রক্তজবা

মুক্তিযুদ্ধ (ডিসেম্বর ২০২৫)

এম. আব্দুল কাইয়ুম
  • 0
  • 0
সকালবেলার আলোটা তখনও পুরোপুরি ফোটেনি। ভাটিপাড়া — পদ্মার ধারে ছোট্ট এক গ্রাম, যেখানে বাঁশঝাড়ের আড়ালে শিশুদের হাসির শব্দে সকাল শুরু হয়। কিন্তু ১৯৭১ সালের সেই মার্চ মাসে গ্রামের বাতাসেও ছিল ভয়, অজানা আতঙ্ক আর ক্ষীণ বিদ্রোহের গন্ধ।

শরিফুল পেশায় গ্রামের স্কুলের শিক্ষক। সে মানুষ শান্ত, চুপচাপ, কিন্তু বুকের ভিতর এক অদম্য আগুন—বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন। তার ঘরে একটা পুরোনো রেডিও ছিল; প্রতিদিন সন্ধ্যায় সে রেডিওর শব্দে কান রাখত, যেন সেই বাক্যের প্রতিটি ধ্বনি তার হৃদয়ে আগুন জ্বালায়।

একদিন সন্ধ্যায় সে শুনল ৭ মার্চের ভাষণ “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” এই বাক্য যেন বজ্রপাতের মতো নেমে এলো শরিফুলের হৃদয়ে।
তারপর থেকেই সে বুঝল—আর চুপ করে থাকা যাবে না।

২৫ মার্চ। রাতটা ছিল অস্বাভাবিক শান্ত। তারপর হঠাৎ, দূর থেকে গুলির শব্দ, চিৎকার, আগুনের লেলিহান শিখা দেখা গেল শহরমুখী আকাশে। পাকবাহিনী ঢাকায় ঢুকেছে—গ্রামে খবর পৌঁছাতে সময় লাগেনি। পরের দিন ২৬শে মার্চ সন্ধায় রেডিওতে শুনতে পায় ”স্বাধীনতার ঘোষনা”।

কিছুদিন পরেই সেই আগুন এসে পৌঁছাল ভাটিপাড়ায়। সেনারা এলো, ঘরবাড়ি পুড়ল, ক’জন গ্রামবাসীকে গুলি করে মেরে গেল। শরিফুল তখন গ্রামের বাইরে, গেরিলাদের সংগঠনের কাজে।
ফিরে এসে সে দেখল—তার স্কুলটা ছাই, আর ঘরের সামনে পড়ে আছে তার ছোট ভাই রহিমের নিথর দেহ।

সে কেঁপে উঠল, তারপর আর চোখের জল ফেলল না। শুধু বলল,
“যে রক্ত মাটিতে পড়েছে, সেই রক্তই এই দেশের পতাকা রাঙাবে।”

শরিফুল প্রতি রাতের আধারে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিল—নির্ভুল নিশানা, বিস্ফোরণ, কৌশল। দিন রাত অনুশীলন, মনে শুধু একটাই কথা— “আমি ফিরে যাব, আমার দেশকে মুক্ত করব।”

সেই সময় শরিফুলের সঙ্গী হলেন কামাল, সালেহা, আর নুরুল—তিনজন তরুণ প্রাণ।
সালেহা ছিল গ্রামের এক সাধারণ মেয়ে, কিন্তু তার চোখে ছিল বিদ্রোহের আগুন।

সে বলত, “আমার ভাইকে তারা মেরেছে, আমার দেহে যদি আগুন লাগে, আমি তবু হাসবো—যদি দেশটা মুক্ত হয়।”

পদ্মার তীরে এক রাতে তারা হামলা চালাল পাকবাহিনীর ঘাঁটিতে। চাঁদের আলোয় নদীর জল যেন রক্তে মিশে যাচ্ছিল। গুলির শব্দ, ধোঁয়া, বিস্ফোরণ—সব মিলেমিশে যেন এক ভয়ংকর সঙ্গীত।

