বেদানার টকটকে লাল শরবতটা এক চুমুকেই শেষ করে একটা তৃপ্তির হাসি দিল সোহানা। মনে হল গলা দিয়ে শরীরের ভেতরের দিকে একটা শান্ত, নির্মল স্রোত বয়ে গেল! আর সেই শান্ত স্রোতের প্রতিটি জলকণা যেন শরীরের ভেতরের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গে একটা শিরশিরে শিহরণ এনে দিল। সাথে সাথেই পেটের ভেতর প্রবলভাবে নড়ে উঠলো সোহানার রাজকন্যা। যদিও সোহানা জানে না তার ভেতরে রাজকন্যা নাকি রাজপুত্র বেড়ে উঠছে। কিন্তু তার গভীর বিশ্বাস রাজকন্যাই আসবে তার রঙিন জীবনটা আরও রাঙিয়ে দিতে। একবুক ভালোবাসা নিয়ে সোহানা হাতদুটো পেটের উপর রেখে ধীরে ধীরে বুলিয়ে দিতে লাগলো। খানিকক্ষণ চোখদুটো বুজে থেকে চকিতেই আবার চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে সামনে অচেনা এক মায়াবী কিশোরী দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকলো সোহানা। কি মায়ামাখা মুখশ্রী! কি গভীর দৃষ্টিসম্পন্ন দুটো আঁখি। সোহানার মনে হলো পাহাড়ের খুব গোপন কোন স্থান থেকে নেমে আসা ছলছলে জলপ্রপাতের কলকল সৌন্দর্য মেয়েটির পুরো অঙ্গজুড়ে। তাহলে এই কিশোরীই খানিক আগে সোহানাকে বেদানার শরবত দিয়ে গেল অথচ সে মেয়েটির দিকে তাকিয়েও দেখেনি! সোহানা ভাবল তার রাজকন্যাটিও কি এই মেয়েটির মতো ভুবন ভোলানো সৌন্দর্য নিয়ে তার কোলে আসবে? একটা অজানা ভালোলাগায় তার পুরো শরীর মন শিহরিত হলো।
এক অন্যরকম মাতৃত্ববোধে সে আচ্ছন্ন হয়ে রইল। হাতের ইশারায় মেয়েটিকে কাছে ডেকে জানতে চাইল তার বাড়ি কোথায়? কবে এসেছে এখানে? মেয়েটি লাজুক ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে তর্জনী উঁচিয়ে জানালা দিয়ে দূরের একটা গ্রাম দেখিয়ে আবার মাথা নিচু করে রইল। সোহানা মিষ্টি হেসে মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে চলে যেতে বললো। তার চলে যাওয়ার পথের দিকে আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আপন মনেই গুনগুন করে গান ধরলো, "মায়াবন বিহারিণী হরিণী, গহন স্বপন সঞ্চারিনী। কেন তারে ধরিবারে করি পণ, অকারণ.....। " আবার নড়ে উঠলো রাজকন্যা। তবে আগের চেয়ে অনেকটা শান্তভাবে। সোহানা পেটে হাত রাখল, কেমন আছো সোনা? আবার নড়েচড়ে উঠল। যেন জানান দিল সে খুব ভালো আছে, খুব আনন্দে আছে। মায়ের গর্ভে যে পদ্মপুকুর রয়েছে সেখানে সে পরম নিশ্চিন্তে সাঁতার কাটছে। মায়ের স্নেহের পরশ রাজকন্যার মাথা থেকে পা পর্যন্ত পুরো শরীরকে আবেশিত করে দিচ্ছে। হঠাৎ কচি কণ্ঠের খিলখিল হাসির শব্দে সোহানা চমকে তাকালো। নাহ! কেউ তো নেই। তবে এ হাসি তার রাজকন্যারই। এবার সেও হাসতে লাগলো। দুজনের খিলখিল হাসির শব্দে আকাশ, বাতাস, নদী সব যেন হেসে উঠলো। হেসে উঠলো পাখির দল, হেসে উঠলো গাছের পাতারাও। এতো হাসাহাসির মাঝে যে মানুষটা চমকে উঠলো সে হলো সোহানার পাশে নিশ্চিন্ত চিত্তে ঘুমিয়ে থাকা সোহানার স্বামী মামুন। দুচোখ কচলে জানতে চাইল, কী হয়েছে? এতো হাসছো যে?
