অনেক দূরে আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখছি সেঁজুতির চলে যাওয়া। সদ্য বিবাহিত দম্পতিকে সবাই কত ভালোবাসা দিয়ে বিদায় দিচ্ছে; কেউ হাসি মুখে আবার কেউবা চোখের জলে। সেঁজুতিও আপনজনদের জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। পাশে ওর বর মায়ামাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দূর থেকেও আমি সেই অদৃশ্য মায়াময় ভালোবাসা স্পষ্ট অনুভব করতে পারছি। আমার চোখে যদিও কোন জল নেই কিন্তু বুকের ভিতর অদ্ভুত রকমের শব্দ হচ্ছে-- ধরাস! ধরাস! ধরাস! এই অস্বস্তিকর শব্দটা আমাকে খুব যন্ত্রণা দিচ্ছে, অনেক পুরনো স্মৃতি পুরনো কথা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মনে করিয়ে দিচ্ছে। সেই ছোট্ট বেলায় পুতুল পুতুল খেলা কিংবা বর বউ খেলার দিনগুলোতে যখন সেঁজুতি রোজ বউ সাজতো তখন খুব করে চাইতাম আমি বর সাজি। কিন্তু আমার ভাগ্যে কখনও বউয়ের বান্ধবী কিংবা বরের বোন ছাড়া অন্য কিছুই জুটতো না। খেলার সাথীরা বলতো আমাকে নাকি বর মানায় না, আমাকে নাকি মেয়েদের মতো লাগে। কতদিন কেঁদেকেটে মায়ের কাছে নালিশ দিয়েছি, মা কোন জবাব দেন নি। শুধু একটা অস্ফুট দীর্ঘশ্বাস নীরবে গোপন করেছেন। ধীরে ধীরে সময়ের গতির সাথে সাথে আমিও বুঝলাম কেন আমি বর বউ খেলায় বর হওয়ার যোগ্য নই, কেন সেঁজুতিকে এতটা ভালোবাসার পরও ওর তাচ্ছিল্যের হাসিটাই আমাকে ফিরে পেতে হয়েছিল বারবার। শিশুকাল থেকেই অনেক চেষ্টা করতাম অন্যসব চটপটে বালকের মতো নিজেকে দুরন্তপনায় মাতিয়ে রাখতে। কিন্তু কোথা থেকে কীভাবে যেনো আমার অজান্তেই কিছু মেয়েলি আচরণ আমার দ্বারা হয়ে যেতো। আত্মীয়, পরিজন, বন্ধুদের হাসাহাসিতে মায়ের চোখে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামতে দেখেছি, বাবার বুক চিড়ে বেরিয়ে আসতে দেখেছি ক্ষয়ে যাওয়া দীর্ঘশ্বাস। বয়ঃসন্ধিতে যখন আমার বন্ধুরা সবাই সদ্য গজানো দাঁড়ি গোঁফ লুকাতে ব্যস্ত, আমি তখন প্রাণপণে ব্যাস্ত আমার যাবতীয় মেয়েলি আচরণ লুকাতে। প্রতিটি মূহুর্তে পুরুষ হয়ে ওঠার চেষ্টায় ব্যর্থ আমি কৈশোরেই বুঝে গেছি সৃষ্টিকর্তা সবার জীবন একসুতোয় বেঁধে দেন নি। মা বাবা অনেক চেষ্টা করেছিলেন আমাকে অন্যসব শিশুর মতো স্বাভাবিক জীবন দিতে, কিন্তু সমাজ বা পরিবারের কঠিন আচরণের কাছে তাঁরা হেরে গেছেন বারবার। তাই এগারো কিংবা বারো বছর বয়সে আমার জায়গা হয় তাদের কাছে যারাও আমার মতো সমাজ কিংবা পরিবার থেকে বিতাড়িত। হ্যাঁ, আমি তাদের কথা বলছি যারা চাইলেও নিজেদেরকে পুরুষ কিংবা নারী হিসেবে পরিচয় দিতে পারে না। আমি আল্লাহ তায়ালার সেই সৃষ্টির কথা বলছি যাদের তিনি ভালোবেসে সৃষ্টি করলেও এই স্বার্থপর সমাজের আত্মকেন্দ্রীক মানুষেরা তাদের নাম দিয়েছে নপুংসক, কেউ বা নাক সিঁটকিয়ে বলে হিজড়া। প্রথম