শরিফুলের গায়ে গুলি লাগে, কিন্তু সে থামেনি। সে নিজের শরীর টেনে এগিয়ে গিয়ে ঘাঁটির বারুদ ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। পরে নদীর ধারে অচেতন হয়ে পড়ে থাকে। ভোরে সালেহা আর কামাল এসে তাকে উদ্ধার করে নেয়। সেই রাতে পাকবাহিনীর ঘাঁটি ধ্বংস হয়ে যায়। আর ভাটিপাড়া গ্রামের মানুষদের বুকেও জ্বলে ওঠে নতুন আশার প্রদীপ।

মুক্তির যুদ্ধ চলমান…ডিসেম্বরের মাঝামাঝি।
রেডিওয় খবর আসে—পাকবাহিনী পিছু হটছে, ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা একসাথে অগ্রসর হচ্ছে। পুরো দেশ উত্তেজনায় থরথর।

১৬ ডিসেম্বর সকালে শরিফুল গ্রামের পথে হেঁটে আসে—তার মুখে ক্লান্তি, চোখে আলো।
সঙ্গে ছিল পুরোনো একটি সবুজ পতাকা, মাঝখানে রক্তলাল বৃত্ত।

সে গ্রামবাসীকে ডেকে বলে, “আজ স্বাধীনতার বিজয়! আজ বাংলাদেশ মুক্ত!”

লোকজন ছুটে আসে, কেউ হাসে, কেউ কাঁদে, কেউ সেজদায় পড়ে যায়।
মাটির গন্ধে, মানুষের চিৎকারে, শিশুর হাসিতে তখন একটাই কথা প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল—
“বাংলাদেশ আমাদের বাংলাদেশ!”

কিছুদিন পর শরিফুল ফিরে এল স্কুলে। ভাঙা দেয়াল, পোড়া টেবিল, কিন্তু তবুও সে বোর্ডে লিখল—
“আজ আমাদের প্রথম পাঠ—স্বাধীনতা মানে দায়িত্ব।”

তারপর গ্রামের ছেলেমেয়েরা প্রতিদিন স্কুলে আসে, আর দেয়ালের পাশে একগুচ্ছ রক্তজবা গাছ লাগানো হলো। সেই ফুলগুলো লাল—যেমন লাল ছিল রহিমের রক্ত, সালেহার চোখ, মুক্তিযোদ্ধাদের পতাকা।

বছর যায়, শরিফুল বৃদ্ধ হয়, তবু সে প্রতিদিন ভোরে জবা ফুলে জল দেয়।
আর বলে— “এই ফুলের রঙে আমার দেশ বেঁচে আছে।”

ভাটিপাড়ার পদ্মার ধারে আজও যখন বাতাস বয়, মানুষ বলে—“শরিফুল মাস্টার এখনো আছেন।”
হয়তো তার শরীর নেই, কিন্তু তার কণ্ঠ ভেসে আসে প্রতিটি শিশুর মুখে—
“বাংলাদেশ আমাদের বাংলাদেশ!”
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

লোকজন ছুটে আসে, কেউ হাসে, কেউ কাঁদে, কেউ সেজদায় পড়ে যায়। মাটির গন্ধে, মানুষের চিৎকারে, শিশুর হাসিতে তখন একটাই কথা প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল— “বাংলাদেশ আমাদের বাংলাদেশ!” গ্রামের ছেলেমেয়েরা প্রতিদিন স্কুলে আসে, আর দেয়ালের পাশে একগুচ্ছ রক্তজবা গাছ লাগানো হলো। সেই ফুলগুলো লাল—যেমন লাল ছিল রহিমের রক্ত, সালেহার চোখ, মুক্তিযোদ্ধাদের পতাকা।

২২ জুলাই - ২০২৩ গল্প/কবিতা: ৩৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“ ” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ , থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী