আমার বাবা একজন কবি হতে চেয়েছিলেন। এক জীবনে তিনি অনেক কবিতা ও গান লিখেছেন। এখনো অবিরত লিখে চলেছেন।
যখন আমরা খুব ছোট ছিলাম তখন থেকে তিনি লেখালেখি করেন। একটা স্মৃতি এখনো আমার চোখের সামনে স্পষ্ট ভাসে। সকাল বেলা ঘুম ভেঙ্গে দেখতাম জানালা খুলে দিয়ে বাবা তার কবিতার খাতা খুলে বসেছেন। লিখছেন, ভাবছেন, জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন, আবার লিখছেন। মাঝে মাঝে বিড়ি টানছেন (সে সময় সিগারেট খাওয়ার মত পয়সা তার ছিল না)। এটা ছিল আমার ছোটকালের একটি পরিচিত দৃশ্য।
আরেকটা দিনের কথা মনে পড়ে। একদিন বাবা সন্ধ্যার পর পর কোথায় থেকে যেন একটা হারমনিয়ম কাঁধে করে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। আমাদের ডেকে নিয়ে হারমনিয়ম নিয়ে খাটের উপর বসলেন। এরপর শুরু করলেন গান। একের পর এক গান গেয়ে চললেন। আমরা সম্মোহিতর মত তার গান শুনছি। গানের সুর আমাদের নিয়ে গেছে অন্য কোন ভুবনে। বাবার এই গানের খ্যাতি আশেপাশের কয়েক গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ পেতেন তিনি।
সেসময় বাবা রেডিওতে বিবিসি বাংলা ও ডয়েচে ভেলের খবর শুনতেন। ২০০৬ সালে জার্মানিতে ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজন করা উপলক্ষে ডয়েচে ভেলে তার সারা বিশ্বের শ্রোতাদের কাছ থেকে গান কবিতা গল্প আহ্বান করলো। বাবা একটি কবিতা লিখলেন। খেতে বসেছি, বাবা তার কবিতার খাতা এনে আমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, জার্মান রেডিও ডয়েচে ভেলেকে নিয়ে একটি কবিতা লিখলাম। ওরা একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে…
বাবা কবিতা আবৃত্তি শুরু করলেন। বেশ লম্বা কবিতা। আমরা আগ্রহ নিয়ে শুনলাম।
বললেন, কেমন হয়েছে?
আমরা ছোট মানুষ, শিল্প সাহিত্যের কি বুঝি তখন। আর মা বাবার এসব খামখেয়ালি নিয়ে বিরক্ত ছিলেন। অভাবের সংসার। তিন বেলা খাবার জুটছে না। অথচ বাবা আছেন সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় একটা বিষয় নিয়ে। কবিতা পেটে ভাত দেয় না।
আমি বললাম, ভালো হয়েছে।
পরে তিনি সেটি ডাকযোগে পাঠিয়ে দিলেন। মাস দুই কেটে গেছে, আমরা সে কবিতার কথা ভুলেও গেছি। হঠাৎ একদিন ডাকপিয়ন বেশ বড়সড় একটা বক্স নিয়ে আমাদের বাসায় হাজির। ডয়েচে ভেলের পক্ষ থেকে পুরস্কারটি পাঠানো হয়েছে। চিঠি, সম্মাননা পত্র, জার্সি, ট্রাউজার্স, পোস্টার, চাবির রিং, ফুটবল, টুকিটাকি আরো অনেক জিনিস। বাবা সেদিন খুব খুশি হয়েছিলেন। এটা ছিল তার কবিতার প্রথম কোন স্বীকৃতি।
আমরা ফুটবল নিয়ে মাঠে খেলতে গেলাম। বাবা জার্মানির জার্সি গায়ে দিয়ে হৃষ্টচিত্তে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন।
একজন ছেলে হিসেবে আমার বাবার বিষয়ে থমাস গ্রে এর এলিজি রিটেন ইন এ কান্ট্রি চার্চইয়ার্ড কবিতাটির কয়েকটি লাইনের কথা বলতে চাই।
Full many a gem of purest ray serene,
The dark unfathom'd caves of ocean bear:
Full many a flower is born to blush unseen
And waste its sweetness on the desert air.
