এতিম

মা (মে ২০১১)

দেবব্রত দত্ত
  • ৪৪
  • 0
আমি আমার মায়ের পাশে বসে আছি। আমার মা, আমার একমাত্র আশ্রয়। আমার সব কিছুই আমার মাকে ঘিরে। আমার চাওয়া পাওয়া, সবই উনার কাছে। উনার পাশে বসে খুব কম সময়ই কাটিয়েছি। মায়ের পাশে থাকতে আমার সব সময়ই ভাল লাগে। আজ ও ভাল লাগছে।
আমার মা বিছানায় শুয়ে আছেন। গলা পর্যন্ত চাদর টানা। মুখটা বামদিকে একটু হেলে আছে। চেহারায় প্রশান্তির ছাপ। অনেক শান্তি নিয়ে আমার মা ঘুমচ্ছেন। তার আলোকিত মুখটা দেখে মনের মধ্যে সুখ অনুভব করছি। অনেক সুখে আছেন এখন আমার মা। সারা জীবন যদি এভাবে তাকিয়ে থাকতে পারতাম। সারা জীবন না পারলেও, আমার ভাই বোনরা আসার আগ্ পর্যন্ত অবশ্যই পারব। তাদের কল করা হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবে।
আমি আমার চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট। সবাই আমাকে অনেক আদর করে। তাই হয়তো আমি সবার অবাধ্য। আর আমার মা আমার প্রতি সবসময়ই একচোখা। আমি বাড়িতে বেশি সময় থাকি না। সকালে বের হয়ে যাই, রাতে ফিরি। সবার সাথে প্রতিদিন দেখাও হয় না। এমনকি বাড়ির অনুষ্ঠানে আমার উপস্থিতি ঈদের চাঁদের মত। তবুও বাড়িতে ভাল কিছু রান্না হলে, তার ভাল অংশটা মা আমার জন্য আলাদা করে রেখে দেন। বড় মাছের মাথার প্রতি আমাদের চার ভাইয়ের লোভ। কিন্তু রান্নার পরপরই মা আমার জন্য মাথাটা আলাদা করে রাখতেন। আমি বাড়ি ফেরার পর সেটা আমাকে খেতে দেওয়া হতো। এটা নিয়ে বড়ভাইয়ের সাথে আমার কত মিথ্যা ঝগড়া। তিনি আমার জন্য এখন আর মাছের মাথা খেতে পারেন না, মা নাকি এখন শুধুই আমার, আর তাকে ভালবাসে না।
আমার প্রতি মায়ের এমন একচোখা ভাব কেন তা আমি জানি না। তবে ছোট-খালা বলেছেন, আমার জন্য মা যতটুকু সময় দিতে পেরেছেন, আর কারো জন্য ততোটা দিতে পারেন নি। তখন আমাদের আর্থিক অবস্থা ছিল করুন। অনেক কষ্ট করে সংসার চালিয়েছেন। সন্তানদের সকল চাহিদা পূরণ করতে পারেন নি। তাই আমাকে দিয়ে তার অপূর্ণ ভালবাসা টুকু পূরণের চেষ্টা।
আমার মায়ের যখন আমার বাবার সাথে বিয়ে হয় তখন নাকি বাবার অবস্থা খুব খারাপ ছিল। আমার বাবার বাবা, মানে আমার দাদা ছিলেন এই এলাকার নামকরা ডাকাত। শিক্ষিত আমার বাবা তার এই পেশা এবং তার সম্পদকে ঘৃণা করতেন। দাদার মৃত্যুর পর, লেখা পড়া শেষ করে, তিনি আর কিছুই করেন নি। দুহাতে তার পিতার রেখে যাওয়ার সম্পদ উড়িয়েছেন। কলেজের ছাত্রদের নিয়ে এলাকার উন্নয়নের জন্য একটি সংগঠন করতেন। আমার মা তখন মাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছেন। বাবার কর্মকাণ্ড তার মন কেড়ে নেয়। তিনি বাবার কাছে আসার অনেক চেষ্টা করেন, কিন্তু ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত আমাদের এক আত্মীয়কে ধরে বাবার সাথে কথা বলার ব্যবস্থা করেন। আমার মা আর ছোট-খালা পিঠাপিঠি বোন। একসাথে পড়তেন। সেদিন দুজন একসাথে বাবার সাথে কথা বলতে যান।
বাবার সাথে মায়ের প্রথম কথা ছিল, “আপনাকে আমার অনেক পছন্দ। আমাকে বিয়া করবেন?”
