জয়ের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতাটার ঠিক কী নাম দেয়া উচিৎ আমি জানি না। তবে এটুকু জানি যে নির্দিষ্ট একটা শব্দে এই সম্পর্কের ব্যাখ্যা দেয়া অসম্ভব। যদি বলি বন্ধুত্ব, তবে ভালোবাসাকে ঠকানো হবে। আর যদি ভালোবাসার মোড়কে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে দেই, তবে তো বন্ধুত্ব অধরা থেকে যাবে। কারণ আমার পানসে শৈশব, রংহীন কৈশরের একমাত্র সঙ্গী ছিলো আমার জয় যে কিনা খুব যত্ন করে সব কষ্ট, হতাশা ঘষে ঘষে তুলে দিত ইরেজারের মতো। মাতৃহীন জীবনে জয়ের ছোঁয়া আমার আঁধার রাতে পূর্ণিমার মতো ছিলো। জয় যখন আমার ঠোঁটের সাথে ওর চিকন অথচ ধারালো ঠোঁট দুটো চেপে ধরে আদর করতো, আমি দুচোখ বন্ধ করে সেই আদরের উষ্ণতা নিতাম। না, ভুল বললাম। উষ্ণতা নয়, শীতলতা। জয়ের ঠোঁটে অদ্ভুত এক শীতলতা ছিলো, ছিলো হেমন্তের টাটকা গন্ধ। সেই শীতলতা, সেই হেমন্তের হাওয়া আমার নি:সঙ্গ জীবনে সুখের পায়রা হয়ে উড়ে বেড়াতো পতপত করে। ওর শরীরের গন্ধে একটা অন্যরকম নির্ভরতার বাঁশি বাজতো মনের গহীনে। সেই বাঁশির সুর আমার অন্ত:করণ ভেদ করে কোথায় গিয়ে আশ্রয় নিতো ঠিক বলতে পারবো না। জয়ের সবুজ ডানায় ভর করে আমি ঘুরে বেড়াতাম অনন্ত নক্ষত্রলোকের প্রতিটি অলিগলি। জয় যখন তার চিকন আর সূঁচালো আঙুল দিয়ে আমার ঘাড়ে সুরসুরি দিতো, আমি হেসে কুটিকুটি হতাম। ওর ধারালো নখে আমার শরীরে সাদাটে দাগ হতো, সেই দাগ খানিক পরে আবার মিলিয়েও যেতো। কিন্তু কত বসন্ত, কত শ্রাবণ চলে গেছে জীবন থেকে অথচ জয়ে স্মৃতি বিন্দুমাত্র বিলীন হয় নি আমার মন থেকে। ওর শরীরের গন্ধ, স্পর্শ, পলাশ ফুলের মতো টকটকে লাল ঠোঁট, ঘাসের চাদরের মতো নরম তুলতুলে শরীর আমার মন থেকে কখনও মিলিয়ে যাবে না। চোখ বন্ধ করলে আজও সেউ অনুভূতিগুলো জীবন্ত হয়ে ধরা দেয় আমার মানসপটে।
কোন এক বসন্তের বিকেলে জয় আমার জীবনে আসে। আমি তখন ১১ কিংবা ১২ বছরের এক মহাভীতু গ্রাম্য শিশু। আমার সঙ্গী সাথীরা যেখানে মহা আনন্দে নদী, পুকুর, বন বাঁদাড় দাঁপিয়ে বেড়াতো, সেখানে আমি সামান্য একটা মুরগির ছানা কোলে নিতেই ভয়ে অস্থির হয়ে যেতাম। একান্নবর্তী পরিবারে অসংখ্য ভাই বোনের মধ্যে বড় হওয়া এই ভীতু আমিকে নিয়ে ভাইবোনদের উপহাস আর তাচ্ছিল্যের কমতি ছিলো না। শৈশবের সাতসকালে মাকে হারানোর কারণে ভিতরে ভিতরে ভীষণ একা আর নি:সঙ্গ জীবন ছিলো আমার। এক অদম্য বাঁধনহীন ভালোবাসার শূণ্যতা আমাকে কূঁড়েকুঁড়ে খেতো। এতো এতো ভাইবোন, সঙ্গী সাথীদের মাঝেও আমি ছিলাম ভীষণ একা, ভীষণ নি:সঙ্গ। এমনই এক নি:সঙ্গ বিকেলে হঠাৎ কয়েকটা টিয়া পাখি ঝগড়াঝাটি করতে করতে আমাদের উঠোনে নেমে আসে। পাঁচ ছয় টা পাখি মিলে একটা পাখিকে ঠোঁকর মারতে মারতে রক্তাক্ত করে দেয়। আর আক্রমণের শিকার হওয়া পাখিটি গলা ছেড়ে চিৎকার দিয়ে বাঁচানোর আকুতি জানায়। সেই দৃশ্য দেখে বরাবরের মতো ভীতু আমি কোথা থেকে যেনো প্রচুর সাহস পেয়ে যাই। দৌড়ে কাছে গিয়ে পাখিগুলোকে তাড়িয়ে দিয়ে আহত পাখিটিকে কোলে নেই। ওর মাথা ও মুখের ছোপছোপ রক্তগুলো মুছে দিয়ে পানি খাওয়াই। তারপর দূর্বা ঘাস থেঁতলে ক্ষতস্থানগুলোতে লাগিয়ে দেই। আমার বড় ভাই বাঁশ কেটে একটা ছোট্ট খাঁচা বানিয়ে দেয় ওর জন্য। আমাদের মাটির খেলনা হাঁড়ি পাতিলের দুটো বেঁধে দেয় খাঁচার ভেতর। একটাতে খাবার ও অন্যটায় পানির জন্য। আমরা সহোদর - সহোদরা ৪ জন হলেও একান্নবর্তী পরিবার হওয়ায় প্রায় ১৮/১৯ জন ভাইবোন এক বাড়িতে বড় হয়েছি। আমার সমবয়সী ছিলো প্রায় ৫/৬ জন। আমাদের খেলার সঙ্গী হিসেবে নতুন সদস্য হয় সেই পাখিটি। যেহেতু তাকে উদ্ধার করেছি আমি, তাই সে আমার কাছে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। যদিও আমার সরলতা আর বোকামির সুযোগ নিয়ে অনেকেই তাকে নিতে চেয়েছিল, কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমার শক্ত অবস্থানের কারণে আর পারে নি। তাছাড়া আমার বড় তিন ভাই বোনের সাপোর্ট তো ছিলোই। আমরা অনেক ভেবে চিন্তে, যুক্তি তর্কের চূড়ান্তে গিয়ে ওর নাম রাখলাম জয়। যেহেতু তাকে আমরা ঘাতক পাখিদের হাত থেকে জয় করেছি! রাতে যখন ঘুমাতাম, জয়ের খাঁচাটা আমি আর আমার বড় বোন যে বিছানায় ঘুমাতাম তার এক সাইডে রেখে দিতাম। জয়ের সেবা করা আমাদের দুই বোনের নিয়মিত দায়িত্ব হয়ে গেলো। জয়ও খুব মজা পেতো। আমি স্কুল থেকে ফিরলেই তার সে কি চিৎকার শুরু হতো। যেনো সারাদিন তাকে একা রাখার জন্য অভিযোগ করছে। আমি যখন খেতাম, তখন খাঁচার ভিতর দুটো আঙুল ঢুকিয়ে জয়কেও খেতে দিতাম। সে মহা আগ্রহে খেতো। আমরা পুরো পরিবার তাই করতাম। এমনকি আমার রাশভারি বাবাও। নিয়মিত গোসল করিয়ে দিতাম। এভাবেই জয় আমাদের পরিবারের অংশ হয়ে উঠলো। একদিন বড় ভাইয়া বললো যে অনেকদিন হয়ে গেছে এখন জয়কে খাঁচা থেকে ছেড়ে দেয়া যায়। ও নিশ্চয়ই এতোদিনে আমাদের পোষ মেনে গেছে। দুরু দুরু বুকে ভাইয়ার প্রস্তাবে রাজি হলাম। খাঁচার দরজা খোলা হল, জয় এক পা দু পা করে বাইরে এলো। কিন্তু কি আশ্চর্য! জয় সোজা উড়ে এসে আমার ঘাড়ের উপর বসলো। সে দিনের কথা মনে হলে আমার আজও চোখ ভিজে যায়, বুকের ভিতর তোলপাড় হয়। শুরু হলো জয়ের মুক্ত জীবন আর আমার নতুন শিহরণ। আমি যখন স্কুলে যাবো, সে কোথা থেকে উড়ে এসে আমার ঘাড়ের উপর বসে আমার সাথে যাবে। আমি কিছুদূর গিয়ে তাকে উড়িয়ে দিতাম। মজার বিষয় হচ্ছে জয় কিন্তু আমাদের ভাষা বুঝতো। কখনও এমনও হয়েছে আমি বলেছি আমার কলম এনে দিতে, সে সাথে সাথে দুই ঠোঁটের মধ্যে চিপে ধরে এনে দিতো। আমরা বিকালে যখন গোল্লাছুট কিংবা লুকোচুরি খেলতাম, সেও ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে বেড়াতো আর চিৎকার করতো। কখনও কখনও উড়ে এসে আমাদের মাথায়,ঘাড়ে বসে খেলার মনোযোগ নষ্ট করতো। বিশেষ করে আমার। এভাবেই দিনগুলো স্বপ্নের মতো যাচ্ছিল। আমার আর নিজেকে একা লাগে না, নি:সঙ্গতার ভূত ততোদিনে আমাকে ছেড়ে পালিয়েছে। আমার প্রতি মূহুর্তের বিশ্বস্ত সঙ্গী আমার জয়। এরমধ্যে একদিন বড় ভাইয়ার বিয়ে হলো, পরিবারে আর একজন যোগ হলো। আর আমিও পেলাম নতুন সঙ্গী। ভাবির সঙ্গে আমার যথেষ্ট ভাব হয়ে গেলো। ভাবিও আমাদের মাতৃহীন ভাইবোনদের আপন করে নিলেন সাথে জয়কেও। জয়ের দুষ্টুমির মাত্রাও যেনো আরও বেড়ে গেলো। যখন তখন ভাবিকে জ্বালাতো। রাঁধতে গেলে, কাপড় ধুতে গেলে, উঠোন ঝাড়ু দিতে গেলে উড়ে গিয়ে মাথায় বসতো। আর সেইসব দৃশ্য দেখে আমি হেসে কুটিকুটি হতাম। আমাদের প্রাণহীন পরিবারে জয় যেনো নতুন করে প্রাণ এনে দিয়েছিলো। আর আমার নি:সঙ্গ জীবনে হয়ে এসেছিল ধ্রুবতারা।
একদিন আমাদের পরিবারে নতুন অতিথি আসে, আমাদের রাজকন্যা। আমার ভাই ভাবির একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তান। আমার খুশি আর কে দেখে। আমার রোজকার রুটিনে যোগ হলো নতুন দায়িত্ব, নতুন ভালোবাসা। স্কুল থেকে ফিরেই ছুটতাম ভাবির ঘরে। রাজকন্যার ছোট্ট নরম তুলতুলে হাত দুটো আমার গালের সাথে চেপে ধরে থাকতাম। কি এক অদ্ভুত ভালোলাগার অনুভূতি তখন আমাকে পেয়ে বসতো বলে বোঝাতে পারবো না। আমি যখন ভাতিজিকে আদর করতাম, তখন জয় খাটের স্ট্যান্ডের উপর বসে চুপচাপ তাকিয়ে থাকতো। একদিন জোরে চিৎকার করায় রাজকন্যা ভয় পেয়ে প্রচুর কান্নাকাটি করেছিলো। জয়কে নিষেধ করায় পরে অবশ্য আর চেঁচামেচি করতো না, শুধু তাকিয়ে থাকতো। আমার জীবনের একটা বড় অংশ হয়ে উঠলো আমার ভাতিজি। ধীরে ধীরে ওকে নিয়েই ব্যস্ততা বাড়তে থাকলো আর জয়ের সাথে তৈরি হতে লাগলো দুরত্ব। আমি আর নিয়মিত জয়কে গোসল কিংবা ঠিকঠাকভাবে সময়মত খেতে দিতাম না। মানে আমার মনে থাকতো না। যখন মনে পড়তো তখন জয়কে কাছে ডেকে আদর করতাম। তবে খুব ঘন ঘন ভুলে যেতে লাগলাম। একদিন স্কুল থেকে ফিরে যথারীতি রাজকন্যাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছি। এমনসময় ভাবি জানালো যে সারদিন নাকি জয়কে একবারও দেখা যায় নি। আমি চমকে উঠলাম! জয়তো কখনও এই বাড়ির বাইরে যায় না! আজ তবে কি হলো! সম্ভাব্য সকল জায়গায় তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। পুকুর পাড়ে, বড় বড় গাছের ডালে। কিন্তু না, কোথাও পেলাম না। শুধু আমি না। বাড়ি সুদ্ধ আমার যত ভাইবোন ছিল সবাই খুঁজেছি। একদিন, দুইদিন, তিনদিন.... প্রতিটি দিন জয়কে খুঁজেছি। স্কুলে যেতে আসতে খুঁজেছি। কোন টিয়া পাখি গাছের ডালে কিংবা উড়ে যেতে দেখলেই ভেবেছি ও বুঝি আমার জয়। জয় রাতে আমাদের দুই বোনের সাথে ঘুমাতো। আমরা বিছানায় ঘুমাতাম আর ও ঘুমাতো খাটের স্ট্যান্ডের উপর। প্রায়ই মধ্যরাতে মনে হতো জয় খাটের স্ট্যান্ডের উপর থেকে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি চমকে ঘুম ভেঙে জেগে উঠতাম। আমার কিছু ভালো লাগতো না। একটা নিষ্ঠুর শূণ্যতা আমাকে গ্রাস করতে লাগলো। জয় কখনও আমাকে ছেড়ে যেতে পারে না। তবে কি ওকে কেউ মেরে ফেলেছে? বিড়াল বা অন্য কোন প্রাণী? তাহলে তো ওর সবুজ পাখনা মাটিতে কোথাও না কোথাও পড়ে থাকতো। তবে? তবে কি জয় স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে তার আপন ঠিকানায় উড়ে চলে গেছে? ভাবতেই আমার মাথা ঘুরে এসেছিলো? জয় কি তবে আমার উপর অভিমান করে আমাকে ছেড়ে গেছে? আমি ওকে ভুলে রাজকন্যাকে নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকায় সে আমাকে ছেড়ে গেছে? একটা অবলা বোবা প্রাণীরও এতো অভিমান থাকতে পারে? তবে তো অভিমান আমিও করতে পারি। আমার ভালোবাসার সুতো ছেড়ে যে চলে যেতে পারে তাকে আমিও ভুলে যেতে পারি। আমাকে বন্ধুহীন, নি:সঙ্গ জীবনে ফেলে রেখে যে চলে যেতে পারে তাকে আমিও মনে রাখবো না। কিন্তু পেরেছি কি? জীবনের পরিনত বয়সে এসে; যখন আমি পরিবারের কত্রী, কারও স্ত্রী, কারও মা, কারও শিক্ষক; তখনও জয়ের স্মৃতি আমাকে তাড়া করে ফেরে। খুব নির্জনে যখন আমার শৈশব আমাকে হাতছানি দেয়, তখন জয়ের সাথে কাটানো সময়গুলো আমাকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়, অসহায় করে দেয়। আমার পরিপূর্ণ জীবনের কোথাও যেনো একটা অপূর্ণতার চিলেকোঠা রয়েই গেছে, থাকবে আজীবন।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
মানুষের বন্ধুত্ব তো বোবা প্রাণীর সাথেও হয়। আমারও হয়েছিল। কিন্তু আমার বন্ধুত্বের মধ্যে হয়তো ছলনা ছিলো। তাই সে আমায় ছেড়ে চলে গেছে।
০৮ জুলাই - ২০২৩
গল্প/কবিতা:
৮ টি
সমন্বিত স্কোর
৪.৪৩
বিচারক স্কোরঃ ২.০৩ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ২.৪ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