০১.
বৈশাখের প্রথম সকাল। মনে অনেক আনন্দ নিয়ে দিনটি শুরু করল রত্না। কাল রাতে তার স্বামীকে বলেছিল আজ বান্ধবীদের সাথে মেলায় ঘুরতে যাবে। মানা করেনি, শুধু সাবধান থাকতে বলেছে।
সব কিছুই ঠিক করা। বিকালে আশাদের বাসা থেকে সব বান্ধবীরা মিলে একসাথে কলেজ মাঠের মেলায় যাবে। কিন্তু দুপুরে আকাশ কালো হয়ে এলো। এলোমেলো বাতাসে বালুর ঝড়। সে ঝড় আকাশ থেকে বৃষ্টি নামাতে পারেনি। কিন্তু বৃষ্টি নেমেছিল রত্নার চোখে। বজ্র সহ বৃষ্টি।
বাতাস কমতে শুরু করলে রত্না তার রুমে ঢোকে। বৈশাখী সাজ সাজতে হবে তাকে। আয়নার সামনে বসে যখন সে সাজছে, তখন তার ভাই সুমন কল করে ফারুকের মৃত্যুর খবরটা জানায়। একটু ও বিচলিত হয়নি সে। ফারুক মারা গেছে তাতে তার কি? সে সাজতে থাকে। হয়তো ফারুকের মৃত্যুতে সে অরেকটু ভার মুক্ত হল। কেউ বিরক্ত করতে আসবে না আর। কারো ভয়ে চোখ ফেলতে হবে না চারদিকে। তবে এই ভাব টুকু ধরে রাখতে পারেনি রত্না। চোখে কাজল দিতে গিয়ে দেখলো, চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। শরীর অবশ হয়ে এলো। কাঁপতে শুরু করেছে সে। কান্নার জোয়ার আসছে। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরেছে, তবুও আটকে রাখা যাচ্ছে না। তাড়াতাড়ি করে বাথরুমে ঢুকল। পানির টেপ ছেড়ে দিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে। বাথরুমের আয়নায় নিজেকে দেখে ভীষণ অবাক হল। কেন কাঁদছে সে? কার জন্যই বা কাঁদছে? ফারুকের জন্য? যে ফারুক তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, দু’বছর ঘর থেকে বের হতে দেয়নি। যার জন্য তার বাবা মা অল্প বয়সে তাকে বিয়ে দিয়েছে, সেই ফারুকের জন্য কাঁদছে সে! ফারুককে সে ঘৃণা করে, তিল পরিমান আবেগ ও জমা হয়নি তার জন্য। আর যদি তাই হয়, তাহলে সে কাঁদছে কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুজে পায় না রত্না।
০২.
সেই দিন থেকে ছয় বছর আগে, কলেজের প্রথম বর্ষে পরীক্ষা দেয়নি সুমন। তার সাথে ছিল ফারুক আর রিংকু। ফলে অন্য বন্ধুদের চেয়ে ওদের সাথেই দিনে দিনে তার ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। যেখানেই যাবে তারা তিন জন এক সাথে। ওদের মধ্যে ফারুক ভাল ফুটবল খেলে।
সে তার শরীর সম্পর্কে অনেক সচেতন। কোন বাজে অভ্যাস তার নেই। তার বড় চার ভাই রাজনীতি করে। ফলে এলাকায় তার অনেক প্রভাব। সে ভাড়ায় এলাকার বাইরে খেলতে যায়। নামি এবং দামি খেলোয়াড় হিসাবে ভাড়ার অংকটাও বেশ বড়। আর মফস্বলের খেলা মানে মারামারি হবেই, ফারুক তাতে ও বেশ পটু। মারামারিতে সব সময় তার সাথে থাকে সুমন আর রিংকু।
