১.'আসসালামু আলাইকুম স্যার।'
'কে রাফি না?'
'জি, স্যার।'
'কেমন আছিস তুই?'
'ভালো আছি স্যার, আপনি ভালো আছেন স্যার?'
'আছি রে, আল্লাহ পাক ভালো রাখছে।'
আমি যাচ্ছিলাম স্কুলে। প্রাইমারীর গণ্ডি পেরিয়ে সবেমাত্র হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছি। উলিপুর থানা শহরের গুনাইগাছ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ি। বাড়ি থেকে প্রায় নয় কিমি দুরে স্কুল। পায়ে হেঁটে স্কুলে যাই। এর আগে পড়তাম কাঁঠালবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক শহিদুল স্যারের সাথে রাস্তায় দেখা। স্যার মোটরসাইকেল নিয়ে স্কুলের দিকে যাচ্ছিলেন।
স্যার বললেন, কোন স্কুলে ভর্তি হয়েছিস?
-স্যার গুনাইগাছ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে।
-ভালো করেছিস। বড় স্কুলে পড়লে অনেকের সাথে পরিচয় হয়, ভালো ভালো শিক্ষকের শিক্ষা লাভের সুযোগ হয়। পড়াশুনা কেমন চলছে তোর?
-ভালো স্যার।
-তোদের নতুন বইয়ের বুকলিস্ট দিয়েছে?
-জি স্যার, দিয়েছে।
-বই কিনেছিস সব?
আমি নানার বাড়ি থেকে পড়াশুনা করতাম। বাড়ি থেকে বাবার লেখাপড়ার খরচ চালানোর সামর্থ্য ছিল না। বাবা তখন চাকরিবাকরির চেষ্টা করে সফল না হতে পেরে হাল ছেড়ে দিয়ে বসে আছেন।
আমার নানার সংসার যে খুব ভালো চলতো তা নয়। নানা পেনশনের যে টাকা পেতেন তাই দিয়ে টেনেটুনে সংসার চালাতেন।
আমরা দুই ভাই। আমি আর রাজিন। রাজিন আমার চেয়ে বছর তিনেকের ছোট। আমার নানা একবার আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসে বাবাকে বললেন, রাফিকে আমার ওখানে নিয়ে যাই, রাজিন এখানে থাকুক।
বাবা দ্বিমত না করে বললেন, আচ্ছা।
তারপর থেকে আমি নানা বাড়িতে আছি।
আমি স্যারকে বললাম, স্যার সব বই কেনা হয়েছে শুধু ইংরেজি গ্রামার আর বাংলা ব্যাকরণ কেনা হয়নি।
আমার বুকলিস্টে যে বইগুলো ছিল তার মধ্যো এই বই দুইটি ছিল দামী। লাইব্রেরিতে গিয়েও টাকার অভাবে কিনতে পারিনি। এদিকে ক্লাসে দ্রুত বই কেনার জন্য তাগাদা দিচ্ছিল।
স্যার জিজ্ঞেস করলেন, বই দুটোর দাম কত জানিস?
-স্যার আটশো টাকা লাগবে।
আমি ভাবছিলাম স্যার কৌতুহল ও ভদ্রতাবশত এসব জানতে চাচ্ছিলেন। স্যার যে আমাকে বই কেনার জন্য এক হাজার টাকা দিয়ে দেবেন এটা আমার ধারণার বাইরে ছিল।
স্যার মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে বললেন, নে টাকাটা নে, বই কিনেনিস।
আমি স্তম্ভিত গলায় বললাম, স্যার!
-আরে নে, লজ্জা করিস না।
ছোটকালের সেই ঘটনাটি আমার মনে আজ পর্যন্ত দাগ কেটে বসে আছে। আজ আমি শিক্ষাজীবন শেষ করে চাকরি করছি। মোটা অংকের মাইনে পাচ্ছি। কিন্তু স্যারের দেয়া সেই এক হাজার টাকার ঋণ কি আমি কোন দিন শোধ করতে পারবো?
২. দুপুরবেলা। টিফিন পিরিয়ড। আমি দাঁড়িয়েছিলাম কাঁঠালবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠের পূর্বপাশে রাস্তা সংলগ্ন বিশাল বট গাছটার নিচে। বট গাছ লাগোয়া একটি মুদি দোকান। রাস্তার ওপারে ছোট একটি হোটেল। ছাত্র-ছাত্রীরা এটা ওটা কিনে খাচ্ছে। আমার কাছে টাকা নেই। লোলুপ দৃষ্টি উপেক্ষা করে তাকিয়ে আছি অন্যদিকে।
কখন যেন নিঃশব্দে শহিদুল স্যার আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
আন্তরিক গলায় বললেন, কিরে রাফি টিফিনে কিছু খেয়েছিস?
আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। কি বলবো স্যারের কাছে জলজ্যান্ত মিথ্যা বলি কি করে?
স্যার আমার হাত ধরলেন। বললেন, আয় আমার সাথে।
স্যার আমাকে হাত ধরে নিয়ে গেলেন হোটেলে। হোটেলওয়ালাকে বললেন, ওকে সিঙ্গারা সমুচা দাও।
হোটেলওয়ালা আমাকে পিরিচ করে সিঙ্গারা সমুচা দিয়ে গেল।
স্যার বললেন, তুই খেয়ে ক্লাসে আয়।
৩. নানার বাড়িতে থেকে আমি ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ি। পরে নানির দুর্ব্যবহারের কারনে মা বাবার ভালোবাসার টান নতুন করে অনুভব করি। তাছাড়া গ্রামের বাঁধাহীন উন্মুক্ত জীবন বার বার টানতো আমাকে। তবে আমার নানা ছিলেন অকৃত্রিম একজন বন্ধু। একমাত্র তার কারনেই তিন বছর আমি নানা বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করি। যাহোক, সপ্তম শ্রেণীতে নিজের এলাকা রৌমারীতে এসে ভর্তি হই। নতুন স্কুলে যেতে শুরু করলাম আউট ড্রেস পরে। বাবার কাছে স্কুল ড্রেস কিনে দেওয়ার পয়সা ছিলনা তখন।
আমাদের স্কুলটা ছিল বাজারের পাশে। টিফিন পিরিয়ডে একদিন বাজার দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছি। হঠাৎ দর্জি দোকানদার রফিক ভাই আমাকে ডাকলেন। অল্পদিনেই তার সাথে ভালো চেনাজানা হয় আমার। তার দোকানে টেপরেকর্ডার গান বাজতো। সময় পেলে আমি গান শুনতে যেতাম। সে আমার বাবাকেও চিনতো।
-এই রাফি, শোনো এদিকে।
আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, কি?
-আসো দোকানের ভিতরে আসো।
দোকানের ভিতরে যাওয়া মাত্রই ফিতা দিয়ে তিনি আমার মাপজোক করতে লাগলেন। আমি অবাক। বললাম, কিসের মাপ নিতেছেন?
-আছে দরকার, তুমি ঠিকঠাক মতো দাঁড়াওতো...
আমি কিন্তু তখনো বুঝতে পারিনি আমার স্কুল ড্রেসের জন্য মাপ নেওয়া হচ্ছিল।
সপ্তাহখানেক পরে আলেয়া ম্যাম আমাকে ডাকলেন। তিনি স্কুল মাঠের পাশে একা দাঁড়িয়েছিলেন। তার হাতে ছিল একটা শপিং ব্যাগ।
ম্যাম শাড়ি পড়তেন। বেশ লম্বা। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। সবসময় মুখে হাসি লেগে থাকতো তার। তিনি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাসিমুখে তাকিয়েছিলেন আমার দিকে।
আমি এগিয়ে গিয়ে সালাম দিলাম। ম্যাম সালাম ফিরিয়ে শপিং ব্যাগটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন, এই নে তোর স্কুল ড্রেস।
আমি কি বলবো ভেবে পেলাম না। নতমুখে দাঁড়িয়ে আছি। আনন্দে ভিজে উঠেছে আমার চোখ।
ম্যাম বললেন, কাল থেকে স্কুল ড্রেস পড়ে আসবি কেমন।
আমি মাথা নাড়ালাম।
-কাঁদছিস নাকি বোকা ছেলে?
-না, ম্যাম।
-এবার যা তাহলে।
-আসি ম্যাম, আসসালামু আলাইকুম।
-ওয়া আলাইকুমুস সালাম।
ছোটকালে অসাধারণ কিছু শিক্ষক শিক্ষিকা পেয়েছিলাম আমি। যারা আমার জীবনকে শিক্ষা দীক্ষা স্নেহ ভালোবাসায় আলোকিত করে তুলেছিলেন। আজও আমি তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
ছোটবেলায় অসাধারণ কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকাকে পেয়েছিলাম আমি। শিক্ষা দীক্ষা স্নেহ ভালোবাসায় যারা জীবনকে অন্য এক মহিমায় উদ্ভাসিত করেছিল। ছোটবেলার স্মৃতি মনে করলে তাদের সেই স্মৃতিগুলো সবার আগে মনে পড়ে আমার।
১৪ আগষ্ট - ২০২৪
গল্প/কবিতা:
১০ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ জানুয়ারী,২০২৫