(একজন প্রবীণ নেতার আত্মবোধ, আত্মসংঘাত এবং আত্মমুক্তির গল্প)
ঘড়ির কাঁটা যখন বিকেল পাঁচটা ছুঁই ছুঁই করছে, শহরের ব্যস্ততা তখনও পুরোদমে চলছে। ট্রাফিক জ্যাম, হর্ণের শব্দ, রাজপথে পোস্টার ছেঁড়ার কণ্ঠস্বর—এই শহরে প্রতিদিনই কিছু না কিছু ঘটে। কিন্তু একটি ঘরে, সময় যেন থমকে গেছে।
তবারক মন্ডল—একটি সময়ের প্রতীক, এক সময়ের আগুনঝরা ছাত্রনেতা, যিনি “মানুষ আগে, ক্ষমতা পরে” এই আদর্শ নিয়ে রাজনীতির মাঠে নেমেছিলেন—আজ সেই তবারক মন্ডল নিঃশব্দে বসে আছেন নিজের অফিসঘরে।
বয়স এখন পঁয়ষট্টি পেরিয়েছে। মাথার চুলে রূপালি আভা, গলায় নরম কাশি, চোখে চিরচেনা ক্লান্তি। দেয়ালে তাঁর মিছিলের ছবি, এক হাতে মাইক ধরা, অন্য হাতে লাল পতাকা। কিন্তু এখন? এখন তাঁর সামনে কেবল একটি ফাঁকা সাদা কাগজ আর একটি পুরনো ফাউন্টেন পেন।
তিনি চিঠি লিখছেন। তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিঠি।
পদত্যাগপত্র।
________________________________________
১. স্মৃতির দরজা খুলে যায়
কলমের ডগা থেমে যায় হঠাৎ। চোখের সামনে ভেসে ওঠে পঁচিশ বছর আগের একটি বিকেল—
যখন এক কৃষক মেয়ের মৃত্যুর খবর শুনে তিনি ছুটে গিয়েছিলেন থানায়। তখনো তিনি এমপি হননি। সেই দিন তিনি বলেছিলেন,
“আমার রাজনীতি যদি মানুষের পাশে দাঁড়াতে না পারে, তাহলে আমি রাজনীতি করব না।”
সেই বাক্য আজ বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে।
গতকাল রাতে মানিক, তাঁর দীর্ঘদিনের সহকারী, খবর নিয়ে এসেছিল—
এক ছাত্রনেতা, আলিফ মিয়া, দলীয় মিছিলে সরকারবিরোধী স্লোগান দিয়েছিল। তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
আর দলীয় দপ্তর থেকে নির্দেশ এসেছিল—“মামলা টানতে দাও, এটা শিখিয়ে দেওয়ার সময়।”
তবারক মন্ডল জানতেন, আলিফ মিয়া সেই ছেলেগুলোর একজন, যারা এখনো বিশ্বাস করে—
দেশটা বদলাতে পারে।
তারা তবারক মন্ডলের ছবি দেখে প্রেরণা পায়।
তবারক মন্ডল সেদিন কিছু বলেননি।
নিজেকে বলেছিলেন—
“আমি আর দায়িত্বে নেই। আমি কিছু করতে পারি না।”
কিন্তু এই বাক্যটা নিজেকেই যেন অপমান করছিল বারবার।
________________________________________
২. মুখোমুখি মা
পরদিন সকালেই এলেন এক নারী—আলিফের মা, মোহনা।
ছোটখাটো গড়নের নারী, চোখে নির্ঘুম রাতের ছাপ। তবারক মন্ডলকে দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। তারপর বললেন—
“ছেলেটা আপনার বক্তৃতা শুনে রাজনীতি শিখেছে। আপনি বলেছিলেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। এখন জেলে আছে। আপনি কী করলেন?”