“না”।
“কেন? আমি কি দেখতে খারাপ?”
“না”।
“তাহলে?”
“কি তাহলে?”
“আমি দেখতে কেমন?”
“সুন্দর”।
“মাত্র এইটুকু! আমি এই কলেজের সবচাইতে সুন্দরী”।
“তো ...আমি কি করবো?”
“কিছুই করতে হবে না। খালি আমাকে বিয়া করেন”।
“পারব না”।
“আমি ঘর গুছাইতে পারি, ভাল রান্না করতে পারি, কাপড়ও ধুইতে পাড়ি, আমার বাপের টাকাও আছে। আপনার কোন সমস্যা হবে না”।
“আমি বিয়ে করতে পারব না”।
“কেন পারবেন না?”
“তুমি জান আমি কে?”
“আপনার নাম সাত্তার”।
“আর?”
“আপনি হীরা ডাকাতের ছেলে”।
“ডাকাতের ছেলেকে বিয়ে করবে!”
“হীরা ডাকাতের ছেলে আমার জামাই, মনে করলেই শইল্যে কাটা দেয়”।
“ফাজিল কোথাকার”। বাবা বিরক্ত হয়। “আর কক্ষনো আমার কাছে আসবে না”, বলেই হাটতে শুরু করেন।
পেছনে আমার মায়ের রাগে ভরা কান্না কান্না চেহারাটা তিনি দেখতে পেলেন না। শুধু এই কথাটা শুনেছিলেন, “আমি আর আসব না, কিন্তু আপনি যদি আজ সন্ধ্যার মধ্যে আমার বাড়িতে বিয়ার প্রস্তাব না দেন, রাইতে আমি গলায় দড়ি দিমু। মনে রাইখেন”।
আমার বাবা মনে রাখেন নি। রাতে মা সত্যি সত্যি গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। ছোট-খালার জন্য পারেন নি। পরদিন সকালে আমার নানা তার আদুরে আর জেদি মেয়ের জীবন বাঁচাতে সাত্তার নামক সেই নিঃস্ব ছেলেটাকে হাতে পায়ে ধরে বিয়ের জন্য রাজি করেন। বাবা কাবিন হিসাবে মাকে দিয়েছিলেন বসত ভিটা, কারণ তার আর কিছুই তখন ছিল না। বাবার অসম্মতি সত্যেও নানা বিয়ের খরচ বহন করেন। বাবা মার বিয়ে হয়। বাবা সমাজ সংসার ছেড়ে নিজ সংসারে মনোযোগ দেন। আমাদের অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। ছোট-খালার কাছে বাবা-মায়ের এই গল্প শুনতে শুনতে আমাদের সবার এখন মুখস্থ । ছোট-খালা আমাদের বাসায় এসেছেন, আর দু’তিন বার এই গল্প বলেন নি, এমনটা কখনো হয়নি। তার ভাষায় এটা তার জীবনের সবচেয়ে “আচানক ঘটনা”। এমন ঘটনা আজ পর্যন্ত তিনি কোথাও শুনেন নি।
যখন থেকে বুঝতে শিখেছি, তখন থেকেই দেখে আসছি, আমার মা সকাল-সন্ধ্যা ব্যস্ত। সংসারের সকল কাজ তার নিজের হাতে করতে হবে। মেয়েরা অনেক কাজ করে সাহায্য করার চেষ্টা করে, কিন্তু তাতে তার মন ভরে না। নিজে করা ছাড়া তৃপ্তি মেলেনা।
মা বাবাকে আপনি করে ডাকেন। সেটা আমরা ও পেয়েছি। মা-বাবাকে আমরা সবাই আপনি বলি। আমি তো আমার ভাই-বোনদেরকে ও আপনি বলি। ওরা আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়।
আমরা মা বাবার ঝগড়া কখনো দেখিনি। বাবা রেগে গেলে মা চুপ থাকেন। মা রুখে দাঁড়ালে বাবা চুপ। আর মা শুধু তার সন্তানদের পক্ষ হয়ে বাবার বিরুদ্ধে দাঁড়ান। আমি তখন স্কুলে পড়ি। বড় দু বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। বড় ভাই আর লেখা পড়া করবে না ঘোষণা দিয়ে বাবার সাথে ব্যবসা শুরু করেছেন। রাত সাড়ে দশটার মত বাজে সেদিন। আমি শুয়ে পরেছি। বাবা তখন রাগে গজ-গজ করতে করতে ঘরে ঢুকলেন। চিৎকার করে বড়ভাইয়ের নামে মায়ের কাছে নালিশ করছেন। কি হয়েছে বুঝতে না পারলেও, বড় ভাই যে অনেক বড় অপরাধ করেছেন, এতটুকু বুঝতে পেরেছিলাম। আমি ভয়ে মুখে কাঁথা মুরি দিয়ে ঘুমিয়ে পরি। সকালে নাস্তা খেয়ে পড়তে বসেছি, তখন বড়ভাই গেইট দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন। তার পেছনে লাল শাড়ি পরা অল্প বয়সী এক মেয়ে। তখনই ছোট-আপার গলা শোনা গেল, “আম্মা, বড় ভাই আসছে”।
মা বের হওয়ার আগেই বাবা বের হলেন। বড় ভাই উঠানের মাঝখানে থমকে দাঁড়ালেন। অপরাধীর মত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। তার একহাত পেছনে মেয়েটিও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। মাও বের হলেন। বাবা ঘরের ভেতরে থেকে একটা লাঠি নিয়ে বড় ভাইয়ের দিকে এগিয়ে যান।
“এই শিখছছ্, সারা জীবন এই শিখাইছি! শইল্যের মধ্য ডাকাইতের রক্ত জাইগা উঠছে, না? মানুষ ডাকাতি করস্। কুলাঙ্গার কুনহানের”। রাগে বড় ভাইকে পেটাতে শুরু করেন বাবা।
মা তাড়াতাড়ি বাবাকে আটকতে গেলেন। “কি করেন, কি করেন. পোলা-ডা মইরা যাইব”।
“মরুক। ডাকাইতের বংশ কমবো”। বাবা থামেন নি।
মা কোন উপায় না দেখে বড়ভাইয়ের সামনে দাড়িয়ে পরেন। বাবা আর লাঠি চালাতে পারেন নি। “তোমার জন্য পোলা-ডা নষ্ট হইছে। লাই দিয়া মাথার তুইল্লা রাখছ”। লাঠি ফেলে দিয়ে ঘরের দিকে হাটতে শুরু করেন। “এমন কুলাঙ্গার ছেলে আমার দরকার নাই। ওরে বাড়ি থেকে বাইর হইয়া যাইতে কও”।
মা বাবার যাত্রা পথে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “ওর যদি এই বাড়িতে জাগা না থাকে আমি ও থাকমু না। ওর সাথে চইলা যাব। মনে রাইখেন”।
মা শাড়ি পরা মেয়েটির দিকে এগিয়ে যান। মেয়েটি ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। কাছে গিয়ে নরম সুরে বললেন, “কি নাম তোমার?”
কোনভাবে কান্না থামিয়ে আস্তে উত্তর দিল, “পুতুল”।
“অনেক সুন্দর নাম। কানতেছ কেন? যে কাজ করছ, সেটা অনেক সাহসের। কানলে হবে? তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। চল, ঘরে চল”।
মেয়েটা বুঝতে পারছিল না কি করবে। মা ধমকের সুরে বললেন, “আমি তোমার শাশুড়ি। ঘরে চল”।
মেয়েটাকে ধরে ঘরের দিকে নিয়ে গেলেন। দরজার কাছে দাড়িয়ে বড় ভাইকে ডাকলেন, “তুইও ঘরে আয়”।
বড়ভাই তখন ও একই ভাবে দাড়িয়ে ছিলেন। মাটি থেকে চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকালেন। মা ধমক দিলেন, “আয়”। মায়ের কাছে যেতেই বললেন, “যা,আব্বার পায়ে ধরে মাপ চা। যা!”
ঔ দিন প্রথম বড়ভাইকে কাঁদতে দেখলাম। বাবার পায়ে ধরে সে কি কান্না। “আব্বা, ভুল হইয়া গেছে আব্বা। মাফ কইরা দেন। আমি ওরে ফিরাইয়া দিয়া আসব। মাফ কইরা দেন আব্বা। মাফ কইরা দেন”।
আব্বা চিৎকার করতে লাগলেন, আমার পা ছাড়। কিন্তু বড়ভাই ছাড়লেন না। তার মুখে একটাই কথা, “মাফ কইরা দেন আব্বা”।
শেষ পর্যন্ত বাবা লাথি দিয়ে বড়ভাইকে সরিয়ে দেন। বড়ভাই মাটিতে পড়ে কাঁদতে থাকেন। বাবা বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। ফিরেন দুপুরে, সাথে মিস্ত্রি নিয়ে। বড়ভাইয়ের জন্য আলাদা ঘর হবে। বড়ভাইকে ডেকে এনে কথা বলেন। আমি একটা ভাবী পাই। পুতুল ভাবী। মা তখন বড়ভাইয়ের পাশে না থাকলে কি হতো কে জানে? জানার সুযোগ ও হয়নি। মা সব সময় আমাদের পাশে থেকেছেন।
আমাকে যেদিন মোটরসাইকেল কিনে দেওয়া হয়, তার আগের দিন বাড়িতে ফিরেছি রাত একটায়। দরজা বন্ধ। তাই থাকার কথা। রেশমি আপার ঘরের জানালায় ডাক দেই। “আফা, রেশমি আফা, দরজা-ডা খুলেন”।
রেশমি আপার সাথে আমার বয়সের পার্থক্য সবচেয়ে কম। তাও সাত বছর। তাকে আমি মাঝে মাঝে তুই করে ও বলি। রেশমি আপা বিরক্তি সহ দরজাটা খুলে দেন।
“আম্মা ঘুমায় গেছে?”
“হু”।
“তাইলে কেমনে হইব? আমার খিদা লাগছে তো!”
“যা না! রান্না ঘরে আছে। নিয়া খা”।
“আপনে একটু বাইরা দেন না?”
“পারব না। আমার ঘুম পাইছে”।
আমার রাগ হল। “যাও ঘুমাও-গা। খামুই না আজ”। আমি আমার রুমে এসে শুয়ে পরি।
দু'মিনিট পর মা এসে দরজার পাশে দাঁড়ালেন। “টেবিলে তোমার খাবার দেওয়া হইছে। খেয়ে যাও”।
মা বাবা আমাদের তুমি এবং শুদ্ধ করে বললে বুঝতে হবে রাগ করে আছেন। এখন মা ও আমার উপর রাগ করে আছেন। আমি চুপচাপ খাবার টেবিলে এসে বসলাম। “আম্মা আপনি খাইছেন?”
“না”। মুখটা খুব ভার করে উত্তর দিলেন।
“তাইলে খেতে বসেন। আমাকে মুখে তুলে দিবেন”।
“অনেক বড় হইছ, নিজে নিজে খাও”।
“তাইলে কিন্তু আমি খামু না”।
“এটাই-তো পারবা, কিভাবে আমাকে কষ্ট বেশি দিতে পারবা সবসময় সেই চিন্তা”।
“তাইলে আপনি খাওয়াই দেন”।
মা খাবার নিয়ে মাখতে শুরু করেন। “তোমাকে বলি তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরবা। কে শুনে কার কথা। সে আরো দেরি করে আসে”। কথার ফাঁকে আমার মুখে ভাত তুলে দিচ্ছেন।
“আম্মা, আমি যদি তাড়াতাড়ি চলে আইতাম, আপনে কি আমাকে মুখে তুলে খাওয়াইয়া দিতেন? এই খাওন আমি কই পাইতাম?”
