুহাত।
যখন আমি চলে যাব, তোমার হাত বাড়িয়ে দিও, আর তুমি আমার স্পর্শ অনুভব করবে। তুমি বুঝবে যে আমি সবসময় তোমার পাশে আছি। এবং একদিন, একটি হাসি নিয়ে, তুমি অনুভব করবে যে আমি ফিরে এসেছি, তোমার সাথে চিরকাল থাকার জন্য।"
অনেক অনেকদিন পর রায়হান ও যখন এই কালমাত্রার ছাড়প্ত্র নিয়ে চলে গেছে তার ও বহু বছর পর কোন এক রৌদ্যুজ্জ্বল বসন্তের সকালে জার্মানির রাইন নদীর তীর ধরে হাতে হাত রেখে হাটতে থাকে রায়হান এবং তমা , তবে এখন ওদের নাম বদলে গেছে রায়হান হয়ে গেছে রায়না আর তমা হয়ে গেছে তনা , নাম বদলে গেছে , মানচিত্র বদলে গেছে, ক্যালেন্ডার বদলে গেছে, সময়ের জ্যামিতি বদলে গেছে , কিন্তু হৃদয় টা এক রয়ে গেছে , যেন নতুন পোষাকে পুরানো মানুষ, পুরানো অনুভূতি ।