সোহানা লাজুক রহস্যময় হাসি হেসে বললো, তোমার মেয়ের কান্ডকারখানা দেখে আমি হাসতে হাসতে পাগল হয়ে যাচ্ছি। একথা শুনে মামুন আলতো করে সোহানার পেটে একটা চুমু খেয়ে আবার পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লো।
অনেক বেলা হয়েছে ভেবে সোহানা বিছানা থেকে নেমে পড়লো। বাগানে খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে তারপর সকালের নাস্তা সেরে নিবে। বাগানের কাছাকাছি যেতেই চোখ পড়লো ফুলে ফুলে ছেয়ে যাওয়া অলকানন্দা গাছটার দিকে। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে গাছের মগডালে আগুন লেগেছে। এবারও নড়েচড়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিলো প্রাণের ভেতরের ছোট্ট প্রাণটা। ফুলে ফুলে ভরে গেছে পুরো বাগান। অলকানন্দা, মাধবীলতা, বেলী, গোলাপ, আরও কত ফুল! সোহানা কয়েকবার বিরবির করলো, কি সুন্দর! সুবহানাল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহ।
কিচেনে আসা মাত্র সালমা বেগম, মানে সোহানার শাশুড়ী মা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বললেন, এই অবস্থায় কেউ এতো বেলা অব্দি না খেয়ে থাকে? তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও তো মা। সোহানা তাকিয়ে দেখলো টেবিলে তার পছন্দের আলু পরোটা, খাশির কলিজা ভুনা আর ডিম পোচ সাজানো রয়েছে। মনে মনে হাসলো। এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে থেকে এমন কোন দিন যায়নি যেদিন তার পছন্দের কোন পদ রান্না হয় নি। আর গর্ভবতী হওয়ার পর তো কথাই নেই। বাড়ির কর্ত্রী সোহানার শাশুড়ী মা থেকে শুরু করে প্রত্যেকের যেন একমাত্র প্রধান কাজ সোহানার খেয়াল রাখা। নাস্তা করতে করতে সালমা বেগম মনে করিয়ে দিলেন আজ সোহানার রুটিন চেক আপে যাওয়ার কথা ডা. নাফিসার কাছে। সোহানা ৩৬ সপ্তাহের অন্ত:সত্তা, কোন গর্ভকালীন জটিলতাও নেই। তারপরও মামুন আর সালমা বেগম নিয়ম করে ওকে চেক আপে নিয়ে যায়, ডাক্তারের পরামর্শ মতো সব ধরনের পরীক্ষা নীরিক্ষা করায়। দিন যতই ঘনিয়ে আসলে, তাদের সচেতনতা যেনো আরও বেড়ে যাচ্ছে।
ডাক্তারের চেম্বারে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে গেলো। আসলে মামুন আজ অফিস ছুটি নিয়েছে সোহানাকে ডাক্তার দেখাবে বলে। কিন্তু ঘুমকাতুরে মামুনের সকালে ঘুম থেকে উঠা সবচেয়ে অপছন্দের কাজ, তাই এতটা দেরি হয়ে গেলো। গিয়েই দেখা গেলো চেম্বারের বাইরে ওয়েটিংরুমে প্রচুর রোগী অপেক্ষা করছে। ডা. নাফিসা শহরের নামকরা গাইনোকোলোজিস্ট। অবসরে গেছে বেশ ক'বছর হলো, তবুও এখনো তাঁর নামডাক এতটুকু কমেনি। সোহানাকে দেখে যে কেউ বুঝবে যে তার সন্তান জন্মদানের সময় প্রায় এসেই গেছে। শরীর যথেষ্ট ভারী হয়েছে। ধীরে ধীরে হেঁটে ডাক্তারের চেম্বারে প্রবেশ করতেই একজন ভদ্রলোক, সম্ভবত কোন রোগীর স্বামী হবেন, নিজের চেয়ারটা সোহানার দিকে এগিয়ে দিল। সোহানাও একটা কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়ে বসে পড়লো। সোহানার খুব ভালো লাগে। পৃথিবীটা সত্যিই খুব সুন্দর, আর পৃথিবীর মানুষগুলো আরও বেশি সুন্দর। সবচেয়ে বেশি সুন্দর এই দেশের মানুষগুলো। এখানে প্রত্যেকেই একে অন্যের প্রয়োজনে নিজেকে বিলিয়ে দেয়। এইতো আজ এখানে আসার সময় সোহানা আর মামুন বেশ অনেক্ষণ রিকশার জন্য রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিলো, কিন্তু ওদের বাড়িটা বেশ খানিকটা ভিতরের দিকে হওয়ায় এখানে রিকশা খুব একটা পাওয়া যায় না। এমন সময় একটা ছোট্ট শিশুকে কোলে বসিয়ে এক দম্পতি রিকশা করে কোথাও যাচ্ছিল। সোহানাকে দেখে তাঁরা নেমে রিকশাটা সোহানার জন্য ছেড়ে দিলো।
সোহানাকে আগে আগেই ডেকে নিল চেম্বারের ভেতরে। ডা. নাফিসা মিষ্টি হেসে জানতে চাইলেন তার শরীরের সার্বিক অবস্থা। তারপর সোহানাকে ভালো করে পরীক্ষা করে আবার একটা হাসি দিলেন। ডা. নাফিসার এই হাসিমাখা মুখটা দেখলে সোহানা অনেক আস্বস্ত হয়, অনেক নিশ্চিত হয়। ডা. নাফিসা সোহানার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তুমি একদম সুস্থ, আর তোমার সন্তানও। বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম কর। আর কোন সমস্যা মনে করলে অবশ্যই আমাকে ফোনে জানাবে,কেমন? সোহানা আর মামুন বাধ্য ছেলে মেয়ের মতো মাথা নেড়ে চেম্বার থেকে বেড়িয়ে আসে। মা এবং সন্তান উভয়ই সুস্থ আছে, এই মূহুর্তে এর চেয়ে বেশি আনন্দের, বেশি নিশ্চিন্তের আর কি হতে পারে! অবশ্য সোহানা নিজেও জানে যে তার সন্তান ভালো আছে, সুস্থ আছে। সে যেভাবে কিছুক্ষণ পরপর তার নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়, মাকে মনে করিয়ে দেয় যে এখন সেই তার প্রথম এবং প্রধান প্রায়োরিটি। মামুন খুব যত্ন করে সোহানার হাত ধরে রিকশায় উঠিয়ে দিল। ফিরতি পথে দুজনার কতো গল্প হলো তাদের অনাগত সন্তানকে ঘিরে! একটা ছোট্ট প্রাণ দুজনের মধ্যে ভালোবাসার সেতুবন্ধনটাকে আরও জোড়ালো করবে, সারা বাড়িময় ছুটে বেড়াবে ভাবতেই দুজনে শিহরিত হয়ে যায়। মামুনের ইচ্ছে করছে বাবুটাকে জোড় করে মায়ের গর্ভ থেকে বের করে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিতে। মনে মনে হাসলো মামুন, বাবা হওয়া কতটা আনন্দের, কতটা প্রশান্তির!
এভাবেই হাসি আনন্দে কেটে গেলো আরও প্রায় তিন সপ্তাহ। দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই যেন সোহানার ভেতরের অস্থিরতা আরও বেড়ে যাচ্ছে। প্রথমবার মা হতে যাচ্ছে সে। ভালোলাগা এবং ভয়ের জোড়া নৌকায় দোদুল্যমান যেন তার অনুভূতিগুলো। মাতৃত্ব যে এতটা সম্মানের,এতটা যত্নের সে আগে বোঝেনি। সবার কতো খেয়াল তার প্রতি! সোহানা প্রথমদিকে যখন খুব ভয় পেতো তখন তার মা এমনকি শাশুড়ী মায়ের কাছেও গল্প শুনেছে যে তাঁদের গর্ভকালীন সময়েও তাঁরা কতটা যত্ন, কতটা ভালোবাসা পেতেন পরিবারের লোকজনের কাছ থেকে, এমনকি পাড়া প্রতিবেশী সবার কাছ থেকে। এই সময়টা একটা মেয়ের জন্য পরীক্ষার মতো, কঠিন পরীক্ষা। এ সময় তার সাপোর্ট দরকার, যত্ন, স্নেহ, ভালোবাসা দরকার। আর এদেশের এটাই নিয়ম। এখানে মাতৃত্ব কোন ভয়ের বিষয় নয়, কোন হতাশা নয়। এটা সুখের, আনন্দের। আর এই আনন্দে সবাই পাশে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। প্রেগ্ন্যাসির শুরু থেকে আজ অবধি আত্নীয়, বন্ধু বান্ধব, প্রতিবেশি এমনকি ডা. নাফিসার কাছ থেকেও যে কতো উপহার পেয়েছে সোহানা তার কোন ইয়ত্তা নেই। সোহানার পোশাক, তার অনাগত সন্তানের জন্য খেলনা, জুতা, কতো রকম ফুল! আর মামুনের কথা তো আলাদা করে বলার কিছুই নেই। এমন কোন দিন যায় নি যেদিন সে সোহানার জন্য প্রিয় ফুল লাল গোলাপ কিংবা চকলেট নিয়ে আসেনি। সোহানা মনে মনে ভাবে, সত্যিই আমাদের দেশের মেয়েরা কতটা ভাগ্যবান! এই কঠিন সময়েও আমরা কতটা নিরাপদ!
তারপর এলো সেই কাংখিত দিন। ভোর থেকেই একটু একটু তল পেটে ব্যাথা হচ্ছিল সোহানার। সময়ের সাথে সাথে ব্যাথাটাও একটু একটু করে বাড়ছে। মামুনকে জানাতেই মামুন অস্থির হয়ে গেলো সেই সাথে বাড়িসুদ্ধ সকলকেই অস্থির বানিয়ে তুললো। ডা. নাফিসাকে ফোন করা মাত্র তিনি দ্রুত তাঁর হসপিটালে ভর্তি হতে বললেন। হসপিটালে সোহানার জন্য বরাদ্দকৃত কেবিনে ঢুকে তো সে আর একবার অবাক হলো। ঝকঝকে তকতকে পুরো কেবিনটাই নানান খেলনা আর ফুলে ফুলে ভরা! দুজন নার্স হাসিমুখে এগিয়ে এসে সোহানাকে বিছানায় শুইয়ে দিল। খানিক বাদেই ডা. নাফিসা এসে পাশে বসলেন। সোহানার মাথায় পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ভয় পেও না, মা। আমরা সবাই তোমার পাশে আছি। লেবার পেইন ঠিকঠাক ভাবে শুরু না হওয়া পর্যন্ত আমরা তোমাকে ফলোআপে রাখবো। আশা করি খুব দ্রুত আল্লাহ তায়ালা তোমার কোলে একটা ফুটফুটে বাচ্চা দিবেন। সোহানা দেখলো সবাই হাসি হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মামুন পাশে এসে একটা হাত ধরে চোখের ভাষায় আস্বস্ত করলো যে সেও পাশে আছে, থাকবে। স মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিল এতো সুন্দর একটা দেশে তার জন্ম হওয়ার জন্য। এই দেশ সুন্দর, দেশের মানুষগুলো সুন্দর। এখানে ভালোবাসার ছোঁয়া ভয়কে দমিয়ে দেয়, নির্ভরতার হাসি কষ্টকে পিষে ফেলে। সোহানার মনে হলো এক ঝাঁক নির্ভরতার শ্বেত পায়রা তার চতুর্দিকে ঘিরে রয়েছে। সবার হাসি মুখের সাথে তাল মিলিয়ে সোহানাও হাসি হাসি মুখে অপেক্ষা করতে থাকলো একটা ছোট্ট প্রাণকে আলিঙ্গনের আশায়।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
নির্ভরতার শ্বেত পায়রা
০৮ জুলাই - ২০২৩
গল্প/কবিতা:
৮ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