“তর আব্বা আমারে প্রতিদিন কয়, আমি নাকি তরে বেশি লাই দেই”। মায়ের রাগ কমতে শুরু করেছে।
এটা আমার নিয়মিত ঘটনা। মায়ের আদর পেতে মাঝে মাঝে দেরি করে ঘরে আসি। প্রথমে রাগ থাকলেও পরে সব ঠিক। মায়ের কাছে আবদার গুলা এই সময়ই করা হয়। ওই দিনও করেছিলাম। “আম্মা, কলেজে না, অনেকের মোটরসাইকেল আছে”।
“তো!” সরু দৃষ্টিতে মা আমার দিকে তাকান। বুঝে ফেলেছেন আমি কি বলব।
আমি হেসে বললাম, “আমার একটা লাগবো”।
“তর আব্বা শুনলে ঠেঙ্গাবে”। মুখে ভাত তুলে দিতে দিতে বললেন।
“আপনে কন না। তাইলে কিছু কইব না”।
“না। মোটরসাইকেল আমার ডর লাগে”।
“কিছুই হইতো না। আপনে কন”।
“ওইল, কইয়া দেকমুনে”।
খুশিতেই আমার ক্ষুধা মিটে গেল। “আমি আর খামুনা। আপনে খান”।
“কিছুই তো খাইলি না”। মায়ের তো আর ছেলেকে খাইয়ে মন ভরে নি।
“না, না, আমি আর খামু না। আপনে খান”।
আমি ঘুমাতে চলে যাই। মা যে সে রাতেই বাবাকে এ কথা বলবেন, বুঝতে পারিনি। সকালে মা এসে আমাকে ডেকে দিলেন, “তাড়াতাড়ি উঠ, তোর আব্বা কথা বলার জন্য বসে আছে”।
আমি হাত মুখ ধুয়ে বাবার সামনে হাজির হলাম।বাইরের ঘরে বসে তিনি নাস্তা খাচ্ছেন।
“তোমার আম্মার মুখে শুনলাম, তুমি নাকি মোটরসাইকেল কিনার ইচ্ছা প্রকাশ করেছ?”
লক্ষণ খুবই খারাপ। আমি কিছু না বলে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকি।
বাবা আবার প্রশ্ন করলেন, “চালাতে জান?”
“জি আব্বা”।
“খুব ভাল। এখনই-তো তোমাকে দেখা যায় না, আর গাড়ি কিনে দিলে তো খুঁজেই পাওয়া যাবে না”।
আমি কি করব বা বলব বুঝতে পারছিলাম না। বাবার জন্য চা এনে মা আমাকে উদ্ধার করলেন। “ছেলে যখন চাইছে, কিনে দিলেই তো হয়”।
“হুম্”। বাবা চা-এ চুমুক দিতে দিতে বললেন। “এখন আমার হাতে টাকা নেই। সামনের ঈদে কিনে দিব”।
“এটা কোন কথা হল”। হাতের বালা দু’টু খুলে দিয়ে বললেন, “ধরেন, এখন ওকে মোটরসাইকেল কিনে দেন। ঈদে আমাকে বালা করে দিয়েন”।
বাবা মায়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর কিছু না বলে বাইরে চলে গেলেন। মা চায়ের কাপ হাতে হাসি মুখে আমাকে বললেন, “যা, নাস্তা খা”।
আমি তখনও বুঝি নি ওই দিনই আমাকে মোটরসাইকেল কিনে দেয়া হবে। সেই দিন সন্ধ্যায় বড়ভাই আমাকে খেলার মাঠ থেকে বাবার কাছে নিয়ে যান। আমাকে আমার পছন্দের মোটরসাইকেল কিনে দেয়া হয়। আমার পেছনে বসে বাবা বাড়ি ফিরেন। মোটরসাইকেল থেকে নেমে বাবা আমার মাখায় হাত রেখে বলেন, “ভালই তো চালাস্। কিন্তু সাবধানে চালাবি। ঠিক আছে?”
“জি আব্বা”। আমি বাবার পায়ে ধরে সালাম করি। ঘরে ঢুকে মাকে সালাম করি। মায়ের কারণে পাওয়া মোটরসাইকেল ছিল অনেক প্রিয়। অনেকটা আমার শরীরের অংশের মত। সারা দিন এটার সাথেই কাটত। সুমন আর ফারুকের সাথে এই মোটরসাইকেলে যে কোথায় কোথায় গিয়েছি তার কোন হিসাব নেই।
ভালই ছিলাম, সুখেই ছিলাম। কষ্ট যে কি, সেটা তখনও জানতাম না। জীবনের মানেও বুঝতাম না। কিন্তু জীবন কাউকে ক্ষমা করে না। জীবন প্রতিটি মানুষকেই তার মানে বুঝিয়ে দেয়। আমিও সেই তালিকা থেকে বাদ পড়ি নি। হঠাৎ করেই বাবা মারা গেলেন। বাবার মৃত্যুর পর আমার জীবন বদলাতে শুরু করল। স্বামী শোকে পাথর আমার মা সংসার থেকে মন উঠিয়ে নিলেন। ঘরের কোন কাজই আর তাকে টানে না। নিজ ঘরে পরের মত বসবাস করতে শুরু করলেন তিনি। আস্তে আস্তে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেক ডাক্তার দেখানো হয়েছে। রোগ ধরা পরে নি। ডাক্তার শুধু বলেন, স্বামীর শোকে তিনি মানুষিক ভাবে ভেঙ্গে পরেছেন।
আমাদের সংসারের দায়িত্ব পড়ে পুতুল ভাবীর উপর। তিনি এই সংসার সামলাতে পারেন নি। শুরু হয় অশান্তি। অশান্তিতে আগুন জ্বালে যখন বড়ভাই তার নামে অনেক দামি একটা জমি কিনে। আমার ভাই-বোনদের মধ্যে সম্পত্তির ভাগ নিয়ে অবিশ্বাস জন্মাতে শুরু করে। মা ব্যাপারটা বুঝতে পারেন। তিনি সবাইকে ডেকে সম্পত্তি ভাগ করে দেন। আমি এসবে ছিলাম না। জানতামও না কার ভাগে কি ছিল। কিন্তু একদিন ঘরে এসে দেখলাম, আমার মা কাঁদছেন। “আম্মা কি হইছে, আপনে কান্দন কেন?”
“কিছু হয় নাই বাবা”।
“না, আপনে কন কি হইছে”।
“কান্দি কি আর শখে! তর বড়ভাই আইজ কইছে কেউরে আর বসাইয়া খাওয়াতে পারবো না। টিংকু আর রেশমা ঝগড়া কইরা বাড়ি ছাইড়া চইলা গেছে। তর আব্বা নাই বইলা আমার আইজ এই দিন দেখতে হইতাছে। তর আব্বা আমারে শাস্তি দেওয়ার জন্য একলা রাইখা চইলা গেছে। আমার আর ভালা লাগেনা। ভালা লাগে না”।
আমার ওই সময় কি হয়ে ছিল জানি না। চিৎকার করে বড়ভাইকে ডাকতে শুরু করি, “বড়ভাই, বড়ভাই”।
বড়ভাই তার ঘর থেকে বর হয়ে বললেন, “কি হয়েছে?”
“আমি আর এই বাড়িতে থাকব না। আমাকে হিসাব বুঝিয়ে দেন, আমি আম্মাকে নিয়ে এ বাড়ি থেকে চলে যাব”।
“চলে যাবি?” বলে বড়ভাই আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। “তুই কেন যাবি? এ বাড়ি তো তোর। আমিই চলে যাব। বাকিরাও নাকি চলে গেছে। আমি ও থাকব না। আমিও চলে যাব। চলে যাব”। বলতে বলতে ঘরের ভেতর চলে গেলেন।
কি হচ্ছে বুঝতে আমার অনেক সময় লাগল। কিন্তু তখন আর কিছুই করার ছিল না। সবাই চলে গেল। আমি আর আমার মা বাড়িতে একা রয়ে গেলাম। বাড়ি টা আমার নামে ছিল। বাবার সম্পত্তির ভাগ আমি পাই নি। মায়ের নামে থাকা এই বাড়ি তিনি আমার নামে করে দিয়েছেন।
জীবনের প্রথম অর্থকষ্টে পরলাম। মা আরও অসুস্থ হয়ে পরলেন। ডাক্তার দেখানোর টাকা ছিল না। উপায় না পেয়ে আমার মোটরসাইকেল বিক্রি করে দিলাম। খুব প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বেড় হই না। সারাদিন মায়ের পাশে পাশে থাকি। ঘরে চুলা জ্বলে না। বাইরে থেকে খাবার এনে খাই। এভাবেই চলছে আজ পর্যন্ত।
আজ সকালে বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। মাধব আসবে। ওকে আনতে ষ্টেশনে যেতে হবে। আমরা স্কুল পর্যন্ত এক সাথেই ছিলাম। ওর বাবার মৃত্যুর পর এখান থেকে চলে যায়। মাধব একটু অন্য রকম ছেলে।একজন ভাল শ্রোতা বলা যেতে পারে। প্রত্যেকের কথা মন দিয়ে শোনে এবং নিজের মত করে ব্যক্ষা করার চেষ্টা করে। কবিতা ও লিখে। তার বেশির ভাগ নিজের করা। সাদা টি শার্টের উপর নিজেই আঁকবে. নিজের কবিতা লিখবে। গতবার আমি একটা টিশার্ট রেখে দিয়েছি।সামনে অদ্ভুত আঁকিবুঁকি আর পেছনে দু লাইনের একটা কবিতা।
ইচ্ছে করে ফিরে যাই সেই প্রেম হীন কৈশোরে
যখন বুঝিনি প্রেম, শরীর কিংবা যৌনতা।
দুলাইনের এই কবিতার মানে আজও আমি বুঝিনি। হয়তো বুঝার বয়স এখনো হয়নি। তবে ভাল লেগেছে। তাই রেখে দিলাম। এবার নাকি আমার জন্য একটা টিশার্ট নিয়ে আসছে। সেই অপেক্ষায় আছি।
আমি তৈরি হয়ে মায়ের কাছে গেলাম। আম্মা আমি একটু বাইরে গেলাম। এক ঘণ্টায় চলে আসব।
মা চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলেন। চোখ খুলে আমার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। “আজকা বাইরইছ না। ঘরে থাক”।
‘আম্মা, চইলা আমু তো’!
‘যাইস না, ঘরে থাক’।
মা কখনো আমাকে কোন কিছুতে এভাবে মানা করেন নি। আজ কেন করেছেন জানি না। আমার ও যেতে মনে চাইছে না।
‘আচ্ছা, যামু না’।মা আবার চোখ বন্ধ করে ফেলেন। আমি পাশের ঘরে টিভি দেখতে থাকি। সুমন এসেছিল আমাকে নিতে। ওকে নিয়ে মাধবকে নিয়ে আসতে যাবার কথা। আমার কথা শুনে ও একাই গেল। আমি আবার টিভি দেখতে শুরু করি।
আধ ঘণ্টা পর মা আমাকে ডাকেন, “রিংকু...”
আমি তাড়াতাড়ি কাছে গেলাম, ‘আম্মা, ডাকছেন?”
মা বিছানায় উঠে বসলেন । উনার পাশে বসার জন্য দেখালেন। আমি পাশে বসলাম। আমার মাথায় হাত বুলাতে শুরু করলেন। “তর ভাইয়ের উপর তর অনেক রাগ, না?”
আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম। সত্যিই আমার অনেক রাগ।
“রাগ করিস্ না। রাগ করে কি হবে? ওরাও তরই রক্ত। তুই তো অনেক ভাল। কথা দে, মনে কোন রাগ রাখবি না আইজ থাইকা”।
আমি মাথা নেড়ে রাজি হলাম।
“ওরা তরে হিংসা করে। তরে তর বাপে চায় নাই। আমার নাকি বয়স হইয়া গেছে! কিন্তু আরেকটা সন্তানের জন্য আমার ভিতরটা কেমন জানি হাহাকার করত। আমার কিছুই ভাল লাগত না। শেষে তর বাপ রাজি হইল । আসলেই আমার বয়স হইছিল। তুই আট মাসে হইলি। আমার কি চিন্তা। একটুর লাইগাও তরে কথাও রাখি নাই। তরে অনেক কষ্ট কইরা বড় করছি বাপ। তরেই সবচেয় বেশি আদর করছি। তুই আমার কলিজার টুকরা। আমারে পানি খাওয়া তো বাপ”।
আমি পানি এনে দিলাম। মা একটু পানি খেলেন। “আম্মা আরও খান”।
“পানি তিতা হইয় গেছে রে বাপ। আর খামু না। অনেক ঘুম পাইছে”।
‘তাইলে ঘুমান’। আমি পানির গ্লাস রাখতে রান্না যাই, তখন মনে পড়ে মাকে ওষুধ খেতে দিতে হবে। ওষুধ নিয়ে যখন মায়ের কাছে ফিরে দেখি মা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। আমি ডাকলাম, “আম্মা, আম্মা....”