কথাগুলো বুকে কামানের মতো এসে বাজলো।
তবারক মন্ডল কিছুক্ষণ নীরব। তারপর কেবল বললেন,
“আমি কিছু করতে পারিনি, এটাই আমার ব্যর্থতা।”
মোহনা বেরিয়ে গেলেন কিছু না বলে।
________________________________________
৩. চিঠি লেখা শুরু
সন্ধ্যায় অফিসঘরে ফেরেন তবারক মন্ডল ।
এই অফিসে তিনি জিতেছেন, হেরেছেন, সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এখন তিনি নিতে চলেছেন শেষ সিদ্ধান্ত—
নিজের পদত্যাগ।
কাগজে প্রথম বাক্য লেখেন—
"আমি তবারক মন্ডল, দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের শেষে আমার সব দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করছি।"
তারপর থামেন। মনে পড়ে, দলের এক নেতা, বিশ্বজিৎ, সম্প্রতি বলেছিলেন—
“দাদা, আপনার সময় শেষ, এখন আমাদের স্টাইল লাগবে।”
স্টাইল! তবারক মন্ডল মনে মনে হাসেন।
তাঁর হাতে শুধু আদর্শ ছিল, এখনকার মতো মিডিয়া টিম ছিল না।
তবু ভোটে তিনবার জিতেছেন। কারণ মানুষ বিশ্বাস করত।
________________________________________
৪. দলীয় অফিসে হট্টগোল
চিঠি পাঠিয়ে দেওয়ার আগে, তিনি ঠিক করেন, সংবাদ সম্মেলনে নিজে ঘোষণা দেবেন।
কিন্তু খবর ফাঁস হয়ে যায়।
দলীয় অফিসে তোলপাড়। বিশ্বজিৎ ফোনে বলেন—
“আপনি দলকে ধাক্কা দিতে চান? আমরা তো আপনাকে রিটায়ার সম্মানে রাখতে চাচ্ছিলাম।”
তবারক মন্ডল বলেন,
“সম্মান যদি নীরব থাকার বিনিময়ে দিতে চাও, তাহলে তা আমার দরকার নেই। আদর্শ বিকিয়ে আমি বাঁচতে পারি না।”
________________________________________
৫. শেষ ভাষণ
সংবাদ সম্মেলনে তবারক মন্ডল উপস্থিত হন সাদা পাঞ্জাবি পরে, মুখে স্বাভাবিক কঠোরতা। ক্যামেরা তাক করা। সাংবাদিকরা চুপচাপ।
তিনি বলেন—
“আমি আজ পদত্যাগ করছি। কারণ আমি জানি, আদর্শ ছাড়লে ক্ষমতা বড় হতে পারে, কিন্তু মানুষ ছোট হয়ে যায়।
আমি চাই না পরবর্তী প্রজন্ম আমাকে দেখে শিখুক কীভাবে চুপ থাকা যায়। আমি চাই তারা শিখুক কীভাবে দাঁড়াতে হয়—সত্যের পক্ষে, একা হলেও।”
এই বক্তব্য ভাইরাল হয়ে যায়।
________________________________________
৬. বিদায়
অফিসে ফিরে আসেন তিনি। মানিক চুপ করে দাঁড়িয়ে।
মানিক:
“স্যার, আপনি ঠিক করলেন তো?”
তবারক মন্ডল:
“হ্যাঁ। আমি আজ হেরেছি না, আজ আমি মুক্ত।”
মোবাইলের স্ক্রিনে একটি মেসেজ ভেসে ওঠে—
“স্যার, আমি মুক্তি পেয়েছি। জেল থেকে ছাড়া পেয়েছি। আপনার বক্তব্য শুনেছি। আমি গর্বিত। – আলিফ মিয়া”
তবারক মন্ডল হালকা হাসলেন।
দেয়ালে থাকা পুরনো মিছিলের ছবির দিকে তাকিয়ে বললেন—
“আজ আবার মনে হচ্ছে, আমি নেতা হতে পারি। কিন্তু এবার নতুনভাবে।”
ঘরের আলো নিভে আসে ধীরে। পেছনে বাজে পুরনো একটি স্লোগান—
“মানুষ আগে, ক্ষমতা পরে।”
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
তবারক মন্ডল—একটি সময়ের প্রতীক, এক সময়ের আগুনঝরা ছাত্রনেতা, যিনি “মানুষ আগে, ক্ষমতা পরে” এই আদর্শ নিয়ে রাজনীতির মাঠে নেমেছিলেন—আজ সেই তবারক মন্ডল নিঃশব্দে বসে আছেন নিজের অফিসঘরে।
বয়স এখন পঁয়ষট্টি পেরিয়েছে। মাথার চুলে রূপালি আভা, গলায় নরম কাশি, চোখে চিরচেনা ক্লান্তি। দেয়ালে তাঁর মিছিলের ছবি, এক হাতে মাইক ধরা, অন্য হাতে লাল পতাকা। কিন্তু এখন? এখন তাঁর সামনে কেবল একটি ফাঁকা সাদা কাগজ আর একটি পুরনো ফাউন্টেন পেন।
তিনি চিঠি লিখছেন। তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিঠি।
পদত্যাগপত্র।
ঘরের আলো নিভে আসে ধীরে। পেছনে বাজে পুরনো একটি স্লোগান—
“মানুষ আগে, ক্ষমতা পরে।”
২২ জুলাই - ২০২৩
গল্প/কবিতা:
২৫ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“আগষ্ট ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ আগষ্ট, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।
প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী