একদিন সন্ধ্যার পর ফোন করে সে কাঁদতে লাগল। আমি বললাম, কি হয়েছে?
সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, খারাপ লাগছে।
-শরীর খারাপ?
-উহু।
-তাহলে?
-এমনি, ভালো লাগছে না।
-তাহলে এক কাজ করুন মোবাইলে ফানি ভিডিও দেখুন, নয়তো টিভি দেখুন অথবা গান শুনুন। আমার মন খারাপ লাগলে আমি গান শুনি নয়তো হাঁটতে বের হই...
সে কল কেটে দিল। আশ্চর্য হলেও সত্যি আমি বুঝতে পারিনি যে, মেয়েটার আমার জন্য মন খারাপ লাগছে বলে কাঁদছে, আমি ভেবেছি অন্য কোন প্রবলেম বুঝি।
মেয়েটার নাম মীরা। আমরা দুজনেই তখন একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে চাকরি করতাম। স্বনামধন্য কোন স্কুল নয়। মোটামুটি মানের একটা স্কুল। মীরা ম্যাডামের সাথে পরিচয় সেখানেই। আমার পরে সে স্কুলে জয়েন করেছিল। সে আমার চেয়ে বছর খানিকের বড় হবে।
এরপর দশ বারো দিন কেটে গেল। মীরা ম্যাডামের সাথে স্কুলে যখন চোখে চোখ পড়তো, সে চোখে দেখতাম অন্যরকম এক আলো। আমাকে দেখে হাসতো, তাকিয়ে থাকতো গভীর দৃষ্টিতে।
এরপর একদিন স্কুল ছুটির পর আমি বাসায় চলে এসেছি। তখন ভরদুপুর বেলা। জামাকাপড় কেবল ছাড়বো তখন ফোন দিল মীরা ম্যাডাম, কোথায়?
-বাসায়।
-একটু ভাই ভাই হোটেলে আসতে পারবেন।
-কেন?
-প্রয়োজন আছে। আসুন।
-আচ্ছা, যাচ্ছি।
আমি সেই অবস্থাতেই আবার বেড়িয়ে পড়লাম। ভাই ভাই হোটেল আমার বাসা থেকে খুব বেশি দুরে না। হাঁটা পথে পাঁচ মিনিট। কিন্তু রোদ আমার অসহ্য। একদফা রোদে পুরে স্কুল থেকে বাসায় এসেছি, আরেক দফা রোদে পুরে বাসা থেকে হোঁটেলে যাচ্ছি। রিকশা কেন নিচ্ছিনা? সেই সময় এইসব ছোট খাটো পথ রিকশা করে ঘোরার মত বিলাসিতা আমার ছিল না।
আমি ঘেঁমে নেয়ে বিরক্তি নিয়ে পথ হাঁটছিলাম। হোটেলে আসলে দেখলাম মাঝামাঝি একটা টেবিলে বসে আছে মীরা ম্যাডাম।
আমি বসে বসলাম, বলুন, কি জন্য ডাকলেন?
-ডেকেছি, কারন আছে। ওয়েটার ডেকে সে গরুর মাংস আর চিংড়ি মাছ দিয়ে ভাত দিতে বলল।
আমি বললাম, বাসায় আমার মিল দেওয়া আছে তো।
-থাক দেওয়া, আজ এখানে খাবেন।
খাওয়া দাওয়া শেষ করলাম চিন্তিত মুখে। পকেটে একটি পয়সা নেই। যদি বিলটা আমাকে দিতে বলে এরমত লজ্জার ব্যাপার আর কিছু হবে না। তবে এই যা ভরসা, যেহেতু অর্ডার সে করেছে, বিলটা সেই দেবে। তাছাড়া সেই তো আমাকে ডেকে নিয়ে এসেছে।
খাবার শেষে টেবিলের উপর যে শপিং ব্যাগটা ছিল সেটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এটা আপনার জন্য।
-আমার জন্য, মানে?
-হ্যা, আপনার জন্য।
-কি আছে এতে?
-একটা পাঞ্জাবী, আকাশী কালার, দেখে খুব পছন্দ হলো, ভাবলাম আপনার গায়ে খুব সুন্দর মানাবে, তাই কিনলাম। বের করে দেখুননা।
আমি শপিং ব্যাগ থেকে পাঞ্জাবীটা বের করলাম। আকাশী কালারের চেয়ে আরেকটু ফিকে সাদা। সামনে অসম্ভব সুন্দর কারুকাজ। বুঝতে অসুবিধা হলো না যে বেশ দামী একটা জিনিস।
সেদিনের মত পাঞ্জাবী নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। পরের দিন সেই পাঞ্জাবী পরে গেলাম স্কুলে। ছাত্র-ছাত্রী সহ শিক্ষক শিক্ষিকারা প্রশংসা করে বলল, দারুণ মানিয়েছে আপনাকে।
মীরা ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে মাথা নিচু করে মিটিমিটি হাসছে।
তারপর এক ছুটির দিন সকালে সে আমাকে ফোন করে বলল, ঘুরতে যাব, দশটার দিকে ওভারব্রিজের নিচে আসবেন।
আমি বললাম, আচ্ছা।
দশটার দিকে ওভারব্রিজের নিচে এসে দেখলাম সেজেগুজে রাজকন্যা সেজে মীরা ম্যাডাম দাঁড়িয়ে আছে। বলল, সিনেমা দেখতে যাব।
রাস্তার ওপারে এসে দাঁড়ালাম আমরা। গন্তব্য নিউমার্কেট। বলাকাতে যে সিনেমাই চলুক সেটা দেখব। বাসে উঠতে যাব, মীরা ম্যাডাম বলল, বাসে যাবো না, রিকশায় যাব।
-এতদুর রাস্তা রিকশায় যাবেন মানে?
-রিকশা করে ঘুরতে ভালো লাগে যে আমার।
পরে একটা অটোরিকশা ডাকলাম।
মীরা ম্যাডাম বলল, না, অটোরিকশাতে যাবো না। পায়ে টানা রিকশাতে যাব।
-কেন?
-রাস্তা তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে যে।
মহা যন্ত্রণা! পরে পায়ে টানা রিকশায় উঠলাম আমরা। সেই প্রথম এত অন্তরঙ্গ হয়ে বসা দুজনের। মন্দ লাগছিলনা অবশ্য। এলোমেলো বাতাস দিচ্ছিল। খোলা হাওয়া গায়ে এসে লাগছিল আমাদের।
সিনেমা দেখলাম, ঘুরে বেড়ালাম, সন্ধ্যার পর পর ফেরার পালা। ফেরার পথেও একই বায়না পায়ে টানা রিকশায় যাবে।
আমি বললাম, রাত হয়ে যাবে তো।
-হোক রাত।
পড়ে আবার রিকশা নিয়ে যাত্রা শুরু। নগর পেড়িয়ে আমিনবাজার থেকে হেমায়েতপুরের দিকে নির্জন রাস্তা। সে আমার হাত চেপে ধরে রইল। খোলা প্রান্তর থেকে শীতল বাতাস গায়ে এসে লাগছে। ঝড়োগতিতে পাশ দিয়ে বাস ট্রাক কার চলে যাচ্ছে। বেশ দুরে দুরে চোখে পড়ে লাইটের আলো। মনে রাখার মত একটি রাত ছিল।
তারপরের শুক্রবার। মীরা ম্যাডাম আমাকে নিয়ে এসেছে সাভারে একটি জুয়েলার্সের দোকানে। আমার কোন ওজর আপত্তি না শুনে সে আমার জন্য একটা আংটি অর্ডার দিল। অগ্রিম দিল ছয় হাজার টাকা।
সাভারেই বেশ রাত হয়ে গেল। ফিরতে হবে হেমায়েতপুর। বাসে প্রায় বিশ পঁচিশ মিনিট লাগে। ম্যাডাম বলল, বাসে যাবে না, পায়ে টানা রিকশায় যাবে।
রিকশা নিলাম। হাসিগল্পে যাচ্ছিলাম। ফুলবাড়িয়া পেরিয়েছে রিকশা। হেমায়েতপুর যেতে আর পাঁচ সাত মিনিট লাগবে। আমরা বুঝতে পারিনি যে একটা কার আমাদের ফলো করছিল। ম্যাডাম আমার ডান পাশে ছিল, তার হাতে ছিল ভ্যানিটি ব্যাগটি। হঠাৎ কার থেকে কেউ একজন চিলের মত ছোঁ মেরে ব্যাগটি নিয়ে নিল। কিছু বুঝবার আগেই হুস করে বেড়িয়ে গেল কারটা।
ব্যাগে টাকা কড়ি তেমন ছিল না। তবে মোবাইল, ঘরের চাবি, আংটি অর্ডারের মানি রিসিভ এসব ছিল। দুইটি মোবাইলের একটা মোবাইল তার হাতে ছিল বলে সেটা রক্ষা পেয়েছিল।
মীরা ম্যাডাম আরেকটি মেয়ের সাথে একটি রুমে ভাড়া থাকতো। সেই মেয়েটি তখন গিয়েছিল বাড়িতে। তালা ভাঙ্গা ছাড়া কোন উপায় ছিলনা। আমিও তার সঙ্গে যেতে পারছি না, সে একটি ফ্যামিলি বাসায় সাবলেট হিসেবে থাকতো।
যাহোক, পরে তালা ভেঙ্গে সে রুমে প্রবেশ করে। পরদিন সকাল বেলা নয়টা দশটার দিকে সে আমাকে ফোন করে বলল, ব্যাগটি পাওয়া গেছে, পুলিশ টাউনের সামনে ফেলে রেখে গিয়েছিল। আংটির মানি রিসিভে যে ফোন নাম্বার ছিল সেটা দেখে এক ভাই ফোন করেছে।
আমরা গেলাম ব্যাগ আনতে। এবার আমরা বাসে গেলাম। মীরা ম্যাডাম আমার পাশের সিটে বসে বলল, রাতে আমার ভালো ঘুম হয়নি। বার বার শুধু দৃশ্যটার কথা মনে পড়েছে।
আমি বললাম, ঠিক হয়ে যাবে।
গাড়িতে বসে আমি ভাবছিলাম মানুষকে নিয়ে। একজন ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে গেছে, আরেকজন টাকা খরচ করে কল দিয়ে সে ব্যাগ ফিরিয়ে দিচ্ছে। মানুষে মানুষে কত বিস্তর তফাৎ!
আমরা বাস থেকে নেমে দেখলাম আটাশ ত্রিশ বছরের একজন লোক ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। পরিচয় হলে সে বলল, ভোরবেলা আমি হাঁটতে বের হয়েছি। দেখি যে ব্যাগটি রাস্তার পাশে পড়ে আছে।
ব্যাগে কিছু পাওয়া গেলনা। তবু আমরা খুব খুশি হলাম। সেই ভাইটিকে বললাম আমাদের সাথে চা খেতে। সে হাসিমুখে বলল, না, ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন আপনারা।
আমরা ব্যাগ নিয়ে রিকশায় উঠলাম। মীরা ম্যাডাম আমার হাত ধরে বসে রইল।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
গল্পটিতে দুই জন নরনারীর ভালবাসার শুরুর দিকের গল্প বলা হয়েছে। আংটি কেনাকে কেন্দ্র করে তাদের জীবনে একটা স্মরণীয় ঘটনা ঘটে যায়।
১৪ আগষ্ট - ২০২৪
গল্প/কবিতা:
১২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৫