হ্যাঁ, সত্যি কিছু কিছু ফুল এমন নিভৃতে গহীন অরণ্যে ফুটে থাকে যে তার ঘ্রাণ মানুষ পায় না। ফুলটি ফুটে এক সময় ঝড়ে যায়। আবার ফুল ফুটে, আবার ঝড়ে যায়। কেউ খবর রাখে না তার? তাই বলে বৃক্ষ কিন্তু ফুল ফুটানো বন্ধ করে না।
আবার কিছু মণি মুক্তা অন্ধকার কোন গিরিগুহায় ঝলমল করতে তাকে, তার দ্যুতি কারো নজরে পড়ে না। আমাদের দেশেও নানা প্রান্তে এমন অনেক প্রতিভা আছে যার খবর কেউ রাখে না।
আমার বাবার প্রতিভাকে আমি কবির সেই ফুল আর মণি মুক্তার সাথে তুলনা করতে চাই। যা কিনা লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে গেল চিরদিন। পৃষ্ঠপোষকতা ও সুযোগের অভাবে সেগুলো আলোর মুখ দেখলো না।
প্রত্যন্ত একটি গ্রামে বাস করে দরিদ্র সংসারের ঘানি টানতে টানতে শিল্পের চর্চা করে গেছেন আমার বাবা। জীবনের প্রথমদিকে সেগুলো প্রকাশের জন্য একটা তাগিদ অনুভব করলেও এখন আর করেন না। স্থানীয় একটি পত্রিকায় কয়েকটি কবিতা প্রকাশও করেছিলেন। পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সে চেষ্টা সেখানেই বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু কলম তার বন্ধ হয়ে যায়নি। না লিখলে শান্তি পান না। কিছু না কিছু লিখতেই হয় তাকে।
আমি এখন ঢাকায় থেকে পড়াশুনা করি। টিউশন করে কষ্টেসৃষ্টে চলি। এবার বাড়িতে গিয়ে বাবার পছন্দের পঞ্চাশটি কবিতা নিয়ে এসেছি। সেগুলো নিয়ে একদিন গেলাম একজন প্রকাশকের কাছে।
প্রকাশক ভদ্রলোক কয়েকটি কবিতা পড়ে বললেন, বোঝেনতো এখন বইয়ের বাজারের অবস্থা। প্রতিষ্ঠিত কবিদের লেখা বই বিক্রি হয় না। আর ইনি তো…এটা ঠিক আপনার বাবা খারাপ লেখেননি। কিন্তু তাকে তো কেউ চেনে না। বই আমরা প্রকাশ করবো, প্রথমে তিনশো কপির মত ছাপবো, এজন্য আপনাকে চব্বিশ হাজার টাকা দিতে হবে।
আমি হতাশ গলায় বললাম, এত টাকা কোথায় পাবো?
-কিন্তু টাকা ছাড়া এতবড় রিস্ক আমরা কেন নেবো বলেন? বইতো বিক্রি হবে না। বই বিক্রি হলে একটা কথা ছিল।
-শুনেছি টাকা ছাড়া অনেক প্রকাশক বই প্রকাশ করেন।
-সেদিন এখন আর নেই। বইয়ের বিক্রি অনেক কমে গেছে। আমরা কি করবো বলুন? দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে আমাদের। প্রকাশকরা তো আর হাওয়া খেয়ে বেঁচে থাকে না।
কথা সত্যি। বই প্রকাশনা শিল্পের ব্যাপার হলেও এটা তাদের জীবিকারও মাধ্যম। অনেকগুলি টাকা ব্যয় করে বই প্রকাশ করা হলো, পরে সেই বই বিক্রি না হলে তাদের প্রতিষ্ঠান টিকবে কি করে।
যাহোক, কবিতার পাণ্ডুলিপি নিয়ে আমি আরেকজন প্রকাশকের কাছে গেলাম। তারাও একই কথা বললেন।
তবে আমি হতোদ্যম বসে থাকিনি। টিউশন করে যে টাকা পাই প্রতিমাসে তারই কিছু অংশ জমা করতে শুরু করেছি। কিছু কবিতা পাঠাচ্ছি পত্রিকায়। এখনো অবশ্য কোন পত্রিকা প্রকাশ করেনি। তাতেও নিরাশার কিছু নেই। সকল কাঁটা ধন্য করে একদিন ফুল ফুটবে। আমি সেই অপেক্ষায় আছি।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
এই গল্পে একজন নিবেদিত প্রাণ কবির কথা বলা হয়েছে। যে সংসার জীবনের হাজার প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও কবিতা ও গানের চর্চা অব্যাহত রেখেছেন। তার শিল্প সাধণার স্থিতিশীলতায় ভাটা পড়েনি।
১৪ আগষ্ট - ২০২৪
গল্প/কবিতা:
৮ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