রিংকুর বাবা প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। তারা আট ভাই-বোন। রিংকু সবার ছোট। তারচেয়েও বড় পরিচয় সে এই এলাকার নামকরা ডাকাতের নাতী। যারা তার নানাকে দেখেছে, সবাই বলে রিংকু অবিকল তার নানার মতো। স্বভাবটা ও রিংকু পেয়েছে তার নানার কাছ থেকে। কাউকে যে মূল্য দিতে হয় সেটা হয়তো সে শিখেনি। তার চরিত্রে নেতা নেতা ভাব আছে। আর তার নেতৃত্ব কেউ অমান্য করে না। তার দামি মোটরসাইকেলের আওয়াজ শুনলেই ছোট বড় সবাই নড়েচড়ে উঠে। প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর ছেলে হিসাবে কলেজে ভর্তি হওয়ার পরই কলেজের সংসদে তার পদ প্রচার সম্পাদক। কিন্তু তার কথার মূল্য সভাপতি থেকে বেশি।
সুমনের বোন রত্না তখন সবেমাত্র ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠেছে। সুদর্শন বাবা আর সুন্দরী মায়ের মেয়ে রত্না দেখতে রত্নের মতই। ফলে এই বয়সেই ছেলেরা তাকে বিরক্ত করা শুরু করেছে। বিরক্ত করা ছেলেদের তালিকায় প্রথম নাম রফিক। রত্নার স্কুলের পরিচালনা কমিটির সভাপতির ছেলে। রত্না কখনো তার মাকে কিছু জানায় নি। কিন্তু একদিন স্কুলে যাবার কিছুক্ষন পরই কাঁদতে কাঁদতে বাসায় চলে আসে। ঐদিন রফিক স্কুলের মোড়ে রিকসা থামিয়ে রত্নাকে চিঠি দেয়ার চেষ্টা করে। রত্না ভয়ে রিকসা ঘুরিয়ে ফিরে আসে। এই ঘটনা সুমনের কানে আসে বিকেলে। সে সন্ধায় রফিককে খুজে বেড় করে সাবধান করে দেয় এমন ঘটনা যেন ভবিষ্যতে না ঘটে। ঘটলে এর পরিনাম ভাল হবে না।
রফিকের কানে সুমনের কথা একটুও আঁচড় কাটতে পারেনি। সে পরদিন রত্নার রিকসা আবার থামায় এবং বাসায় জানালে তুলে নিয়ে যাবার ভয় দেখায়। রত্না ভয়ে বাসায় কিছুই বলেনি। কিন্তু ফারুক দূর থেকে ঘটানাটি দেখে ফেলে। ফলে বিকালে রফিক যখন স্কুলের মাঠে ক্রিকেট খেলছিল তখন রিংকুর মটরসাইকেল থামে পিচের কাছে। রফিক উল্টো দিকে দাড়িয়ে বেটিং করছিল, তাই দেখতে পায়নি। যখন দেখল তখন তার আর করার কিছুই ছিল না। তখন ফারুকের হাতে উঠে এসেছিল একটি স্টাম্প।
রফিককে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার মাথায় আটটি সেলাই লেগেছে, ডান হাত ভেঙ্গেছে আর উপরের পাটির সামনের দু'দাঁত স্কুলের মাঠে হারিয়ে ফেলেছে। রফিকের বাবা মামলা করার চেষ্টা করে। পুলিশ মামলা নেয়নি। শেষ পর্যন্ত রিংকুর বাবাকে বিচারক করে বিচারের আয়োজন করে। বিচারের দু’দিন আগে রিংকু রফিকের বাবাকে কল করে যা বলল তার সারমর্ম হলঃ বিচার হবে ঠিক আছে, কিন্তু আপনার ঘরেও স্কুল পড়ুয়া মেয়ে আছে, কথাটা মনে রাখবেন। নির্দিষ্ট দিনে বিচার আর হয়নি। রফিকের ঘটনার পর রত্নার দিকে অনেক দিন কেউ তাকানো সাহস পায় নি।
সুমন মাঝে মাঝে বন্ধু সুলভ আচরনে ফারুকে শালা বলে গালি দিতো, তখন ফারুক হেসে তার উত্তর দিতো, “ আমার তো বোন নেই, তোর বোন আছে, তুই আমার শালা”। সুমনের কথাটা ভাল লাগতো না। কিন্তু সে কিছু বলতো না। কথাটা রসিকতা হিসাবে নিতো। ফারুক তার পরিবারের একজন ছিল। সুখে-দুখে তার পরিবারের পাশে থেকেছে। কিন্তু বেশিদিন সেই সম্পর্ক ছিল না।
রাজকুমারের মত দেখতে সুমনের আসে পাশে মেয়ের অভাব ছিল না। অন্য সবাইকে পাশ কাটিয়ে যে মেয়েটির সাথে সুমন সম্পর্ক তৈরী করে, সম্পা নামের সেই মেয়েটিকে কারো পছন্দ ছিল না। রূপ আর গুণের ঘর খালি থাকলেও তার দোষের ঘরের অংকটা বেশ বড়। প্রথমে বন্ধুরা সুমনকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। লাভ হয়নি। সে সম্পর্কটা রাখবে না বলেও ধর রেখেছে। তাই বন্ধুরা সবাই ব্যপারটা এড়িয়ে যেতে শুরু করল। সুমনের পরিবার জানার পর, এর সকল দোষ এসে পরে তার বন্ধুদের উপর। বিশেষ করে ফারুক ও রিংকুর ঘারে। একদিন এ নিয়ে ফারুকের সাথে সুমনের চরম ভাবে ঝগড়া হয়। তাদের মাঝে বন্ধুত্বরে মাঝে ফাটল সৃষ্টি হয়। রাস্তা ঘাটে দেখা হলেও কেউ কারো সাথে কথা বলতো না। এভাবেই কেটে যায় দু’বছর।
এ দু’বছরে ঘটে যায় অনেক কিছু। ফারুক কলেজ ছেড়ে ভকেশনালে ভর্তি হয়। পাশ করে সে ইটালি চলে যাবে। রিংকুর বাবা মারা যায়। ছয় মাসের ব্যবধানে তার মা। মায়ের মৃত্যুর পর রিংকুর ভাই বোনদের মাঝে টাকা আর সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা তৈরী হয়। সবাই নিজেরটা গুছিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগহীন বাড়িতে একা হয়ে যায় রিংকু। মাঝে মাঝে ফারুক আর সুমন দেখতে আসতো তাকে। কিন্তু কখনো একসাথে আসতো না। একসাথে এইচ. এস. সি পরীক্ষা দেয় সুমন আর রিংকু। পরীক্ষার শেষ দিন সন্ধায় সুমন রিংকুকে অচেতন অবস্থায় আবিষ্কার করে তার রুমে। হাসপাতালে স্যালাইন চলা অবস্থায় রিংকুর জ্ঞান ফিরে। তখন জানা যায় সে গত দু’দিন কিছু খায়নি। ঘরে খাওয়ার মত কিছুই ছিল না।
এই দু’বছরে সুমনের তেমন পরিবর্তন হয়নি। সে শুধু ব্যস্ত ছিল সম্পাকে নিয়ে। তার বোন রত্না অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পায় এবং জেলায় প্রথম স্থান অর্জন করে। ভাল ছাত্রী হিসেবে সবার কাছে পরিচিত হয়ে উঠে সে।
এইচ. এস. সি. পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের দিন রাতে কলেজ মাঠে সতের জন স্কুল বন্ধু একসাথে মদ খায়। তাদের মধ্যে সুমন, ফারুক আর রিংকুও ছিল। মদ খাওয়ার দুটি কারন; একটি সুখের, রিংকুর ভাল ফলাফল। অন্যটি শোকের, সুমন পাশ করতে পারেনি। মদ খেয়ে তারা মতলামি করেছে। নগ্ন হয়ে কলেজের পুকুরে লাফালাফি করেছে। আশেপাশে ছড়াছড়ি থাকার পরও যে ফারুক সিগারেটে একটি টান ও দেয়নি, সেও সেদিন মদ খেয়েছিল। মাতাল হয়ে ফারুক আর সুমন নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করে। বন্ধুরা ভাবল এবার হয়তো ওদের সম্পর্ক ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু হয়েছে তার উলটো। তাদের মধ্যে তুমুল ঝগড়া হয় এবং শেষ পর্যাযে হাতাহাতি। সেই ঝগড়ার কারণ ছিল রত্না। আবেগপ্রবণ ও মাতাল ফারুক সুমনকে জানায়, সে রত্নাকে ভালবাসে এবং তাকে বিয়ে করতে চায়। সুমন সেটা মানতে পারেনি। ফারুক আর সুমনের বন্ধুত্বের ওখানেই সমাপ্তি ঘটে।
এরপর থেকে ফারুক প্রকাশ্যে সবাইকে বলে বেড়ায় রত্নাকে সে ভালবাসে। স্কুলে যাবার পথে রত্নার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় রত্না গৃহ বন্দি হয়ে পরে।
রিকুর তখন পায়ের নিচে মাটি ছিল না। সে ঢাকায় চলে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিতে।
একা সুমনের জীবনে তখন পরিবর্তন আসে। ছেলের খারাপ ফলাফল এবং মেয়ে রত্নার সমস্যা বিদেশে থাকা বাবাকে ভাবিয়ে তোলে। তিনি দেশে চলে আসেন। প্রথমে ছেলেকে ঢাকায় পাঠান। পরে একই এলাকার মাঝ বয়সী ধনি ব্যবসায়ীর সাথে মেয়ের বিয়ে ঠিক করেন। হলুদের আগের দিন রাতে রত্নার মা তার মেয়ের রুমে ঢুকে দেখেন, তার মেয়ে বই দিয়ে ব্যাগ গুছাচ্ছে। রত্না তার মায়ের করুণ চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “ আম্মা, আমার কি পরীক্ষা দেওয়া অইতো না”? রত্নার মা আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “ তুই আমার পুতের মত আছিলি ফারুক, আমার ম্যাইয়ার এই ক্ষতি কেরে করলি? কেরে করলি?”
ফারুকে সেই দিন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার পেটে ভয়ানক ব্যাথা। রত্নার বিয়ের দিন তার পেটে অপারেশন করা হয়। প্রথমটা ভুল হওয়ার ফলে পর পর আরো দু’বার ফারুকের পেটে অপারেশন করা হয়। ফারুক আর উঠে দাড়াতে পারেনি। বিছানায় শুয়েই কাটিয়েছে জীবনের শেষে দিন পর্যন্ত। অসুস্থ অবস্থায় তাকে যে ই দেখতে যেতো, তাকেই সে বলতো একবার নিজের পায়ে দাড়াতে পারলে রত্নাকে তুলে নিয়ে আসবে। তাকে আটকাতে পারে এমন লোক এখনো জন্ম গ্রহন করেনি। ফারুকের সেই আশা পূরণ হয়নি। এক বছর অমানুষিক কষ্ট ভোগের পর বৈশাখের প্রথম দিন দুপুরে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সময় আকাশে কালো মেঘ ছিল। হয়েছিল ধূলো ঝড়।
০৩.
বৈশাখের প্রথম দুপুর। আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে। প্রচন্ড বেগে বাতাসের সাথে ধূলো উড়ে আসছে। যাকে মোটামুটি ধূলোর ঝড় বলা যায়। সেই ঝড়ের মধ্যে রাস্তার ঠিক মাঝখানে দাড়িয়ে আছে সুমন। কি করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। আগে নাকি বৈশাখ মাসেই কালবৈশাখী ঝড় হতো। বড়দের কাছে তাই শুনেছে সে। কিন্তু আজই হতে হবে এমন তো কথা নেই। বিরক্ত হল মনে মনে। ধূলো থেকে বাঁচার জন্য রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে ঢুকল।
“ঔ, একটা চা দে”। চায়ের অপেক্ষায় বসে সিগারেট ধরাল সুমন। সবকিছুই বিরক্ত লাগছে। প্রতিদিনকার মতো আজও সম্পার সাথে ঝগড়া হয়েছে তার। এমন হবার কথা ছিলনা। আজ তাদের ঘুরতে যাবার কথা। কিন্তু হল উল্টো। ঢাকায় ফিরে যাবার কখা ভাবছে সে। চা খেতে খেতে আকাশ পরিষ্কার হয়ে এল। বাতাসও কমে গেল। চা শেষ করে স্টেশনের দিকে হাটতে শুরু করে সুমন।
স্টেশনের মোড়ে ফারুকের ভাই কাউসারের দোকান। তার সামনে কিছু মানুষের জটলা। কি হয়েছে দেখা দরকার। যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না সে। রত্নার জন্য ফারুকের অধ্পতনের পেছনে সুমনকেই দায়ী করে ফারুকের চার ভাই। তবুও আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল। জটলার ভেতর কাউসার ভাই মাটিতে গড়িয়ে গড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। হঠাৎ করে তিনি উঠে দাড়ালেন এবং বাড়ি দিকে ছুটলেন। কর্মচারীরা দোকান বন্ধ করে তার পেছন পেছন ছুটল। কি হয়েছে বুঝার বাকি ছিল না। ফারুক ভীষন অসুস্থ ছিল। তিন বার কাটাছেড়া করা হয়েছে তার শরীর। সেই ধকল সামলে উঠতে পারেনি। বন্ধুরা তাকে অন্তত একবার ফারুককে দেখে আসতে বলে ছিল। সে যায় নি। শেষ দেখাটাও আর হল না। বুকের ভেতরটা কেমন যেন হাহাকার করে উঠল। ফারুকের মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠছে বারবার। আম্মাকে আর রত্নাকে জানানো দরকার। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দু’জনকেই জানাল। বন্ধুরা কল করে মৃত্যুর সংবাদ দিতে শুরু করেছে। মোবাইলটা পকেটে ঢুকাল। কোন কিছু চিন্তা না করেই ফারুকের বাসার দিকে হাটতে শুরু করল সুমন।
ফারুকে বাড়ির সামনাটা তখনও ফাঁকা। লোকজন এখনও আসতে শুরু করেনি। বাড়িটাতে মরা মরা ভাব চলে এসেছে। গেইটের কাছে এসে থেমে গেল সুমন। অনেক দিন এ রাস্তায় আসা হয়নি তার। বাড়িটাতেও না। চারপাশে তাকাল পরিচিত মুখের খোজে। যার সাথে বাড়ির ভেতরে ঢোকা যায়। তেমন কেউকে পেল না। নিজে ভেতর থেকে কেমন যে তাড়া অনুভব করছে। তাই আর অপেক্ষা না করে ভেতরে ঢুকে গেল। ফারুকের ঘর থেকে তার মায়ের কান্না ভেসে আসছে। কান্নার সাথে সাথে প্রলাপ বকছেন তিনি। পুত্রের মৃত্যুতে মায়ের কষ্ট সবচেয়ে বেশি। মা তো কাঁদবেই। ঘরের ভেতর ঢুকার পর সুমনের দিকে সবাই একপলক তাকিয়েছে শুধু, কিছুই বলেনি। ফারুকের বিছানার পাশে মাটিতে বসে কাঁদছিল তার মা। তিনিও তাকালেন এবং চিৎকার করে বললেন, “ তুই আমার ব্যাইত আইছছ্ কেরে? আমর পুত মরছেনি দেকতি? তুই আমার পুতেরে খুন করছছ্, তুই আমার পুতের খুনি। তুই বাইরা আমার ব্যাইত্যে। হেরে আমার ব্যাইত্যে বাইরইতে ক”। বলতে বলতে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। বাড়ির মেয়েরা ছুটে যায় তাকে ধরতে। ফারুকের মায়ের কথা সুমন শুনতে পেল কিনা বুঝা গেল না। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিছানায় পরে থাকা ফারুকের লাশের দিকে। শুকনো একটা শরীর। মনে হচ্ছে কংকালের উপর চামড়া লাগিয়ে দিয়েছে কেউ। গায়ের সেই চামড়াটাও পুড়িয়ে দিয়েছে। মাথায় মাত্র কয়েকটা চুল। ফারুক বলে বিশ্বস হচ্ছে না সুমনের। দু’জন বন্ধু সুমনের সাথে এসে দাড়াল। চোখে অবিশ্বাস নিয়ে তাদের দিকে তাকায়। ওরা বুঝতে পারে।
কাধে হাত রেখে সান্তনা দেয়। তখন রত্নার কল আসে। যন্ত্রের মত মোবাইল কনে দেয় সে। রত্নার কান্নার শব্দ শুনতে পায়। “ভাই... তুমি ফারুক ভাইরে মাফ্ কইরা দিও” বলেই কেটে দেয় রত্না। এতক্ষন হয়তো বোনে অনুমতির জন্যই অপেক্ষা করছিল। এবার হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। বন্ধুরা তাকে জড়িয়ে ধরে। ঐ অবস্থাতেই জ্ঞান হারায় সুমন।
রিংকু আসে বিকেলে। তার আসার কথা না। একটি হত্যা এবং তিনটি অস্ত্র মামলার পলাতক আসামি সে। তার নামে ওয়ারেন্ট বের হয়েছে। মামলাটি গোয়েন্দা পুলিশের হাতে। গত আঠার দিন ধরে পলাতক রিংকু, এর মাঝে দু’বার তার বাসায় তল্লাশী চালিয়েছে পুলিশ। যে কোন সময় ধরা পরতে পারে। তারপরও রিংকু এসেছে। কারন, যা করার তা সে এই কয়দিনেই করে ফেলেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসণ তার মামলা তুলে নিবে কথা দিয়েছে। বিনিময়ে প্রশাসণের জন্য তাকেও অনেক কিছু করে দিতে হবে। দু’পক্ষের বোঝাপড়া ভালই হয়েছে, তাই রিংকু আর এতটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। ধরা পরলেও বের হয়ে আসতে পারবে। হয়ে উঠবে বড় ছাত্রনেতা।
সন্ধার আগে আগে ফারুকের দাফন সম্পন্ন হয়। তার শেষ যাত্রায় প্রথম দু’টি ভার নেয় দুই ভাই আর শেষ দু’টি সুমন ও রিংকু তাদের কাধে তুলে নেয়। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে জানাযায় অংশ নেয় দেশ-বিদেশের অনেকেই। কবরে মাটি দেওয়ার সময় গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ধরা পরে রিংকু। দাফন কাজ শেষ করার জন্য সময় দেওয়া হয় তাকে।
দাফন শেষে সবার সাথে কুলাকুলি করে বিদায় নেয় রিংকু। সুমনের সাথে কুলাকুলির সময় কানে কানে বলে, “ভাল থাকিস্, পহেলা বৈশাখের শুভেচ্ছা রইল”। রিংকু তার সাথে রসিকতা করল কিনা বুঝতে পারেনি সুমন। রিংকু পুলিশের গাড়ির কাছে যাবার আগেই বৃষ্টি নামল। ঝুম বৃষ্টি। সবার তাড়াহুড়া বেড়ে গেল। রিংকু তার দু’হাত ছড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভিজতে থাকল। একজন পুলিশ দৌড়ে এসে তার হাতে হাতকড়া পড়িয়ে গাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল।
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে রাস্তায় দাড়িয়ে রিংকুর চলে যাওয়া দেখল সুমন। মানুষর জীবন কত না বিচিত্র। বিচিত্র তাদের দিন গুলো।
২০ জানুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৭ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