সাড়া নেই। এত তাড়াতাড়ি তো ঘুমিয়ে পড়ার কথা না। আমি আবার ডাকলাম। তবুও সাড়া নেই। মায়ের হাত ধরে ঝাঁকি দিলাম। মায়ের মুখটা বাম দিকে হেলে পড়ল। বুকে মধ্যে ধক্ ধক্ করে উঠল। তাড়াতাড়ি নাকের কাছে হাত নিলাম। নিঃশ্বাস পড়ছে না। হাত দেখলাম। অনড় নাড়ি। আমার পৃথিবী থেকে সবকিছু শূন্য হয়ে গেল। মায়ের পাশে বসে পড়লাম।
আমি আমার মায়ের পাশে বসে আছি। আমার মা, আমার একমাত্র আশ্রয়।
বাইরে আমার বোনের কান্না শুনে বাস্তবে ফিরে এলাম। আমার বোন কাঁদতে কাঁদতে মায়ের উপর আছড়ে পড়লেন। আমি ঘর থেকে বেড় হয়ে এলাম। উঠানে এসে মাটিতে বসে পড়ি।
মাধব এলো তারও অনেক পরে। তখন বাড়িতে অনেক মানুষ। ভাই বোন আর আত্মীয়ের কান্নায় ভারি হয়ে গেছে বাতাস। আমি তখনও মাটিতে বসে আছি। বাড়ির সবাই কাঁদছে। শুধু আমি কাঁদতে পাড়ছি না। মাধবের দিকে তাকিয়ে দেখি সে ও কাঁদছে। টপ টপ করে পানি পড়ছে তার চোখ দিয়ে। অবাক লাগল আমার। উঠে তার কাছে গেলাম। দু’হাতে তার কাঁধ দরে ঝাঁকি দিলাম। “আরে পাগল , তুই কাঁদিস কেন? তোর কি মা মারা গেছে? মা তো আমার মারা গেছে। এতিম তো আমি হলাম। তুই কাঁদিস কেন?”
এতিম.........! সত্যিই তো, আজ তো আমি এতিম। আমার চোখেও পানি এলো। আমি মাধবকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করি। “আম্মা গো.. আম্মা... আপনে আমারে এতিম কইরা দিয়া গেলেন। আমার আর কেউ নাই আম্মা। আমি এতিম হইয়া গেলাম আম্মা। এতিম হইয়া গেলাম”।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফাতেমা প্রমি ভালই লাগলো গল্প..প্যরা/চ্যাপ্টার করা না থাকায় পড়তে খুব কষ্ট হয়েছে ...
শাহ্‌নাজ আক্তার চমত্কার লাগলো আমার কাছে , ভোট টা ও পাবেন চমত্কার
বিন আরফান. কি বলব, চমত্কারই বলতে হয়. বয়সের সাথে গল্পের পরকক্কতা পাওয়া গেলেও একটু কি যেন না পাওয়ার আফসোস রয়ে গেল. আশা করি সামনে তা পূরণ হবে. আর বাকি কথাতো অনেকে বলে গেছে. চালয়ে যান. শুভ কামনা রইল.
ঝরা ভাল লিখেছেন
দেবব্রত দত্ত সেটা আমার ব্যর্থতা। যদিও গল্প, তবুও ঘটনা সত্য। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ @ রওশন জাহান
রওশন জাহান সুন্দর লিখেছেন. তবে শেষ অংশে মাধবের সাথে সহজ ভাবে কথা বলাটা বাস্তব সম্মত লাগলনা আমার কাছে.
দেবব্রত দত্ত ভাই পাঠকের তো বড়ই অভাব @ বিষণ্ণ সুমন
দেবব্রত দত্ত আপনার কথা যেন পূর্ণ হয় @ শিশির সিক্ত পল্লব
বিষণ্ন সুমন আসলে এই গল্পে বলার কিছু নেই. শুধু বলব লিখে যান, আপনার পাঠকের অভাব হবেনা .
শিশির সিক্ত পল্লব খুব ভালো লাগলো।আপনি অবশ্যই পারবেন।শুভ কামনা রইল। এগিয়ে যান।

২০ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