প্রথম মা বাবাকে ছেড়ে থাকতে ভীষণ কষ্ট হতো। খুব মনে পড়তো মায়ের স্নেহমুখ, বাবার আদর আর, আর সেঁজুতির নিষ্পাপ মুখশ্রী। কিন্তু নপুংসকদের তো কোন পিছুটান থাকতে নেই, হাহাকার থাকতে নেই। তাই মায়ের কোল থেকে ছিটকে গিয়ে আমার শুরু হলো অন্য এক জীবন। জীবন বাঁচানোর জীবন। নপুংসকদের শরীরের ক্ষুধা না থাকলেও পেটের ক্ষুধা তো মরে যায় না। খুব অল্প সময়েই আমি অনেক জটিল বিদ্যা আয়ত্ব করে ফেললাম। পাবলিক বাস বা ট্রেনে হেলেদুলে, অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাতে তালি দিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা নেয়া, বিয়ে বাড়ি কিংবা সদ্য সন্তান ভূমিষ্ট হয়েছে এমন জায়গায় গিয়ে নেচে গেয়ে চাঁদা তোলা আমার প্রতিদিনের নেশায় পরিনত হয়ে গেলো। আর এসব করতে গিয়ে কতো মানুষের চোখে আতঙ্ক দেখেছি, ঘৃণা দেখেছি তার কোন ইয়ত্তা নেই। শুরুতে খুব খারাপ লাগতো। জীবন জীবীকার তাগিদে অন্যকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে অর্থ উপার্জন করাটা নিঃসন্দেহে অপরাধ। কিন্তু এই অবহেলিত জনগোষ্ঠী যাদের সমাজ রেখেছে একঘরে করে তাদেরই বা কী করার আছে? তাদেরও তো ক্ষুধার জ্বালা রয়েছে, তৃষ্ণার কষ্ট রয়েছে। আমাদের করা প্রতিটি বিকৃত অঙ্গভঙ্গি এই পাষাণ সমাজের বিপরীতে করা জোড়ালো প্রতিবাদ।
আজ এসেছি আমার চিরচেনা সেই গ্রামে একটা বিয়ে বাড়িতে চাঁদা তুলতে। এসে জানতে পারলাম আজ সেঁজুতির বিয়ে। শৈশবের বরবউ খেলার সেই সেঁজুতি যার বর হওয়ার কী ভীষণ ইচ্ছা ছিলো আমার! সেই সেঁজুতি যে অন্য সবার মতো আমার আধা মেয়েলি আধা পুরুষালি আচরণে হেসে কুটিকুটি হতো। আর আমি মুগ্ধ হয়ে তার হাসির আলোকচ্ছটায় ভাসতাম। আমার সঙ্গী সাথীরা চলে গেলেও আমি শেষ পর্যন্ত রয়ে গেলাম। আড়ালে দাঁড়িয়ে যতটা পারলাম মন ভরে সেঁজুতিকে দেখে নিলাম। এতো বছরের চাপা পড়া ক্ষতটা যেনো হঠাৎ টনটন করে উঠলো। শরীরের মতো মনটাও যদি তৃতীয় লিঙ্গের হত, নপুংসক হতো তাহলে মনে হয় বেঁচেই যেতাম। অন্তত কাউকে ভালোবেসে কষ্ট তো পেতে হতো না! পরিবার বা সমাজ যাদের বোঝা ভেবে নর্দমায় ফেলে দেয় তাদের কী অধিকার আছে কাউকে ভালোবাসার? কারও ভালোবাসা পাওয়ার? আমাদের অদ্ভুত আচরণ, হাঁটা চলা, কণ্ঠস্বর অন্যদের কাছে হাস্যকর লাগলেও এগুলো আমাদের জন্য কতটা যন্ত্রণার তা কেউ বুঝবে না। পেটের দায়ে আমরা নিজেদের হাস্যকর করে তুলি, ভালোবাসা আর যত্নের অভাবে নিজেদের বানাই হিংস্র। আমরা বুঝি, মানুষ হিসেবে আমরা যেমন অবহেলিত, আমাদের ভালোবাসাও ঠিক তেমনি অবহেলিত, বিতাড়িত।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
এক তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের ভালোবাসার গল্প।
০৮ জুলাই - ২০২৩
গল্প/কবিতা:
৮ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